সুব্রত কুমার দাসের ‘উৎস থেকে পরবাস’: নতুন এক অভিজ্ঞতার সন্ধান
২০২১ সালে সারা কানাডায় যে ২৫ জন শ্রেষ্ঠ অভিবাসীর ৭৫ জনের যে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশিত হয় তার মধ্যে লেখক, গবেষক ও সংগঠক সুব্রত কুমার দাস একজন। তাঁর আত্মজীবনীমুলক গ্রন্থ ‘উৎস থেকে পরবাস’ পড়লাম। পুরো বইটিই বিভিন্ন সময়ের ফোনালাপন সাক্ষাৎকার। এই বইটি পাঠ ছিল আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা। দেবান্জনা মুখার্জি ভৌমিকের সহজ, সরল, বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের মাধ্যমেই শ্রদ্ধেয় সুব্রত কুমার দাস বর্ণনা করেছেন তাঁর শিকড় থেকে বেরিয়ে এসে এখন পর্যন্ত শাখা প্রশাখায় বেড়ে উঠার গল্প।
বইটি যখন পড়ছিলাম মনে হচ্ছিল লেখকের সামনে বসে গল্প শুনছি। সুব্রত স্মৃতিচারণের মাধ্যমে বলে গেছেন তাঁর শৈশব, দুরন্ত কৈশোর, তারুণ্যের আর বর্তমানের পাওয়া, না-পাওয়া, সাফল্য, প্রতিকূলতার গল্প।
বইটি পড়তে গিয়ে আমার দেখা দাদা সুব্রত কুমার দাস আর সাহিত্যিক সুব্রত কুমার দাসের মধ্যে ফাড়াক বিস্তর। সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত মানুষটির জ্ঞানভান্ডার যে কত সমৃদ্ধ ‘উৎস থেকে পরবাস’ বইটি না পড়লে সেটা বুঝতে পারতাম না। এই বইটিতে তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর ছোটবেলায় কীভাবে পাঠ্যাভাস গড়ে উঠেছে আর তা চলছে এখন পর্যন্ত – এটি যে কোন পাঠকের জন্য হতে পারে একটা গাইড লাইন।
সকল ধর্মের প্রতি লেখকের রয়েছে প্রচন্ড শ্রদ্ধাবোধ। তিনি বলেছেন বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমানদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান। পাশাপাশি তিনি বলেছেন পরবর্তীকালে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির মাধ্যমে হিন্দু মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা। তাঁর বর্ণনায় দেখতে পেয়েছি একটা ৬/৭ বছরের শিশুর দেখা মুক্তিযুদ্ধ। দেশ ছেড়ে অন্য দেশে থাকার বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
লেখক অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তুলে ধরেছেন তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সাথে তাঁর সম্পর্ক, কানাডার সব গুণী ব্যক্তিত্বদের যাদের সংস্পর্শে তিনি নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন সেই সব কথা। তিনি বলেছেন দেশ থেকে কীভাবে কানাডায় আসার চিন্তা করলেন। আর নতুন একটি দেশে কীভাবে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও সবকিছু মানিয়ে নিয়ে সফলতা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলছেন। গল্পের মাধ্যমেই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর পারিবারিক জীবন, দর্শন, ধর্ম, কর্ম , কানাডার সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি।
সুব্রত কুমার দাস বাংলাদেশে থাকাকালীন বেশির ভাগ সময়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকায় শেখানোর অভ্যাসটা তার মধ্যে সহজাত। তাই তো এই বইটিতে শিশুদের লার্নিং টেকনিক বা শিক্ষা পদ্ধতি, কমিউনিকেটিভ মেথোডোলজির যে উদাহরণ তিনি দিয়েছেন তা ফলো করলে শিশুরা শিখতে পারবে মনের আনন্দে।
খুব মজা লেগেছে তাঁর ছেলেবেলার পারিবারিক লাইব্রেরির বর্ণনা দেখে। একজন কিশোর সুব্রত মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে থাকার পর দেশে ফেরার সময় কলকাতা থেকে নিয়ে আসে একটা টিনের বাক্স –
কিভাবে সেই বাক্সকে লাইব্রেরিতে পরিণত করেছেন সেই গল্প লিখেছেন সুব্রত। পরবর্তীকালে সেই লাইব্রেরিরে সংগৃহীত হয় পাঁচ হাজারের বেশি বই । তাঁর এই লাইব্রেরিকে তিনি বন্ধু বান্ধব, প্রতিবেশী, গ্রামের লোকের জন্য উন্মুক্ত রেখেছিলেন। যেখানে তিনি পুরোপুরি লাইব্রেরিয়ানের মত বই ধার দিয়ে লিখে রাখতেন।
ছোটবেলা থেকে বই পড়া এই মানুষটির নেশার মতো ছিল। তিনি একটা বই পড়তে গিয়ে তার আদ্যোপান্ত জানার জন্য রেফারেন্স বইও অনেক পড়েছেন আর সংগ্রহে রেখেছেন। তাঁর এই পাঠ্যাভ্যাসই তাঁকে হয়তো গবেষণার কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। কানাডায় আসার পর কানাডার সাহিত্য নিয়ে বই লেখা তাঁর অগ্রগণ্য কাজ। তিনি রচনা করেছেন ‘কানাডীয় সাহিত্য: বিচ্ছিন্ন ভাবনা’। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এই বই কানাডার সাহিত্য বোঝার ব্যাপারে বাঙালিদের কাছে রীতিমতো একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। অভিবাসী জীবনে তিনি আরও লিখেছেন ‘শ্রীচৈতন্যদেব’ – গ্রন্থটি প্রথমে টরন্টো থেকে এবং পরে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে থাকতেই প্রকাশিত তাঁর বইগুলোর মধ্যে ছিল ‘আমার মহাভারত’, ‘নজরুল-বীক্ষা’, ‘অন্তর্বাহ’, ‘রবীন্দ্রনাথ: ইংরেজি শেখানো’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও মহাভারত’, ‘আলোচনা-সমালোচনা’, ‘রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা, অজানা’ ইত্যাদি।
শিক্ষকতা পেশায় লেখক সুব্রত কুমার কতটা সফল হয়েছেন তা বোঝা যায় ইউনেস্কোতে তাঁর আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ থেকে। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার আঘাতের পর সারা বিশ্বে দুশ্চিন্তার ঝড় বইতে থাকে। ২০০৪ সালে ইউনেস্কো বিশ্বব্যাপী আলাপন বৃদ্ধির জন্য মনডিয়ালোগো নামে একটা প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পে সারা বিশ্বে প্রায় ২০০৬ সালে ২৬৬০ জন শিক্ষক অংশ নেন। এদের মধ্যে থেকে ৫০ জন শিক্ষককে শ্রেষ্ঠ মনোনীত করা হয়। যাদের সাথে আরো ৫০ জন শিক্ষার্থী কনফারেন্সে অংশ নেন ইতালির রোমে। সুব্রত কুমার দাস সেই ৫০ জন শিক্ষকের মধ্যে একজন ছিলেন। আর তার চেয়েও আনন্দ আর গর্বের বিষয় হলো পরবর্তী বছরের জন্য প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনা আর নতুন নতুন সৃষ্টিশীল কাজের জন্য যে তিনটি দলকে নির্বাচন করা হয় সেখানে তাঁর দলটিকে নাম্বার ওয়ান দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই স্বীকৃতির পুরস্কার হিসেবে ২০০৭ সালে তিনি ও তাঁর একজন শিক্ষার্থী মুম্বাই কনফারেন্সে অংশ নেন।
২০১৩ সালে কানাডার জীবন শুরু করলেও বইকে তিনি ছাড়তে পারেননি। তিনি প্রতিনিয়ত পড়ে চলেছেন কানাডিয়ান সাহিত্য। নিজেকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি অন্যদেরও সুযোগ বা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন কানাডিয়ান সাহিত্য সম্পর্কে। কাজটি তিনি করে চলেছেন আমেরিকা আর কানাডার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখে , টিভিতে সাহিত্য-ভিত্তিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্যমে।
সুব্রত কুমার দাস ২০১৯ সালের ১৫ ই জুন থেকে এনআরবি টেলিভিশনে কানাডা জার্নাল নামে একটা অনুষ্ঠান শুরু করে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫৩টি পর্ব পরিচালনা করেন। অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর করোনাকালীন সময় থেকে এখন পর্যন্ত তিনি ভার্চুয়ালি অনেক লাইভ করেছেন এবং করছেন সাধারণ মানুষকে একটু ভালো সময় উফার দেবার প্রচেষ্টায়। তিনি যখন কোন নতুন জায়গায় যান সেই জায়গাটি নিয়ে বেশ পড়াশোনা করে নেন। এরপর সেই জায়গাটা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য তুলে ধরেন এবং নিজের ভাল লাগাটুকু শেয়ার করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর এই শিক্ষনীয় আনন্দ প্রদানের উদ্যোগ বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রশংসা পেয়েছে।
লেখক, গবেষক প্রিয় সুব্রত দাদার সমৃদ্ধ জ্ঞান ভান্ডার আমাদের বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। ২০০৩ সালে যখন দেশের খুব সংখ্যক মানুষ ইন্টারনেটে অভ্যস্ত ছিলেন, সেই সময় বাংলা সাহিত্যকে অবাঙালিদের কাছে পৌঁছে দিতে তিনিই প্রথম সাহিত্য নিয়ে একটি ওয়েবসাইট নির্মাণের উদ্যোগ নেন। শুরুতে ইংরেজি ভাষায় করা সেই ওয়েবসাইটে ২০০৫ সালে যুক্ত হয় বাংলাভাষাও।
‘উৎস থেকে পরবাস’ বইটিতে দেখতে পাই কানাডায় বাংলা সাহিত্যকে তুলে ধরার জন্য সুব্রত কুমার দাস যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তা চোখে পড়ার মতো। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে তিনি আয়োজন করেন কানাডীয় বাঙালি লেখক সম্মেলন। এতে তিনি পোয়েট লরিয়েট অথবা রাইটার্স ইউনিয়ন অব কানাডার প্রধান, বা কানাডার অনেক কবি সাহিত্যিকদের আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি আরেকটি প্রকল্প হাতে নেন। সেটা হলো ‘ ইংরেজি অনুবাদে বাংলা সাহিত্য’। এই প্রকল্পের উদ্বোধনীতে তিনি যুক্ত করতে পেরেছিলেন লিটারারি ট্যান্সলেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডার প্রধানকে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েদেরকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের লেখাগুলোকে ইংরেজিতে পড়ার ব্যবস্থা করা। তাদেরকে আমাদের সাহিত্যের প্রতি উৎসাহিত করা।
লেখক গবেষক সুব্রত কুমার দাস সব সময় যে বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করেন তার মধ্যে একটি প্রধান বিষয় হচ্ছে কীভাবে বাংলা সাহিত্যকে কানাডায় প্রতিষ্ঠিত করবেন! সেই লক্ষ্যেই তিনি চেষ্টা করেন কানাডীয় মূলধারার লেখকদের সাথে বাঙালি লেখকদের সংযোগ সাধন । কানাডায় পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সাথে বাংলাদেশি কানাডীয় লেখকদের সংযোগ সাধন। আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মেকে আমাদের লেখালেখি, সাহিত্যিক উদ্যোগ বা আমাদের মূল যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারা সে বিষয়ে অবগত করা।
লেখক, গবেষক সুব্রত কুমার দাসের সাহিত্যের প্রতি এই অনুরাগ আমাদের দেশকে যেমন সমৃদ্ধ করছে তেমনি উত্তর আমেরিকার একটি সমৃদ্ধশালী দেশ কানাডাতেও বাংলাদেশকে তিনি তুলে ধরছেন প্রতিটি মুহূর্তে। তাঁর যাপিত জীবন, অতীত সব কিছুর মধ্যেই দেশের প্রতি ভালোবাসা ফুটে উঠেছে তাঁর ‘উৎস থেকে পরবাস’ বইটিতে। মুর্ধন্য থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থ একটি মূল্যবান পাঠ হবে যে কোনো পাঠকের কাছেই।