বারী ভাইকে আজ খুব বেশি মনে পড়ছে

নিরঞ্জন রায়

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন অভিযুক্ত আসামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাহফুজুল বারী আমাদের কাছে অতি পরিচিত এবং আমাদের খুব কাজের একজন মানুষ ছিলেন। চিন্তা, চেতনা, আদর্শ এবং রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে বারী ভাই একেবারেই নিজের একজন মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় সেই বারী ভাইয়ের কথা সবসময়ই মনে পড়ে এবং প্রতিনিয়তই স্মরণে আসে। কিন্তু আজকের পরিবর্তিত বাংলাদেশের অবস্থা দেখে অনেকের কথাই মনে পড়ছে, তবে বারী ভাই যেহেতু আমাদের কাছের একজন মানুষ ছিলেন, তাই তাঁর কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে।

মাহফুজুল বারী আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। মাহফুজুল বারী আমাদের সকলের কাছে শ্রদ্ধেয় বারী ভাই হিসেবেই বেশী পরিচিত ছিলেন। অনেকের মত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অগ্রসৈনিক, মাহফুজুল বারী, আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। তিনি ঐতিহাসিক  আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং বঙ্গবন্ধুসহ আরও অনেকের সাথে জেল খাটেন। তিনি ছিলেন সেই মামলার ২২ নং আসামী। পরবর্তীতে এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সাথে সরাসরি জড়িত হয়ে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে চলে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে দেশ গঠনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উপ-প্রধান ও আওয়ামীলীগের ৩৭ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হবার পর তীব্র ক্ষোভে, দুঃখে এবং ঘৃণায় তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জীবন বেছে নিয়ে কানাডা চলে আসেন এবং সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কানাডাতেই বসবাস করছেন।

বারী ভাই কানাডায় প্রবাসী জীবন বেছে নিলেও তিনি সবসময় মনেপ্রাণে বাংলাদেশের কথা ভাবতেন। প্রতিনিয়ত ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত রাখতেন বাংলাদেশের প্রতিটা ঘটনা প্রবাহের সাথে। এক বছর পর পর দেশে যেয়ে  স্বচক্ষে দেখে আসতেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমির উন্নতি এবং সেইসাথে সাক্ষাৎ করে আসতেন তাঁর পরিচিতদের সাথে। বারী ভাইয়ের অসাধারণ গুণ ছিল যে তিনি মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারতেন। একবার কেও তার সান্নিধ্যে আসলে তাকে আর তিনি কখনও দূরে ঠেলে দেননি। নিঃস্বার্থভাবে তিনি মানুষকে ভাল বাসতেন, তাদেরকে আতি আপন করে নিতেন এবং সবসময় তাদেরই মঙ্গল কামনা করতেন। তবে যারা তার মৌলিক আদর্শ, যেমন – মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলত, তাদের তিনি কোনরকম ছাড় দিতেন না, এমনকি সে যদি তার নিজের অতি নিকট আত্মীয়ও হতেন। আমরা অনেকেই অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি কিন্তু বারী ভাইয়ের মত অসাম্প্রদায়িক হওয়া খুবই কঠিন। তিনি নিজে অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতেন এবং সারাজীবন তিনি তা অনুসরণ করেছেন। আর তাঁর এই অসাম্প্রদায়িক অবস্থানের কারণে অনেকের কাছে তিনি বিরাগভাজনও যে হন নাই তেমন নয়। তথাপিও তিনি কখনই তার নীতির সাথে আপোষ করেননি। তাইতো তিনি অনেক সত্যিকার শুভাকাঙ্ক্ষীও যেমন পেয়েছেন তেমনি অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসাও লাভ করেছেন।

বারী ভাই অনেকের মত নিজের জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের শাস্তি কার্যকর দেখে যেতে পেরেছেন জন্যে নিজেকে ধন্য ও সার্থক মনে করেছেন। কেননা সারাটা জীবন তিনি এটাই কামনা করেছেন। এজন্য তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি চির কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিভিন্ন আসরে কথা বলার সময়। যে বছর তিনি মারা যান সেসময় তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন এবং তখন তাঁর একটি সুপ্ত বাসনা ছিল যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে সাক্ষাৎ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসবেন, কিন্তু সে সুযোগ তিনি আর পাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি সবসময়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উল্লেখ করে বলতেন “যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা”। কেননা বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে থাকার কারণে তিনি শেখ হাসিনাকে তখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসাবে খবু কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।

বারী ভাই ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হওয়ায় এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি যুক্ত হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর খুব সান্নিধ্যে চলে এসেছিলেন। আমি যতবার বারী ভাইয়ের টরণ্টোর বাসায় গিয়েছি, সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর সেই সময়ের যৌবন উদ্দীপ্ত জীবনের একান্ত ছবিগুলো শোভা পেতে দেখেছি। তবে বঙ্গবন্ধুর সাথে এরকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তিনি কখনও কোন প্রকার ব্যাক্তিগত সুবিধা নেননি। তিনি এতটাই নিঃস্বার্থভাবে দেশকে ভাল বেসেছেন এবং দেশের জন্য সংগ্রাম ও যুদ্ধ করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে “এক অভিযুক্তের বয়ানে আগরতলা মামলা” নামে একটি বই লিখেছেন যা সময় প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। খুবই ছোট্ট পরিসরে বইটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ দলীল হিসাবে বিবেচিত হতে পারে কেননা এখানে অনেক মূল্যবান তথ্য সন্নিবেশিত আছে।

১৯৭৫ এর পর প্রবাস জীবন বেছে নিলেও প্রথম দিকের চলার পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। কিছুদিন কলকাতায় আত্মগোপনে থেকে কানাডা চলে আসেন, ফলে অনেক মানসিক ও শারীরিক কষ্ট জীবনে সহ্য করেছেন। এমনকি তার এই সংগ্রামী জীবনের কারণে তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি প্রায়ই দেশে যেতেন বেড়ানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু দেশ বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কখনই তিনি কিছু প্রত্যাশা করেননি। স্বাধীনতা পদক বা অন্য কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান না পেলেও এ নিয়ে তার কোন রকম আক্ষেপ বা অনুতাপ ছিল না। এমনকি মৃত্যুর পর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার কথাও তিনি কখনও চিন্তা করেননি বা কারও কাছে এই অভিব্যাক্তি প্রাকাশ করেছেন বলে কেও তা বলতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর দল এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল এবং বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পেরেছেন, তাতেই তিনি আত্মতৃপ্তিতে ডুবে থাকতেন। যদিও ঢাকার বুকে মেট্রো রেল চলাচল, পদ্মানদীর উপর নির্মিত সেতু দিয়ে মাত্র তিন ঘণ্টায় দক্ষিণবঙ্গে পৌঁছে যাওয়া, রুপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং এমনকি চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের মত মাইলফলক অবকাঠামোগুলো দেখে যেতে পারেননি। অবশ্য এসবও এখন ইতিহাস এবং খুব সহসাই জাতিকে ভুলিয়ে দেয়া হবে যে এসব উন্নত অবকাঠামো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখা হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তাঁর একক নেতৃত্বে নির্মাণ করা হয়েছে। দুর্ভাগা জাতির একটি বড় অংশ তা হয়ত বিশ্বাসও করবে।  

মারা যাবার মাত্র দের বছর আগে বারী ভাইয়ের শরীরে কঠিন অস্ত্রোপচার হয়েছিল এবং তিনি পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠেছিলেন। নিজে গাড়ি চালিয়ে স্বাভাবিক চলাচলও শুরু করে দেন। তথাপিও এত বড় অস্ত্রোপচারের মাত্র বছর দেরেক পরে এভাবে দেশে যাওয়া তারা ছেলেমেয়েরা চাননি। আমি নিজেও মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বরাবরই একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। তাছাড়া মাতৃভূমির টানের কাছে সব বাধাবিপত্তিই ছিল তাঁর কাছে তুচ্ছ। তাইতো তিনি ২০১৭ সালের  নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ যান বেড়াতে। এরকম প্রতি বছরই তিনি দেশে গেছেন বেড়ানোর জন্য এবং ঘুরেও এসেছেন। কিন্ত ২০১৭ সালের দেশে যাওয়াই যে হবে তাঁর শেষ যাওয়া তা কেও ভাবতেও পারেনি। যা-হোক সেবছর দেশে যেয়েই তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানেই তার স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। দেখা করেছেন সকল পরিচিতদের সাথে।

সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে স্থাপিত বিশ্বমানের হাসপাতালের গল্প আমার কাছে শুনে সেটাও দেখার জন্য এবং সেই সাথে শাহজাদপুরে রবি ঠাকুরের কাছারি দেখার জন্য সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। দেশের দৃশ্যমান উন্নতি দেখে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন এবং কানাডা ফিরে এসে এ ব্যপারে মন খুলে গল্প করারও ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। সে বছর স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানের সভায় বক্তব্যও রেখেছেন। সর্বশেষ তার নিজ জন্মস্থান হাতিয়া এবং রাজনৈতিক স্মৃতি বিজড়িত আগরতলা যাওয়ার ইছচা তার ছিল এবং সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছিলেন। কন্তু সে সুযোগ আর তিনি পাননি। দেশে তিনি যেভাবে তার স্মৃতিবিজড়িত প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন এবং পরিচিতদের সাথে দেখা করছিলেন তাতে মনে হয় তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। এভাবেই ঘুরে বেড়ানোর এক পর্যায় নোয়াখালী থেকে ফেরার পথে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মিরপুর ন্যাশনাল হার্ট ফাউনডেশনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কাওকে একদিনের জন্যও না ভুগিয়ে, সম্পূর্ণ সক্ষম থেকে নিজের প্রিয় দেশ দেখতে দেখতে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। এ যেন ঈর্ষানীয় মৃত্যু এবং অপূরণীয় ক্ষতি। কেননা তার মত আদর্শবান মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। কানাডা থেকে রিটার্ন টিকিট কেটে দেশে গিয়েছিলেন বেড়ানো শেষে ফিরা আসার অভিপ্রায় নিয়ে। কিন্তু তা আর হয়নি।

যে দেশের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, সারাটা জীবন ত্যাগ স্বিকার করেছেন এবং মন প্রান দিয়ে যে দেশকে ভাল বেসেছেন সেই দেশের আজকের যে অবস্থা, তা যদি বারী ভাই দেখতেন তাহলে তিনি হয়ত স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে পারতেন না। বারী ভাই ভাগ্যবান তাই তাঁকে স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরে বাংলাদেশের এই করুণ পরিণতি দেখতে হলো না। আর আমরা হতভাগা, তাই এসব দেখছি এবং নিরবে সহ্য করছি। তাই আজকের দিনে বারী ভাই তোমাকে খুব বেশি মনে পড়ছে।

বারী ভাই তুমি যেখানেই থাক, শান্তিতে থাক; আর উপর থেকে আমাদের জন্য আশীর্বাদ করো যেন তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশ সঠিক পথে ফিরতে পারে। #