‘শ্রীচৈতন্যদেব’: একটি সমীক্ষা

শেখর কুমার সান্যাল

গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে এবং সে বৈশিষ্ট্য শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে বিবর্তিত হয়েছে। ঈশ্বর যেখানে ‘বজ্রাদপি কঠোরাণি’ সেখানে তিনি ভক্তির পাত্র নন, ভীতির পাত্র। যেখানে তিনি ‘মৃদুনি কুসুমাদপি’ সেখানে তিনি রসময়, অর্থাৎ ভক্তি ও প্রেমের ঘনীভূত সত্তা। প্রেমের এই নিগূঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যা সাপেক্ষ নয়, অনুভূতিবেদ্য। জ্ঞানমার্গ সাধারণ মানুষের সহজগম্য নয়। ভক্তিমার্গ সহজতর বিকল্প। শ্রীচৈতন্য মানুষকে দেখিয়েছেন ভক্তিমার্গের পথ।

শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব বঙ্গদেশ, ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্বে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ধর্ম যখন আচার সর্বস্বতায় তমসাচ্ছন্ন হয়ে মানুষকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনে, তখন সেই চরম সঙ্কটময় কালে সমাজকে গ্লানিমুক্ত করবার জন্য যুগে যুগে জন্ম হয় এমন কিছু মানুষের যাঁদের বিস্ময়কর অবদান তাঁদের অবতার পদবাচ্য করে। চৈতন্যদেব ছিলেন এমনই এক যুগাবতার। শব্দার্থেই তিনি একটি যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। ১৫০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু’শ বছর ব্যাপী যুগটি ‘চৈতন্যযুগ’ নামে পরিচিত।

সুব্রত কুমার দাস তাঁর নাতিবৃহৎ ‘শ্রীচৈতন্যদেব’ গ্রন্থে শুধুমাত্র এই মহাপুরুষের বৈচিত্র্যময় জীবন ও কর্মসাধনার বিভিন্ন পর্যায়ই বিবৃত করেননি, শিক্ষা, দর্শন এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সংক্ষেপ অথচ সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাছাড়া তিনি শ্রীচৈতন্য বিষয়ক প্রধান গ্রন্থসমূহের একটি তালিকা দিয়েছেন যা শ্রীচৈতন্যদেব সম্বন্ধে উৎসুক পাঠকের তৃষ্ণা নিবারণের সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের ফরিদপুরের সুসন্তান, বর্তমানে কানাডার টরন্টো প্রবাসী সুব্রত কুমার দাস প্রণীত ‘শ্রীচৈতন্যদেব’ পুস্তকটির প্রথম সংস্করণ আত্মপ্রকাশ করে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে টরন্টো থেকে। বাংলাদেশের আগ্রহী পাঠকদের কাছে সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে ঢাকার প্রথম সারির প্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে। ইতিমধ্যে ২০১৬ সালের ১২ মার্চ টরন্টোতে অত্যন্ত সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয় ব্যাপক আকারের ‘চৈতন্যমেলা’। ঐতিহ্য সংস্করণের পরিশিষ্টে ‘টরন্টোতে চৈতন্যমেলার লক্ষ্য ও আয়োজনের কথা’ নামে একটি অতিরিক্ত অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর সুব্রত কুমার প্রবাসী হওয়ার পূর্বে দেশে অধ্যাপনা করেছেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনার অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন দেশে থাকতেই। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে টরন্টোতেও তিনি ব্যাপক কর্মযজ্ঞে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন অত্যন্ত সফলভাবে। কানাডায় সর্বাধিক সংখ্যক বাঙালি অধ্যুষিত শহর টরন্টোর সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে সুব্রত কুমার একটি সর্বজনপ্রিয় নাম। তিনি ইতিমধ্যেই লেখক ও সাহিত্য-সংগঠক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন সমগ্র কানাডার বাঙালি সমাজে। কানাডার মূলধারা সাহিত্যিকদের উল্লেখযোগ্য অংশেও রয়েছে তাঁর ব্যাপ্তি।

আলোচ্য পুস্তকটি নিবিষ্টভাবে পড়লেই বোঝা যায় লেখক কতটা পরিশ্রম দিয়েছেন বইটির পিছনে। লেখা যখন অর্ধসমাপ্ত তখন ২০১৫ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি টরন্টোর দেওঘরিয়া দম্পতির কাছে পেয়ে যান শ্রীচৈতন্যদেব এবং বৈষ্ণবধর্ম সম্পর্কে আড়াই শতাধিক পুস্তক-পুস্তিকার খনি, যার কয়েকটি বাংলা আর অবশিষ্ট ইংরেজিতে। ফলে লেখা বিলম্বিত হলেও আমরা পেলাম একটি সুখপাঠ্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। পনেরোটি অধ্যায়ে বিভক্ত গ্রন্থের পরিশিষ্টে রয়েছে নব-সংযোজিত একটি সহ চারটি অধ্যায়।

ভূমিকায় সুব্রত লিখেছেন ‘ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম’ এই প্রবচনকে গুরুত্ব দিয়ে শ্রীচৈতন্য সময়ের প্রয়োজনে ধর্মের প্রাচীন নির্দেশকে সংস্কার করতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি শ্রীচৈতন্যকে ঈশ্বরে কম আসক্ত মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য করেছে। সেকালের ব্রাহ্মণদের হাত থেকে তিনি ধর্মকে সাধারণ্যের দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছেন। প্রচলিত জাতিভেদ প্রথাকে অসীম সাহসে অস্বীকার করে আচারের কঠিন নিগড় থেকে ধর্মকে মুক্ত করেছেন। ধর্মচর্চায় নারী-পুরুষের সম অধিকার দিয়ে প্রগতিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।

‘কেন শ্রীচৈতন্যদেব’ অধ্যায়ে সুব্রত কুমার লিখেছেন প্রায় পাঁচশ বছর আগে বঙ্গভূমি ছাড়িয়ে এই একজন বাঙালি ভারতবর্ষের দূরদূরান্ত অঞ্চলেও ধর্ম কৃষ্টি নির্বিশেষে অগণিত মানুষকে শুনিয়েছেন মানবতার বাণী। শ্রীচৈতন্যদেব বাঙালির কাছে গুরুত্ব পেয়েছেন প্রথমত হয়ত বাঙালি বলে। তিনি ধর্মমত নির্বিশেষে সকল বাঙালির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর যুগান্তকারী কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে রচিত বিপুল পরিমাণ সাহিত্যকর্ম ও সংগীত সৃষ্টির কারণে।

শ্রীচৈতন্যদেব যে সামাজিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেখানে তাঁর সঙ্গী যে কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের নিপীড়িত বর্ণের মানুষ ছিল তা’ কিন্তু নয়। ব্রাহ্মণ কায়স্থ এমনকি অহিন্দুও ছিলেন সেখানে।  

শ্রীহট্ট থেকে জগন্নাথ মিশ্র ন্যায়শাস্ত্র পাঠের উদ্দেশ্যে জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান নবদ্বীপে আসেন। অধ্যয়নান্তে নীলাম্বর চক্রবর্তীর কন্যা শচীদেবীকে বিবাহ করে নবদ্বীপেই স্থিত হন। নবদ্বীপের মায়াপুরে তাঁদের ঘরে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন নিমাই। গৌর দেহবর্ণের জন্য তাঁর এক নাম গৌরাঙ্গ। নিমাই পাঁচ বছর বয়সে বিদ্যারম্ভ করেন। বাল্যকালে নিমাই অসম্ভব দুরন্ত ছিলেন। তাঁর ছয় বছর বয়সে দাদা বিশ্বরূপ গৃহত্যাগ করেন। অসাধারণ মেধাবী নিমাই ষোলো বছর বয়সেই কাব্য, ব্যাকরণ, বেদান্ত,‌ ন্যায়শাস্ত্র ও ভাগবত দর্শনে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। এই সময় পিতৃদেব আকস্মিকভাবে প্রয়াত হলে নিমাইকে বাধ্য হয়ে অধ্যাপনা শুরু করতে হয়। অল্প সময়ের মধ্যে নিমাই সমাজে ব্যাপকভাবে আদৃত হতে শুরু করেন। তিনি সতেরো বছর বয়সে লক্ষ্মীপ্রিয়াকে বিবাহ করেন।

অধ্যাপনা কালে নিমাইয়ের ঔদ্ধত্য, অহংকার ও দুর্বিনীত স্বভাবের কথা জানা যায়। বিশেষ করে পাণ্ডিত্য দিয়ে সমবয়সী, এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠদের অপদস্থ করা ছিল নিয়মিত বিষয়। এ সময় তিনি তর্কযুদ্ধে ভারত বিখ্যাত পণ্ডিত কেশব কাশ্মীরিকে পরাজিত করেন। উঁচু নিচুর সামাজিক গণ্ডি ভাঙার কাজও তিনি একই সময় শুরু করেন। কুড়ি বছর বয়সে তিনি পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে যান। ভ্রমণকালেই তাঁর প্রিয়তমা পত্নী লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু হয়। প্রত্যাবর্তনের পর ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে মাতার অতিরিক্ত আগ্রহে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিবাহ করে আবার অধ্যাপনা শুরু করেন।

১৫০৮ সালে তেইশ বছর বয়সে পিতার আত্মার সদ্গতির জন্য এবং সম্ভবত লক্ষ্মীপ্রিয়ার প্রেতকৃত্য সম্পাদনের জন্য গয়া যান তিনি। পিণ্ডদান অন্তে সেখানে একদিন নিভৃতে ঈশ্বর পুরীর কাছে দীক্ষালাভ  করেন। দীক্ষাগ্রহণের পর গৌরাঙ্গের চরিত্রে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে। উদ্ধত স্বভাব ও পাণ্ডিত্যের গর্ব একেবারে দূর হয়ে যায়। মানসিকভাবে বিচলিত নিমাই সকলের প্রতি কোমল হয়ে ওঠেন। ঔদ্ধত্য ও অহংকার বিসর্জন দিয়ে হয়ে গেলেন বিনয়ের পরাকাষ্ঠা। গয়াতেই তাঁর বৈরাগ্য এবং ভক্তি ভাব এসে যায়। নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজ একটু একটু করে পুষ্ট হচ্ছিল। কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা গৌরাঙ্গ নবদ্বীপে এসে বৈষ্ণবগোষ্ঠীতে যোগ দিলেন। নবদ্বীপের বৈষ্ণবগোষ্ঠী তাঁর মতো বিরাট পুরুষের নেতৃত্ব লাভ করল। কৃষ্ণপ্রেম তাঁকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে প্রত্যাবর্তনের পর মাস চারেকের বেশি অধ্যাপনা করতে পারেননি। বিভোর হয়ে তিনি হাতে তালি দিয়ে নেচে নেচে ছাত্রদের কীর্তন শেখাতেন –

হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ                                                                                                               গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদনঃ

বলা হয় উপরোক্ত পংক্তিদ্বয় শ্রীগৌরাঙ্গ প্রবর্তিত কীর্তন গানের আদি বাণী। সন্ধ্যা সমাগমে ভক্তরা নিমাই পণ্ডিতের বাড়িতে এসে জড়ো হতেন। সুকণ্ঠ গায়ক মুকুন্দ দত্তের ভক্তিশ্লোক পাঠের পর গভীর রাত পর্যন্ত চলত নাম সংকীর্তন। কৃষ্ণভক্তি নিমাইকে নেতৃত্বের এমন উচ্চতায় নিয়ে গেল যে নবদ্বীপের সকল বৈষ্ণব এমনকি ধনী-দরিদ্র অগ্রজ-অনুজ নির্বিশেষে গৃহীও তাঁর পাশে এসে গেল। শ্রীগৌরাঙ্গ কীর্তনকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। শুরু হলো নগর সংকীর্তন। ক্রমশ নবদ্বীপ কীর্তন নগরীতে পরিণত হলো। সকলকে জপ করতে উপদেশ দিলেন মহামন্ত্র –

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।                                                                                        হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

সন্ন্যাস গ্রহণের আগে নিমাই পণ্ডিতের দুই অসমসাহসী কীর্তির পরিচয় পাওয়া যায়। নবদ্বীপের মহাত্রাস ছিল কাজি নিযুক্ত দুই কোটাল শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ জগন্নাথ রায় ও মাধব রায়। জগাই মাধাই নামে কুখ্যাত এই দুই দুরাচার মদ্যপ একদিন নগর সংকীর্তনের সময় কীর্তন দলকে আক্রমণ করে কলসীর কানা ছুঁড়ে গৌরাঙ্গকে আহত করেও কীর্তন বন্ধ করতে পারে না। গৌরাঙ্গের অসীম কৃপায় পরিশেষে দুই পাপীর উদ্ধার হয়। তৎকালে বাংলার সুলতান ছিলেন সৈয়দ আলাউদ্দিন হুশেন শাহ্‌। বৈষ্ণব-বিরোধীদের অভিযোগে কাজীর লোকজন নগর কীর্তনের উপর চড়াও হয় এবং এক ধরণের নিষেধাজ্ঞা জারী হয়। গৌরাঙ্গদেবের নেতৃত্বে কীর্তন দল কাজির বাসভবন ঘেরাও করলে এক সময় বিতর্কে পরাজিত কাজি কীর্তনের যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। তিনশ বছরের মুসলমান শাসনকালে বাঙালি মাথা তুলে দাঁড়াল।

শ্রীগৌরাঙ্গ দেখলেন, শুধু নবদ্বীপেই ভক্তিধর্ম প্রচার করলে চলবে না, সমগ্র বঙ্গদেশ এবং বাংলার বাইরেও ভক্তিধর্ম প্রচার করা আবশ্যিক। এক পর্যায়ে তিনি সংসারজীবন ত্যাগ করতে মনস্থির করেন।

১৫১০ সালের ২৬ জানুয়ারি গৌরাঙ্গ কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে খ্যাত হলেন। গার্হস্থ্যজীবন ত্যাগ করে কিছুকাল রাঢ়ভূমি ভ্রমণের পর তিনি নীলাচলে যান। পরে তিনি দক্ষিণ ভারত যাত্রা করেন। এই যাত্রা ভারতজুড়ে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণবধর্মের ভক্তিবাদ প্রচারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। 

শ্রীচৈতন্যদেবের মাত্র সাতচল্লিশ বছর জীবনকালের অর্ধেক কাটিয়েছেন নবদ্বীপে। বাকি অর্ধেকের প্রথম ছয় বছর ভারত ভ্রমণ করেছেন আর শেষ বারো বছর ছিলেন উড়িষ্যার পুরীতে। শ্রীচৈতন্য দেহরক্ষাও করেছিলেন পুরীতে। মহাপ্রভুর তিরোধান বিষয়টি আজও রহস্য অবগুণ্ঠনে আবৃত। মহাপুরুষের মৃত্যু হয় না। ভক্তদের কাছে মহাপুরুষ ঈশ্বরের প্রতিভূ। শ্রীচৈতন্যও তাই ছিলেন। জীবনীকাররা চান নি নিছক মৃত্যুজনিত কিছু লিখে ভগবান শ্রীচৈতন্যদেবকে মানুষের কাছাকাছি আনতে।  

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশ থেকে বঙ্গদেশে চৈতন্য-চর্চায় নতুন জোয়ার আসে, যে জোয়ারের তীব্রতায় ভারতবর্ষ ছাপিয়ে বর্তমানে পৃথিবীর সকল প্রধান শহরে হরেকৃষ্ণ কীর্তন শোনা যায়। ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর নিয়ে আজ হিন্দুধর্মাবলম্বীদের নাম সংকীর্তন বিশ্বব্যাপী মন্দিরে মন্দিরে, রাজপথে রাজপথে।

শ্রীচৈতন্যদেবের দর্শন বিপুল সংখ্যক মানুষকে শতকের পর শতক জুড়ে ঋদ্ধ করে চলেছে। অথচ তিনি নিজে কোন গ্রন্থ রচনা করেননি। শুধুমাত্র তাঁর মুখনিঃসৃত ‘শ্রীশিক্ষাষ্টক’ নামে পরিচিত কৃষ্ণপ্রাপ্তির নির্দেশিকা অষ্টশ্লোক লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাইশ পঙক্তির আটটি শ্লোকের মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য –

তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।                                                                                      অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ।।

যিনি তৃণাপেক্ষাও আপনাকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করেন, যিনি তরুর ন্যায় সহিষ্ণু, নিজে মানশূন্য ভেবে অপর লোককে সম্মান প্রদর্শন করেন, তিনিই সদা হরিকীর্তনের অধিকারী।

শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে তাঁর সমকালে রচিত হয়েছে অনেক গ্রন্থ। উত্তরকালে তার জীবনী ও দর্শন নিয়ে প্রণীত হয়েছে বহুতর গবেষণাগ্রন্থ। সময়ের প্রবাহে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। ভবিষ্যতে আরো বহু গ্রন্থে তাঁর দর্শনকে নূতন আলোকে দেখে বিশ্বজন বিমোহিত হবে।

সুব্রত কুমার এই মাঝারি আকারের বইটি লিখে তৃপ্ত নন। তিনি অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন ভবিষ্যতে চৈতন্যদেবের জীবন, কর্ম, দর্শন ও প্রভাব নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগ্রন্থ রচনার। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে বৈষ্ণবদর্শন ও শ্রীচৈতন্য সম্পর্কিত বিপুল গ্রন্থভাণ্ডার। সন্ধানে রয়েছে আরো বেশ কিছু পুস্তক। আমি অতিরিক্ত একটি গ্রন্থ সংযোজন করতে চাই। অমরেন্দ্রনাথ সাহা প্রণীত ‘বৈষ্ণব-দর্পণ’। বইটির ভূমিকায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাসাহিত্যের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান  অধ্যাপক ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “আলোচ্য গ্রন্থের লেখক সমস্ত তথ্য একত্র করে শ্রীচৈতন্য ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের যে কোষগ্রন্থ রচনা করেছেন, এ যুগে ডঃ সুশীলকুমার দে মহাশয়ের ‘Early History of the Vaishnava Faith and Movement in Bengal’ এবং গবেষক ডঃ রমাকান্ত চক্রবর্তীর ‘Vaishnavism in Bengal’ গ্রন্থ দুটি বাদ দিলে, শ্রীযুক্ত সাহার সমতুল্য গ্রন্থ বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির ইতিহাসে দুর্লভ। তথ্য ও তত্ত্বের খনি এই মহাগ্রন্থ চিন্তাশীল পাঠকের মানসিক রসায়নের কাজ করবে এ আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস।“

আমরা ভবিষ্যতে সুব্রত কুমারের কাছ থেকে শ্রীচৈতন্যদেব সম্বন্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ অভিসন্দর্ভ গ্রন্থের আশায় রইলাম।  

(সমীক্ষক প্রফেসর শেখর কুমার সান্যাল পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। জন্ম নাটোরে, বর্তমানে কানাডার ক্যালগেরী প্রবাসী)