শ্রীচৈতন্যদেব গ্রন্থের ওপর আলোকপাত

রেখা পাঠক

“বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া” – বাঙালির এমন নিমাই শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে টরন্টোবাসী লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাসের বড়ো আদর, বড়ো শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে লেখা গ্রন্থ শ্রীচৈতন্যদেব। গ্রন্থের মর্মমূলে প্রবেশ করার পূর্বে গ্রন্থের ‘প্রাককথন’-এ উল্লিখিত গোঁসাই দাদুর রূপ-মাধুর্যে এবং জাগতিক ও আধ্যাত্মিক গুণ মাধুর্যে মুগ্ধ লেখক তাঁর গোঁসাই দাদুর প্রতি আশৈশবের শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রেম, ভালোবাসাকে যে বাণী মাধুর্যে বন্ধন করেছেন, তা পাঠ করে আমার অনুভব ও উপলব্ধির জগতে এক অপার্থিব আনন্দ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। সেই সাথে আমাদের এই কথাটিও জানিয়ে এবং শিখিয়ে দিয়েছে যে, কোনো সনাতনী পরিবারে লেখকের ‘গোঁসাই দাদুর’ মত একজন গোস্বামী সন্তান, প্রভু সন্তানের আগমন, আতিথ্য গ্রহণ সেই পরিবারের প্রজন্মের মনে ও জীবনে কী পরিমান মহতীগুণ বর্ষণ করে তাদের এক-একটি সমৃদ্ধ সন্তান রূপে গড়ে তুলতে পারে, যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ ‘গোঁসাই দাদুর ‘স্নেহ ও আদর্শের ছায়া পুষ্ট নাতি শ্রীচৈতন্যদেব গ্রন্থের লেখক সুব্রত কুমার দাস।

প্রাককথন শেষে পার্থিব অপার্থিব অমৃতের আস্বাদনে প্রবেশ করলাম গ্রন্থের মর্মমূলে। কিন্তু আমি যে অতি অভাজন! কেমনে করব এ গ্রন্থের যথাযথ মূল্যায়ন? ১১৮ পৃষ্ঠার ‘শ্রীচৈতন্যদেব’ গ্রন্থের ভেতর কলির অবতারীরূপে যুগধর্মের প্রবর্তক এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর তমসাচ্ছন্ন ভারতবর্ষে নবজাগরণের পৌরোহিত্যকারী মহানায়ক বাঙালি শ্রীচৈতন্যদেবের আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনায় ভরপুর। শ্রীচৈতন্যদেবের দেওয়া সংগীত এবং নৃত্যনাট্যকলাই যে ভারতকে একত্রিত করেছিল আঞ্চলিকতামুক্ত একটি নতুন নান্দনিক সাংস্কৃতিক লাবণ্যের রক্ত মণিহারে সেই সব বিষয়কে বিষয়োচিতভাব ও ভাষায় প্রাণস্পর্শী করে বর্ণনা করেছেন গ্রন্থের লেখক। বাঙালি নবীন সন্ন্যাসী শ্রীচৈতন্যদেবের কলির যুগধর্ম হরিনাম সংকীর্তন ও প্রেমভক্তি প্রচার আন্দোলন এবং বৈষ্ণব দর্শনের রাগানুগা ভজনের মূলে ছিল ‘রাধাবাদ বা রাধাতত্ত্ব। রাধাশ্রিত নৃত্য-শিল্পকলা যা ভারতবর্ষব্যাপী বিস্তৃত, তা যে শ্রীচৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ভক্তিমার্গের ফল, এই সব বিষয়ের ব্যাপক মোহমুক্ত আলোচনা সমৃদ্ধ সফল গ্রন্থ ‘শ্রীচৈতন্যদেব।

বাংলা ও বাঙালির জীবনে আধ্যাত্মিক, মানবিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক জগতে প্রথম নব জাগরণের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে সুব্রত সম্প্রদায়মুক্ত, নির্মোহ মনে, খালি চোখে, তাঁর শুদ্ধ জ্ঞান বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দ্বারা ‘শ্রীচৈতন্যদেব’ নামক গ্রন্থখানি রচনা করে বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি জাতিকে অমৃতবারি বর্ষণকারী একখানা অমর গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। মাত্র ৪৭+ আয়ুষ্কালে সিলেটি এক বৈদিক ব্রাহ্মণ সন্তান এবং নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত চব্বিশ বছরের নবীন সন্ন্যাসী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবকে নিয়ে বাংলা ভাষায় “সহায়ক শ্রীচৈতন্যবিষয়ক গ্রন্থ” এই শিরোনামে (পৃষ্ঠা ১১৩) এত গ্রন্থ আছে, তার সুগঠিত তালিকা পড়ে আমি যেমন ধন্য হয়েছি, তেমনি তা পড়ে ঋদ্ধ হবেন এই গ্রন্থ পাঠকারী যে কোন সুধী পাঠক। এই তালিকায় আছে ৫৮ জন অতি উচ্চ মার্গের লেখকের ৫৮টি গ্রন্থের নাম, যা শুধু শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুকে নিয়ে লেখা। তা’ছাড়া ইংরেজি ভাষায় ২৫ জন লেখকের ২৫খানা গ্রন্থের তালিকা আছে। ১১৮ পৃষ্ঠায় গ্রন্থখানি সমাপ্ত করেছেন, শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে লেখা পাঁচ লেখকের পাঁচখানি উপন্যাসের নাম তালিকা ভুক্ত করে।

লেখক তাঁর গ্রন্থটিতে শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে বাংলা, ইংরেজিতে লেখা তালিকার সাথে, শ্রীচৈতন্যদেবের পিতৃ-মাতৃকুলের বংশ-লতিকাটি অতি নির্ভুলভাবে তুলে ধরেছেন। ফলে গ্রন্থখানি পাঠ করলে একজন পাঠক সহজেই শ্রীচৈতন্যদেবের পিতৃ-মাতৃকুলের পরিচয় পেয়ে যেতে পারেন, যা এই গ্রহের মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং দরকারী। শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে বিশ্ববন্দিত, বিশ্বনন্দিত যে সব আকরগ্রন্থ আছেন, যা পাঠ করে সাধারণ পাঠকের পক্ষে মানবতাবাদী, সমাজসংস্কারকারী, কলির যুগধর্ম প্রবর্তনকারী এবং বাংলা ও ভারতবর্ষে কীর্তনসহ, সবধরনের নান্দনিক সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি র পৌরোহিত্য দানকারী যে শ্রীহট্টিয়া, নধদের চাঁদ,ভারত রত্ন, বিশ্ব প্রদীপ শ্রীচৈতন্যদেব তা সহজে বুঝে ওঠা অত সহজ হয়ে ওঠে না, ঠিক ততটা সহজ হয়ে ওঠে সুব্রতর গ্রন্থ “শ্রীচৈতন্যদেব” পাঠে। এই অর্থে তাঁর “শ্রীচৈতন্যদেব” গ্রন্থখানি ইতিহাস, ঐতিহ্যপ্রিয় বাঙালির কণ্ঠহারের দাবিদার বলে আমি মনে করি। ষোড়শ শতাব্দীর তমসাচ্ছন্ন, মানবতা লুণ্ঠিত, হতাশা ক্লিষ্ট বঙ্গ-ভারতের বহুধ বিভক্ত সমাজকে বাঙালি শ্রীচৈতন্যদেব যেভাবে রিক্ত হাতে, সিক্ত চোখে তাঁর প্রেমধর্ম আন্দোলনের মাধ্যমে একটি রত্নমণির হারে গেঁথে দিয়েছিলেন, যা আজকের একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান শাসিত পৃথিবীর মানুষের জাগতিক এবং পারমার্থিক জীবনের একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা জানার জন্য, বোঝার জন্য সুব্রতর “শ্রীচৈতন্যদেব” গ্রন্থখানি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ।

আজ হতে পাঁচ শ আটত্রিশ বছর আগে যখন কারো মুখে এই শব্দ ছিল না, সেই শব্দ উচ্চারিত হয়েছিল নবদ্বীপের নিমাই বিশ্বম্ভর মিশ্রের মুখে – “প্রভু কহে আমি বিশ্বম্ভর নাম ধরি।/ নাম সার্থক হয় যদি প্রেমে বিশ্বভরি।” ভাবা যায়? প্রাগ্-ইতিহাসে, ইতিহাসে কোনো মহামানবের মুখ দিয়ে এমন প্রতিজ্ঞা বাণী উচ্চারিত হয়েছে? তেমনি বলেছেন – “ভারত ভূমেতে হৈল মনুষ্য জন্ম যার।/জন্ম সার্থক করি করে পর উপকার” (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত। আদিঃ নবম।) এমন যে শ্রীচৈতন্যদেব, যিনি ইতিহাসের বুকে ভারতবর্ষে প্রথম মানবতাবাদের প্রচারক, প্রবর্তক এবং বাস্তবায়নকারী, যার মানবধর্মের, প্রেমধর্মের অক্ষয় বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়া তলে বিজ্ঞানমনস্ক যান্ত্রিক বিশ্বের মানুষ আশ্রয় নিয়েছে, সেই চৈতন্যদেবকে নিয়ে লেখা সুব্রত কুমার দাসের “শ্রীচৈতন্যদেব” গ্রন্থখানি বাংলা ভাষায় রচিত একটি নির্ভরযোগ্য, সুখপাঠ্য এবং বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ বটে।

লেখক সুব্রত কুমার দাসের শুভ জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর অমূল্য গ্রন্থ “শ্রীচৈতন্যদেব” পাঠ করে আমার ভালোলাগাটুকু, আমার মতো করে তাঁকে উপহার দিলাম – যেন গঙ্গা জলে গঙ্গাপূজার মতো। প্রার্থনা করি তাঁর শিরে বিশ্ববাসীর শিরে মানবধর্মের প্রবর্তক, প্রেমভক্তির প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেবের প্রেমবারি অজস্র ধারায় বর্ষিত হোক।

রেখা পাঠক, টরন্টোপ্রবাসী লেখক।