‘….সূর্য মানে না বশ’
দেলওয়ার এলাহী
‘ কবিতা কি শুধু তাই / মনের খেয়ালে কাগজে কলমে শব্দ সাজাই?’ কবি ও গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এই গানের কবিতায় যে প্রশ্ন, যে জিজ্ঞাসার প্রকাশ হয়েছে, তা আমলে নিতেই হয়। কেননা, কবিরাও মানুষ। আর মানুষ যেহেতু সমাজ ও প্রতিবেশেরই অংশ; সেহেতু, কবিকেও এর প্রভাবে বিচলিত হয়ে হয়। আনন্দে উদ্বেলিত হতে হয়৷ বহু মানুষের প্রেরণার আবেগকে ধারণ করে শব্দের ইট-পাথরে ‘কবিতা’ নামের এক অপার মহিমান্বিত ও আশ্চর্য শিল্পের প্রাসাদ বা কুঠির বানাতে হয়। কবি জামিল বিন খলিল প্রণীত ‘ও আকাশ তুমি থামো’ কবিতা গ্রন্থের অপরূপ সব কবিতা পাঠ করে আমার বারবার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই গানের কবিতার কথা মনে পড়েছে। জামিল যে সমাজ, দেশকাল বা তার পারিপার্শ্বিক পরিসর ও ব্যক্তিবর্গ নিয়ে সজাগ ও সচেতন, তার কবিতায় তা বিধৃত হয়েছে।
করোনার মহামারীর থাবায় সারা পৃথিবীর অসংখ্য প্রাণ অসময়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। জামিল এইসব হারিয়ে যাওয়া প্রাণকে তারাদের সঙ্গে তুলনা করে আকাশের দিকে ব্যাকুল জিজ্ঞাসায় বলছেন- ও আকাশ, তোমার আর কত তারা প্রয়োজন! শুধু কি তাই? জামিল জর্জ ফ্লয়েডের কান্নার আহাজারিকে কবিতায় বুনন করেছেন৷ বুনন করেছেন এলান কুর্দীর শোকগাথা। জুলকারনাইনের অশ্রুপাত।
বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একাধিক কবিতায় জামিল অনন্য কুশলতায় বেঁধে দিয়েছেন নির্বাচিত শব্দের সাযুজ্যে। সকলের প্রিয় মানুষ কবি আসাদ চৌধুরীকে ‘আমাদের বাতিঘর’ সম্বোধন করে আশ্চর্য সুন্দর এক কাব্যগাথা রচনা করেছেন। আসাদ চৌধুরীর নির্মোহ ও নির্লোভ ব্যক্তিত্বের মরমিয়া উজ্জ্বলতাকে নিপুণভাবে প্রাণ উজাড় করে প্রকাশ করেছেন কবি জামিল বিন খলিল।
‘ও আকাশ তুমি থামো ‘ কবিতাগ্রন্থের কবিতা পাঠ করার আগেও আমি জামিলের কবিতা দেখেছি৷ অনলাইনে অনুষ্ঠান হচ্ছে। একেকজন আবৃত্তি শিল্পী বা বক্তাকে দেখানোর আগে একটি পাখি ডানা ঝাপটিয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। পর্দার নিচু থেকে গজিয়ে উঠেছে লতাগুল্ম। লতাটি জড়িয়ে ফুটে আছে ফুল। ফুলে ফুলে উড়ে এসে বসেছে সুন্দর সব প্রজাপতি। নানান অনুষঙ্গে এতো কবিতারই অন্য এক বিস্তার! একজন মানুষের মধ্যে কত অনন্যসাধারণ গুণ থাকে, থাকতে পারে, জামিল বিন খলিল তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
যারা কবিতা আবৃত্তি করতে ভালোবাসেন জামিল বিন খলিলের ও আকাশ তুমি থামো কবিতাগ্রন্থটি তাদের জন্য এক বিশেষ উপহার হিসেবে গণ্য হবে৷ এই একটি মাত্র গ্রন্থে আছে অসংখ্য আবৃত্তি যোগ্য কবিতা। যা ইতোমধ্যেই দেশ সেরা আবৃত্তি শিল্পী মাহিদুল ইসলামের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়ে সারা বিশ্বের আবৃত্তি প্রেমিদের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে।
জামিলকে বাচনিক পরিবারের একজন হিসেবে পেয়ে আমরা গর্ববোধ করি। বলতে দ্বিধা নেই- জামিলের অনন্য শিল্পকুশলতার জন্য বাচনিকের উপস্থাপনা ও পরিবেশনা সারা বিশ্বের কবিতা আবৃত্তি প্রেমিদের কাছে আরো বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে।
‘খুঁজে বেড়াই খুলে গেছে বোধের বন্ধ দোর,
খুঁজে বেড়াই রাত্রিশেষে এক মানবিক ভোর।’
খুঁজে বেড়াই কবিতার শেষ দিকের দুটি পংক্তি। বোধের বন্ধ দরজা খুলে কবিরা তো একটা মানবিক ভোরের প্রত্যাশায়ই থাকেন। মানবিক একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখান। প্রেরণার প্রেষণে নির্ঘুম জাগিয়ে রাখেন স্বপ্ন বুননের পংক্তিমালার শব্দের আড়ালের সাহসে।
‘ঘাতক জানেনি সূর্যকে ঢাকা যায় না
ঘাতক জানেনি সূর্য থাকে না ডুবে
প্রতিরাত শেষে প্রভাতের হাত ধরে
মুজিব সূর্য জাগে বাংলার পূবে।’
‘মুজিব জ্যোতির্ময়’ কবিতায় এভাবেই জামিল দ্ব্যর্থহীনভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাঙালির প্রাণপুরুষ, ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতির স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশী অস্তিত্বের কথা উচ্চারণ করেছেন। সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে সুরে, রেখায়, শব্দে, ছন্দে, গল্পে, গানে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন পুরণের অসমসাহসিকতার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহিমাকীর্তন করেছেন। জামিলের পংক্তিরাও সেখানে যুক্ত হলো। শত শত, এমনকি হাজার বছর পরেও এই সবুজ ভূখণ্ডের মানুষ যখন বাঙালিদের গৌরব গাথা চর্চা করবে। এই পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষকে এক কাতারে ভাবনার যে মানবিক দর্শন মধ্যযুগীয় কবিয়াল থেকে সমকালীন কবিদের কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে – জগত ভরমিয়া একই মায়ের পুত হিসেবে মানুষকে বিবেচনা করার, সেই বাঙালির মানবিক দর্শনকেই সারা পৃথিবীর মানুষ একদিন চর্চা করবেই। সেই দর্শন বাস্তবায়নের উত্তম পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই হয়ে উঠবেন এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেতা। তখন মানুষ জানতে পারবে, দেশী বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফলে কিছু লোভী বিশ্বাসঘাতকদের হাতে এই মহান নেতার মৃত্যু হলেও আপামর মানুষ কোন বিবেচনায় তাঁকে বুকে ধারণ করতো৷ অবিনশ্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে জামিলের এই পংক্তি মালাও সেদিন উচ্চারিত হবে।
‘ও আকাশ তুমি থামো’ প্রকাশ করেছেন প্রতিভা প্রকাশ। সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। কবির আলোকচিত্র ধারণ করেছেন চঞ্চল কামাল। কবি তার বাবা ডা. খলিলুর রহমান ও মা নুরজাহান রহমানকে বইটি উৎসর্গ করেছেন। বইটির মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন কবি আসাদ চৌধুরী। আছে বরেণ্য আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলামের আন্তরিক শুভেচ্ছা বার্তা। বইটির প্রথম ফ্ল্যাপে কবি জামিল বিন খলিলকে নিয়ে আছে অপরাহ্ণ সুসমিতোর কথা। এসবই বইটিকে আরো মূল্যবান বা মহিমান্বিত করে তুলেছে। একজন কবির প্রথম কবিতাগ্রন্থের এমন বহুমাত্রিক সাফল্য বিশাল প্রেরণাদায়ক।
কবি জামিল বিন খলিলকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন, অফুরান শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
এপ্রিল ১৮, ২০২২
টরন্টো