শ্রদ্ধাঞ্জলি: মোল্লা বাহাউদ্দিন

সুব্রত কুমার দাস

২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট টরন্টোর স্থানীয় সময় রাত বারোটা পেরিয়ে একটায় বাসাতে ফিরি। একটি নিমন্ত্রনে যাওয়াতে ফিরতে এতো রাত হয়ে গিয়েছিল। শুতে যাবার আগে নৈমিত্তিক কাজ হিসেবে ফেসবুকে ঢুকতেই দেখলাম ইনবক্সে কয়েকটি মেসেজ। একটি মোল্লাভাইয়ের কাছ থেকে। অনেক রাত হয়ে গেছে, মোল্লাভাই ঘুমিয়ে গেছেন, এই ভেবে ওটা খুললাম সবার পরে। খুলতেই শরীর-মন অবশ হয়ে আসতে লাগলো। মোল্লাভাইয়ের ফেসবুক একাউন্ট থেকে মেসেজটি পাঠিয়েছেন তাঁর মেয়ে। লিখেছেন, ‘হাই আঙ্কেল, আমি শ্যামা, আব্বা আর আমাদের মাঝে নেই।’

ওইদিন অর্থাৎ সোমবার বাইরের কাজ সেরে আমি বাসাতে ঢুকি সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। ফেরার পথে দিনের হাঁটাটা হেঁটে নেবার সময় আরও কয়েকজনকে ফোন দেবার এক পর্যায়ে আমি মোল্লা বাহাউদ্দিনকেও ফোন দেই। কেউ ধরেননি। ভেবেছিলাম তাঁকে পেলে বাইরে আসতে বলবো, ঘণ্টাখানেক একসাথে কাটিয়ে যাবো দুজনে। কফি খাবো। বাসায় ফেরার পর সাড়ে ছটার দিকে তাঁর কলব্যাক পাই। তিনি তখন বেরুনোর আগ্রহ প্রকাশ করলেও আমি বাদ সাধি। কেননা, সারাদিন বাইরে কাটিয়ে ঘরে ঢুকেছি মাত্র। তাছাড়া রাতে অন্যত্র নিমন্ত্রন থাকায় আরেকবার বেরুতেই হবে। তাই তখন দুজনের সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন সন্ধ্যায় আমাদের আড্ডা হবে, সময়টা বিকেল নাগাদ ফোন করে তিনি নিশ্চিত করবেন।

গভীর রাতে বাসাতে ফিরে তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে বিচলিত করে দেয়। আমি দমবন্ধভাবে তাঁর বাসাতে ফোন দেই। ফোনটা ধরে শ্যামা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবকথা বলেন। যে মেয়েটিকে আমি মাত্র তিন-চারবার দেখেছি এবং যাঁর সাথে কখনই ‘কেমন আছেন’ এর বেশি কথা হয়নি, কিন্তু যাঁর স্নেহের ছায়ায় পিতা বাহাউদ্দিন মোল্লার দিনরাত, সেই পিতৃহারা মানুষটির সাথে দুমিনিটের ফোনালাপ আমাকে গভীর শূন্যতায় নিয়ে চলে।

আমি জানতাম বন্ধু কবি দেলওয়ার এলাহী রাতে কাজে আছেন, জেগে আছেন। তাই তাঁকে ফোন করে খবরটা জানাই। কয়েকবার ফোনাফোনির পর দুজনে সিদ্ধান্ত নেই তখনই হাসপাতালে যাবার। দেলওয়ার আসলে দুজনে রাত দুইটার দিকে টরন্টো ইস্ট জেনারেল হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে ঢুকি। ভাবীসহ আরও কয়েকজনকে দেখি লাশের পাশে অবস্থানরত। ভাবিই জানালেন, সম্ভবত ফোনে আমার সাথেই মোল্লাভাই শেষ কথা বলেন। এরপর মোল্লাভাই বাইরে যান। সাড়ে আটটার দিকে কেউ ওদের বাসাতে গিয়ে খবর দেয় যে মোল্লাভাই বিল্ডিঙের নিচে, অবস্থা খুব খারাপ। ভাবি দৌঁড়ে নিচে নামতে নামতে ততক্ষণে এ্যামবুলেন্স এসে গেছে। হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে তিনি ঘেমে নেয়ে ফেলেন। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে ধরে রাখতে পারেননি।     

১৯৯৫ সালে নিউইয়র্কের ওজন পার্কে কবি শামসুর রাহমানের ৬৭তম জন্মদিনে কবির সাথে মোল্লা বাহাউদ্দিন

দেলওয়ারের সাথেই একসময় বাসাতে ফিরে আসি। আমার করোটিতে হুমরি খেয়ে পরতে থাকে শতশত পুরনো কথা, স্মৃতি। শেষ ফোনেরটা দিয়েই শুরু করি। এর কয়েকমাস আগে মোল্লাভাই একটি উপন্যাস শেষ করেছেন। নাম ‘দূরদিগন্তের পানে’। উপন্যাসটি টরন্টোর প্রাচীনতম পত্রিকা যেটি তখন শুধু অনলাইনে চলে সেই ‘দেশেবিদেশে’-তে প্রকাশিতও হয়েছে। সেই উপন্যাসটিকে এখন বই-আকারে প্রকাশের প্রয়োজন। কয়েকদিন ধরে বইটির প্রকাশক নিয়েও দুজন শলাপরামর্শ করেছি। মোল্লাভাইয়ের মাথায় ঢুকেছে উপন্যাসটির একটি ভূমিকা লাগবে যেটি লেখার জন্যে তিনি আমাকে উপযুক্ত ভেবেছেন। বলে রাখা যেতে পারে ১৯৯৮ সালে মোল্লাভাইয়ের প্রথম উপন্যাস ‘সীমান্ত সংবাদ’ প্রকাশিত হয় ঢাকার মাওলা বাদার্স থেকে। সেই উপন্যাসটির প্রথম ফ্লাপ লিখেছিলেন প্রয়াত সাহিত্যিক আহমদ ছফা। ফ্লাপে আহমদ ছফা লিখেছিলেন, “ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির পটভূমিকায় উপন্যাসের শুরু, আর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে এই রচনার পরিসমাপ্তি। … দেশবিভাগের বেদনা, দেশান্তর, অসহায় হিন্দু-মুসলমানের অপরিসীম দুঃখকষ্ট লেখক তাঁর লেখনির মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলেছেন। দেশভাগের বিরুদ্ধে এই গ্রন্থ একটি প্রবল বেদনাঘন প্রতিবাদ।…” একই বছরেই তাঁর ‘কালোরক্ত’ উপন্যাসটিও ছাপা হয়। ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘স্বপ্ননগরী নিউ ইয়র্ক’ উপন্যাসের ভূমিকা ছিল সলিমুল্লাহ খানের। মোল্লাভাইয়ের কেন যেন মনে হতো উপন্যাসে লেখক ছাড়াও আরও কারও ভূমিকা থাকতে হবে।  

ওই ভূমিকা নিয়ে ইতোমধ্যে দু-চার বার মোল্লাভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছিল। ‘দূরদিগন্তের পান’এর সফট কপিটা মাসদুয়েক আগে তিনি আমাকে ই-মেইলও করেছিলেন। ৫৮ হাজারের বেশি শব্দ, অর্থাৎ ছাপাতে দুশ পৃষ্ঠা ছাড়াবে। পড়তে হবে, সেই মূল্যায়ন নিয়ে ভূমিকা – তাই এড়াচ্ছিলাম। তাছাড়া গত কয়েক মাসে এতো বেশি লেখার চাপ পড়েছে – নতুন কোনো ভাবনার ভেতর ঢুকতেও চাইছিলাম না।

এ প্রসঙ্গে আরও বলে রাখা যেতে পারে যে, ‘সীমান্ত সংবাদ’ যখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় তখন আহমদ ছফা স্নেহবশেই বইটি আমাকে দিয়েছিলেন। তখনই বুঝেছিলাম প্রবাসী মানুষটির বইটি প্রকাশে ছফাভাইয়ের সহযোগিতা ছিল। প্রবাসী সে লেখকের লিখনশৈলীর ব্যাপারে তখন থেকেই আমি আগ্রহী। কিন্তু ২০১৩ সালে টরন্টোতে আসার পর বহুদিন আমার মনেই পরেনি সেই বইটির লেখক আমার বর্তমান শহরেই থাকতে পারেন। এ বছরের শুরুর দিকে একদিন শ্রদ্ধেয় বন্ধু অরুণ দত্ত এক আলাপে বললেন যে আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে মোল্লা বাহাউদ্দিনের সাথে কথা বলা যেতে পারে। শুনে আমি তো চমকিত। শেষে ফোন নম্বর নিলাম, যোগাযোগ হলো। দেখা হলো। এরপর থেকে দেখাটা প্রতি সপ্তাহে মোটামুটি একবার করে হতে থাকলো।

১৮ আগস্ট ২০১৫ সালে মোল্লা বাহাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর শেষ যাত্রায় অংশ নেন কমিউনিটির অনেক বিশিষ্ট জন। ছবিতে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক ড. নূরুন নবী, কবি দেলওয়ার এলাহী, লেখক সুব্রত কুমার দাসসহ অন্যেরা।

আমি জানতে শুরু করলাম মু্ক্তিযুদ্ধে মোল্লাভাইয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা, নিউইয়র্কে থাকাকালে তাঁর সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের কথা। প্রবাসে বাংলা সাহিত্য নিয়ে তিনি এবং তাঁর বন্ধুদের উদ্যোগের কথা। আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাথে তাঁর ঘনিষ্টতার কথা। শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে তাঁদের অনুষ্ঠানের কথা। ছফাভাইয়ের সাথে তাঁর সংযোগের কথা। একটা ব্যাপার বুঝে গিয়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের ‍বিরোধীশক্তির উত্থান তাঁকে কতোখানি পীড়া দিতো, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি তাঁকে কতো গভীরে গিয়ে বিচলিত করতো। বুঝতে পারতাম এইসব বিচ্যুতি মানুষটিকে স্বাভাবিক আচরণ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে চাইতো।

এমন ব্যক্তিগত আড্ডার মধ্যেই তিনি আমাকে তাঁর ‘স্বপ্ননগরী নিউ ইয়র্ক’ উপন্যাসের একটি কপি উপহার দেন। সময়টা মার্চের শুরু। সে-উপন্যাসটি আমি দ্রুত পড়ে শেষ করি এবং উপন্যাসটির সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে থাকি। বুঝতে পারি তিনি আমার পাঠ-বিশ্লেষণ পছন্দ করছেন। যেমনটি অতীতেও করেছি, ভালোলাগা বই নিয়ে আমি লিখি। আনন্দের সাথে সে উপন্যাসটি নিয়েও একটি বড়ো আলোচনা লিখে ফেলি। আলোচনাটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ডেইলি সান’ পত্রিকায় জুনের ১২ তারিখে প্রকাশিত হয়। আমার সৌভাগ্য মোল্লাভাই সেটি পড়ে উল্লসিত হয়েছিলেন। পরে লেখাটি আমাদের উপন্যাস বিষয়ক ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করি।

মোল্লাভাই পরিকল্পনা করেছিলেন চার খণ্ডে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটি শেষ করবেন। সম্প্রতি সমাপ্ত ‘দূরদিগন্তের পানে’-তে তিনি তাঁর শৈশব-কৈশোর-তরুণ কাল ধরেছেন। ‘কালোরক্ত’-তে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দিনগুলোর কথা। ‘স্বপ্ননগরী নিউ ইয়র্ক’ তাঁর আমেরিকা জীবন নিয়ে। আর এখন যে উপন্যাসটির কথা ভাবছিলেন, লিখছিলেন সেটির নাম ভেবেছিলেন ‘দিগন্তের শেষে’। শেষজীবনে পৃথিবীর সর্বপশ্চিমের দেশটিতে থেকে তাঁর যে বোধ সেটিকে তুলে আনতে বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। আমি পরিকল্পনা করেছিলাম মোল্লাভাইয়ের সবকটি উপন্যাস নিয়ে বাংলায় একটি দীর্ঘ লেখা লিখবো। কিন্তু সে লেখাটি শুরুর আগেই তিনি না-ফেরার জগতে চলে গেলেন।       

কিছুদিন আগে তিনি আমাকে তাঁর ‘রাজাকারের জবানবন্দি’ নামের গল্পগ্রন্থটিও উপহার দেন। আগের এপ্রিলে দেওয়া তাঁর সেই উপহারে তাঁর স্বহস্তের স্বাক্ষর এবং ভালোবাসা এখনও জ্বলজ্বলে। আমি জানতাম তাঁর ‘রোমন্থন’ এবং ‘বিবিসাব’ নামের আরও দুটি গল্পসংকলন রয়েছে যদিও সেগুলো দেখার সুযোগ আমার হয়নি। কিন্তু সুযোগ হয়েছিল তাঁর নতুন গল্পগ্রন্থের অনেকগুলো গল্প শোনার।

যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ঘনিষ্ট ছিলেন, তাঁরা জানেন তিনি অবসরে ছবি আঁকতেন। তাঁর সে-আঁকাআঁকির গল্প বলেছিলেন একদিন আমাকে। বলেছিলেন দুইছেলের একজন ছবি আঁকাতে অসাধারণ। আমেরিকার কয়েকটি মিউজিয়মে সে চিত্রীপুত্রের কয়েকটি ছবিও স্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে। সেই ছেলে স্কুলে পড়ার সময় এক ছবিআঁকা প্রতিযোগিতায় পরপর তিনবার সেরা পুরস্কার পায়। স্কুলপ্রধান ডেকে পাঠালেন ছেলেকে। জানতে চাইলেন, কোন সে বড়ো শিল্পীর কাছে ছবি আঁকা শিখছে সে। ছেলে জানিয়েছিল – সেই শিল্পী তার বাবা। তো বাবা মোল্লা বাহাউদ্দিনের সাক্ষাৎ চাইলো স্কুল। তিনি সেখানে বললেন তাঁর আঁকিয়ে হয়ে ওটার গল্প।

তখন ১৯৭৩ সাল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান শাখাতে কর্মরত মোল্লাভাই। কাজকাম কম। কী মনে হলো, অফিসের ফাইলগুলোর সুন্দর কাগজ তাঁকে আকর্ষণ করলো ছবি আঁকতে। একের পর এক ছবি আঁকতে লাগলেন আর ড্রয়ার ভরতে লাগলেন। একদিন বিটিভি-র এক টিম ব্যাংকে গেছেন একটা শুটিং করতে। বিষয়: অবসরে কে কী করেন। একপর্যায়ে তাঁদের সাথে মোল্লাভাইয়ের সাক্ষাৎ। ছবি দেখে তো তাদের চোখ ছানাবড়া। পরপর তিনদিন তাঁর ছবি নিয়ে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল। শেষের বছরগুলোতেও নাকি তিনি ছবি আঁকতেন। দেখা হয়নি আমার। বুঝতে পারি তাঁর অনেককিছুই দেখা হয়নি আমার। যখন জেনেছিলাম, মানসিকভাবে রোগগ্রস্থ হয়ে মোল্লাভাইয়ের মেধাবী সে-ছেলেটি আমেরিকার এক কোম্পানিতে মাত্র একমাস কাজ করার পরেই হাসপাতাল আর ঘরে বন্দি হয়ে পরে। যুবক সে পুত্রের দুরারোগ্য সে পরিস্থিতিটা চোখের সামনে দেখে মোল্লাভাই যে দেহধারণ করতে পারতেন, মানুষের সাথে মিশতেন সেটাই আমার কাছে কঠিন এক সফলতা বলে মনে হতো সব সময়।  

মোল্লা বাহাউদ্দিনের মৃত্যুর পর ঢাকার সকালের খবর দৈনিকে প্রকাশিত সুব্রত কুমার দাস রচিত শ্রদ্ধাঞ্জলি (তারিখ ২৩ আগস্ট, ২০১৫)

মোল্লাভাই আমার ওয়েবসাইট (bdnovels.org) খুব দেখতেন। সম্ভবত স্নেহের কারণেই বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে এক দশকের বেশি সময় ধরে চালু সাইটটা নিয়ে আমার কাজকে প্রশংসা করতেন। সম্প্রতি আমার লেখা তিনটি বই নিয়েছিলেন পড়তে। আমার পঞ্চাশতম জন্মদিনে আমাকে নিয়ে প্রকাশিত বইটি কয়েকদিন আগে পড়া শেষ করেছিলেন। সে বইতে মহাভারতের ওপর  আমার বইটা নিয়ে নৃপেন্দ্রলাল দাসের লেখা আলোচনাটি পড়ে তাঁর ইচ্ছে হয় তিনি মহাভারতকে নতুন করে পড়বেন। আমার মতো বয়ঃকনিষ্ঠের কাছে মহাভারত পড়তে সাহায্য কামনা করতে সামান্য দ্বিধা করেননি ঊনসত্তর বছরের মানুষটি। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার বইটাতে বিনয়কুমার সরকারের কবি-প্রীতি জেনে বিস্মিত হয়েছেন। আমার কাজের প্রশংসাও করেছেন।      

২০১৩ সালের আগস্টে টরন্টোতে আসার আগে এই শহরের মাত্র দুটি পরিবার আমার পূর্বপরিচিত ছিল। মাত্র দুই বছরেই কতোজন প্রিয়জন হয়ে উঠেছেন। অথচ দুর্ভাগ্য এই যে, নতুন করে যাঁরা প্রিয়জনের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হলেন তাঁদের অন্যতম মোল্লা বাহাউদ্দিন সকল মায়া ত্যাগ করার শক্তিও অর্জন করে ফেললেন। কিন্তু তাঁকে হারানোর বেদনাটা আমি কীভাবে সইবো। তাঁর সামান্য ইচ্ছেটাও তো পূরণ করার সুযোগ আমার আর হবে না। হঠাৎ বিকেলে ফোন করে বলবেন না, চলেন, আজকে বসা যাক। তাঁর সাথে ম্যাকডোনাল্ডসে বসে দীর্ঘ কফি খাওয়া হবে না। কফি সেরে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে নতুন করে আড্ডা শুরু করা হবে না।

মোল্লাভাই সর্বশেষ যে বইটি পড়েছিলেন সেটি হলো মহিবুল আলমের লেখা ‘তালপাতার পুথি’। বইটি অস্ট্রেলিয়া থেকে টরন্টোতে এসে পৌঁছলে সেটি নিয়ে ফেসবুকে দেওয়া আমার স্ট্যাটাসটি মোল্লাভাইয়ের চোখে পড়েছিল। তিনি বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, মহিবুলের তো বয়স কম, সে কী করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উপন্যাস লিখবে? শেষে ‘তালপাতার পুথি’ নিয়ে লেখা আমার রিভিউটা পড়ে বইটা নিয়ে গেলেন। আমার পড়া শেষে সেটি কবি দেলওয়ার এলাহীকে দেওয়ার কথা ছিল। ভেবেছিলাম, মোল্লাভাই মুরুব্বি মানুষ। তাঁকে আগে দেই, দেলওয়ারকে পরে দিলে দোষ হবে না। বই দেওয়ার তিন/চার দিনের মাথায় ১৩ আগস্ট বিষ্যুদবার সন্ধ্যায় হাঁটার কালে ফোন দিতেই আবদার করলেন, বাসাতে যেতে। হাতে সময় থাকায়, চলে গেলাম। যেতেই বললেন, ‘তালপাতার পুথি’ পড়া শেষ। হাসিমুখ দেখে বুঝলাম, পছন্দ হয়েছে। বললেন, ‘কম বয়স। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সে লেখলো কেমনে!’ আরও বললেন, ‘বইটা নিয়ে আমি লিখবো।’
মোল্লাভাইয়ের ডাকে ওই বাসাতে সেটাই আমার শেষ যাওয়া।

‘তালপাতার পুথি’ তাঁর পড়া সর্বশেষ বই। অত দীর্ঘ বইটি এতো দ্রুত পড়তে পেরেছিলেন কারণ সেটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে তাঁর গভীর আস্থার প্রকাশ ঘটিয়ে গেছেন মোল্লাভাই।

মোল্লাভাই, আপনার মতো সাহসী মানুষেরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে যে দেশটাকে  স্বাধীন করেছিলেন, সেটাকে আমরা স্বাধীনতাবিরোধীদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে পারিনি বলে আপনার অনেক অভিমান ছিল, ক্রোধ ছিল, কষ্ট ছিল। তাই বলে চোখের সামনে দেশমাতার গ্লানি, ঘরে প্রিয় সন্তানের রোগক্লিষ্ট মুখ সহ্য করতে না পেরে এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবেন?    

মোল্লা বাহাউদ্দিন-এর বইসমূহ

কালো রক্ত

রাজাকারের জবানবন্দি

সীমান্ত সংবাদ

স্বপ্ন নগরী নিউইয়র্ক