স্মৃতিতে প্রশান্ত সরকার

সুব্রত কুমার দাস

২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর আমাদের সাহিত্য সংগঠন বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) আয়োজিত দ্বিতীয় কানাডীয় লেখক সম্মেলনের শুরুতে সকল অতিথি দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে কানাডার বাঙালি কমিউনিটির সেই সময় পর্যন্ত প্রয়াত যে সকল লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন তাঁরা হলেন ড. মীজান রহমান, মোল্লা বাহাউদ্দিন, ড. জহিরুল ইসলাম, মাহফুজুল বারী এবং ড. প্রশান্ত সরকার। জানিয়ে রাখতে চাই, সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন টরন্টো পোয়েট লরিয়েট অ্যান মাইকেলস, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি ইকবাল হাসান, লেখক ড. দিলীপ চক্রবর্তী, রাইটার্স ইউনিয়ন অব কানাডার নির্বাহী পরিচালক ঔপন্যাসিক, কবি ও কলামিস্ট জন ডেগেন, রাইটারস ট্রাস্ট অব কানাডার নির্বাহী পরিচালক মেরি অসবর্ন এবং বিচেস-ইস্টইয়র্ক এলাকার এমপিপি আর্থার পটস (কানাডায় ‘বাঙালি লেখক সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত https://bangla.bdnews24.com/probash/article1408672.bdnews

স্ত্রী রুমার সাথে ড. প্রশান্ত সরকার। বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো ছবিটি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন সুব্রত কুমার দাস।

জানিয়ে রাখা যেতে পারে যে, বিএলআরসি-র উদ্যোগে প্রথম লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। কিন্তু তারও আগে ওই বছরের ১২ মে তারিখে ফেসবুকে আমি প্রশান্ত সরকারের বই ‘শ্যাকেলস অব ইনডিপেনডেন্স’ নিয়ে একটি পোস্ট দেই। লিখেছিলাম, “প্রবাসে কতো যে গুণী মানুষ বাস করেন সেটা বোধ করি জানা শেষ হবার নয়। প্রশান্ত সরকার তেমনই একটি কৃতী নাম। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র গ্রন্থ স্মৃতিচারণমূলক ‘শ্যাকেলস অব ইনডিপেনডেনস’। ৫৬০ পৃষ্ঠার ক্রাউন সাইজের এই মূল্যবান বইটিতে একজন সফল পেশাজীবীর দেশত্যাগের পেছনের কথা, দেশের বাইরে নিজেকে দাঁড় করানোর কথা যেমন আছে, তেমনি আছে ভারত-ভাগের কথা, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কথা, এবং জাপান ও কানাডাতে নতুন এক অভিবাসীর জীবন-সংগ্রামের কথা।“ মনে আছে সেই পোস্টে কমেন্ট করেছিলেন লেখক ও গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামী (১৯৪৩–২০১৭)। তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন প্রশান্তদার সাথে পরিচিত হবার। আমিও সেই আগ্রহে সায় দিয়েছিলাম। অত্যন্ত মর্মান্তিক যে, এর ঠিক এক বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ৩০ জুন করুণাময় গোস্বামী প্রয়াত হন। সে ঘটনার ঠিক তিন মাস পরে ৩০ সেপ্টেম্বর প্রশান্তদাও চলে যান এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে।  

পেশায় ভূতত্ববিদ  প্রশান্ত সরকার টরন্টো শহরে বাস করছিলেন ১৯৭০ সাল থেকে। ২০১৩ সালে তাঁর একমাত্র বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। সুবিশাল এই বইতে প্রশান্তকুমার সরকার তাঁর জৈবনিক তথ্যাদি পরিবেশন করেছেন। সাথে সাথে তিনি স্পর্শ করে গেছেন ভারতবর্ষীয় সমাজের সেই সময়কার উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীকে। এভাবেই আত্মকথনকে মূল্যবান করে তুলেছিলেন প্রবীন এই ভূতত্ত্ববিদ। সেই বই শেষ হয়েছিল কানাডায় তাঁর আগমনের মধ্য দিয়ে।    

২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর টরন্টোতে সাহিত্য সংগঠন বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) আয়োজিত দ্বিতীয় কানাডীয় লেখক সম্মেলনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

টরন্টোতে আমার মতো চালচুলোহীনের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ঘটে যায় আসার বছর খানেকের মধ্যেই। সাহিত্য নিয়ে আমার পাগলামী তাঁর মতো জ্যেষ্ঠজনের দৃষ্টিতে পড়েছিল। স্থিতধী  প্রশান্তদা সে-পাগলামীকে প্রশ্রয় দিতেন। আমার ডাকে আমাদের সাহিত্য আয়োজনে আসতেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ও ইয়েটসের বন্ধুত্ব উদযাপন করি আমরা। প্রশান্তদা সেই আয়োজনে এসেছিলেন। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ আয়োজিত চৈতন্যমেলায় বিপুল সংখ্যক বইয়ের সমাহারে পরমহংস যোগানন্দের বইয়ের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ জানতে পারি।  

তাঁর বাসাতে তিনি আমাকে নিয়ে গেছেন দুবার। প্রথম বার যখন যাই, তখনই বৌদি যথেষ্ট অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই যাবার সময় বাসার কাছাকাছি দোকান থেকে খাবার কিনে নিতেন তিনি। বাসাতে নিয়ে সংগ্রহের বইপত্র দেখাতেন।   

ড. প্রশান্ত সরকারের একমাত্র বইয়ের প্রচ্ছদ

প্রশান্তদার মৃত্যুর পর তাঁর মেয়ে রাখী কানাডার বিখ্যাত পত্রিকা গ্লোব এন্ড মেইলে ওর বাবাকে নিয়ে একটা স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। সেখানে রাখী লিখেছিলেন ওর বাবা বইয়ের দ্বিতীয় খন্ড লিখছেন যেখানে থাকবে নতুন দেশে প্রশান্তকুমার সরকারের পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার কথা। রাখী আরও লিখেছিলেন, ওর বাবা তাঁর আশিতম জন্মদিনের বক্তৃতা রেডি করছিলেন। এটি খুবই মর্মান্তিক ছিল কারণ মাত্র ঊনত্রিশ দিন পরেই আশিতম জন্মদিনটি আসার কথা ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য প্রশান্ত সরকার তাঁর সেই বক্তৃতা শুনিয়ে যেতে পারেননি, পারেননি কানাডায় তাঁর চার দশকের বেশি সময়ের স্মৃতিকথা লিখে যেতে।