সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব
কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় লিখে গেছেন-
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।
মানুষ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যেই, সহজাতভাবেই মুক্ত, অবাধ থাকতে চায়। জন্মজাত রিপুর তাড়নে, ক্রীয়াশীল থাকতে চায়। সামাহীন ইচ্ছাকে পূরণ করতে চায়। জৈবিক ক্ষুধা নিবারণ করতে চায়। মানুষের এ চাওয়া অতলান্তিক, অপরিমিত। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত চাওয়া এবং পরিণামে কাড়াকাড়ি, হানাহানি, হিংসা, হিংস্রতা, বর্বরতা মানুষের মধ্যযুগীয় জীবন ধারার কথা মনে করিয়ে দেয়। মধ্যযুগীয় সেই বর্বর, পাশবিক জীবনধারা থেকে মানুষ নিজের প্রয়োজনে, চেষ্টায় এবং বুদ্ধিমত্তায় বেরিয়ে আসতে পেরেছে একটি সভ্য মানবিক জীবন যাপনের কাঠামো নির্মাণ করতে পেরেছে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্র প্রশস্ত হওয়ার সাথে সাথে, মানুষ তার ইচ্ছাশক্তিকে চালিকাশক্তিতে পরিণত ক’রে, স্বপ্নকে একে একে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মানুষ উন্নত থেকে উন্নততর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তার জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশ এবং প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের ভেতরে থাকা পশুত্ব নিয়ন্ত্রন করে বিবেক বিবেচনা ও মানবিকতার মেলবন্ধনে একটি সুস্থ সহায়ক এবং সহযোগিতার বাতাবরণে আধুনিক সমাজ রাষ্ট এবং বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণ করেছে মানুষ।
কথায় আছে , Rome was not built in a day – যার অর্থ, কোন মহৎ সৃষ্টিই একদিনে হয়নি। মানবসভ্যতার আজকের এই উৎকর্ষতাও মানুষ রাতারাতি অর্জন করেনি। এ অর্জন এসেছে মানুষের অদম্য ইচ্ছা, উন্নতর চিন্তাচেতনা, জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের, ক্রমবিবর্তনের কঠোর ও সুতীক্ষ্ণ বিচার ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে।
মানুষ শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞান বিজ্ঞানে যত এগিয়েছে ততই সচেতন হয়েছে, সোচ্চার হয়েছে নিজের অধিকার রক্ষায়। কী সেই অধিকার? মানুষের সর্বজনীন, সহজাত এবং মুক্ত-অবাধ অথচ সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানুষের অধিকার যা মানবধিকার হিসাবে সর্বাধিক এবং সর্বত্র আলোচিত শব্দনিচয়। মানবধিকার আজ বিশ্বে মানুষের জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য এবং অবশ্য প্রদত্ত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং দেশে দেশ সংবিধানিকভাবে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে সমুন্নত। মানবধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, গোত্র, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। বর্ণবাদ বিরোধী কিংবদন্তী নেতা সাউথ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডলার মত “To deny people there human rights is to challenge their very humanity.” দালাইলামার মতে, “Peace can only last where huma rights are respected, where the people are fed and where individuals and nations are free.” মানবাধিকার বলতে মূলত যেসব অধিকারের কথা বলা হয় তার মধ্যে বাঁচার অধিকার, মুক্ত থাকার অধিকার,স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, কাজ করার অধিকার ইত্যাদি অন্যতম। বৈষম্যহীনভাবে এসবে রয়েছে সবার সমান অধিকার।
এবার আলোকপাত করা যাক কানাডীয় নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়ে। তার আগে একটু জেনে নেই নাগরিক অধিকার ও মানবধিকারের মধ্যে কী সম্পর্ক। নাগরিক অধিকার হচ্ছে সে সব অধিকার যা কেউ কোন একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার সুবাদে উপভোগ করার অধিকারী হন। রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার বৈষম্যহীনভাবে আদায় নিশ্চিত করার জন্য, সুরক্ষিত রাখার জন্য সাংবিধানিকভাবে লিপিবদ্ধ করে এবং রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে তা রক্ষা করে। যে কোন রাষ্ট্রের প্রদত্ত নাগরিক অধিকার সে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থাপনার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। যার ফলে সামগ্রিক ভিন্নতার কারণ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, নাগরিক অধিকার প্রয়োগ ও সুরক্ষার মধ্যে প্রকৃতিগত ও গুণগত ভিন্নতা থাকতে পারে।
অপরপক্ষে, মৌলিক মানবাধিকার হলো সে সব অধিকার যা একজন মানুষ কেবল একজন মানুষ হয়ে জন্ম নেবার ফলেই পেয়ে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামগ্রিক ভয়াবহতায়, বিশেষ করে নাৎসি বাহিনীর নির্মমতায় যে ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটে তার প্রেক্ষাপটে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে, ১৯৪৮ সালে প্রথম জাতিসংঘের মানবধিকার ঘোষণার মাধ্যমে সর্বজনীনভাবে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় মৌলিক মানবাধিকারসমূহকে সমুন্নত রাখে এবং রক্ষা করে। জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মানুষের জীবনের অধিকার, খাদ্যের অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার ইত্যাদি যার নিরিখে সদস্য রাষ্ট্র সমূহ স্বস্ব রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সাংবিধানিক সুরক্ষার বলয়ে তা সমুন্নত রাখার বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ। যদিও বাস্তবে এর প্রয়োগ অধিকারসমূহের বাস্তবায়ন সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সমানভাবে পরিলক্ষিত হয় না। কোন রাষ্ট্র একজন নাগরিকের সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত এবং ন্যায়সঙ্গত মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। তবুও বিভিন্ন রাষ্ট তার নাগরিককে বিভিন্ন নাগরিক এবং মানবাধিকার প্রদানে অস্বীকার করে কিংবা সুরক্ষিত করতে যথাযথ সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। মানবাধিকার তখনই নাগরিক অধিকারে পরিনতহয় যখন তা রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে সর্বোচ্চ আইনি আওতায় স্বীকৃতি দেয়।
কানাডা একটি অভিবাসী অধ্যুষিত দেশ। ইংরেজি ও ফরাসি যদিও এদেশের সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃত তবে এদেশে দু’শর বেশী ভাষাভাষীর মানুষ বসবাস করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অসংখ্য ভাষা ও সংস্কৃতিক মানুষের এক অনন্য ও অপূর্ব সম্মিলনের দেশ এই কানাডা। তাদের সবার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রকৃতি ও পর্যায়গত প্রেক্ষাপট। এই বহুধা জনগোষ্টীকে একসূত্রে গাঁথার জন্য কানাডার অভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং নাগরিক অধিকারের সাংবিধানিক সুরক্ষা অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা পালন করে আসছে।
কানাডায় প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত এবং সুরক্ষিত “The Canadian Charter of Rights and Freedoms” – এ সে সকল অধিকার ও স্বাধীনতাকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে যা একটি গনতান্ত্রিক সমাজে ও রাষ্ট্রে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে বসবাসের জন্য প্রতিটি নাগরিকের প্রয়োজন। এই চার্টার কানাডার সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ যা সাংবিধানিক আইন হিসেবে ১৯৮২ সালে অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল এই চার্টারের স্বাক্ষরের দিবসটিকে উদযাপন করা হয়। তবে কানাডায় চার্টার কার্যকর হওয়ার পূর্বে বিভিন্ন কানাডীয় আইন দ্বারা নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষিত হতো। যেমন Canadian Bill of Rights যা সংসদ ১৯৬০ সালে আইনে পরিণত করে যদিও Bill of Rights কানাডার সংবিধানের অংশ নয়। সংবিধান কানাডার সর্বোচ্চ আইন যার আওতায় অন্য যে কোন আইন প্রণয়ন হলে তা অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়। তিন স্তরের সরকার ব্যবস্থায় অর্থাৎ কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কোন আইন প্রণীত হলে যদি তা সাংবিধানিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তবে সংবিধানই সমুন্নত থাকবে। অবশ্য সাংবিধানিকভাবে প্রদত্ত অধিকার কখনোই নিরষ্কুশ নয়। নিজের অধিকার আদায়ের সীমারেখা সে পর্যন্ত বিস্তৃত যা অতিক্রান্ত হলে অন্যের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বাকস্বাধীনতা কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতা সে পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য যে পর্যন্ত না তা অন্যের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ায়, অন্যের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করে বা লঙ্ঘণ করে।
“The Canadian Charter of Rights and Freedoms” যদিও ১৯৮২ সালে ১৭ এপ্রিল স্বাক্ষরিত হয় এবং কার্যকর হয়, তবে Section 15 তার তিন বছর পর বাস্তবায়িত হয় যাতে সরকার তার সকল আইন এর সংঙ্গে সমন্বয় করে সমানাধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
নাগরিক হিসেবে একটি সুস্থ, সুন্দর, সহায়ক এবং সুশৃঙ্খল সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনে প্রত্যেকের ভূমিকা রয়েছে। একজন নাগরিকের যেমনি নাগরিক অধিকার, মৌলিক মানবাধিকার রয়েছে তেমনি রয়েছে নাগরিকের দায়িত্বপালনের কর্তব্য। সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে চার্টারের সেকশন ১ এ বলা হয়েছে যে, অধিকার আইনের দ্বারা সীমিত সে পর্যন্ত যতটুকু একজন স্বাধীন ও গনতান্ত্রিক সমাজে যৌক্তিক বলে বিবেচিত হয়।
কানাডার অভ্যন্তরে অস্থান করছেন, তা তিনি Citizen, Permanent Resident কিংবা New Comer যাই হোন, অধিকার সবার বেলায় প্রযোজ্য হবে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। ব্যতিক্রমের মধ্যে যেমন ভোট দানের অধিকার, কানাডার প্রবেশ কিংবা ছেড়ে যাওয়ার অধিকার।
কয়েক দশক ধরে, সামাজিক পরিবর্তন, অগ্রযাত্রা এবং ন্যায়নীতি নিশ্চিত করার উৎস হিসাবে কাজ করছে। কানাডার ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, এবং সামাজিক মূল্যবোধকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে এই চার্টার। উদাহরণস্বরূপ ভাষার অধিকার। আগেই বলেছি, কানাডায় দু’শর বেশি ভাষাভাষীর বাসস্থান ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার বাইরেও যে কোনো ভাষার ব্যবহার ও সংরক্ষণের পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সমর্থন রয়েছে। রাস্ট্রা ও সমাজ সবার নিজস্ব জাতিগত সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে সর্বাত্মক, সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এক কথায় চার্টার মানুষের সেসব মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখে যা কানাডাকে একটি অগ্রসর, আধুনিক, মুক্ত ও গনতান্ত্রিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। বর্তমান সময়ে তাই কানাডা সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে বসবাসের এক স্বপ্নভূমি।
সমাজদর্পনে আইন কানুন প্রতিবিম্বিত হয়। আর সমাজ ও এর স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভিন্ন ভিন্ন মত, আদর্শ, বিশ্বাসের সহাবস্থান এবং যুক্তিতর্কের সোপান ধরে উন্নততর জীবনাদর্শ গড়ে ওঠে সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, আইনের শাসন, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের অনুগামীতা ইত্যাদির ভিত্তিতে। নাগরিক অধিকার কিংবা মানবাধিকার উপভোগের জন্য বা আদায়ের জন্য কিছু দায়িত্বও পালন করতে হয়। যেমন কানাডার প্রতিটি নাগরিক তার নিজস্ব মতামত, ধারণা ও যুক্তি বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সংঙ্গে যোগাযোগ, বা আলোচনার মাধ্যমে প্রকাশ করার পূর্ব স্বাধীনতার উপভোগ করেন।
এধরনের কার্যক্রম কিংবা উদ্যোগ মৌলিক স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। যে কোন নাগরিক সরকারের নীতির কার্যক্রমের অবাধ সমালোচনা এবং তাদের নিজস্ব মতামত নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করতে পারেন। কিন্তু কখনোই মত প্রকাশের জন্য যোগাযোগ স্থাপন কিংবা প্রকাশ্যে অন্যাদের জানানো আর প্রভাব বিস্তারের প্রয়াস এক নয়, যে ক্ষেত্রে অন্যের স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। এই সীমারেখা নির্নয়ের ক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতা অত্যন্ত অপরিহার্য।
কানাডার মতো একটি দেশে যেখানে অসংখ্য জাতিগোষ্ঠি, ভাষাভাষি মানুষের বসবাস, যে দেশে একটি সু-সমন্নিত, সুদৃশ্য মোজাইকের মতো সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে সেখানে প্রতিটি নাগরিক তার নিজস্বতা বজায় রেখে যত সহজে ও স্বাচ্ছন্দে মূলধারার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারবেন এবং দেশটির অন্তর্নিহিত মূল্যবোধকে ধারণ করতে পারবেন তিনি তত দ্রুত একজন আদর্শ ও গর্বিত কানাডিয়ান নাগরিকে পরিনত হবেন এবং এদেশ তত সুখি, সুন্দর, ও উন্নততর দেশে পরিণত হবে।
তথ্যসূত্র: The Canadian Charter of Rights and Freedoms