সুশীল কুমার পোদ্দারের “অবলাচরণ”

ঝর্ণা চ্যাটার্জী

সুশীল কুমার পোদ্দারের লেখা ‘অবলাচরণ’ বইটি পড়তে পড়তে অনেক কথা মনে এলো। কোনটা আগে, কোনটা পরে লিখব তা ভেবে পাচ্ছি না। তার ওপরে সুশীল প্রযুক্তিবিদ্যায় সারা পৃথিবী থেকে এত এত ডিগ্রি অর্জন করে আর জীবনের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পরেও বাংলা ভাষায় এত দক্ষতার সাথে লিখতে পারে, তার জন্য সময় করে নিতে পারে – আমি তাই দ্বিধাগ্রস্ত।    

একটি একাকী প্রায়-বৃদ্ধ মানুষের মনের, তার ‘নস্টালজিয়া’, তার অনুতাপ-মিশ্রিত অভিমান, তার প্রিয়জনেদের জন্য মমতা, প্রকৃতির সাথে একাত্মতা অনুভব, আর প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি – এত সুন্দর বিশ্লেষণ উপন্যাসের পাতায় বিরল। জীবনের নানা লগ্নে, নানা উপলক্ষ্যে বিবেকের সাথে অবলাচরণের নীরব কথোপকথন, আর অনেক পরে নাতি ঋষির মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের বিষয়ে জানার পরে তাই নিয়ে অবলাচরণের গবেষণার বিবরণ পড়ে মনস্তত্ব সম্পর্কে লেখকের জ্ঞান ও আগ্রহের পরিচয় পাই। সাধারণ মানুষের দুর্বলতা নিয়ে লিখেছেন সুশীল। তার সুন্দর উদাহরণ ঋষির এই অবস্থার জন্য পুত্রবধূ মাধুরীকে দোষ দেবার প্রাথমিক বাসনা।    

বইয়ের শেষ দিকে দেখি অবলাচরণের স্মৃতি লোপ পাবার ক্রমবিবর্তন – এই বিষয়ে আবার দেখি কি আশ্চর্য নিপুণতার সংগে লেখক তাঁর গল্পের জাল বুনে চলেছেন। গাছপালা, ফুল ও ফলের সম্পর্কে অনেক বিজ্ঞান-সন্মত তথ্যের পরিচয় ছড়ানো আছে এ-বইএর পাতায় পাতায়। কিন্তু আমাকে সব চেয়ে মুগ্ধ করেছে অবলাচরণের সাথে ভৃত্য কালীচরণের সম্পর্ক। প্রভু-ভৃত্য শুধু নয়, যখন অবলাচরণ দুর্বল, অসুস্থ, অসহায়, একা তখন স্বেচ্ছায় অভিভাবকের দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে কালীচরণ। আবার অবলাচরণের উপলব্ধি যে আমাদের সংসারে কিছু কিছু মানুষদের নিজেদের প্রয়োজন, তাদের সুখ-সুবিধা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবহেলিত হয়ে থাকে – এই দলে আছেন তার মা, তার স্ত্রী, আর এর সূত্র ধরে, তার পুয়াতন ভৃত্য। এ-ও লেখকের মনের গভীরতার পরিচয়।  

সুদূর অতীতে বাল্যবন্ধুর প্রতি হৃদয়হীন ব্যবহারের জন্য অনুশোচনায় তার মনের গভীরতার পরিচয় পাই। প্রবল বৃষ্টিতে আত্মহারা আনন্দে অবলাচরণ মাঠে ঘাটে, বনে জঙ্গলে ছুটে চলেছে, সাথে কালীচরণ। কি অপূর্ব দৃশ্য!  কালীচরণের কি হবে তার মৃত্যুর পর – তাই নিয়ে অবলাচরণের চিন্তা। তাই একটি নিঃসন্তান বিধবার (লক্ষীর) সাথে তার বিয়ে দিয়ে তাকে সংসারী করা, ছেলে-ছেলের বৌ এর কাছে কালীচরণকে ‘কাকুর’ সন্মান দেওয়া – এমনি সব ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে অবলাচরনের আসল চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সে অভিমানী, খামখেয়ালী, কিন্তু অন্তঃশীলা নদীর মত দয়ালু, হৃদয়বান।      

লক্ষীর সাথে ঋষির অন্তরঙ্গতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সন্তানহীনা লক্ষীর কাছে ঋষি শুধু এক স্নেহের পাত্র, এক নির্মল শিশু। তার কথা না বলা, তার অন্য শিশুদের মত না হওয়াতে কিচ্ছু আসে যায় না লক্ষীর। সে তার উপবাসী মনের স্নেহ উজাড় করে দিয়েই খুশি।

বইটির শেষ হয়েছে অবলাচরণের পরম অসহায়তার দৃশ্যে, যা পাঠকের অন্তর স্পর্শ না করে পারে না।

আমি সুশীল কুমার পোদ্দারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই বইটি আমাকে উপহার দেবার জন্য। এই সুন্দর উপন্যাসটি সবাইকে পড়তে অনুরোধ করে আমার বক্তব্য শেষ করছি।