মহাভারতের নিবিড় পাঠ

নৃপেন্দ্রলাল দাশ

মহাভারতকে বলা হয়ে থাকে  শ্রুতিরূপ জোৎস্না, বলা হয়ে থাকে পঞ্চমবেদ। এতে এই মহাকাব্যটির প্রচ্ছদ মোড়া হয়ে যায় ধর্ম-ভাবুকতায়। আবার মহাভারতকে ইতি-আস অর্থাৎ ইতিহাস রূপেও তাঁর চরিত্রকে শনাক্ত করা হয়ে থাকে। সুব্রত কুমার দাস মহাভারতকে বলেছেন, আমার মহাভারত। আমার মহাভারত মানে যা তাঁর নিজস্ব অধীত বিদ্যার ফল তাই তিনি পরিবেশন করেছেন প্রজ্ঞার পানপাত্রে। মূর্ধন্য প্রকাশন এই ধীমান বই প্রকাশ করে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। সম্ভবতঃ বাংলাদেশে এটাই সর্বপ্রথম প্রকাশিত মহাভারত বিষয়ক বই যা মননশীলতায় ও নিজস্ব বিবেচনায় ভাস্বর। বইটির প্রথম প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০১০। পরবর্তী সংস্করণ হয় ২০১৪ তে।

সুব্রত আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস ও সাধারণীকৃত ধারণার বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন। সাধারণ হিন্দুর কাছে মহাভারত একটি ধর্মগ্রন্থ। বর্তমান লেখক সে ভাবে মহাভারত পাঠ করেননি। তিনি সাহিত্যগ্রন্থ রূপে মহাভারতের সমীপবর্তী হয়েছেন। মুক্তমন ও স্বচ্ছ ধারণাই ছিল তাঁর বাহন। আমার মহাভারত নামটি বলে দেয়, তাঁর যা নিজস্ব চিন্তা মহাভারত সম্পর্কে, তিনি সেটিই প্রকাশ করেছেন। তবে আলাদা রকম কোন ডগমার আমদানি করেননি। তাঁর গদ্য মেদহীন, প্রায় অলংকার বর্জিত, শুধু তথ্যের কাছে বিশ্বস্থ থাকার প্রয়াস। লেখক তত্ত্বের পরিধি বেয়ে বৃত্তাবদ্ধ করেননি তাঁর চিন্তনকে।

আমার কাছে এ গ্রন্থ পাঠ সুখকর হয়েছে এ  কারণে যে তিনি বহু অজানা তথ্য উপহার দিয়েছেন আমাদের। যদিও তাঁর নির্দেশ প্রযুক্তি নির্ভর তবুও অভিনন্দনযোগ্য এ কাজ। প্রারম্ভিক অধ্যায়টি আমার মহাভারত প্রীতি। শিক্ষিত অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু পরিবারের সন্তানের একই রকম অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তবে আমি মোহিত হয়েছি তাঁর নাম না জানা দাদুটির জীবনচর্চা পাঠ করে। যিনি হত দরিদ্র হয়েও ছিলেন অভিনিবেশী মহাভারত পাঠক। তবে সে পাঠ ছিল পূণ্যলোভে সমর্পিত এক বৃদ্ধের পাঠ।

মহাভারত নিয়ে নামের অধ্যায়টিতে তিনি মহাভারত বিষয়ে গভীরতা স্পর্শী আলোচনা করেছেন। অনেক মূল্যবান গ্রন্থের কথা লিখেছেন। মহাভারত নিয়ে ভাবুকদের নানা তথ্য দিয়েছেন। তাঁর মূল অভিযাত্রা সম্ভবতঃ যাকে ইংরেজিতে বলে ইনফরমেশন বা তথ্যের যোগান দেয়া সেই দিকে। মহাভারতের ফিলসফি বা দর্শন প্রস্থানের দিকে নয়। তাঁর ব্যাপক পাঠ পরিধির খবর পাই এখানে। নিবিষ্ট একজন পাঠক মহাভারতের নানা আঙ্গিক কুশলতাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন – এটা বড়ই উপভোগ্য। অনেক মহাভারত বিষয়ক বইয়ের নাম পাই এখানে। যদিও একটা অতি উল্লেখযোগ্য বই বিষয়ে তিনি কিছুই বলেন নি দেখে হতবাক হয়েছি। সর্বজ্ঞ এই মহাভারত পাঠক নিশ্চয় জানেন যে, পুনের একদল গবেষক দীর্ঘদিনের শ্রমে মহাভারতের একটি শুদ্ধপাঠ তৈরি করেছিলেন। তাই বইটির শিরোনাম উল্লেখ করি- The Mahabharata, For the first time critically edited । Vishnu S. Sukthankar সম্পাদিত সে গ্রন্থটি ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল পুনের Bhandarkar Oriental Research Institute থেকে। সুব্রতকে ধন্যবাদ জানাই তিনি এত সব বইয়ের নাম আমাদেরকে জানিয়েছেন। মহাভারত বিষয়ে এত বহুলো, এত বহুমেধার বিস্তার করেছেন। সুব্রত কুমারের মহাভারত বিষয়ক পাঠ আয়তন যে কত বিশাল এ লেখা তার প্রমাণ। আবেগহীন গদ্যে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি একান্ত নিষ্ঠার তিনি এ কাজ করেছেন। মহাভারতচর্চা যে মহাভারতের মতো অমেয় ও বিপুলায়তন।

এ গ্রন্থের দুটি প্রবন্ধের কাছে আমি অর্ধমর্ণ। মহাভারতের পশ্চিম যাত্রা, একটি পর্যবেক্ষণ প্রচেষ্টা ও বাঙালির মহাভারত। এ দুটি প্রবন্ধে অনেক তথ্যের রাজমোটক মিলন ঘটিয়েছেন লেখক। তিনি যে গবেষক সেই পরিচয় এখানে সোচ্চারভাবে মুদ্রিত হয়েছে। তবে এক ধরনের অপূর্ণতা আমাকে পীড়িত করে। গ্রন্থ তালিকার মতো অনেক বইয়ের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন। আমাদের তথ্য ভাণ্ডারকে পূর্ণ করেছেন কিন্তু মননযোগ প্রায় অনুপস্থিত। সবগুলি সম্ভব নয়, অন্ততঃ প্রধান ও মূল্যবান বই সম্পর্কে মননশীল আলোচনা করা যেতো – তা তিনি না করে শুধু নাম উল্লেখ করেছেন মাত্র। ফলে সেই সব লেখকদের সারস্বত পরিচয় থেকে পাঠক বঞ্চিত হয়েছেন।

মহাভারত প্রসঙ্গে মহাভারত মঞ্জরী একটি মৌলিক তথ্য নির্ভর আলোচনা। এ বইয়ের মধ্যে এটাই একেবারে নতুন একটা প্রসঙ্গ। যা পূর্বে কোথাও আলোচিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে অন্য আরেকটির মহাভারত কথার উল্লেখ করা যায়। সিলেটের সঞ্জয় রচিত মহাভারত। যে গ্রন্থটি নিয়ে সুনীলকুমার বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন। এই মহাভারতে দ্রৌপদীর যুদ্ধ বলে একটা অধ্যায় রয়েছে, যা অন্য কোন মহাভারতে নেই।

রবীন্দ্রনাথের মহাভারতচর্চা প্রবন্ধও খুব মূল্যবান। এখানে রবীন্দ্রনাথের মহাভারতচর্চার একটা পূর্ণায়বয়ব পরিচয় পাওয়া যায়। মহাভারতে গীতা বিষয়ে অমলেশ ভট্টাচার্যও ব্যাপক আলোচনা করেছেন। ১৮ সংখ্যা বিষয়ে আলোচনা ও কৌতুহলকে জাগ্রত করে। বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী এ বিষয়ে নানা খুঁটিনাটি আলোচনা করেছেন। পৌরাণিক ইতিহাসে শ্রীকৃষ্ণ অধ্যায়টিও মূল্যবান।

ব্যাস এবং ব্যাস প্রসঙ্গ নানা সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। ব্যাস ব্যক্তি নাম না গোষ্ঠী নাম এ বিতর্ক একটি জটিল বিষয়। জৈমিনি মহাভারত বিষয়ক প্রবন্ধটি অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়।

আমার মহাভারত আমাদের চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করে। আমরা ধর্মীয় পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে যাতে মহাভারতের রস আস্বাদন করতে পারি এ বোধে প্রাণিত করে বইটি। মহাভারতের প্রভাব যে পৃথিবী নামক গ্রহের সর্বত্র প্রসারিত এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ বই পাঠের পর।

কবি বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন মহাভারত কোন নান্দনিক সূত্রে বিচার্য্য নয়। এ কথাটা যে সঠিক নয় তা প্রমাণ করলেন গবেষক সুব্রত কুমার দাস। তিনি চেষ্টা করেছেন দেখাতে বহু ভাষায় অনূদিত এই মহাকাব্য মানুষের ভাষা ও ভূগোলকে পেছনে ফেলে কিভাবে এক মানবিক প্রত্যয়তন্ত্রকে প্রসারিত করেছে। আকারে শোভন, প্রকারে সাহিত্য আর বিশ্বাসে আধুনিক মানুষের চিন্তার দোসর মহাভারত সারা জীবনব্যাপী চর্চার বিষয় একথাও বলেছেন লেখক। তাঁর এই ঘোষণার পরিচয় পাই ইংরেজি ডেইলি সান পত্রিকায় প্রকাশিত সুব্রতের ইংরেজি প্রবন্ধটি Reading the Mahabharata শিরোনামের তিন কিস্তিতে প্রকাশিত দীর্ঘ প্রবন্ধটিতে ।

এই কথাটি বলতেই হবে এ বইয়ে পাঠকের দু’টি দাবী পুরণ করেন নি লেখক। এক: বইটির শেষে সহায়ক গ্রন্থের তালিকা নেই। বোধ নামক লিটল ম্যাগের প্রয়োজনীয় প্রকাশন তথ্য দেয়া হয়নি। যার কাছে লেখক তাঁর নিজের ঋণ স্বীকার করেছেন। পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশকের কথা যথাযথভাবে দেয়া হয়নি। দুই: বইটিতে একটা নির্ঘন্ট যুক্ত করা দরকার ছিল।

মহান একুশের বইমেলার বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে সুব্রত কুমার দাস আমাকে বইটি দিয়েছিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে কোন মতামত জানাইনি। নিবিড় পাঠের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন একটি ক্লান্ত দুপুরে আমি এই বইটির সঙ্গে  বসবাস করে লিখছি। আমার মন প্রসন্ন হয়নি প্রচ্ছদ দেখে; সামান্য কিছু মুদ্রণ ত্রুটিও আছে। তবু বলবো আজিব ভাষায় অতি মূল্যবান একটি গ্রন্থ পড়া গেল এই পুঁথির প্রতাপের যুগে। বার বার এ বই খুলে বসতে হবে নানা তথ্যের খোঁজ নেয়ার জন্যে। সুব্রতর মহাভারতচর্চা একটা স্বতন্ত্র মুদ্রায় সুমেধাকে স্পর্শ করুক। মহাভারতেই বলা হয়েছে অতীতে এ বিষয়ে লিখেছেন অনেকে। ভবিষ্যতেও লিখবেন। বর্তমানেও লিখেছেন সুব্রত। তাকে নন্দিত করি।