মীজান রহমান: দৃপ্ত এক মানবিক বোধের নাম

সুব্রত কুমার দাস

অধ্যাপক ড. মীজান রহমান (১৯৩২-২০১৫) প্রয়াত হয়েছিলেন জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়া মাত্রই টরন্টোর বাঙালি সমাজে গভীর এক হাহাকারের শব্দ শোনা গিয়েছিল। সে শব্দের তীব্রতা পুরো উত্তর আমেরিকা জুড়েই চলেছিল বেশ কিচুদিন। কানাডা-আমেরিকা জুড়ে অনেকগুলো শহরে তাঁকে নিয়ে শোকসভাও হয়েছিল। আমার বর্তমান শহর টরন্টোতেও তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে ৮ ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা সমবেত হয়েছিলেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কারবরো ক্যাম্পাসে। সেখানে মনস্বী এ বাঙালির জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ছাড়াও তাঁর জীবনী নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, তাঁর লেখা বইয়ের প্রদর্শনী, তাঁর রচিত পুস্তক থেকে পাঠ, এবং তাঁর পছন্দের গান ও কবিতা নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বার বার মনে প্রশ্ন জেগেছিল এমন জনপ্রিয় একজন মানুষ কীভাবে হন?

২০১৩ সালের আগস্ট মাসে টরন্টো আসার পর থেকেই এখানকার সুধীসমাজে মীজান রহমান নামটিই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি শুনেছি। দুর্ভাগ্য, আমি ঢাকাতে থাকাকালে তাঁর কোনো বই আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। হয়তো তাঁর কম পরিচিতিই সে না-পাঠের কারণ। মিডিয়ানির্ভর এ সময়ে তাই মীজান রহমান আমার মতো বইপত্রের খোঁজখবর রাখা একজনের কাছেও অপরিচিত থেকে গিয়েছিলেন। রস অপরাধ থেকে নিজেকে কোনোদিনই বোধহয় মুক্ত করতে পারব না। ‘শূন্য’ বইটার নাম এখানকার বন্ধুদের মুখে মুখে থাকলেও দেখা হয়ে ওঠেনি নতুন জীবনের নানাবিধ জটিলতার কারণে। যে কারণে প্রবাসজীবনের বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে নতুন বইপত্র না পড়েই, না দেখেই। এরপর এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০১৪ সালের এপ্রিলের ২৭ তারিখে টরন্টোতে আমার সবচেয়ে প্রিয়জনদের একজন আকবর হোসেন তাঁর বাসাতে নিমন্ত্রন করলেন। জানালেন নিমন্ত্রিত অন্যদের মধ্যে থাকবেন মীজান রহমানও।

১৯৬৫ সাল থেকে অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে একনাগারে তেত্রিশ বছর অধ্যাপনা করা মানুষটির গাম্ভীর্য নিয়ে খানিকটা যে আতঙ্কিত ছিলাম না, তা নয়। আমার চেয়ে ৩২ বছর বয়সে বড়ো, উত্তর আমেরিকাতে প্রতিষ্ঠিত একজন প-িত মানুষ বাংলাদেশ থেকে সদ্য আগত চালচুলোবিহীন এক লেখককে কীভাবে গ্রহণ করবেন সে ভয়টা নিজেকে সঙ্কুচিত করে রেখেছিল বৈকি। কিন্তু সে সন্ধ্যেটা যে এতো নিঃশঙ্ক এতো নির্ভার হয়ে উঠবে তা কি আকবর ভাইয়ের বাসাতে ঢোকার আগে মনের গোপন অন্দরেও অনুমিত হয়েছিল?

‘আরে সুব্রত, আপনার সাথে আলাপের জন্যেই বসে আছি। অনেক গল্প শুনেছি আপনার বিষয়ে’- একম একটি বাক্য মুহূর্তেই ঝেড়ে দিয়েছিল আমার সব শীতলতা। আমি আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম তিনি আমার কতো যে আপন। সেদিনের দীর্ঘ আড্ডায় তাঁর কথা যতো না শুনেছি, তারচেয়ে বেশি তিনি আমার কথা শুনেছেন। প্রাচীন ভারতীয় চিন্তা, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল নিয়ে আমার মতো বয়োকনিষ্ঠ কোনো লেখকের ভাবনা যে এতো প্রতিষ্ঠিত কেউ জানতে চাইতে পারেন তা ছিল আমার আছে অচিন্তিতপূর্ব। আগস্ট মাসে আরও একবার একই বাসাতে আড্ডা হলো।

এরপর তাঁর সাথে আমার বারকয়েক ফোনে কথা হয়েছে। তাঁর বিনয় প্রতিবারেই আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রতিবারই যেন আবিষ্কার করেছি তিনি আরও খানিকটা যেন বেশি কাছের হয়ে গেলেন। ১৬ আগস্ট টরন্টোতে হলো উত্তর আমেরিকা নজরুল সম্মেলন। সেখানে কথা বলার আমন্ত্রন পেলাম। আয়োজকরা আমাকে চিনতেন না, নজরুল নিয়ে আমার বইয়ের কথাও জানতেন না। মীজান রহমানই আসল আমন্ত্রক। সম্মেলনে তাঁর সাথে একই মঞ্চে বসার সুযোগ হলো। আমার পরে তাঁর বক্তৃতা। লিখিত সে অসাধারণ বক্তৃতাতে তিনি আমার রচনা থেকে পাঁচ-ছয়বার উদ্ধার করলেন। করার সময় তিনি প্রতিবারেই আমার দিকে যখনই ইঙ্গিত করছিলেন আর আমি প্রতিবারেই বিস্মিত হচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, আমি তো তাঁর বই তখনও পড়ে উঠতে পারিনি, অথচ তিনি- মহৎ হৃদয়ের মানুষেরা হয়তো এমনই হন। পরবর্তীতে বিডিনিউজে সে লেখা ছাপা হলে আমি অধিকতর বিস্মিত হয়েছি।

একদিন প্রাণ ডুকরানো কান্না ছড়িয়ে তিনি চলে গেলেন। কান্না যখন থামলো তখন টরন্টোর বন্ধুরা সমবেত হলেন তাঁর বিরাটত্বকে আরও বেশি করে জনসমাজে ফুটিয়ে তুলতে। বৈঠকের পর বৈঠক হলো। আয়োজকদের নেতৃত্বে এলেন সর্বপ্রিয় আকবর হোসেন, নাসির-উদ-দুজা, টিটো খন্দকার, দেলওয়ার এলাহী, শেখর ই গোমেজ, শওগাত আলী সাগর, হাসমত আরা চৌধুরী জুঁই, প্রতিমা সরকার এবং হোসনে আরা জেমি। মজার বিষয় হলো টরন্টোর বাঙালি সমাজে শিল্প-সংস্কৃতির সাথে যুক্ত বিপুলসংখ্যক মীজান-ভক্তের এই তালিকাভুক্ত বোদ্বাজনদের সাহচর্য নতুন জীবনপথে আমার পাথেয় হয়ে উঠল। টরন্টোর পুরো বাঙালি সমাজ অপেক্ষায় থাকল প্রয়াত সে বিদ্বৎজনের স্মৃতির সম্মানে আয়োজিত সভাতে উপস্থিত হতে, প্রাণের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে।

কিন্তু তাঁকে নিয়ে বিস্ময় তো কাটবার নয়! আমার কাজের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ দেখে যে বিস্ময়ের শুরু, তাঁর প্রতি এতো বিপুল সংখ্যক মানুষের ভালোবাসা দেখে সে বিস্ময় ঊর্ধ্বগামী। বোধ করি সে বিস্ময় কখনই হ্রাস পাবার নয়। যখন তাঁর বইগুলো আমার টেবিলে ছড়িয়ে থাকে চারপাশে আমি সেটা বুঝতে পারি। আমি যখন এক বৈঠকে আগ্রহ প্রকাশ করছিলাম তাঁর গ্রন্থ প্রাপ্তির, মীজান রহমানের আরেক প্রিয়ভাজন আকতার হোসেন শর্তহীনভাবে বরফের ভেতর পঞ্চাশ মাইল গাড়ী ঠেলে সেগুলো আমার বাসার দরজায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন।

তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর দিকে যদি চোখ ফেরাই দেখা যাবে সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থটি হলো ‘শূন্য’। মৌলিক গ্রন্থ নয় সেটি, তবে রয়েছে গভীর পঠনের ছাপ। রয়েছে লব্ধ জ্ঞানকে সাধারণের উপযুক্ত করে উপস্থাপন করার উদ্যোগ। ২০১২ সালে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকেই। উল্লেখ করা যেতে পারে ২০০৯ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ভাবনার আত্মকথন’ ছাড়া বাকি সবগুলোই ঢাকা থেকে প্রকাশিত।

শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী প্রমূখের সমসাময়িক মীজান রহমান একই সময়ে লেখালেখি শুরু করেছিলেন আনওয়ার মীজান নামে। পিতৃদত্ত নাম মীজানুর রহমান নিয়েই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘তীর্থ আমার গ্রাম’ ১৯৯৪ সালে। একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত সে গ্রন্থ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে গ্রন্থের শিরোনাম দেখে বুঝতে পারি নিজ ভূমির প্রতি কী বিশাল টান ছিলো তাঁর হৃদয়ের গভীরে।

ড. মীজান রহমানের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘লাল নদী’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০১ সালে। প্রকাশক ছিলেন সে সময়ে মন্ট্রিয়লবাসী আলম খোরশেদ। বোঝা যায় গ্রন্থের সামগ্রিক কাজটিও হয়েছিল ঢাকাতেই। প্রথম থেকেই মীজান রহমান নিজের দীর্ঘপাঠ এবং অভিজ্ঞতাসঞ্জাত প্রজ্ঞাকে আধেয় করেছিলেন তাঁর রচনাতে। ক্রমশ সেসবে মূর্ত হতে থাকে তাঁর জীবনবোধ।

২০০২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দুটি গ্রন্থ- ‘অ্যালবাম’ এবং ‘প্রসঙ্গ নারী’। অনুমান হয় তাঁর শুধুমাত্র এ দুটি গ্রন্থই দ্বিতীয় মুদ্রণ পেয়েছিল। দুই বছর পর প্রকাশিত হয় পঞ্চম গ্রন্থ ‘অনন্যা আমার দেশ’। পরের গ্রন্থ ‘আনন্দ নিকেতন’ প্রকাশ পায় ২০০৬ সালে। পরবর্তী গ্রন্থগুলো হলো ‘দুর্যোগের পূর্বাভাষ’ (২০০৭) এবং ‘শুধু মাটি নয়’ (২০০৯)।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ভাবনার আত্মকথন’ (২০০৯) এর রচনাগুলোর অধিকাংশই পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোতে অন্তর্ভুক্ত। ধারণা করা যায় তাঁর চিন্তা-চেতনার প্রতিফলনকারী প্রধান রচনাগুলোকে তিনি গ্রথিত করেছিলেন ‘ভাবনার আত্মকথন’-এ। অসামান্য এক সংকলন। তাঁর সকল রচনার প্রধান বৈশিষ্ট গভীর প্রত্যয় এবং দার্ঢ্য। স্বাদু গদ্যে সেসবের প্রকাশে সফলতার চূড়ান্তে পৌঁছেছিলেন যৌবনোত্বর পুরোটা সময়ে প্রবাসী এই লেখক।

জীবনকে তিনি যে সোজাভাবে দেখেছেন, সেই ভাবটাই তাঁর রচনাতে মূর্ত। তিনি সত্যের প্রশ্নে, ন্যায়ের প্রশ্নে নির্ভীক ছিলেন। বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর কল্যাণে আবশ্যিক যে শুভ চেতনা তার বোধ থেকে কখনও পিছুপা হননি তিনি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অসুস্থতা এবং মৌলবাদের উত্থান নিয়ে তাঁর ছিল গভীর উদ্বেগ। ধর্মের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল সে মানুষটির রচনাতে পাওয়া যায় ধর্মের ধ্বজাধারীদের অসহিষ্ণু মানসিকতার প্রতি ক্ষোভ এবং ব্যঙ্গ। ছিল সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার আহ্বান। তিনি বিশ্বাস করতেন সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতায়।

তিনি যখন লেখেন, ‘ধর্মে মৌলিক প্রশ্নের কোনো প্রশ্রয় নেই, আছে অবান্তর প্রশ্নের’ আমরা বুঝতে পারি তিনি মৌলিক প্রশ্নে আগহী। অধিকাংশ মানুষের মানুষ হতে পারার ব্যর্থতা চিহ্নিত করে তিনি তাই আহ্বান জানান, ‘দেশের ভাগ্য বদলাতে মানুষকে বদলাতে হবে। অর্থাৎ মানুষকে মানুষ হতে হবে।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আজকের জগতে সত্যিকারের সংখ্যালঘু হল মানুষজাতি। বিশেষ করে আমাদের দেশে।’

বাংলাদেশের প্রতি নিরত প্রেমী মীজান রহমানের দেশ ও সমাজের প্রতি ঋণের স্বীকার ছিল পৌনঃপুনিক। তিনি যখন লেখেন, ‘সন্দেহ নেই যে আমি দেবার নাম করে পাবার উল্লাসে চষে বেড়িয়েছি সারাদেশ। সন্দেহ নেই যে দেশ আমাকে হারায়নি, আমি দেশকে হারিয়েছি’ তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দেশচ্যুত মানুষটির ভেতরে ছিল সর্বক্ষণের রক্তক্ষরণ। তাই তাঁর বিলাপ, ‘মানবিক ইতিহাসের গূঢ় তথ্য কি এই নয় যে নিজের দেশ যে হারিয়েছে একবার তার ভাগ্যে দেশ বলতে আর কোন জিনিস থাকে না।’ সে বছর মাতৃভূমি দর্শনে তাঁর যাওয়ার কথা ছিল ৭ জানুয়ারি। এরপর কোলকাতার বইমেলাতে নিজের নতুন প্রকাশিতব্য গ্রন্থের উদ্বোধনে তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন এমনটিও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু প্রকৃতির কঠোর নিয়মকে অবজ্ঞা করতে পারেননি মানবতাবাদের কঠোর অনুসারি মীজান রহমান।