মিস্টার প্রেসিডেন্ট
আবুল হাসান (কায়সার) চৌধুরী
সদ্য প্রকাশিত ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ উপন্যাসের নায়ক হলেন জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী, আমার পিতা। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোয় যখন স্লোগান দেওয়া হতো ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ ঠিক সেই সময়টাতে আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দেন। এর আগে তিনি ছিলেন হাই কোর্টের একজন বিচারপতি। ১৯৭১-এর মার্চে তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভা যান। পরিবারের বড় ছেলে, অর্থাৎ আমি তখন লন্ডনে পড়ালেখা করছিলাম। আমার সঙ্গে কিছুদিন থাকবেন বলে ছোট ভাই খালেদ ও বোন শিরিনকে নিয়ে আম্মাও তখন আব্বার সঙ্গে চলে আসেন। আম্মা যখন আমার সঙ্গে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন তখন জেনেভার একটি পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ পড়ে আব্বা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে শিক্ষা সচিবকে এক পত্রে লিখেন, ‘আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম।’
এরপর অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে দেশের সার্বিক চিত্র বদলে যায়। বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশ স্বাধীন করার জন্য। আব্বা ২৬ মার্চে জেনেভা থেকে লন্ডনে চলে আসেন। পরদিন সকালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে বসেই ঢাকা থেকে পাঠানো ব্রিটিশ হাইকমিশনের বিশেষ টেলেক্সের মাধ্যমে জানতে পারেন ২৫ মার্চের সার্বিক চিত্র। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রবেশপথে অপেক্ষমাণ আবু সাঈদ চৌধুরীর বর্ণনা দিয়েই শুরু ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ উপন্যাসের। এরপর দীর্ঘ নয় মাস ধরে প্রবাসের বাঙালিরা যা যা করেছে তার একটি বড় চিত্র ফুটে উঠেছে এ বইটিতে। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত মুজিবনগর সরকারের আমন্ত্রণে আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের বিশেষ দূত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে যেভাবে কর্মব্যস্ত ছিলেন সেটাই মিস্টার প্রেসিডেন্ট বইটির বিস্তার।
১৯৮৭ সালে আমার পিতা এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যখন তাঁকে ভুলেই গেছে তখন তাঁর মৃত্যুর ৩৪-৩৫ বছর পর তাঁকে নায়কের চরিত্রে বসিয়ে লেখা উপন্যাসটি আমার হাতে এসেছে কয়েকদিন আগে। বইটি লিখেছেন প্রবাসী লেখক আকতার হোসেন। গেল বছর ছিল আব্বার শততম জন্মবার্ষিকী। মিস্টার প্রেসিডেন্ট বইটিও প্রকাশিত হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে অর্থাৎ আব্বার শততম জন্মবার্ষিকীতে। ২৪০ পৃষ্ঠার এ বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন রাজীব রায় এবং প্রকাশ করেছে ঢাকার নন্দিতা প্রকাশ। অনেক আগ্রহ নিয়ে এ বইয়ের কাজে হাত দিয়েছিলেন প্রকাশক ভবো রঞ্জন বেপারী। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কভিড আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যাওয়ার কারণে বইটির মুদ্রিত অংশ দেখে যেতে পারেননি। যেমন আমার পিতা জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরীও তাঁর ধারাবাহিক লেখা ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ শেষ করার আগেই মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে ‘দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড’ থেকে সেটি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সাহায্য করা, মুক্তিযোদ্ধাদের হাত শক্ত করার জন্য প্রবাসী বাঙালি ও বিদেশি বন্ধুদের যে কত বড় ভূমিকা ছিল তার বেশ কিছুটা অংশ তুলে ধরা হয়েছে আব্বার অসমাপ্ত লেখা ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ বইটিতে। অতটুকু যদি তিনি লিখে যেতে না পারতেন তবে আজ অনেক কথাই অজানা রয়ে যেত। লেখক আকতার হোসেনের ভাষ্য হলো, এ বইটি পড়ার পর থেকেই তিনি ভাবতে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকা নিয়ে একটা সিনেমা করার। ইংরেজি ভাষায় এ সিনেমা প্রকাশ করার উদ্দেশ্য হলো বহির্বিশ্বের কাছে নতুন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তুলে ধরা। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্ম যেন জানতে পারে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে একসময় কী পরিমাণ অন্যায় ও জুলুম করা হয়েছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির ওপর। আকতার হোসেন ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে কানাডায় অবস্থান করছেন। নয় বছরের একটা দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৮ সালে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। হঠাৎ একদিন আমার ছোট বোন শিরিনের কাছে একটি ফোন আসে। ফোনটি করেছিলেন অ্যাম্বাসাডর সোহরাব হোসেনের স্ত্রী রওশন হোসেন। যিনি সম্পর্কে আকতার হোসেনের ছোট বোন। রওশন হোসেন বলেন, তার ভাই আমাদের পরিবারের সঙ্গে একটু দেখা করতে চান। উদ্দেশ্য আমাদের পিতাকে নিয়ে তিনি একটি বই লিখতে আগ্রহী। এর কিছুদিন পর শিরিনের বাড়িতেই আমাদের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। আকতার হোসেনের সঙ্গে সেই প্রথম দেখা। তিনি বললেন, অনেক অপেক্ষা করলাম এখন বুঝতে পারছি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্রবাসী বাঙালিদের অবদান নিয়ে সিনেমা করার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা আমার দ্বারা আর সম্ভব হবে না। বিখ্যাত গান্ধী সিনেমার আদলে একটা সিনেমা করতে পারলে নতুন প্রজন্মকে অন্যভাবে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ফিরিয়ে আনা যেত। যেখানে বেশির ভাগ অংশে বিদেশ ও বিদেশিদের অন্তর্ভুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা পুনরায় ফুটিয়ে তোলা যেত। কিন্তু সময় ফুরিয়ে গেছে। এখন আপনারা অনুমতি দিলে অন্তত একটা উপন্যাস লিখতে চাই। আমার ছোট ভাই খালিদ বলেছিল উপন্যাস তো অনেক বড় কাজ আর তা ছাড়া উপন্যাসের চরিত্রে কি আব্বাকে মানাবে। আকতার হোসেন উত্তর দিয়েছিলেন আপনার আব্বা যত বড় তার থেকে ছোট করেই কাজটা করব। এরপর আমিও তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসের নায়ক চরিত্রে আবু সাঈদ চৌধুরী কেন? দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে লিখতে চাইলে অনেক বড় বড় ব্যক্তি আছেন যাদের নিয়ে এখনো তেমন কিছু লেখা হয়নি। অর্থাৎ আব্বাকে কেন বেছে নিচ্ছেন? তারও একটা সুন্দর জবাব দিয়েছিলেন তিনি। জবাবটা এ রকম- আজকাল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকেই বই লিখছেন। তার বেশির ভাগই লেখকের নিজস্ব বক্তব্য। আমি এমন একটি চরিত্রের আশ্রয় নিতে চাই এবং তাঁর মুখ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে আমার নিজের সীমানার বাইরে নিয়ে যেতে চাই। বলা বাহুল্য, আমাদের পরিবারের অনুমতি নিয়েই লেখক বইটির কাজ শুরু করেন। মিস্টার প্রেসিডেন্ট এখন বইমেলায় নন্দিতা প্রকাশের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। বইটি ইংরেজি অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছেন কলকাতার বিশিষ্ট অনুবাদক, শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত। মিস্টার প্রেসিডেন্ট আমার হাতে আসার পর দেখলাম লেখক যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তাঁর কথা রাখতে। বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখা একটি অংশে তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘এই দুই বাঙালিই হলো জোড়াসাঁকো। বাংলার নির্ভেজাল প্রাপ্তি। জানেন চৌধুরী, আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কোনো আফসোসের কথা যদি এ মুহূর্তে বলতে হয় তা হলো, তিনি শেখ মুজিবের কীর্তি দেখে যেতে পারলেন না। রবীন্দ্র-মুজিবের জোড়াসাঁকোতে বাঙালিরা বহু যুগ ধরে হেঁটে বেড়াবে এই আমি আপনাকে বলে দিলাম।’
পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা যে কত জরুরি ছিল তা বুঝতে পেরে আবু সাঈদ চৌধুরী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, মন্ত্রী, এমপি, বিচারক, শ্বেতাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের কাছে গিয়ে জোর গলায় দাবি করতেন ইয়াহিয়াকে চাপ দিতে। লেখক এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, ‘আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনী শুধু মনের বল ও রণনৈপুণ্যের দ্বারা সেকেলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ডেনমার্কের সহানুভূতিশীল সরকার, জনগণের অনুপ্রেরণা পেলে নিশ্চয়ই আমাদের স্বীকৃতি দেবেন। আপনারা পত্রিকার পক্ষে থেকেই ডেনমার্কের জনগণকে সত্য খবর জানাতে থাকবেন সেটাই আশা করি। শেখ মুজিব একটি দেশের রাষ্ট্রপতি। বাঘের মতো যার সাহস তিনিই আবার ফুলের মতো কোমল। তাঁর দেশের নাম বাংলাদেশ। তাঁর বিদ্রোহ অন্য একটি দেশের বিরুদ্ধে। সে দেশের নাম পাকিস্তান। এটাই সত্য। আশা করি বাকি অংশটা আপনারা জানেন। যতটুকু জানেন না সেটা জানাতেই আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আপনারা প্রশ্ন করুন।’
হাতিয়ার তুলে নিয়ে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে আকতার হোসেন জাতি-নিধন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যুক্তি তুলে ধরেছেন। ছক এঁকে অর্থাৎ এথনিক ক্লিঞ্জিংয়ের মাধ্যমে নিষ্ঠুর হত্যালীলার যে পরিকল্পনা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতারা একত্রে বসে করেছিল, সে চক্রান্ত রুখতেই নিরীহ বাঙালিরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল বলে তিনি মত দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র নাটকে অভিনয় করা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা হঠাৎ একদিন ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন। তাদের একসঙ্গে প্লেনে উঠিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়া হলো। ভয়াবহ কিছু যে হতে যাচ্ছে সেটা আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা টের পেয়ে গেলেন। কিন্তু কেউ মুখ খুললেন না। একজন নেতাও না। একটি দলও না। অথচ এরা রাজনীতি করে দেশের মানুষের জন্য। আইনগতভাবে পূর্ব পাকিস্তান তখনো পাকিস্তানের অংশ। অথচ দেশের জনগণের বিপদের দিন বিমান ভর্তি করে পালিয়ে আসা মানুষদের আমরা কোনো দিনও মাফ করব না। যে রাজনৈতিক নেতারা শুধু বাঙালি হওয়ার কারণে আমাদের বিপদে রেখে চলে এসেছে ইতিহাসের খাতায় তারা পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি। এরা কেউ কিছু বলেনি বলেই পরের দিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও কাউকে কিছু না জানিয়ে প্লেনে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে গেলেন। আমার দেশের মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল শুধু বন্দুক কামান আর ট্যাংক।’
১৯৭১ সালের নয় মাসের সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালিরা যা যা করেছেন গল্পের আকারে মিস্টার প্রেসিডেন্ট বইটিতে তা তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসে বিয়োগান্ত ঘটনার ক্ষেত্রে আমার পিতার করুণ মৃত্যুকে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকে হয়তো মনে রেখেছেন যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন লন্ডনের পাতালরেলের প্ল্যাটফরমে। তাঁর মৃত্যুর করুণ বর্ণনা দিয়েই বইটির সমাপ্তি টানা হয়েছে। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেসব চিত্র পুনরায় পড়ে। তা ছাড়া প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ সরকারের নির্দেশে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে যে বক্তৃতা লেখক কল্পনাশক্তি দিয়ে তৈরি করেছেন সত্যিকার অর্থে আমার পিতা সে রকমই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘যে দায়িত্ব আমাকে মুজিবনগর সরকার বিশ্বাস করে দিয়েছিল আমি তা পালনে সচেষ্ট থেকেছি। বাংলাদেশের মানুষ কেন মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল তা বহির্বিশ্বের কাছে যতটুকু সার্থকভাবে তুলে ধরা সম্ভব সে চেষ্টা আমি করেছি। বাংলার নিরীহ অসহায় মানুষ এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি যতটুকু সহানুভূতি আদায় করা সম্ভব আমরা তা সমবেতভাবে চেষ্টা করেছি। গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে অন্য দেশের নাগরিকবৃন্দকে আমরা সঠিকভাবে জাগাতে পেরেছি। প্রবাসী বাঙালিরা সংঘবদ্ধ হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তা বিশ্ব ইতিহাসে দুর্লভ। বাংলাদেশ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিপুল বিস্তার ঘটিয়ে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এত বড় দেশ দেখেনি বিশ্ব। এত কর্মচঞ্চল হয়নি কোনো দেশের মানুষ।’ আবু সাঈদ চৌধুরীর মৃত্যুর এতগুলো বছর পর একজন অচেনা-অজানা লেখকের হাতে লেখা মিস্টার প্রেসিডেন্ট পড়ে আমি সত্যি আবেগে আপ্লুত। মিস্টার প্রেসিডেন্ট বইটিতে আমার নামও বেশ কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে। এত দিন পর আমিও ইতিহাসের পাতা উলটে দেখতে সমর্থ হয়েছি। আজ মনে পড়ছে কত নাম, কত সংগ্রামের দৃশ্য। আশা করছি আগ্রহী পাঠকরা আমার মতোই অনেক কিছু জানতে পেরে শুধু অবাকই হবেন না, মিস্টার প্রেসিডেন্ট সংগ্রহে রাখার লোভ সামলাতে পারবেন বলে মনে হয় না।
সবশেষে কবি আসাদ চৌধুরীর কিছু কথা দিয়ে শেষ করছি। প্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী মিস্টার প্রেসিডেন্টের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেছেন, আকতার হোসেনের গদ্য ভঙ্গিটি ভারি সুন্দর। একটি দৃষ্টান্ত দিই- “বুক পকেট থেকে কলম বের করে আন্ডারলাইন করলেন কেনেথ ক্লার্কের উদ্ধৃতি; ‘জিন্নার একতার স্বপ্ন রক্তে ধুয়ে-মুছে গেছে। একই কলম দিয়ে লন্ডন টাইমসের ওপর মোটা দাগে আন্ডারলাইন করলেন আরেকটি খবর, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। কলমের দাগ গুরুত্বপূর্ণ খবরের নিচ দিয়ে কালো নদীর মতো বয়ে যেতে থাকে। একের পর এক ছোট ছোট নদী ফুটে উঠতে লাগল তাঁর হাতে।’ এরকম ঝকঝকে গদ্যেই বইটি লেখা। এ বইয়ে বাঙালির ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে জনাব চৌধুরীর বিস্ময়কর ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় তুলে ধরেছেন আকতার হোসেন। সব মিলিয়ে ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ আমার পড়া বইগুলোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই, কোনো সন্দেহ নেই।”
লেখক : সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।