রবীন্দ্র-অধ্যয়নে মূল্যবান সংযোজন
নুরুল আনোয়ার
রবীন্দ্রজন্মের সার্ধশত বৎসর পার হচ্ছে। রবীন্দ্রকৃতি নিয়ে স্বদেশে বিদেশে আজও চলছে অজস্র গ্রন্থ প্রকাশ। তাঁর শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, রাজনীতি ও সমাজচিন্তা, কৃষি ও গ্রাম-সংস্কারের কাজ, শিক্ষাচিন্তা এমনি বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড ভাবিয়ে তুলছে বর্তমান প্রজন্মকেও। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকায় যে অনুকূল ও প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল তার কালানুক্রম অনেকেরই এখনো কম-জানা বা অজানা রয়ে গেছে। পুরস্কার প্রাপ্তির পর নিজ দেশের বাইরে অন্যান্য দেশে বিশ্বমানব রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-ধারণা এবং সাহিত্যকর্ম কতখানি গৃহীত হয়েছিল তা এখনো দেশবাসীর কাছে অস্পষ্ট। রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তও কখনো কখনো প্রবল হয়ে উঠেছিল। সুব্রত কুমার দাসের ‘রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা, অজানা’ গ্রন্থটি এসব নিয়ে বহুতথ্য ও প্রমাণাদিসহ উপস্থাপন করেছে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার, বিস্মৃৃত এক রবীন্দ্র-ভাষ্যকার, রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনী, রবীন্দ্রনাথের একটি অজানা সাক্ষাৎকার, রবীন্দ্রনাথের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ পরিকল্পনা, অস্ট্রেলিয়ার পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার সংবাদ, আমেরিকায় রবীন্দ্র-অস্তিত্বের সংকট : হিন্দু জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা পোয়েট্রি পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ হলো এ গ্রন্থের ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অধ্যায়। বইটি ১০৪ পৃষ্ঠার হয়েও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ দলিল। রবীন্দ্র-অনুরাগী পাঠক এবং গবেষণামনস্ক লেখক এ গ্রন্থে বহু পরিশ্রমের দুর্লভ ফসল ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত বহু তথ্য পেয়ে যাবেন।
বিদেশ ভ্রমণের ভেতর দিয়ে চিন্তা-ভাবনার যে ফসল রবীন্দ্রনাথ কুড়িয়ে এনেছিলেন, পাশ্চাত্যের মনীষীরা রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে জেনেছিলেন, বহির্বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ কোন সব বিষয় নিয়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন ইত্যাদি বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র নিয়ে খুব বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। আমরা দেখতে পাই, অতি আধুনিক কালেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বিতরিত জ্ঞান সময়ের সীমানায় আবদ্ধ নেই। এক দিকে সেগুলো ছিলো সুপ্রাচীন, অন্যদিকে ছিল তরুণতর। সুব্রত কুমার দাসের গ্রন্থের উপস্থাপিত তথ্যাবলী রবীন্দ্রনাথের মনন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝতে সহায়ক হবে। রবীন্দ্রনাথের বিশাল প্রতিভা জনগণের দৃষ্টির সম্মুখে সহস্র বর্ণচ্ছটায় সর্বদা আবৃত রয়েছে আজও। সেই রশ্মিজালের আবরণ ভেদ করে রবীন্দ্রনাথকে চিনে নেওয়া সহজ সাধ্য নয়। রবীন্দ্র প্রতিভাকে তার পরিপূর্ণ মহিমায় নিত্যনবীন করে উপলব্ধি করার শুভলগ্ন আসে তাঁর জন্মদিনে। যেমন, এবার সুযোগ হল তাঁর জন্মের সার্ধশত বৎসরে। সুব্রত কুমার দাস হয়তো রবীন্দ্রজন্মের সার্ধশত বৎসরের গুরুত্বের কারণেই ‘রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা, অজানা’ গ্রন্থটি এসময় প্রকাশ করেছেন।
বিদেশে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ, বিভিন্ন সুবিখ্যাত ব্যক্তিবৃন্দ ও মনীষীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, পত্র-পত্রিকার মন্তব্য ইত্যাদি বিষয়ক তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে স্বদেশের বিদ্বজ্জন ও পণ্ডিত ব্যক্তিরাও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে খুব একটা সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেননি। তাছাড়া নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে তখনকার এবং এখনকার রবীন্দ্রনাথের সকল কৃতি এবং ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষের কাছে বহুভাবে অজানা রয়েছে। তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার মত ‘ক্যান্সার বীজ’ আমাদের উন্নত ও অগ্রসর চেতনাকে বার-বার প্রতিহত করেছে। এসবের জন্যে এখনো প্রয়োজন তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ। পাঠকের নিজস্ব নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি তখনই গড়ে ওঠার জন্যে সহায়ক হবে। সে বিবেচনায় ‘রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা, অজানা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
যদিও স্বদেশ-বিদেশের পণ্ডিতদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে এ ধারণাই দীর্ঘকাল ধরে লালিত হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথ মহামানব এবং তাঁর মধ্যে বিচিত্র ধারা ক্রমে মিশেছে – অতীতের ঐতিহ্য, ভাব ও চিন্তনকে তিনি যেমন গ্রন্থন করেছেন, তেমনি সাগ্রহে গ্রন্থন করেছেন দেশ বিদেশের সারস্বত সাধনা। প্রকৃত প্রস্তাবে রবীন্দ্রনাথ সারা বিশ্বের আকাক্সক্ষা, আরাধনা নিজের মধ্যে ঘনীভূত করেছিলেন। ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন মানব জীবনের ক্ষুদ্রতা ও খণ্ডতার মধ্যে সমগ্রতা ও পূর্ণতা।
নোবেল পুরস্কারের ঠিক আগের বছর (১৯১২), নোবেল প্রাপ্তির সময় ও পরের বছর, কে-ই বা রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেন, ইংরেজ কবি ইয়েটস ও চিত্রী রোদেনস্টাইন কি ভূমিকা নিয়েছিলেন এসব নিয়ে বইয়ের প্রথম অধ্যায়। রবীন্দ্রনাথকে আমেরিকায় জনপ্রিয় করে তোলায় ছাব্বিশ বছর বয়সী ধনবান পণ্ডিত বিক্রমপুরের মানুষ বিনয়কুমার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং পত্রিকায় লেখালেখি ও গ্রন্থ প্রকাশ এখনো অনেকেরই অজানা। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারের ছবি বইয়ে ছাপানোর জন্যে লেখককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এটি একটি দুর্লভ প্রাপ্তি। ‘বিস্মৃৃত এক রবীন্দ্রভাষ্যকার’ অধ্যায়টিতে বিনয়কুমারের অসাধারণ কীর্তিকে তুলে ধরেছেন লেখক। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ের মাত্র পনেরো মাসের মধ্যে বাঙালি অধ্যাপক বসন্তকুমার রায় নিউইয়র্ক থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবনী ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রথম ইংরেজি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। অথচ তিনি রবীন্দ্রনাথের সুদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অনুমতি ছাড়াই তাঁর জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ হওয়াই হয়তোবা এর প্রধান কারণ। এ অধ্যায়টিও অত্যন্ত চমৎকারভাবে লিখেছেন সুব্রত কুমার দাস। প্রথম রবীন্দ্রজীবনী (‘রবীন্দ্রনাথ’) রচয়িতা অজিতকুমার চক্রবর্তীকে নিয়েও লেখক বিস্তৃত করে লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই যে আমেরিকায় চলমান হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হয়ে গিয়েছিলেন এবং সে-মামলা থেকে মুক্তি পেতে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে টেলিগ্রাম করা ছাড়াও আরো বহু কিছু করতে হয়েছিল তা এ বই পড়ার আগে বোধ করি খুব কম পাঠকেরই জানা থাকবে।
জীবনকালে রবীন্দ্রনাথ অনেকবার নিন্দুকদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছেন। আবার স্তাবকদের হাস্যকর প্রশস্তির যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়েছেন। এই দুই চূড়ান্ত বিপরীতধর্মী স্রোতের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি প্রতিভা ও জীবনের সত্য স্বরূপটি খুব কমই আবিষ্কারের চেষ্টা হয়েছে। ব্রিটিশ শিল্পী জ্যাকব এপস্টাইন, তাঁর আত্মজীবনী ‘Let there be Sculpture’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের বিকৃত মূর্তি এঁকেছিলেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, অন্য ধর্মের দীন-দরিদ্র মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অশ্রদ্ধা ও অসহিষ্ণুতা ছিল। এপস্টাইন ছিলেন বিতর্কিত চরিত্র। ব্যক্তিগত কোনও কারণে এপস্টাইন রবীন্দ্রনাথের প্রতি রুষ্ট হয়েছিলেন। এ ধরনের বিরূপ সমালোচনা পাশ্চাত্যে কেউ মেনে নেয়নি। পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রসাহিত্য, সংগীত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্র খোলা হযেছে। যেমন লন্ডনে ‘দি টেগোর সেন্টার’ রবীন্দ্রনাথের সংহতরূপ তুলে ধরার জন্যে প্রকাশ করেছে ‘দিজ ওয়ার্ল্ড ইজ বিউটিফুল’ নামে একটি সুন্দর সংকলন। চিঠিপত্র, স্মৃতিকথা, সংগীত, কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস এ সংকলনে স্থান পেয়েছে। এদেশে এধরনের সংকলন খুব একটা দেখা যায় না। সুব্রত কুমার এ শূন্যতার কিছুটা হলেও পুরণ করেছেন ভিন্নধর্র্মী তথ্য দিয়ে তার নতুন গ্রন্থ ‘ রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা, অজানা’-তে।
সুব্রত কুমারের এ বইটি লেখকের বহুদিনের বহু উৎস থেকে কুড়ানো ফসল। এমন না যে তিনি কোনো গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। নিজ আগ্রহে দিনের পর দিন অনুসন্ধান করে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে, বিশেষ করে ১৯১২ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত বিদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সঞ্চয় করে এ গ্রন্থ রচনা করেছেন লেখক। এটি একটি গবেষণা কাজের ফসল বলতেই হবে। “নিউইয়র্ক টাইমসে’- এ নোবেল পুরস্কার ও রবীন্দ্র প্রসঙ্গ’, “নিউইয়র্ক ট্রিবিউন’-এ নোবেল পুরস্কার ও রবীন্দ্র প্রসঙ্গ’, ‘রবীন্দ্রনাথের একটি অজানা সাক্ষাৎকার’, ‘রবীন্দ্রনাথের অষ্ট্রেলিয়া ভ্রমণ পরিকল্পনা’, ‘আমেরিকায় রবীন্দ্র অস্তিত্বের সংকট: হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা’ এবং আমেরিকার শিকাগো শহর থেকে মাসিক কবিতা “পোয়েট্রি’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ’ গ্রন্থটির কয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম। ‘নোবেল’ পাওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যে আলোড়ন তুলেছিলেন। ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকা ১৯১২ (ডিসেম্বর), ১৯৬৬ (সেপ্টেম্বর), ১৯৫৯ (জানুয়ারি) এবং ১৯৬১ (নভেম্বর) সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও লেখা ছাপা হয়েছিল। লেখক ‘পোয়েট্রি’র চার সংখ্যার প্রচ্ছদ তুলে দিয়ে পাঠকদের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমনি করে লেখার সঙ্গে দুর্লভ ছবি ছেপেছেন ‘নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত (২৯ অক্টোবর, ১৯১৬) জয়েস কিল্মারের নেয়া রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারটির। ১৯১৮ সালে ২৩ এপ্রিলে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার রায় তখনকার একটি বিশিষ্ট ঘটনা। অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর আমেরিকায়। উর্দুভাষী রাম চন্দ্র (‘গদর’ পত্রিকার সম্পাদক) নিহত হয়েছিলেন তারই আরেক সঙ্গী রাম সিং এর গুলিতে। রবীন্দ্রনাথকেও সন্দেহ করে সংবাদ শিরোনাম হলো – ‘Tagore Named with Japanese Plot Trial’’! সুব্রত কুমার দাস ১৯১৮-র লোমহর্ষক ঘটনা নিয়ে চমৎকার তথ্য পরিবেশন করেছেন। এ বইয়ে এ অধ্যায়টির তথ্যাবলী সত্যি দুর্লভ। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে রবীন্দ্রচর্চা। আমেরিকানরাও সরকারী পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখেছে। ভারতীয় বা বাংলাদেশীরা ছাড়াও আমেরিকানরাও বহুলভাবে যুক্ত হয়েছেন এসব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, সংগীত, চিত্র এবং তাঁর সমাজ, রাষ্ট্র ও দর্শন চিন্তা পৃথিবীর সমস্ত পীড়িত মানুষের কাছে আজ এক সঞ্জীবনী প্রলেপ। হিটলারের সময় রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন জার্মানিতে। যুদ্ধোত্তর পর্বে নিশ্চিহ্ন সেই রবীন্দ্রনাথ আবার স্মৃত ও অনুস্মৃত হচ্ছে সেখানে। এমনি করে স্বদেশে বিদেশে সবখানেই রবীন্দ্রনাথের চিহ্ন পাওয়া যাবে। পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র চর্চাও প্রসারিত হচ্ছে অনেক। দেশের শহরে এগুলি দিনে দিনে সম্প্রসারিত হচ্ছে আরও।
বৃদ্ধ বয়সেও রবীন্দ্রনাথ কাজের জটিলতা ও শারীরিক পরিশ্রমকে উপেক্ষা করেও দূরদেশ ভ্রমণে গিয়ে বিদেশী সমাজ ও ব্যক্তিবর্গের সামনে উপস্থাপিত করেছেন তাঁর সৃষ্টি সামগ্রী এবং তাঁর জীবনের মিশনকে। যতই সময় এগিয়ে চলেছে, মানুষ রবীন্দ্রনাথকে জানতে পারছে ত্রিকালদ্রষ্টা এক মনীষীরূপে। স্বদেশ-বিদেশের বহু বিদ্বজ্জন বিভিন্ন সময় রবীন্দ্রনাথকে ভুল বুঝেছিলেন। কেননা, রাজনৈতিক স্বাধীনতার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ আত্মার স্বাধীনতার কথা বলতেন। যেমন করে রোমাঁ রোলাঁও বলতেন যে ফ্রান্সের সমরশক্তির গৌরবের চেয়ে তার (ফ্রান্সের) আত্মার পরিচয় অনেক বড়।
প্রতিভার বহুমুখীনতা ও প্রাচুর্যের বিচারে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গ্যয়টের তুলনা হতে পারে। দুজনেই যুক্তিবাদী, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধে বিশ্বাসী, বিশ্বমানবতার অকুণ্ঠ সমর্থক। কিন্তু স্বদেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে না-বুঝে নানাভাবে সমালোচনা করেছে। গ্যয়টের মত রবীন্দ্রনাথও জেনেছেন জীবনের সার্থকতা বিকাশে। যে কারণে বৈরাগ্যতত্ত্ব বা গান্ধীর মত আত্মনিগ্রহ নীতিকে রবীন্দ্রনাথ স্বাগত জানাতে পারেননি। বিশ্বভারতীর আদর্শ প্রচারে রবীন্দ্রনাথ ১৯২০ সালে ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণে গিয়ে তিনি বিপুল সংবর্ধনা ও সমাদর পেয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে চেকোশ্লোভাকিয়ার সফর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে দেশের দুই মনীষী লেজনি ও নিটজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পরিচয় ছিল এবং সেখানে সফরে যাওয়ার ফলে তাঁদের বন্ধুতা আরও ঘনিষ্ঠ হয়। জার্মানি কর্তৃক চেকোশ্লোভাকিয়ার অঙ্গচ্ছেদ ও বিকাশের ঘটনা তাই রবীন্দ্রনাথের মর্মে আঘাত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ চেক প্রেসিডেন্ট নেস্কে সমবেদনা জানিয়ে তারবার্তা প্রেরণ করেছিলেন। ফরাসী শিল্পী আঁদ্রে কার্পেলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল প্যারিসে এবং রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে কার্পেলে শান্তিনিকেতনে এসে, শ্রীনিকেতনে শিল্পভবনের সূত্রপাত করেছিলেন। শ্রীমতি কার্পেলে রবীন্দ্রাথের কয়েকটি গ্রন্থও অনুবাদ করেছিলেন ফরাসিতে। এসব প্রসঙ্গ এজন্যে যে, সেদিনের মানুষ হয়েও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কত অজানা রয়ে গেছে আমাদের!!! আর ‘কম-জানা, অজানা’ ছোট একখানি বই হয়েও অবতারণা করেছে এমন বহু বিষয়ের ।
গবেষণা-মনস্ক লেখক ও অনুরাগীর জন্যে এ গ্রন্থ পাঠ অপরিহার্য কেননা, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, সংগীত এবং তাঁর নির্ভীক বাণী আজও ধ্বনিত। এরকম একটি অনন্য বই সফলতার দাবি রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস। নবীন প্রকাশনা সংস্থা গদ্যপদ্য বইটির পরিশীলিত প্রকাশের কারণে প্রশংসার দাবিদার। প্রচ্ছদশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর এটির নান্দনিকতার ভাগীদার বটে।