যাদীদ বিহনে যাপিত জীবন

আকবর হোসেন

পরিণত বয়সে আমরা মৃত্যুকে মেনে নিই, কিন্তু মৃত্যু থেকে সঞ্জাত যে বেদনা তা মেনে নিতে পারি না। প্রথমে আমরা সবার সামনে কাঁদি, তারপর সারাজীবন নিজের ভিতরে কাঁদি। আমার স্মৃতিশক্তি প্রবল বিধায় সেই শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত কত কথা আর দৃশ্য যে নিজের ভিতরে জমা করেছি সে আমি জানি আর আর আমার মনই জানে। তবে সায়ীদ যাদীদকে এতো দ্রুত আমার স্মৃতির মণিকোঠায় সাজাতে হবে তা ভাবিনি। চারদিন আগে তাঁর পাশে গিয়ে বসলে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, দাদা এই যে আপনি বার বার নিত্য-অনিত্যের কথা বলেন, সেখানে আমি আপনার আগে চলে যাব। যদি পারি, জানাবো কেমন সেই নিত্যধাম। অফুরন্ত ভাবনার সময় হবে সেখানে; পলে পলে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হবে না। আর সেখানে যদি কোন রাজার দেখা পাই, তাকে টেনে এনে পাশে বসিয়ে বলবো, তুমি কেবল একটু আলোর বিন্দু দিয়েছিলে। আর দেখ, আমি চন্দ্র-সূর্য বুকে করে নিয়ে এসেছি। তুমি আমার ভাবনার ভাগ নাও, আর অবাক হও। বলে নীরবে অশ্রুপাত করেছিলেন। বড় আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন তিনি; রবীন্দ্রনাথের কোন কোন গান শুনে কেঁদে বুক ভাসাতেন।

আবহাওয়া একটু উষ্ণ হলে বারান্দায় গিয়ে বসে ভাবতেন, আমি কখন তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে তাঁর পাশে গিয়ে বসবো। এমন স্নেহকাতর অথচ সত্যের প্রতি পর্বতপ্রমাণ আস্থার মানুষ আমি আর দেখিনি। আমাকে একদিন অত্যন্ত দৃঢ় স্বরে বললেন, যে মানুষ সত্য বলতে দ্বিধা করে সে জ্ঞানত মিথ্যাবাদী, সে দুর্জন, সে সভ্যতার শত্রু। বাস্তবকে যে অস্বীকার করে সে মূর্খ।

আমি বড় একা হয়ে গেলাম। কাল তিনি ছিলেন আজ তিনি নেই। সুন্দরের নন্দনকাননে যার আবাস ছিল, তিনি আজ আমার স্মৃতির সিংহাসনে বসেছেন। (৩০ মে ২০২২)

——

“বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো / সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।“ আজ এক বিশাল সবুজ মাঠের মাঝে চির মাতৃস্বরূপা মাটির গভীর বুকে সায়ীদ যাদীদকে অনন্ত শয্যায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে এলাম। প্রকৃতি সরবে পাঠিয়েছিল কিন্তু আজ ফেরত নিল নীরবে। আমরা অর্বাচীন অবোধ মানুষ এই ভেবে কাঁদি, বুঝি মরণের মাঝ দিয়ে সব বন্ধন চিরতরে ছিন্ন হয়ে গেল। আসলে তা নয়; আমরা নানা রূপে আর রসে কোথাও না কোথাও জেগে থাকি। সেই মধ্যাহ্ন থেকে আমার ভিতরে এক গম্ভীর নীরবতা বাসা বেঁধেছে। তাঁর বারান্দায় কিছুদিন ধরে যে চেয়ারটিতে বিকেলবেলায় নির্জীব হয়ে বসে থাকতেন আর আমার অপেক্ষা করতেন সেই আসনটি আজ শূন্য দেখে এলাম। দেখা হলেই দুর্বল দুটি হাত তুলে প্রণাম করে বলতেন, দাদা আসুন সেই কখন থেকে বসে আছি। কর্কটরোগের নিদারুণ যাতনার মাঝেও নিচু স্বরে রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে কথা বলতেন। আমি এখন নিজেকে নানা ভাবে শাসন করছি; তুমি মেনে নাও না কেন, সে নেই? সে এতোদিন এক ঠিকানায় ছিল, এখন সে ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র বিরাজমান। নিজেকে ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে বিস্তারিত করেছে। সে তোমাদের সবাইকে শেষ প্রণাম করে গেছে। তার এই শেষ প্রণাম স্বীকার কর।

২০২০ সালে টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব অথরস (টিফা)-তে প্রথমবারের মতো বাংলাভাষী লেখকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সায়ীদ যাদীদ ও অন্যরা যুক্ত হন সেই আয়োজনে।

“গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;

আমাকে কেন জাগাতে চাও?

হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া,

আমাকে জাগাতে চাও কেন।

অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর;

তাকালে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে

অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে

কীর্তিনাশার দিকে।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো— ধীরে— পউষের রাতে—

কোনোদিন জাগবো না জেনে—

কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন আর।” (৩১ মে ২০২২)

———

“সুদূর কোন নদীর পারে গহন কোন বনের ধারে / গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার।“ সতত প্রণাম সেই চির চলমান সময় সন্ন্যাসীকে যিনি আমাদের যত ক্ষত আর ক্ষতির সব বেদনাকে ভুলিয়ে দিয়ে আবার সংসারের পথে অবিচল করে দিয়ে পালিয়ে যান। আজ ১১ দিন সায়ীদ যাদীদ গত হয়েছেন। যার বিচ্ছেদ অসহনীয় হয়ে উঠে বলে তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত বন্ধ রেখেছিলাম। গতরাতে আমাদের সুজিত কুসুম পাল দাদা এসেছিলেন নিজের বেদনা ও আমার বেদনাকে পাশে বসে লাঘব করার জন্য। দুদিন আগে বড় ঘটা করে অঝোরধারায় বৃষ্টি নেমেছিল রাতে। গভীর রাতে জানালা দিয়ে বাড়ির পেছনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, যে মানুষ জানালায় দাঁড়িয়ে মুখর বাদল দিনের গান গাইত, সেও কি আজ এই ঘনবরষা উপভোগ করছে? হয়তোবা করছে অন্য এক নিঃশব্দ নিঃসীম জগতের কোন এক বলয় থেকে। যা কোন জীবিতের জগত-জীবনের পরিসীমার বাইরে।

কিছু হারিয়ে তাকে মেনে নিয়ে আবার জীবনের পুটুলি কাঁধে নিয়ে জীবনতীর্থের সন্ধানে নির্গত হওয়ার নামই জীবন। এটা আমরা যত দ্রুত বুঝতে পারি ততই আমাদের জন্য ভালো। তবে বেদনার ভিতর দিয়ে না গেলে বেদনাকে অতিক্রম করা যায় না। জীবনে যে বেদনা পায়নি সে জীবন যাপন করেনি। আমি চোখ বন্ধ করলে আমার সেই সময় সন্ন্যাসীকে যেন দেখতে পাই। সে ঋজু, দীর্ঘ, নির্ভয় আর তার প্রতিটি পদক্ষেপ একাগ্র আর নির্বিকার। হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো তাঁর পেছনে অনন্তকাল ধরে অযুত মানুষ ছুটে চলেছে। পথে কতো মানুষ হারিয়ে গেল, ঝরে গেল, তবুও সীমাহীন মানুষের স্রোত তাঁর পেছনে। এই ছুটে চলতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া আর ঝরে যাওয়াই জীবন। (০৮ জুন ২০২২)

———-

গত বছর আমাদের বাগানে শুভ্র ফুল গাছটির পাশে দাঁড়িয়ে সায়ীদ যাদীদ বলেছিলেন, অবাক লাগে দাদা; কঠিন শীতে জমে থাকা পত্র-পল্লব বিহীন এই শুষ্ক ডালপালার ভিতর থেকে এই শুভ্র আর পেলব ফুলেরা জন্ম নেয় কীভাবে? মে মাসের ২৯ তারিখে তিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। গতরাতে তাঁকে স্বপ্নে দেখলাম একসাথে বসে গল্প করছি। এই মূঢ় মনটাকে বলে রেখেছিলাম, যদি দেখা হয় তাকে যেন জিজ্ঞেস করি, জীবনের স্রোত থেমে গেলে আরও এক আলো এসে যখন আমাদের নিয়ে যায় সেখানে কেমন জীবন। সেখানে কি বসন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোটে? ডাহুক, ফিঙে পাখী আর শীতের রাতের পেঁচারা কি সেখানে আছে? সেখানে নদীর স্রোত কোন দিকে বয়? আনন্দ বেদনার কী রূপ সেখানে? মৃত্যুকে অস্বীকার করে তাঁকে কাছে পেয়ে আমার আর কিছুই মনে ছিল না।

যতদিন বেঁচে ছিলেন, সূর্যে সূর্যে বেঁচে ছিলেন। জ্ঞান, আলো আর জিজ্ঞাসার মাঝে তন্ময় থাকতেন। সংস্কৃত ভাষা শেখার তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। বলতেন, প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য আর কবিতার প্রকৃত রস আস্বাদনের জন্য সংস্কৃত জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই বিষয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর খুব প্রশংসা করতেন। (১৭ জুন ২০২২)

——-

কতক্ষণ আগে সায়ীদ যাদীদের কোনোকালের নিবাসের অন্ধকার বারান্দাটুকু পার হয়ে এসেছি। বাড়িটা এখন প্রায়ই থমথমে অন্ধকারে ঢেকে থাকে। সামনে একটি চেয়ার ছিল পাতা, যেখানে বসে তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। কাছে গেলেই দুর্বল দুটি হাত তুলে প্রণাম করে আমাকে বসতে বলতেন। পরিবারের লোকেরা সেই চেয়ারটি এখন সরিয়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে অনেক রাতে যখন সেদিক দিয়ে যাই, ভাবি, কড়া নেড়ে জিজ্ঞাসা করি, অবনী বাড়ি আছো?

(১৯ জুলাই ২০২২)

সায়ীদ যাদীদের লেখাসমূহ