মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে প্রেমের উপন্যাস

সামিনা চৌধুরী

বাংলাদেশের একটি মফস্বল শহর  চাঁদপুরের স্কুলপড়ুয়া অঞ্জন আর মঞ্জুলী’র প্রথম ভালবাসার অনুভূতি দিয়ে উপন্যাসের শুরু। একটু চোখের দেখা, একটু হাসি, ভুল করে হাতে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে হালকা ইশারায় প্রেম।  মুরুব্বীদের পাহারার মাঝেও লুকোচুরি করে করে এগিয়ে যায় কিশোর-কিশোরীর প্রেম। এমনি সময় চলে আসে রক্তঝরা একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে জীবন বাঁচাতে আরো অনেক পরিবারের মত অঞ্জনের পরিবারও মফস্বল ছেড়ে প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যায়। আর মঞ্জুলীর পরিবার চলে যায় ভারতের শরণার্থী শিবিরে। 

এদিকে যুদ্ধ শেষ হলে অঞ্জনের পরিবার যদিও চাঁদপুরে ফিরে আসে, কিন্তু  মঞ্জলীর পরিবার কোলকাতায় রয়ে যায়। দুই শহরে দু’জন তাদের এই ভালবাসা বুকে রেখেই শেষ করে পড়াশোনা।  অঞ্জন জীবন জীবিকার প্রয়োজনে টরন্টো শহরে সংসার পেতে বসে।  মঞ্জুলীর আর বিয়ে করা হয় না। কোলকাতা শহরের ব্যাংকে কাজ করে সংসারের হাল ধরতে হয়। বাবা মায়ের দেখাশোনা, ছোটবোনের বিয়ে এবং সংসারের আরও আরও দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। ছোটবেলার প্রেম ছোটবেলার পুতুলের মতোই পরে থাকে গোপন ড্রয়ারে। লেখকের কলমে মঞ্জুলীর ভাষায় …

“এক জায়গা থেকে অন্যত্র – জীবন জীবিকার কঠিন যুদ্ধে স্বার্থপরের মতো নিজ ভালোবাসা সন্ধান করার চেয়ে তখন প্রতি মুহুর্তে মা-বাবা-ছোট বোনটির বেঁচে থাকার জন্য একটা  কিছু অবলম্বন খোঁজাই বেশী জরুরি ছিল।“ 

এদিকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও রাজনৈতিক পালাবদল হয়। পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে শুরু হয় এক কালো অধ্যায়।  তারপর সামরিক শাসনের দিন এসে বদলে দেয় দেশের চিত্র। এরপর আরও চড়াই উৎরাই-এর পথ শেষে একাত্তরের ঘাতক দালালদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় আসতে হয়। কার্যকর হয় গোলাম আজমসহ আরও কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি।  

যে কিশোর-কিশোরী সারাজীবন একসাথে থাকার স্বপ্ন নিয়ে ভালবেসেছিল, রেললাইনের সমান্তরাল রেখার মত তাদের জীবন বয়ে চলে পৃথিবীর  দুই প্রান্তে।  কোলকাতা শহরে মঞ্জুলী শক্ত হাতে ঘুরিয়ে চলে সংসারের চাকা। আর অন্যদিকে অঞ্জন দুই মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে টরন্টো শহরের ব্যস্ততায় কাটিয়ে যায় জীবন। সময়ের পরিক্রমায় দুজনেই পৌঁছয় মধ্যবয়সে। তারপরও পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকেও দু’জনেই  তাদের মনের রুপোর কৌটোয় স্বযত্নে ভরে রাখে তাদের মখমল দিনের ময়ূরের পালক। সেই পালক কখনও ‘অগুরু’র সৌরভ দেয়; দু’জনকে করে নস্টালজিক। বুকের গভীর থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস। বুকের ক্ষত লুকিয়ে দু’জনেই  জীবনকে বয়ে নিয়ে যায় জীবনের নিয়মে। 

উপন্যাসটি ডায়েরীর মত করে লেখা হয়েছে। এক অধ্যায় অঞ্জনের ডায়েরী৷ পরের অধ্যায় মঞ্জুলীর ডায়েরী।  উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা নিজেদের ভালোলাগার অনুভূতিগুলো নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেছে। বলেছে তাদের প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্ত,  প্রথম দেখাতেই দু’জনের মনের শিহরণ আর নিজের মনের ভাবনার কথা। বলেছে তাদের বিরহের কথা, দূরে থেকেও পুরো হৃদয় জুড়ে থেকে যাওয়া প্রিয় মানুষের জন্য হাহাকারের কথা। ফলে এই দু’টো চরিত্রের মনের ছবি পাঠকের চোখে খুব স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। 

খুব সরল ভাষায় গল্পটি লেখা হয়েছে। পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে আসলেই বুঝি এটি মঞ্জুলী আর অঞ্জনের সেই কিশোর বেলার ডায়রী। কখনো কখনো অঞ্জন মঞ্জুলীর ভালোবাসা বোঝাতে লেখক কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন। ভালোবাসার আবেগ বোঝানোর জন্য কবিতা খুব ভাল একটি মাধ্যম। তাই উপন্যাস পড়া শেষ করেও পাঠকের  মনের ভেতর গল্পের অনুরণন থেকে যাবে অনেক দিন। 

বইটির প্রচ্ছদ করেছেন লেখক নিজেই। প্রচ্ছদে হালকা গোলাপি রঙে উপর কালো রেখাচিত্রের মাধ্যমে একজন অবনতমুখি কিশোরীর মুখাবয়ব আঁকা হয়েছে। কিশোরীর মুখের অর্ধেক চুল দিয়ে আড়াল করা – কপালে লাল টিপ। কল্পনা করে নিতে পারি যে অবনত মুখটি মঞ্জুলীর। মঞ্জুলীরা মুখ তুলে কখনো নিজের ইচ্ছার জন্য জোর করতে পারে না। সারাজীবন মুখ নীচু করে সংসারের সকলের জন্য নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে যায়। কাজেই কিশোরীর এই অবনত মুখ খুব অর্থবহ। কিশোরীর কপালের লাল টিপ যেন মঞ্জুলীকে দেয়া অঞ্জনের কল্পনার সিঁদুর। কপালের লাল টিপ যেন স্বাধীনতার পরও দীর্ঘ সময় রাজাকারের দাপট সহ্য করে থাকার পর  মুক্তিপ্রাপ্ত  বাংলাদেশের নতুন সুর্য, নতুন জীবনের আশার সুর্য। পুরো প্রচ্ছদের গোলাপি রঙ যেন কিশোরী মনের নিষ্পাপ ক্যানভাস। এককথায় খুব অর্থবহ এবং নান্দনিক প্রচ্ছদ।  

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ধর্মের ভিত্তিতে অনেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষকে যেমন ভারতে চলে যেতে হয়েছিল, তেমনি অনেক মুসলমান মানুষকেও বাংলাদেশে চলে আসতে হয়েছিল ভারত থেকে।  ব্রিটিশ রেডক্রসের তথ্যানুযায়ী সেই সময় ১৪ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুহারা হয়েছিল৷  এই দেশত্যাগের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুল্য দিয়েছেন সেই জেনারেশনের মানুষেরা। বাংলা সাহিত্যে সেই সময়ের অনেক গল্প অনেক উপন্যাস আমরা পড়েছি। সেই সময়ের অন্তপ্রবাহ ছিল প্রত্যাশিত যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল। 

কিন্তু ১৯৭১ সালেও আরেকটা বড় ধরনের অন্তপ্রবাহ হয়েছিল। ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজির তথ্যানুযায়ী  ১৯৭১ সালে ১০ মিলিয়ন  হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ গনহত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি লুট হওয়ার ভয়ে ভারতে যায়।  এই অন্তপ্রবাহ ছিল একটি  ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় এবং অপ্রত্যাশিত। কী কারণে এই বিপর্যয় ঘটেছিল,  সে তাত্ত্বিক আলোচনা পাশে রেখে আমার মনে হয়েছে  যে মুক্তিযুদ্ধ  নিয়ে যত গল্প উপন্যাস লিখা হয়েছে, এই অন্তপ্রবাহ বা বিশেষ একটি ধর্মের মানুষের দেশ স্বাধীন  হওয়ার পরেও  দেশত্যাগ করে ভারতে আবার নতুন করে বসত করার যে সংগ্রাম করেছে, সেই সমস্যাটি নিয়ে প্রয়োজনমতো লেখা হয়নি,  যতজখানি লেখা যেত।  এই বিবেচনার উপন্যাসের পটভূমিটি অত্যন্ত মুল্যবান। 

যদিও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে উপন্যাসটি  লেখা হয়েছে, তবুও এটি রাজনৈতিক  উপন্যাস নয়। কারণ শুধু ঐতিহাসিক পটভূমিতে মিষ্টি প্রেমের গল্পটি ছাড়া আর কোন ঐতিহাসিক চরিত্র বা কাহিনিকে এই উপন্যাসে আশ্রয় করা হয়নি। উপন্যাসে যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু হত্যা, গোলাম আজমের ফাঁসি ইত্যাদি বিষয় এসেছে, কিন্ত কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বা ঐতিহাসিক সময়ের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, আশা-নিরাশার টানাপোড়নের চেয়ে অঞ্জন আর মঞ্জুলীর ব্যক্তি-জীবনের টানাপোড়েন বেশি অনুভব করা যায়। ভুমিকাতে লেখক নিজেই বলেছেন …

“কৈশোরে এসে দেখলাম রক্তঝরা ‘৭১। যারা ছিল পড়শি, স্কুলের বন্ধু, তাদের অনেকেই গেল হারিয়ে। দেখা হয়নি আর কখনো। তেমনি দুই কিশোর -কিশোরীর কথা বলা হয়েছে এই উপন্যাসে।“

 উপন্যাসের ৩২ এবং ৩৪ পৃষ্ঠায় বোমা বানাতে গিয়ে চাঁদপুর শহরের চার তরুণের মৃত্যু শীর্ষক একটি খবর আছে। এটি উপন্যাসের স্বার্থে লেখকের কল্পনা নাকি এর পেছনে কোন সত্যতা আছে জানা নাই। কিন্তু যদি এটি সত্যি ঘটে থাকে, তবে তথ্যসূত্র দেয়া যেত। পাশাপাশি গোলাম আজমের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার বিষয়টিও এসেছে। এই বিষয়গুলো আরেকটু বিস্তারিত করে তথ্যসূত্র দিলে, নতুন জেনারেশনের পাঠক, যারা স্বাধীনতা পরবর্তী রাজাকারদের পুনর্বাসন বিষয়ে জানেন না, তাদের জন্য সুবিধা হতো। 

দেশভাগ,  যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয় মানুষের। সব ডামাডোল এক সময় থেমে গেলেও প্রিয়জন হারানোর কান্না থেকে যায় বুকে। তাই লেখকের ভাষায় …

“কান্না সবসময় দেখা যায় না – বোঝাও যায় না। কিন্তু মনতো সবসময়ই কাঁদে! এ কান্না অন্যকে স্পর্শ করে না। ব্যথিত করে না। নিজের মধ্যে নিজেই সান্ত্বনা খুঁজে ফেরে যেন!”

এতো চমৎকার একটি পটভূমিতে মিষ্টি প্রেমের এই উপন্যাসটি অন্য লেখকদের অনুপ্রাণিত করবে এবং ভবিষ্যতে এই পটভূমিতে আমরা লেখকের আরও উপন্যাস পাবো প্রত্যাশা থাকবে। 

কানাডা-প্রবাসী লেখক মামুনুর রশীদ অন্টারিও প্রদেশের লন্ডন শহরে বাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগে পড়াশোনা শেষে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনে  চাকরি করেছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থেকেছেন।  বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্র এবং সংস্কৃতি সংসদের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীও।  

এপর্যন্ত  তাঁর কবিতার দুটি সংকলন,  একটি উপন্যাস, ছোটগল্পের একটি সংকলন, ও  ছেলেবেলার কথা প্রকাশ পেয়েছে। কানাডাতেও তিনি উদীচী শিল্পী গোষ্ঠি র সাথে যুক্ত আছেন। ছোটবোন  রেবেকা চম্পা তাঁর লেখার অন্যতম অনুপ্রেরণা।  তাঁর বাবা মরহুম মোহাম্মদ ফরিদুল্লাহ  একজন ক্রীড়া সংগঠক। মাতা ফয়জুন্নেসা বেগম চাঁদপুর জেলার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি।  

মামুনুর রশীদ উপন্যাস “মঞ্জুলী” প্রকাশ করেছে সুচয়নী পাবলিশার্স, ঢাকা। প্রকাশকাল জানুয়ারি ২০২৩।

নতুন এই উপন্যাসের জন্যে মামুনুর রশীদকে অভিনন্দন জানাই।