ষড়ভুজের মণ্ডল কানাডা
দেশ দেশান্তরে ঘড়ির কাটা কখনও এক থাকে না। কারণ একেক দেশ ওই জায়গার নির্দিষ্ট সময়ের মানদণ্ড মেনে চলে। আমরা যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করি তখন সেভাবে ঘড়ি ঠিক করে নিতে হয়। সর্বউত্তরের নুনাভুট, ইউকন থেকে শুরু করে সর্বদক্ষিণের প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড, সেন্ট জোনস দ্বীপপুঞ্জ, নিউ ফাউল্যান্ড। আমরা বলছি আটলান্টিক সাগর পাড়ের শ্বেতকন্যা কানাডার কথা।
তার সীমানা এত দূর দূরান্তে বিস্তৃত যে তাকে ছয়টি সময় নির্ঘন্ট মেনে চলতে হয়। আয়তনে রাশিয়ার ঠিক পরেই অবস্থান করা কানাডার সময়ের মান-মণ্ডল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে যায়। ওখানেও ছয়টি ভিন্ন ঘড়ি চলে। সবচেয়ে বেশি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের হিসাবে চলে রাশিয়া – মোট এগারো বার আপনাকে ঘড়ির কাটা পালটাতে হবে ওই দেশে বেড়াতে গেলে।
আমাদের শুভ্রকন্যার আয়ত্তে রয়েছে দশটি প্রদেশ এবং তিনটি প্রাদেশিক অঞ্চল। আমরা সকলেই এসবের নাম জানি। কিন্তু তারপরও আজকে আবার ছোট্টবেলার পরীক্ষা শেষে পুনঃপাঠ করার সেই দিনগুলোতে ফিরে যাবো।
দশটি প্রদেশ – অন্টারিও, কুইবেক, বৃটিশ কলম্বিয়া, অ্যালবার্টা, ম্যানিটোভা, সাস্কাচুয়ান, নোভাস্কোশিয়া, নিউ ব্রান্সউইক, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড, নিউ ফাউল্যান্ড এন্ড ল্যাব্রাডর এবং নর্থ ওয়েস্ট টেরিটোরিস বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য, নুনাভুট, ইউকন এই তিনে মিলে প্রাদেশিক অঞ্চল।
ষড়মণ্ডল:
মূল আলোচনা সময়ের হিসাব নিকাশ নিয়ে। তাই প্রসঙ্গে চলে আসি – পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে সময়-মান মণ্ডলের দিকে তাকালে দেখি প্যাসিফিক, মাউন্টেন, সেন্ট্রাল, ইস্টার্ন, আটলান্টিক এবং নিউ ফাউল্যান্ড।
ছয়টি ঘড়ির মধ্যে শুধুমাত্র সর্বদক্ষিণের নিউ ফাউল্যান্ডের নিজস্ব সময় রয়েছে। যাকে নিউ ফাউল্যান্ড টাইম জোন বলে। আটলান্টিক টাইম জোন যা মূলত নোভাস্কোশিয়ার সময়, ইস্টার্ন টাইম জোন – অন্টারিওর ঘড়ি, সেন্ট্রাল টাইম জোন – ম্যানিটোভার সময়, মাউন্টেনকে অ্যালবার্টা প্রদেশের এবং প্যাসিফিককে বৃটিশ কলম্বিয়ার ঘড়ির সময় বলে।
দুটো সময়কে কানাডায় আমরা মেনে চলি – Coordinated Universal Time বা সমন্বিত সর্বজনীন সময় Daylight Saving Time বা দিনের আলো সংরক্ষণের সময়।
ইতিহাসের পাতা থেকে:
বর্তমান সময়ের এই মানদণ্ডের স্রষ্টা রেলওয়ের স্কটিশ কানাডিয় প্রকৌশলী স্যার স্ট্যান্ডফোর্ড ফ্লেমিং, যিনি ২৪ ঘন্টার হিসেবে ঘড়ির সময় প্রবর্তকদের অন্যতম এবং তাঁর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই সমন্বয়িত ইউনিভার্সাল সময়ের প্রবর্তন হয় যাকে আমরা গ্রিনিচ সময় বলেও জানি (Coordinated Universal Time)। শুধু তা-ই নয়, তিনি পৃথিবীর মূল মধ্যরেখার স্রষ্টাদেরও একজন।
কানাডার প্রথম ডাকটিকিটের নকশাকার তিনি এবং টরেন্টোর কানাডিয়ান ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতাও। কানাডার বর্তমান রেলওয়ের প্রারম্ভিক পর্যায়ের যাত্রাপথের অগ্রগণ্য একজন দিকপাল হিসেবে তাঁর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়।
১৮৭৯ সালে স্ট্যান্ডফোর্ড ফ্লেমিং (১৮২৭–১৯১৫) ইন্টার কলোনিয়াল রেলওয়ের একজন শীর্ষস্হানীয় প্রকৌশলী ছিলেন। তখন সবেমাত্র যাত্রা শুরু করা রেলওয়ের জন্য জরিপ প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পর্বতবহুল এলাকায় জরিপ করতে গিয়ে তিনি ক্রমশ পশ্চিমদিকে চলে যাওয়া জায়গাগুলোর যাত্রাপথের সময় নির্ধারণে বিশেষভাবে চিন্তিত হন। রেলওয়ের প্রকৌশলী হওয়ার পূর্বে এক রাতে রেলের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে বেশ দ্বিধান্বিত ফ্লেমিংকে পরবর্তীকালে এই বিষয়ে চিন্তার খোরাক জোগাতে সাহায্য করেছিল সেটা একপ্রকার নিশ্চিত। জরিপ করতে গিয়ে এক্ষেত্রে কী করা উচিত তা স্পষ্ট হলেও কীভাবে করা যায় সেই বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না। তখন ফ্লেমিং উক্ত সমস্যার সমাধান কল্পে নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত ধারণাগুলো লিপিবদ্ধ করেন এবং নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেন। ১৮৭৮ সালে গ্রীষ্মে বৃটিশ অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্মেলনে ডাবলিনে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাঁর ভাষণ শুনতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। পরবর্তীকালে সে বছরের শীতকালীন সময়ে তিনি পুরো নথিপত্রের পুনরায় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অধ্যয়নের পর পরের বছর প্রকাশ করেন। “Time -Reckoning” নামে লেখা তার সেই নথিপত্রে তিনি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময়কে কৃত্রিম এবং বিধিবহির্ভূত উল্লেখ করে পুরো পৃথিবীর অক্ষপথে ঘূর্ণনকে একটি ঘড়ি হিসেবে দেখিয়েছেন। যদি পৃথিবীর অক্ষপথের প্রতিদিনের ঘূর্ণনকে ২৪টি সমান ভাগে মূল মধ্যরেখা বরাবর বিভক্ত করে সময়কালকে নির্ধারণ করা হয় তখন সেটাকে সময়ের উত্তম মানদণ্ড হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
১৮৮৪ সালে উত্তর আমেরিকান রেলওয়ে ফ্লেমিং-এর উদ্ভাবিত সময়ের মানদণ্ডকে আদর্শ বলে মেনে নেয়। ওয়াশিংটন ডি.সি-তে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে।
সময়ের পালা বদল:
বর্তমানে Coordinated Universal Time কে লেখা হয় UTC। বৃটেনের গ্রীনউইচ মানমন্দিরের সময়কে দাপ্তরিকভাবে সমন্বিত সর্বজনীন সময় বলা হয়। লেখার ধরন – UTC- _ h। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বৃটিশ কলম্বিয়াতে শীতকালীন সময়ে লেখা হয় UTC – 8h, অর্থাৎ তাদের সময় UTC সময়ের চেয়ে আট ঘন্টা পেছনে চলছে৷ একই সময়ে নিউফাউল্যান্ড এন্ড ল্যাব্রাডর এ লেখা হয় UTC -3h30। মানে ওখানকার সময় তিন ঘন্টা তিন মিনিট পিছিয়ে।
বছরের দুটো বিশেষ সময়ে দিনের আলো সংরক্ষণের সময় হিসেবে ঘড়ির কাটা এক ঘন্টা এগিয়ে আসে এবং পিছিয়েও যায়। প্রতি বছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় রবিবারে রাত দু’টায় এর সূত্রপাত ঘটে এবং নভেম্বরের প্রথম রবিবারে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। পূর্বে ডেলাইট সেভিংসের সময়কাল এপ্রিল মাসের প্রথম রবিবারে শুরু হয়ে অক্টোবর মাসের শেষ রবিবার পর্যন্ত স্থায়ী হত। কিন্তু ২০০৬ সালে সাংবিধানিক সংশোধনী বলে বর্তমান নিয়মে সময় বদল হয়ে আসছে।
বিভিন্ন জায়গার নাম এবং সংক্ষিপ্ত রূপ আলো সংরক্ষণের সময়ের নামের সাথে সাথে বদল হয়। উদাহরণস্বরূপ – ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম (EST) বদলে গিয়ে হয়ে যায় ইস্টার্ন ডেলাইট টাইম (EDT)। কানাডার কিছু জায়গায় DST ব্যবহৃত হয় না। ফোর্ট সেইন্ট জোন্স, চার্লি লেইক, বৃটিশ কলম্বিয়ার টেইলর এন্ড ডওসন ক্রিক, ইস্ট কোটেনেসের ক্রেসটন এবং সাস্কাচুয়ানের অধিকাংশ জায়গা (ডেনারে বিচ এবং ক্রেইগটন বাদে)। ইউকনের বাসিন্দারা প্যাসিফিক অঞ্চলের সময় মেনে চলেন।
তিনটি জায়গায় কানাডাতে ভিন্ন সময় রয়েছে। প্রথমটা সাস্কাচুয়ান প্রদেশ। ওখানে ডে-লাইট সেভিংসের সময় ব্যবহার করা হয় না কারণ সারা বছর সেন্ট্রাল টাইম জোনের সময় মানা হয়। এরপর নিউফাউল্যান্ড এন্ড ল্যাব্রাডর। দুটো সময় মেনে চলে – নিউফাউল্যান্ড দ্বীপে নিউফাউল্যান্ড সময় এবং ল্যাব্রাডরে আটলান্টিক সময় যা মূলত নোভাস্কোশিয়ার।
২০১১ সালে নিউফাউল্যান্ড এন্ড ল্যাব্রাডর একটি বিশেষ আইন সংশোধনের মাধ্যমে সময়কাল নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসে। বর্তমান আইনে তারা নিজস্ব সময়সূচি অনুসরণ করেন কারণ ওখানকার অধিবাসীগণ এমন আইনের পক্ষে রায় দিয়েছেন এবং এভাবে সময় পালনেই অভ্যস্ত হয়েছেন। ওখানে পূর্বে ডেলাইট সেভিংসের সময়কাল মূল সময়ের সাথে এক মিনিটের ব্যবধান রেখে অদলবদল হত।
মূলত কানাডার বিশালাকার আয়তনের কারণেই আমরা ছয়টি ভিন্ন সময় মেনে চলি। যদি আমরা ম্যাপের দিকে তাকাই লক্ষ করবো, এর বিস্তৃতি পশ্চিমে ৫২ ডিগ্রি থেকে ১৪১ ডিগ্রি পর্যন্ত। একটি সময়ের মানদণ্ডের পরিমাপ দাঁড়ায় ১৫ ডিগ্রি, সে হিসেবে কানাডাকে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন সময়কে মেনে চলতে হয়। মোটামুটি সবগুলো প্রদেশকে এক ঘন্টার ব্যবধানে এবং শুধুমাত্র নিউফাউল্যান্ড এন্ড ল্যাব্রাডরকে আধা ঘণ্টার ব্যবধানে সময় পরিবর্তন করতে হয়।
ইতিহাসে দিনের আলো সংরক্ষণের সময় বা ডেলাইট সেভিংস টাইম:
আমরা DST মূলত মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মেনে চলি। ইতিহাসের পাতা উলটিয়ে দেখতে পাই ১৯১৮ সালে সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যবস্হা জারি করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪–১৯১৮) সময় অস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধির অবলম্বন হিসেবে এমন সময়ের হিসাব বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জার্মানি এবং ব্রিটেনেও একই আইন জারি করা হয়েছিল।
বর্তমানে আমরা মার্চের দ্বিতীয় রবিবার থেকে ঘড়ির কাটা এক ঘন্টা এগিয়ে দিই। আবার নভেম্বরের প্রথম রবিবারে এক ঘন্টা পিছিয়ে আগের জায়গায় নিয়ে যাই। প্রধানত দিনের বেলা সময় সংরক্ষণের অংশ হিসেবে এমনটা করা হয় এবং বিকেলে অতিরিক্ত এক ঘন্টা পাওয়া যায়। বছরের এ সময়ে দিনের বেলা কিছুটা দীর্ঘায়িত মনে হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি ভিন্ন দেশ বলতে সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ের কথা আমাদের মাথায় আসে। সেদিক থেকে কানাডার ছয়টি ভিন্ন সময়ের অবতারণা এবং একই প্রদেশে দুইটি সময়ও মেনে চলি আমরা। সবকিছু মিলিয়ে কানাডার তুলনা মেলা ভার এবং সকলের কাছে এটি একটি অত্যন্ত দর্শনীয় গন্তব্যস্থল।
পরিশেষে বলা যায়, এত ভিন্ন ভিন্ন সময়ের হিসাব নিকাশ মূলত কোন দেশকে বিভক্ত নয় বরং একীভূত করতে করা হয়েছে।
আরও কিছু তথ্য:
- পূর্ব কুইবেকের ৬৩ ডিগ্রি পশ্চিমের দ্রাঘিমাংশে সারা বছরের জন্য আটলান্টিক টাইম জোন মেনে চলে।
- পশ্চিম অন্টারিওর ৯০° পশ্চিমাংশে সেন্ট্রাল টাইম জোনের হিসেবে চলে এবং দিবাগত রাত দু’টোয় তা পরিবর্তন হয়।
- সাস্কাচুয়ানের অধিকাংশ জায়গায় সারা বছর সেন্ট্রাল টাইম জোনের সময় মেনে চলে। ব্যতিক্রমধর্মী লইডমিনিস্টারের (Lloydminster) এলাকাগুলো অ্যালবার্টার অনুকরণে মাউন্টেন সময়ের ঘড়ির কাটায় বিশ্বাসী।
- নুনাভুটের অধিবাসীরা তিনটি সময়ের মানদণ্ড মেনে চলেন এবং রাত দু’টোয় সময়ের পালাবদল ঘটে। যদিও সাউথাম্পটন দ্বীপে সারাবছরই চলে ইস্টার্ন বা অন্টারিও প্রদেশের ঘড়ি।
- ২০২০ সাল থেকে ইউকনে Coordinated Universal Time – 7h বা ইউকন স্হানীয় সময় মেনে চলে।
তথ্যসূত্র: