‘সপ্রতিভ’: মানব চরিত্রের সুপ্ত সত্তারই অন্বেষণ
শিউলী জাহান
একটি ভালো উপন্যাস সম্পর্কে অনেকগুলো বিখ্যাত উপন্যাসের জনক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন, “All good books have one thing in common – they are truer than if they had really happened.” আজকের আলোচ্য উপন্যাস ‘সপ্রতিভ’ পড়তে গিয়েও পাঠকের ভেতরে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর অনুভূতির সংক্রমণ ঘটবে। সঞ্চারিত হবে আবেগের উত্থান-পতন। মনে হবে ঘটনাগুলো যেন সত্যি ঘটে যাচ্ছে। চরিত্রের দুঃখবোধে পাঠকের চোখেও জল গড়াবে কিংবা মুখে মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়বে। ঠিক এভাবে উপন্যাসটি হয়ে উঠবে একটি ভালো উপন্যাস। এ বিষয়ে আমেরিকান জনপ্রিয় লেখক রিচার্ড ইয়ানসি যেমনটি বলেছেন, “One of the joys of a really good book is that you’re so into the world of the book, you forget what you’re looking at is words on a page.”
‘সপ্রতিভ’ উপন্যাসটির ক্ষেত্রে একটি ভালো উপন্যাসের সব কয়টি গুণাবলী প্রযোজ্য। যদিও উপন্যাসটি লেখক দিলীপ চক্রবর্তীর (জন্ম ১৯৩৭, ফরিদপুর জেলা) উপন্যাস লেখার সিঁড়িতে প্রথম পদযাত্রা, কিন্তু তাঁর লেখনীর পরিপক্বতায় একজন পাঠকের পক্ষে সেটা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এখানেই তার সার্থকতা। আমাদের আনন্দ এই যে ৭৯ বছর বয়সী কানাডার ব্রাম্পটন নিবাসী এই মানুষটির নতুন করে লেখক হওয়ার সাথে আমরা নিজেদেরকে যুক্ত করতে পারছি।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র থেকে অন্যান্য চরিত্রের সুচারু বিন্যাস, ভাষা এবং শব্দের ব্যঞ্জনায় লেখক দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। ব্যক্তিজীবনে কলেজে অধ্যাপনায় নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি লেখালেখির ক্ষেত্রে মূলত ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লেখায় তিনি নিমগ্ন ছিলেন। উপন্যাস লেখার কথা কখনো ভাবেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “উপন্যাস লেখার ব্যাপারে ঠিক অনীহা না, একটা অকারণ ভীতি আছে। আমি কল্পনার ফানুস উড়িয়ে অসংলগ্ন কল্পনা – যেটা অনেক সময় কষ্ট কল্পনার হয় – করতে পারি। কিন্তু যুক্তিসঙ্গত এবং সুসংবদ্ধ কল্পনার শক্তি দেবার ব্যাপারে সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি সুবিচার করেছেন, এটা বলা যায় না।” কিন্তু বইটি পড়ে আমার অনুধাবন সৃষ্টিকর্তা লেখকের অগোচরেই সেই সুবিচার করে রেখেছেন, সেটা তাঁর অজ্ঞাত। ‘সপ্রতিভ’ উপন্যাসটিতে তিনি তার সেই লুকায়িত সুসংবদ্ধ কল্পনাশক্তিকে পরিস্ফুটিত করতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি।
একটা ভালো উপন্যাসের মূল উপাত্ত হচ্ছে, উপন্যাসের অঙ্কুরোদগম থেকে বৃক্ষের বিস্তৃতির মতই চরিত্রগুলোর পূর্ণাঙ্গ জীবন, তাদের উত্থান-পতন এবং মানবীয় পরিবর্তন ঘিরে ঘটনা প্রবাহ। ‘সপ্রতিভ’ উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র অধ্যাপক সপ্রতিভ মজুমদার। সংসারে মা এবং বোনকে নিয়ে তার আবর্তন। ছাত্রাবস্থায় বাবাকে হারিয়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং ভাগ্যের বিড়ম্বনার মধ্যে দিয়ে প্রতিটি দিনকে টেনে হিঁচড়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে নিতে একসময় কর্মজীবনে প্রবেশ। একদিকে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, আরেকদিকে ব্যক্তি মর্যাদা এবং নীতি বিসর্জন না দেয়া। শেষ পর্যন্ত অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে নিজস্ব পছন্দ শিক্ষকতাকে সপ্রতিভতা দিয়েই অর্জন করতে পেরেছে। সপ্রতিভ মজুমদার যদিও নিজে তার সপ্রতিভ নামের স্বার্থকতা নিয়ে দ্বিধান্বিত। পদে পদে অপ্রতিভ হওয়াটাই যেন তার জন্য নির্ধারিত বাস্তবতা। কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে আমার মূল্যায়ন, একটি দুর্বল অবস্থান থেকে শুধু নিজের একনিষ্ঠ মনোবল, ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে অধ্যাপক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তার সুপ্ত সপ্রতিভ মানসিকতারই স্বাক্ষর বহন করে। কলেজে অধ্যাপনায় জ্ঞানের গভীরতা এবং সেটা অন্যকে জানানো বা শিক্ষাদানের প্রতি তার অপরিসীম আগ্রহ তার সুপ্ত সপ্রতিভ সত্তাকেই একজন পাঠকের সামনে প্রতিভাত করে।
সপ্রতিভ মজুমদারের নিজস্ব চিন্তার উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করতে পারি যখন কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. রাজিয়া হাসান তাকে কলেজে ক্লাসের পাশাপাশি টিউশনি করানোর পরামর্শ দিলেন এবং সপ্রতিভ সাগ্রহে তাতে রাজি হলো – “একটা কথা আছে, The more you teach, the more you learn” – কথাটা ও প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে আরো ভালোভাবে বুঝলো। একই বই পরীক্ষার জন্য পড়া, পরীক্ষার জন্য না পড়ে আনন্দের জন্য পড়া, আবার অন্যদের পড়ানোর জন্য সেই বইটা পড়া – সব আলাদা আলাদা অনুভূতি… এই টিউশন পড়ানোয় সপুর অন্য একটা বড় লাভ হলো যার দাম টাকা দিয়ে মাপা যায় না। সপুর কিছু ছাত্র ছাত্রী বিদেশী ছিল। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তাদের সঙ্গে গল্পে সপু ইসলাম সম্বন্ধে, খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলো যা আগে জানত না।” (পৃ. ৮০/৮১) এর মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই সপ্রতিভ ওরফে সপু জীবনের চলার পদে পদে ভাগ্য বিড়ম্বনায় বিভিন্ন দুরবস্থা, দুর্দশায় বাহ্যত অপ্রতিভ হলেও নিজস্ব মনোজগতের চিন্তাধারায় সে একজন সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ব। এর প্রমাণ মূলত আমরা উপন্যাসের শুরু থেকে শেষপর্যন্তই পাই যদি একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি – যেমন দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থেকে পিতার মৃত্যুর পর জীবনজ্যেঠুর সাহায্য নিয়ে তার পড়াশুনা এবং সংসার চালাতে হলেও নিজের দৈন্যতাকে কখনো প্রকাশ করেনি। এমএ পাশ করে কলেজে শিক্ষকতার জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তার জ্ঞানের প্রাণবন্ত উপস্থাপন। ক্লাস নেবার সময় দুই ছাত্রনেতাকে তাৎক্ষণিক ক্লাস থেকে বের করে দেয়া। কাহিনির শেষ অঙ্কে আকাশ থেকে উল্কাপিণ্ডের মত যেন রাবণের হাত থেকে পালিয়ে সীতার উদয় এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সীতাকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে স্কুটারে তুলে নিয়ে তার প্রস্থান; এবং পরিশেষে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে, ভিন্ন সংস্কৃতির আবহে তার ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন – সর্বত্রই তার সপ্রতিভ ব্যক্তিসত্তার প্রকাশ। এই বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটির “সপ্রতিভ” নামকরণের স্বার্থকতা খুঁজে পাই।
লেখক দিলীপ চক্রবর্তী জীবনের একটা দীর্ঘসময় অধ্যাপনায় জড়িত থাকার দরুণ একজন শিক্ষকের মনোজগতকে একজন নিপূণ চিত্রশিল্পীর মতই রং তুলিতে চিত্রায়ণ করেছেন। তার জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার আধুনিক স্রোতধারা, তদুপরি সনাতন ধারার প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ, সেই সাথে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ এর মতো ‘কলেজ পলিটিক্স’ এর অন্তর্গত অন্ধকার বান্তব রূপটি তুলে ধরেছেন। অন্ধকার এবং আলোর যেহেতু পাশাপাশি সহাবস্থান, এরই মাঝে তাই আমরা একজন প্রিন্সিপাল ডা. রাজিয়া হাসানের মত বিদূষী এবং আলোকিত ব্যক্তিত্ব দেখতে পাই আমাদের সমাজ জীবনে যিনি নীতি এবং আদর্শের প্রতি গিরিশৃঙ্গের মত দৃঢ়। তিনি সন্তানস্নেহে সপ্রতিভকে ছায়া দিয়েছেন, কিন্তু কোনো ন্যায়ের বিচ্যুতি ঘটিয়ে নয়, সততার পথে অটল থেকে। আবার বাহ্যিকভাবে পাথর রূপটির প্রকাশ ঘটলেও তার ভেতরে কাকচক্ষু জলের মত স্বচ্ছ এবং কোমল অভিমানী মাতৃরূপটি কুল কুল করে বয়ে চলেছে সবার আড়ালে। একমাত্র ছেলে আমেরিকায় গিয়ে একজন বিদেশী মেয়েকে বিয়ে করায় তার এই অভিমানী মন এবং আদর্শবোধ তাকে অবুঝ করে তোলে। তার ফলশ্রুতিতে তিনি ছেলেকে পরিত্যাগ করেন। পরবর্তীতে সময় পরিক্রমায় এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তার আত্মোপলব্ধি এবং সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটে। তার মনে হয়েছে – “ওনি ওর ছেলের সাথে এভাবে একতরফা সম্পর্ক ত্যাগ করে অনুচিত কাজ করেছেন। ওর ছেলে তো পিতৃহীন এবং সত্যই মা-অন্তপ্রাণ। ওর মনে হচ্ছে উনি নিজের ছেলে মুজিবুরকে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দিয়েছেন আর মুজিবরের স্ত্রীর প্রতি তো খুবই নির্দয় ব্যবহার করেছেন” (পৃ. ১০৭)। এই উপলব্ধিতে তিনি ছেলেকে সপরিবারে ঘরে তুলে নেন। এই চিত্র এখন আমাদের সমাজে এক রূঢ় বাস্তবতা। যতোই শিক্ষা এবং আধুনিকতার প্রান্ত ঘেঁষে আমরা চলি না কেন নিজস্ব একান্ত পরিবার বলয়ের মাঝে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা, আচার এবং সংস্কৃতির একজন মানুষকে একাত্ম করে নেয়া খুব সহজ হয়ে উঠে না একজন পিতামাতার পক্ষে। এখানে লেখক মনোবাস্তবতার সাথে সামাজিক বাস্তবতার যে দ্বন্দ্ব, আধুনিকতার সাথে সনাতন প্রথার যে স্নায়ুযুদ্ধ সেই স্বরূপটি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের দোলায়িত মানব জীবনের সুখবোধ, ভাঙ্গা-গড়া, প্রাপ্তির-অপ্রাপ্তির দুঃখবোধ নিয়ে সপুর মনে প্রায়ই আত্ম-অনুসন্ধান চলে। নিজস্ব দর্শন এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের দর্শন দিয়ে তার ভাবনার জগতে বোধগুলোর নিরূপণ করার চেষ্টা করে। তাই উপন্যাসের শেষ ধাপে সপু যখন জীবনকে একটি স্থির অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। সংসারে স্বচ্ছলতার হাসি ফুটেছে, তখন তার মা এবং বোন নিয়ে বেড়াতে বেড়িয়ে কাশির গঙ্গা ঘটে যখন জীবনের এই সুখ-দুখ বোধের আঙ্গিনায় ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে স্মৃতিমন্থন করতে যেয়ে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিল তখন তার প্রিয় কবি রবি ঠাকুরের দু’টি চরণ যেন তাকে পথ দেখালো –
রাত্রে যদি সূর্য শোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা। (পৃ.৭১)
এবং সে অনুভূতি ছুঁয়ে যায় একজন পাঠককেও। আন্দোলিত মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যি কি আমরা বড় করে দেখি না আমাদের না-পাওয়াগুলোকে? শূণ্যতাবোধের হাহাকারের কারণে আমাদের যা কিছু বর্তমান প্রাপ্তি, সেই সুখটুকুকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হই! তাই এই চৈতন্য থেকে সপুও জীবনের প্রারম্ভেই বাবাকে হারানোর শোক, এমএ-তে প্রথম শ্রেণি না পাওয়ার শোক, ভালোবাসার অলকাকে হারানোর শোক, এবং আরো অন্যান্য অপ্রাপ্তির শোক সবকিছুকে অতিক্রম করে উঠতে সক্ষম হয়।
উপন্যাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জীবন জেঠু যিনি মানবিক বট বৃক্ষ ছায়া হয়ে আছেন সপুর জীবনে শুরু থেকে শেষ অবধি। লেখক হয়ত এই ব্যক্তিত্বকে সৃজন করে সমাজের বর্ণচোরা এবং স্বার্থান্বেষী মানুষের ভিড়ে একজন ব্যতিক্রমী সত্তাকে পাঠকের সম্মুখে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সপু যখন বিএ-এর দরজায় কেবল কড়া নাড়ছে তখন সপুর বাবা দীর্ঘ অসুস্থতার পর প্রয়াত হলেন। সপু মা এবং ছোটবোন মিনুকে নিয়ে সম্মুখে ঘোর অন্ধকারে কী করে পথ হাঁটবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত। তখন এই জীবন জ্যেঠু তাকে বুকে জড়িয়ে নেন। তাদের সংসার এবং সপুর পড়াশোনা করার জন্য সাহায্য নয়, ধার দিলেন যাতে সপুর আত্মসম্মানে না বাঁধে। যিনি একাডেমিক শিক্ষায় ‘অশিক্ষিত’ কিন্তু আপন আলোকিত জ্ঞানে অনেকের চাইতে অনেক বেশি শিক্ষিত। অথচ তাদের সমাজে তিনি একজন মদ্যপ, সুদখোর, কসাই। সপুদের কলেজে সম্মানিত হয়ে তিনি যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেন, তার স্বশিক্ষায় শিক্ষিত জ্ঞানের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। এখানে তিনি সংস্কারহীন এবং উদার মানসিকতায় উজ্জীবিত একজন ব্যক্তিত্ব। তাই মেয়েদের শিক্ষাদানকে তিনি বিশেষ জরুরি মনে করেন, এমনকি ছেলেদের চেয়েও। তিনি বিশ্বাস করেন – If you teach a boy, you teach one man. But if you teach a girl, you teach one generation.
সপু সনাতন প্রথার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু আধুনিক চেতনায় সিক্ত। জীবন জেঠুর ন্যায় সে-ও মেয়েদের শিক্ষা এবং সামাজিক সচেতনার প্রতি চিন্তাশীল। প্রস্তর যুগ পেরিয়ে যখন থেকে মানব মনে সভ্যতার বীজ রোপিত হয়েছে এবং শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝতে শিখেছে, সেই তখন থেকেই মেয়েদের শিক্ষা এবং সামাজিক মর্যাদা নিয়ে শুরু হয়েছে তার্কিক-বিতার্কিক আলোচনা। এখানেও সেই একই আধুনিকতা এবং সনাতন ধ্যান-ধারণার সংঘাত। প্রথাগত শিক্ষার কারণে পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীরাও কি নারীদের এগিয়ে যাবার পথে বাঁধা হয়ে দাড়ায় না? তারা না পারে প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে, না পারে অন্যকে সমর্থন দিতে। একবিংশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও সংস্কার, ধর্ম এবং সংস্কৃতির এই ‘ব্ল্যাকহোল’ থেকে সমাজ কতটা বেরিয়ে আসতে পেরেছে? সপুর ভাবনায় তারই প্রতিফলন দেখতে পাই, “… এখনও ভারতবর্ষের অনেক পরিবারে ছেলে জন্মালে আনন্দের রোল ওঠে, মেয়ে জন্মালে কান্নার। … এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতার মধ্যেই গ-গোল আছে। আমরা এখনও মেয়েদের পুরো মানুষ বলে মনে করি না – সপুর আরো মনে হলো, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। যে মেয়ে নতুন বউ হয়ে শাশুড়ির অত্যাচার সহ্য করেছে, নিজে শাশুড়ি হয়ে নিজের পুত্রবধুর ওপর সে নিজেই অত্যাচার করে।” (পৃ. ৪৪)
যদিও লেখকের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বিষয় নির্বাচন, চরিত্রের সাবলীল বিন্যাস এবং ঘটনার ধারাবাহিকতায় ইতিবাচক দিকটিই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে অসঙ্গতি যে কিছু নেই, সেটা বললে ভুল বলা হবে বৈকি। যেমন পড়তে পড়তে যখন উপন্যাসের মাঝপথে, তখনও মনে হয়েছে যেন একই জায়গায় বৃত্তাকারে ঘুরছি। যেন সপ্রতিভ চরিত্রটির ‘মোশন’ আছে কিন্তু কোনো ‘ডিরেকশন’ দেখা যাচ্ছিল না। মনে হয়েছে একই ভাবনায় আবর্তিত-পুনরাবর্তিত হচ্ছি। এছাড়া কিছু চরিত্রের যথাযথ বিকাশ ঘটেনি বলেই মনে হয়।
লেখক দিলীপ চক্রবর্তী সেই শুরুর প্রয়াসটিতে নিঃসন্দেহে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বচ্ছন্দ শব্দের গাঁথুনিতে প্রাঞ্জল উপন্যাসটি অনায়াসে পাঠকের হৃদয়গ্রাহী হবে বলে আমার বিশ্বাস। অপরূপ উকিলের নান্দনিক প্রচ্ছদে ৩৭ অধ্যায়ের ১১১ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি টরন্টোর সাহিত্য সংগঠন বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) প্রকাশের ব্যবস্থা করেছে।
লেখাটি বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) সাহিত্য পত্রিকার ২০১৬ সালের সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত।