রবীন্দ্রনাথ ও মহাভারত: পাঠ অভিজ্ঞতা

নৃপেন্দ্রলাল দাশ

মহাভারতকে বলা হয়ে থাকে ভারতীয় চিৎপ্রকষ্ট তথা ধী-শক্তির ইতিহাস। ভারত এখানে রাষ্ট্রিক কিংবা ভৌগলিক অভিধার ভূখণ্ড নয়। ভা অর্থ অলৌকিক আলো, রত অর্থ হচ্ছে বিকিরণ। তার সরল ভাবার্থ হচ্ছে যা চিরকাল আলোর দিব্যতাকে ডেকে আনে। সেই ভাবগত অর্থে মহাভারত হচ্ছে ধী-শক্তির আধার। এই মহাকাব্যকে নিয়ে যুগে যুগে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আগামীতে আরও বহু গ্রন্থ প্রণীত হবে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যদিও মহাভারত ভাবুক খুব বেশী নেই। তবু বেশ কিছু চিন্তক, মহাভারত নিয়ে লিখেছেন। তারই সাম্প্রতিক প্রকাশনা রবীন্দ্রনাথ মহাভারত লিখেছেন সুব্রত কুমার দাস।

মূর্ধন্য নামক এক নবীন প্রকাশনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ১৫১টি বই প্রকাশ করেছেন। তার অন্যতম সুব্রতর এই বই। প্রকাশিত হয়েছে ডিসেম্বর ২০১১ রবীন্দ্র-স্মারক গ্রন্থমালা রূপে। এক শিশু শিল্পী তাসনিম তাবাসসুম খান প্রচ্ছদ এঁকেছে। গ্রন্থমালা বিষয়ে দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন মনজুরে মওলা। রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে এ গ্রন্থমালা প্রকাশিত হয়েছে। গজদন্তমিনারবাসী নাগরিক বিদগ্ধ সমাজে নয়Ñ সুবিধাবঞ্চিত জনের কথা মনে রেখে নাকি এ সব করা হয়েছে। আমার পরিতাপ এ জন্যে হচ্ছে যে, এ সিরিজের বই আমরাও কিনতে আগ্রহী, কিন্তু ঢাকার বাইরে পাওয়ার কোন ব্যবস্থা তো তারা করেননি। আমি এক মফস্বল শহরে বাস করি। সেখানে এই গ্রন্থমালার নামই জানে না কোন লাইব্রেরি বা বইয়ের দোকানদার। তাহলে কি মনজুরে মওলা সাধারণ পাঠক বলতে ঢাকা শহরের পাঠককেই বুঝিয়েছেন? আমার অনুরোধ, কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্সের বাইরে যে বাংলাদেশের সর্বত্র রবীন্দ্রপ্রেমীরা ছড়িয়ে আছেন, তাদের কথা একবার ভাবুন। তারপরেও আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ এই রবীন্দ্র-স্মারক-সিরিজটি প্রকাশনায় যুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি। রবীন্দ্রচর্চার একাডেমিক ধারার বাইরে তাঁরা মুক্তচর্চাকে আবাহন করেছেন।

সুব্রত কুমার দাসের এই সুমুদ্রিত বইটি পড়তে গিয়ে প্রথমেই এক সমস্যায় পড়লাম – কোন সূচিপত্র নেই। তাই গোড়ার কথা থেকে শেষকথা পর্যন্ত যেতে হয়েছে অরণ্যচারী পথিকের মতো। ধারণা করা যায় যে, পুরো সিরিজের সকল বইতেই সূচিপত্রের কোন অস্তিত্ব নেই। আমাদের আলোচিতব্য গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের মহাভারত চিন্তনের এক সমূহ বিবরণ দিয়েছেন লেখক। সেই প্রতিপাদ্যের প্রান্তিক পাঠক হিসেবে আমার যাত্রা শুরু।

রবীন্দ্রভাবিত মহাভারতচর্চাকে লেখক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বিচার করেছেন। তথ্য উপাত্তের ধ্বজা উড়িয়ে তিনি বর্ণনা করেছেন মহাভারত বিভাসিত রবীন্দ্র মননকে। কৈশোরকাল থেকে সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ এই মহাকাব্য নিয়ে যা ভেবেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন বিশ্বস্তভাবে। জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের প্রধান অবলম্বন ছিল কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ। কালীপ্রসন্নের সমালোচনা না করেও বলা যায় যে, আমি মনে করি, মহাভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অনুবাদ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের। সংস্কৃত ভাষায় সামান্য অধিকার থাকলেই বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারা যায় স্থানে স্থানে কালীপ্রসন্ন কত স্বাধীনতা নিয়েছেন মূলের আনুগত্য অনেক স্থানেই শিথিল ছিল। রাজশেখর বসুর সারানুবাদ অত্যন্ত মুলানুগ, যদিও খুব সংক্ষিপ্ত।

ধরে নিতে পারি প্রসঙ্গ: মহাভারত দিয়েই বইটির আরম্ভ হয়েছে। মহাভারতের কাল বিষয়ে অমলেশ ভট্টাচার্যের উক্তি উৎকলন  করেছেন সুব্রত। মহাভারত মল্লিনাথ অমলেশ ভট্টাচার্য আমার অতি আপনজন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের উর্ধ্বে উঠে বলতে পারি খি.পূ. ৩০৪১ সালে ব্যাসদেব জয় কাব্য মহাভারত লিখতে আরম্ভ করেন এই দাবী বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত (পৃ. ১৭) নয়। বুদ্ধদেবের জন্ম (খ্রি. পূ. ৬৩৩) ও আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ (খ্রি. পূ. ৩১৩) এর পরে মহাভারতের রচনাকাল ধরলে জাতকের কাহিনি মিথ্যে হয়ে যায়। কালিদাস ও বরাহ মিহিরের বিবেচনাও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের যুধিষ্ঠিরের সময় নিবন্ধটি পাঠককে সঠিক বোধ দিতে সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস। আর পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত গুরুচরণ দাসের দ্য ডিফিক্যাল্টি অফ বিইং গুড, অন দ্য সাটল আর্ট অব ধর্ম বইটি দেখতে অনুরোধ জানাই। ঐতিহ্য অনুযায়ী মানুষ হিসেবে ব্যাসদেব এক ব্যক্তি নন এটাও মানতে পারি না। সুব্রত উল্লিখিত দীপংকর লাহিড়ীর অভিমত গ্রাহ্য নয় আমাদের কাছে। ব্যাসদেব গুহা কিংবদন্তি ও ঐতিহাসিক বিবেচনায় সিদ্ধ নয়। বালক রবীন্দ্রনাথ ও মহাভারত অধ্যায় থেকেই মূলতঃ সুব্রতর নিজস্ব অভিযাত্রার শুরু। রবীন্দ্রজীবনী পাঠকের কাছে এ সব জ্ঞাতব্য খুব জরুরী নয়।

মহাভারতের রবীন্দ্র মূল্যায়ন অংশটি মূল্যবান তথ্যে ভরা। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত বইটির সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ যে সব উক্তি করেছেন, তা সেই সময় আলোড়ন তুলেছিল। প্রাচীন সাহিত্য আলোচনায় বারবার এসেছে মহাভারত এসব তথ্য দিয়ে সুব্রত মন্তব্য করেছেন মহাভারত বিষয়ে এভাবেই ক্রমে ক্রমে দার্শনিকতার একটি স্তরে পৌঁছে যান আধুনিক বাংলা ভাষার সাহিত্য নির্মাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা প্রবন্ধ ছাড়া অন্যত্র মহাভারত দর্শনতত্ত্ব খুব নেই। সুব্রত ব্যাখ্যা করে দেখাননি কোন দার্শনিক কুললক্ষণ মহাভারত-ভাবনায় সোচ্চার হয়েছে। এ অপূর্ণতা মানতেই হবে। এমন কি ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা থেকেও কোন উৎকলন করেননি। যেখানে তাঁর উক্তির স্বপক্ষে যুক্তির বিস্তার করা হয়েছিল। পরিচয় বইটি হাতের কাছে থাকলে এই উক্তির সারকথা উদ্ধৃতি সহায়ে দেখানো যেতো।

মহাভারত কাহিনির পুননির্মাণে রবীন্দ্রনাথ অধ্যায়ে বাংলা সাহিত্যে মহাভারত উপাদানের ব্যবহার বিষয়ে বর্ণনা আছে। অনেক অপ্রধান গ্রন্থাদির উল্লেখ আছে। প্রধান গ্রন্থগুলি যেমন সঞ্জয়, কাশীরাম দাস, প্রমূখের তেমন বিশ্লেষণ নেই। তালিকা দীর্ঘ, মূল্যায়ণ অনুপস্থিত। সাম্প্রতিক কালের মহাভারত চিন্তকদের কোন উল্লেখ নেই। রাজশেখর বসু, বুদ্ধদেব বসু, হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সুখময় সপ্ততীর্থ ও নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী প্রমুখ আলোচনার বাইরে থেকে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথ মহাভারত মিথটি কত নতুন উপস্থাপনা ও মূল্যমানে নির্মাণ করেছেন সেটাও গভীরতাস্পর্শী নয়। তবে তার বর্ণনা খুবই প্রাসঙ্গিক তথ্যে ভরা – তত্ত্ব সেখানে উপস্থিত নয়। চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্য ও নৃত্যনাট্য বিষয়ে মিথের নির্মাণ কত তুঙ্গস্পর্শী হয়েছে এসব নান্দনিকতাকে উপেক্ষা  করেছেন লেখক। চিত্রাঙ্গদার শিল্প ভাবনা নিয়ে সে যুগে সৃষ্ট  বিতর্ক ও সমালোচনাও এখানে উপস্থাপিত হতে পারতো। কিছু বিবরণ আছে তবে ডি,এল, রায় যে আলোচনা করেছেন সুনীতি-দূর্নীতি সম্পর্কে তা নেপথ্যে রয়ে গেছে। বিদায় অভিশাপ নিয়েও আলোচনা করেছেন সুব্রত। নরকবাস, গান্ধারীর আবেদন, কর্ণকুন্তী সংবাদ ইত্যাদি সুবিখ্যাত কবিতায় মহাভারতকে এক নতুন মহিমায় আমরা আবিষ্কার করি। ব্যাসদেবের চিন্তার অগম্য লোক থেকে রবীন্দ্রনাথ নতুন মহাভারতকে স্থাপন করেছেন আধুনিক পাঠকের সামনে। সেই সব মহাভারত সংশ্লিষ্ট কবিতার কবিআত্মা ও কাব্য শিল্প বিষয়ে আরো নন্দননির্ভর আলোচনার সাপেক্ষতা ছিল। সুব্রত কুমার দাস রসপ্রস্থানিক আলোচনায় যাননি।

জাভাযাত্রীর পত্রে রবীন্দ্রনাথ মহাভারত প্রসঙ্গকে এনেছেন। জাভা ও বালী দ্বীপে মহাভারতের অন্যবিধ সংস্করণ দেখে তিনি আপ্লুত হয়েছেন সে সব কথাও লিখেছেন।

সমস্ত জীবনব্যাপী রবীন্দ্রনাথ মহাভারত বিষয়ে ভাবিত ছিলেন সুব্রত কুমার দাসের বইটি পড়লে এ কথা খুব ভালো করে বুঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের মহাভারত ভাবনা নিয়ে এটিই একমাত্র বই। যদিও সুখময় সপ্ততীর্থ রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত অনুশীলন প্রসঙ্গে মহাভারত কথার উল্লেখ করেছেন। মহাভারত চিন্তার পূর্ণায়ত বিবরণ হচ্ছে সুব্রতর বই।

এখন কিছু প্রত্যাশার কথা বলা যায়। একজন সচেতন পাঠক হিসেবে যা মনে হয়েছে। বইটির শেষে একটা উল্লেখপঞ্জি থাকা দরকার ছিল। গ্রন্থ তালিকা থাকলে আগ্রহী পাঠক সেসব বই সংগ্রহ করে পড়তে পারতেন। উক্তিগুলির সাধর্ম মিলিয়ে পড়তে পারতেন। একটি নির্ঘন্টও প্রয়োজনীয় ছিল। সাধারণের কাছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবেই সম্ভবত এ গ্রন্থমালায় উল্লেখপঞ্জি বা নির্ঘন্ট জাতীয় বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে, অতি সরল গদ্যে আর বিনীত তথ্যে রচিত এই বই সকলেরই পড়া উচিত বলে মনে করি। কারণ, মহাভারত বিষয়ে ভ্রান্তি ও অনির্ভরতা খুব বেশি আমাদের মধ্যে।

সুব্রতর আগে মহাভারত ও রবীন্দ্রনাথ এই প্রাসঙ্গিতায় ব্যাপকভাবে না হলেও ভাবিত হয়েছিলেন ড. ভবতোষ দত্ত। আলেখ্য (২০ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৩৭, মে-জুলাই ১৯৯০ পৃ. ৩৯৭-৪০১) পত্রিকায় ভবতোষ দত্ত রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মহাভারত শীর্ষক প্রবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় নয়, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতেই আলোচনা করেছেন। ১৯৯৪ সালে নাগ হর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে Rabindranath Tagore on the Ramayana and Mahabharata (১৯৯৫) বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। এই ছোট ভাবনাটি পরে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

সুব্রতর সারস্বত চিন্তাকে নন্দিত করি তাঁর অধ্যয়নের গভীরতাও অধীত বিদ্যার সার্থক উপস্থাপনার জন্যে। অনেকে মনে করেন, মহাভারত হিন্দুদের একটা পঠিত ধর্মগ্রন্থ। মহাকাব্য হিসেবে, শুদ্ধ সাহিত্য হিসেবে শিক্ষিত বাঙালি এই বই পড়ার মানসিকতা অর্জন করতে পারেনি। সুব্রত কুমার দাসের কৃতিত্ব এই যে, সব রকম সংকীর্ণতা ও গোড়ামির উপরে  উঠে তিনি মহাভারত নিয়ে ভেবেছেন। ২০১১ সালে প্রকাশিত তাঁর আমার মহাভারত বইটি এ বিষয়ে একটি মাইল ফলক। বর্তমান বইটিতে রবীন্দ্র-কেন্দ্রিক মহাভারত ভাবনার এক বি¯তৃত ব্যাখ্যানকে তিনি মাধুকরীপন্থায় উপস্থাপন করেছেন। নানা প্রসঙ্গকে সম্পূর্ণতা দিয়েছেন। রবীন্দ্রচর্চার ভূগোলকে তিনি আরো বেশি আতত করেছেন। বাংলাদেশে মহাভারতচর্চার প্রেক্ষাভূমিকে উজ্জ্বলতর করেছেন। সাহিত্যের নান্দনিক পন্থায় মহাভারতকে এনে স্থাপন করেছেন আধুনিক জীবনের খুব কাছাকাছি। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বাইরে এনে পুঁথিপাঠের আসর থেকে, কুপী লন্ঠনের কেরোসিনের গন্ধভরা আবহ থেকে বের করে এনে বসিয়ে দিয়েছেন নাগরিক বিদগ্ধ পাঠকের এয়ার কন্ডিশন করা পাঠ কক্ষে।

মূর্ধন্যকে ধন্যবাদ জানাই বস্তাপচা অধ্যাপকীয় রচনার বাইরে এসে একটা মননজীবিতার গ্রন্থ উপহার দেবার জন্যে। বহু দিন ভালো বই পড়তে পাই না। অন্ততঃ একটা বই আপনারা উপহার দিলেন। আপনাদের প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ বইয়ের তালিকা পাইনি বলে জানি না আর কি চিন্তাযোগকে আপনারা উপহার দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ মহাভারত মহাভারতচর্চায় যেমন, রবীন্দ্রচর্চায়ও নতুন ক্ষেতকে কর্ষণ করেছে।  

কালি ও কলম, ঢাকা, অক্টোবর, ২০১২