হে মহাজীবন- গ্রন্থ পর্যালোচনা

মানসী সাহা

মুক্তচিন্তক ও দার্শনিক আকবর হোসেন মনের মাধুরী মিশিয়ে সততার দলিল হিসেবে রচনা করছেন একটি বিশুদ্ধ আত্মজীবনী “হে মহাজীবন”। ​​কলকাতার ঋতবাক থেকে প্রকাশিত ১৮৩ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি (২০১৯) বাংলা ভাষায় রচিত অন্যতম আত্মকথন বলে আমি মনে করি। অত্যন্ত চমৎকার ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রচ্ছদ করেছেন সৌম্য ব্যানার্জি। ধূসর রঙের আঁচড়ে আঁকা প্রকৃতির এক মেঠো পথ আর সে পথেই হেঁটে চলছেন ত্রিশূল হাতে এক মৌন সন্ন্যাসী। গেরুয়া রঙের অক্ষরে লেখা হে মহাজীবন। প্রচ্ছদে চোখ বুলালেই মনে হয় সংসারে থেকেও নির্মোহ সন্ন্যাসী আকবর হোসেনের জীবনের প্রতিচ্ছবি যেন। মলাটের শেষ প্রান্তে গেলে দেখি নিজ বাগানে সযত্নে ফুটানো গ্রীষ্মকালীন ফুলগুলোর সামনে স্মিতহাস্যে লেখকের প্রাঞ্জল আলোকচিত্র। অত্যন্ত রুচিপূর্ণ ও নান্দনিক একটি উপস্থাপন যা অনায়াসে পাঠককে টেনে নিয়ে যায় ভিতরের পৃষ্ঠাগুলোতে। সেখানে গেলই দেখা যায় বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন তাঁর সহধর্মিণী হাসুকে আর কারণ দর্শিয়েছেন এই বলে, “সে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, সে আমার প্রশ্ন বিহীন জীবন সাথী যে সুখে দুঃখে সারা জীবন আমার পাশে থেকেছে।” 

জীবন পথের পথিক আকবর হোসেন সুললিত ভাষায় ছোট ছোট অধ্যায়ে সময়রেখার আলোকে বর্ণিত করেছেন তাঁর জীবন নামের বহমান নদীর বিভিন্ন রূপ – কখনো কলকল জলধারা, কখনো চৈত্রের তীব্র শুষ্কতা, কখনোও বা প্লাবনের উচ্ছলতা। স্মৃতির মিনারে বসে প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন আকবর হোসেন অকপটে লিখেছেন তাঁর পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতার অনুভব। ছোটবেলা থেকেই তাঁর লেখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। কচি বয়সে কচি হাতের লেখা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর শিক্ষক গোপালবাবু একদিন বলেছিলেন, “লিখতে পারা একটি বিশেষ গুণ, যা সবাই পারেনা”। আর আকবর হোসেন লিখতে পারেন তাই তিনি লিখে যাচ্ছেন। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী আকবর হোসেন রচিত দুটো গ্রন্থ “আমার সময় আমার পথ” বাংলায় এবং “My Lonely Thoughts” ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে।

“হে মহাজীবন” গ্রন্থটির প্রথম কয়েকটি লাইন পড়েই সৃষ্টি হয় ভালো লাগা। লেখক প্রারম্ভেই অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তাঁর নিজের অবস্থান সম্পর্কে পাঠককে এই বলে অবহিত করলেন যে, “আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ তাই আমার জীবনে এমন অসাধারণ কিছু নেই যা আরেকজনের সামনে তুলে ধরলে সে মনোযোগ দিয়ে পড়বে। তবুও ভাবলাম কি জানি হয়তোবা এমন মানুষও আছেন যিনি আমারই মতো সুখে দুঃখে নানা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জীবন যাপন করে গেছেন অথচ কোনদিন সময় হয়নি ভাববার কি এবং কেমন জীবন তিনি পেছনে ফেলে এসেছেন।” এটি লেখকের সততা এবং উদারতার প্রতিবিম্ব। রবীন্দ্র অনুরাগী আকবর হোসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে যেমন লেখেছেন, “প্রেমে ভালোবাসায়, আনন্দ বেদনায়, সুখে দুঃখে, সুরে সংগীতে, কাছের দূরের সব কিছুকে দিয়ে এক ভাবনার মালা গেঁথে রেখে গেছেন আমাদের জন্য” ঠিক তেমনি তিনি এই গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠকদের জন্যে একটি ভাবনার মালা গেঁথেছেন।

আকবর হোসেন ১৯৫০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার গুনিয়ক গ্রামে। পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে ছোটবেলা কাটান মায়ের স্নেহে আর তাঁর মনের মনিকোঠায় ধরে রাখেন বাবার সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি। ভাই বোনদের মাঝে তিনি সবার ছোট বলে বাবা তাঁকে ভীষণ আদর করতেন – কোলে বসে গল্প শোনাতেন, কোলে নিয়ে হাঁটতেন, কাঁটাওয়ালা মাছ খেতে পারতেন না বলে সেরকম মাছ কিনতেন না। বাবার মাছ ধরার খুব শখ ছিল এবং আকবর হোসেনও এই শখটি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। নিজের মায়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “তিনি আমাদের সব সময় ভালো পড়াশোনা করে ‘মানুষ’ হওয়ার কথা বলতেন।” তাঁর পিতামহ একজন মুন্সিকে ডেকে প্রথমদিন স্কুল শুরুর আগে পাঠ দেওয়ান  – রাব্বি যিদনী ইলমান কাতিরা – যার মানে ‘হে প্রভু, আমাকে অনেক জ্ঞান দান করো।’ সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর শিক্ষা জীবন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য তিনি লেখাপড়া করেন গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জ স্কুলে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা স্কুলে, ঢাকা কলেজে, জগন্নাথ কলেজে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু জ্ঞানপিপাসু আকবর হোসেনের জীবনী পড়ে জানা যায় তিনি সারা জীবন ধরে প্রকৃত জ্ঞানলব্ধের সাধনাই চালিয়ে যাচ্ছেন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থাবলী পড়ে এবং প্রজ্ঞাবান মানুষদের সংস্পর্শে এসে। তাঁর গ্রন্থের পরতে পরতে দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, রোম্যাঁ রোলাঁ, শেক্সপীয়র, কিটস, গালিব, ও রুমী সহ বিভিন্ন সাহিত্যকদের সাবলীল আনাগোনা যা থেকে সহজেই উদ্ভাসিত  হয় লেখকের বিজ্ঞ পাঠকরূপ। 

একটি জমিদার পরিবারে জন্ম নেয়া আকবর হোসেনের শৈশব কাটে একটি হিন্দু-মুসলিম সম্মিলিত পূর্ব বাংলার বাংলা-সংস্কৃতির রীতিনীতির মধ্য দিয়ে। আমার ছেলেবেলা অধ্যায়ে তিনি বলছেন, “আমার ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামে হিন্দু মুসলমান সবাই মিলে মিশে বসবাস করতো আর ধর্ম নিয়ে কোন সংঘাত ছিল না…তখন মসজিদে আজান আর পাশের হিন্দু বাড়িতে সন্ধ্যা পূজার ঘন্টায় কোন বিবাদও ছিল না”। তবে তিনি এটিও লক্ষ্য করেছেন যে ধীরে ধীরে বাড়ি-ঘর, জমিজামা বিক্রি করে হিন্দু পরিবারগুলো নিরবে কোথায় যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট জিনিসের মাঝে কীভাবে স্মৃতি আঁকড়ে থাকে তার একটি সুন্দর উদাহরণ পেয়ে থাকি তাঁর লেখনীতে। তাঁর বাবার ব্যবহৃত পুরাতন একটি কাঠের চেয়ারের স্মৃতি তুলে ধরেছেন। তাঁর বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্ষেত্রমোহন বাবার সেই পুরনো চেয়ারে নিরবে বসে তাঁর মাথায় হাত রাখতেন আর ধুতির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতেন। তিনি যখন বড় হলেন বাড়িতে গিয়ে আবারও সেই চেয়ারটির সন্ধান করেছিলেন তখন পুরানো কাজের লোকটি বলেছিলেন, “বাজান, মানুষই থাকে না আর তো চেয়ার।” বাবার বন্ধু ক্ষেত্রমোহন সপরিবারে গ্রাম ত্যাগ করেছেন শুনে গিয়ে দেখলেন ভিটে বাড়ি শূন্য এক নিরব নিস্তব্ধ করুন আর্তনাদ। “একটি গর্জন মুখর প্রশ্ন বারবার হৃদয় তটে এসে আঘাত করতে লাগলো, কি সেই দুর্দম প্রলয়, যা মানুষকে তার বাস্তু ভিটে ত্যাগ করতে বাধ্য করে? আজও ক্ষেত্রমোহনেরা তাদের পিতা-প্রপিতার ভিটেমাটি ত্যাগ করে যেতে বাধ্য হন।”  অনুভূতিশীল লেখক দেশ বিভাজনের সাথে সাথে লেগে থাকা মানুষের অসহনীয় বেদনার ভার মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন।

জীবনের বিভিন্ন বাঁকে কিছু বৈচিত্র্যধর্মী মানুষের সান্নিধ্যতার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করে তুলেছে সদুরের পিয়াসী আকবর হোসেনকে। জীবনের রঙ্গমঞ্চে তিনি বিভিন্ন পাত্র-পাত্রীর সাথে অভিনয় করেছেন, কখনো বা শুধু অবলোকন করেছেন আর শিক্ষা নিয়েছেন জীবন বোধের। হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্কুলের জ্যামিতির শিক্ষক নিত্যানন্দ রায়কে অনেকদিন পর রামকৃষ্ণ মিশনে দেখতে পেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “স্যার আপনি হঠাৎ করে এমনভাবে উধাও হয়ে গেলেন কেন? কোথায় গিয়েছিলেন?” তাঁর সেই নিত্যানন্দ স্যার সেদিন তাঁকে বললেন, “তোর মনে আছে আমার ঘরে একটা বিরাট মানচিত্র ছিল। আমি দিনরাত সেটাকে দেখতাম আর ভাবতাম যদি আমি এর কিছুটা দেখতে পারতাম। একদিন মাঝরাতে স্বপ্ন দেখলাম এক সন্ন্যাসী আমার হাত ধরে বাইরে টেনে নিয়ে এসেছে। এই দেখ আকাশ, এই বিশ্বকে নিজের ভিতর না নিলে মুক্তি নেই।” সেই স্বপ্নের ডাকে তিনি সেদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। আবার অন্যদিকে দেখি মাধবপুরের খেয়া পারাপারের হরিহর মাঝি কীভাবে সব মানুষকে আনন্দ মনে নদী পার করে দিতেন কিন্তু নিজের সদ্য বিবাহিত কন্যাকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে ফিরে আসার পথে তাঁর মৃত্যু ঘটে। সংসারের বাঁধনে বাঁধা একটি বেদনা হরিহর মাঝি সইতে পারলেন না। বিচিত্র জীবনের এমন অনেক ছোট ছোট চিত্রগুলো হৃদয় নিংড়ানো রঙে চিত্রকর আকবর হোসেন এঁকেছেন সযত্নে।

রামকৃষ্ণ মিশনের সরল দর্শন লেখককে অভিভূত করে আর সেই দর্শন নিজের জীবনপাত্রে ভরে নিতে সচেষ্ট হলেন। তিনি সংসারে থেকেও সংসার থেকে আলাদা থাকতে শিখলেন। ভারতীয় দর্শনের প্রতি লেখকের আকর্ষণের জন্য তাঁর অনেক বন্ধু তাঁকে একজন ধর্মত্যাগী বলে মনে করলেও তিনি মনে করেন তাঁর বন্ধুরা ভ্রান্ত, তারা ধর্মত্যাগী অর্থের প্রকৃত মানে জানে না। তিনি বিশ্বাস করেন মানুষ যখন ন্যায়, সত্য আর জ্ঞানকে ত্যাগ করে তখন সে ধর্মচুত্য হয়। ভারতবর্ষে বর্ণবিবাদজনিত বিভ্রান্তিকর সমাজ ব্যবস্থার জন্য মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছে বলে তিনি বর্ণিত করেছেন। আমিও ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি সাধারণ মানুষের কাছে ধর্ম একটি সামাজিক আচার-আচরণ, রীতি-নীতি ও সমাজ ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। ধর্মের মৌলিক উদ্দেশ্য আত্মার বিশুদ্ধকরণ, ঈশ্বরের সাথে একাত্মিকরণ, পরম আনন্দে স্থিতি লাভ করা কখনোই সাধারণ মানুষের জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল না। ধর্মের নামে ভারতবর্ষে সাধারণ মানুষ পরিবার-পরিজনকে নিয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য একটা সমাজ ব্যবস্থা থেকে আরেকটা সমাজ ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে। আর সেই সমাজ ব্যবস্থাকে আজ আমরা একটা অন্য ধর্ম বলে আখ্যায়িত করছি। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে হিন্দুধর্মের রীতিনীতি পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি পালন করার মধ্যে যে ব্যাপারটা রয়েছে সেটিকে একটি সামাজিক পরিবর্তন বলা যেতে পারে।

ছাত্র জীবনে তিনি কমরেড মোজাফফর আহমদের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন এবং ধর্মের অন্ধবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি মনে করেন বামপন্থী রাজনীতিবিদরা মৌলিক চিন্তাধারাকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি বলে সেকালের অনেক নিবেদিত প্রাণ বামপন্থীরা নিজেদের লালিত আদর্শকে বলি দিয়ে অসৎ জীবন বেছে নিয়েছেন। নিরিশ্বরবাদী আকবর হোসেন ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন কোন প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম মানুষকে উদার হতে সহায়তা করে না। সে কারণে তিনি তাঁর সন্তানদের কোন প্রকার প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম শিক্ষা দেননি। সচেতন আকবর হোসেন তাঁর ছেলেমেয়েদের নৈতিকতা, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্য শিখেয়েছেন কিন্তু কোন অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করতে শেখাননি। খ্রিষ্টান ধর্মের উদারতার ব্যাখ্যা করে লেখক বলেন এদের সহনশীলতা এবং পরিবর্তনকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা উদাহরণযোগ্য। খ্রিস্টান ধর্মযাজকগণ শুধু বাইবেল নয় ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চা করে থাকেন। আকবর হোসেন ধর্মকে মানুষের চরিত্রের উন্নয়ন এবং ব্যাক্তির মানসিক অবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে পরম সত্যের দিকে ধাবিত হওয়ার একটি পদক্ষেপ বলে মনে করেন। পশ্চিমাদেশে এসে লেখক বুঝতে পারলেন মানুষের অন্তরে একটা চির স্বাধীন সত্য বাস করে যাকে নির্ভয় না দিলে সে নিজেকে প্রকাশ করে না এবং তিনি যা মনে প্রানে বিশ্বাস করেন তা প্রকাশ করতে এখন আর কোন বাধা নেই।

দীর্ঘদিন প্রবাসী জীবন যাপন এবং বহু জনের সংস্পর্শে এসে তাদের পারিবারিক বন্ধন, বিবাহবিচ্ছেদ, একাকীত্ব জীবনের কাহিনি হৃদয়ঙ্গম করে আকবর হোসেন বুঝতে পেরেছিলেন একজন সক্ষম পুরুষের জীবনে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তিনি মনে করেন প্রকৃতির নিয়মে একের সঙ্গে দ্বিতীয়ার মিলন না হলে মানবের উপলব্ধি পরিপূর্ণতা লাভ করে না। প্রকৃতিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। এটাই প্রকৃতির দ্বৈত ভাব। এই দ্বৈত ভাবের ভিতর দিয়েই অদ্বৈত ভাবের প্রকাশ ঘটে। তাইতো অদ্বৈত পরমানন্দের জন্য প্রকৃতিতে কারো কোন সাহায্যের দরকার পড়ে না।

এই পৃথিবীতে আমরা জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। মৃত্যু জীবনের আরেকটি পর্যায় মাত্র। লেখক দেখেছেন তার পাঁচ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর সময়ে পিতামহ জীবিত অবস্থায় তাঁর ছেলের মৃত্যুর শোক বহন করে চলছেন। চিকিৎসার কারণে কানাডার হাসপাতালের অপারেশন রুমে তাকে অসাড়করনের ফলে তিনি জ্ঞান থেকে অজ্ঞানে চলে যান। মনে মনে ভাবলেন হয়তোবা এমনি ভাবে সত্যি সত্যি একদিন মৃত্যু চলে আসবে। তাই লেখক বললেন “হে প্রকৃতি মাতা, তুমি জীবনের ডোর হাতে দিয়ে জেনেছিলে, এ বোঝা টেনে বেড়ানো সহজ হবে না। আর তাই বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস দিলে, যাতে হৃদয়বিদর্ণ না হয় আর আঁখি ভরা জল দিলে যাতে বেদনার আগুন অশ্রু হয়ে বয়ে গিয়ে জীবনকে নোঙ্গর বিহীন না করে।” আমরা সবাই সময়ের সাথে সাথে সময়ের হাত ধরে জীবনের পথ চলছি। আর যার যখন ডাক আসবে সে তখন চলে যাবে। তাই নির্ভীক লেখক বললেন “হে সময়, জন্মে আমি তোমায় আলিঙ্গন করেছিলাম, এখন বসে আছি তোমাতে আত্মসমর্পণের অপেক্ষায়।”

“হে মহাজীবন” গ্রন্থে আকবর হোসেন তাঁর জীবনে নানা ধরনের মানুষের ভালবাসা ও বঞ্চনার কাহিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের আত্মার সাথে আত্মিকভাবে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, তাদের সুখে দুঃখে সঙ্গী হয়ে তাদের কথাই এখানে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটিতে লেখক তাঁর শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে কর্মরত থাকা এবং বর্তমানে কানাডায় বসবাস করার অভিজ্ঞতা ও মানসিক অবস্থার চিত্র সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। আজ আমরা যে আকবর হোসেনকে দেখছি তিনি কীভাবে জীবনের বিভিন্ন ধাপ এবং ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে আর আরশিতে যেন তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখা জীবনকে “হে মহাজীবন” নামে অভিহিত করে রচিত আত্মচেতনার বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। আলোর মাঝে লুকিয়ে থাকা জ্ঞান অন্বেষী মুক্তমনের বিভিন্ন দর্শনে স্নাত আকবর হোসেন জীবনের চলার পথে বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে যেসব মনি-মুক্তো কুড়িয়েছেন তার সাথে যুক্ত করেছেন তাঁর নিজস্ব দর্শন যা কিনা ঋদ্ধ করবে পাঠককুলকে। আর সে কারণেই অন্য কোন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা “হে মহাজীবন”। লেখকের সার্থকতা এখানেই।