মম কাজীর অনুবাদে ‘চড়ুই’
কদিন আগে একটা বই পেলাম –বইটির নাম চড়ুই । এটি অনুবাদ কাব্যের বই । মূল লেখাটি কবি আলবার্ট ফ্যাঙ্ক মারিৎজের লেখা নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ । অনুবাদ করেছেন মম কাজী।
আমি এর আগে মম কাজীর লেখা কোন বই পড়িনি। প্রথমেই এই কাব্যগ্রন্থ – যা একটি অনুবাদ গ্রন্থ –
এই গ্রন্থটি পড়েই ওর লেখার সাথে আমার পরিচয় হলো।
কবি আলবার্ট ফ্যাঙ্ক মারিৎজ, কানাডার বহুল পরিচিত একজন কবি। তিনি নির্বাহী সম্পাদক, প্রকাশক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেছেন। ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালে গুগেনহেইম ফেলোশিপ পান – কবিতার জন্য । ওর কবিতা প্রিন্সটন সিরিজ কনটেম্পোরারি পোয়েটসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০০৫ সালে কবিতার জন্য রিলিট পুরস্কার, ২০০৯ সালে গ্রিফিন কবিতা পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে রেমন্ড সাউস্টার পুরস্কার বিজয়ী। ইংরেজি ভাষার কবিতা ক্যাটাগরিতে তার নাম গভর্নর জেনারেল পুরস্কারের জন্য তিনবার মনোনীত হয়।
২০১৯ সালে ফ্যাঙ্ক মারিৎজকে টরন্টোর পোয়েট লরিয়েট হিসেবে সম্মানিত করা হয়।
এই বইটি মম কাজীর প্রথম বই। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। সবুজের উপর হলুদ দুটি চড়ুই এবং একটি উড়তে থাকা চড়ুই – এক কোনে মারিৎজর ছবি হালকাভাবে – প্রচ্ছটি দারুণ সুন্দর। মূর্ধন্য প্রকাশনের বইটি অফসেট পেপারে ঝকঝকে ছাপা ।
বইটি হাতে পাওয়ার প্রথম কয়েকদিন আমি পড়তেই পারিনি – ব্যক্তিগত ব্যস্ততায়, জীবন যাপনের জটিলতায় । ইচ্ছে ছিল ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই লেখাটা প্রকাশ করব। যা না হওয়ায় নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। বই না পড়ে বা অন্তরস্থ না করে তো আর বই নিয়ে লেখা সম্ভব না মাথায় আসা ভাবনার মতো।
কিন্তু বইটি পড়তে শুরু করার পর আমি নিজেকে আর থামাতে পারলাম না। অবাক হয়ে মম কাজির ভাষা ছন্দ শব্দ ব্যবহারের সরবরে হলাম নিমজ্জিত। এবং এখন প্রতিদিন একটা দুটো কবিতা আবারও পড়ছি বারবার এবং ভালোলাগায় সমৃদ্ধ হয়ে আত্মস্থ করছি।
আলবার্ট ফ্যাঙ্ক মারিৎজর সতেরোটি বই পড়ে সেখান থেকে কিছু কবিতা নির্বাচন করে কবির অনুমতি নিয়ে, তিনি এই অনুবাদের কাজে হাত দেন। মম কাজী নিজে বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, “কবিতাগুলো পড়ার সময় প্রেম স্নেহ বন্ধুত্ব আনন্দ এবং উত্তেজনা অনুভব করতে থাকে আমি।
সেগুলো অনুবাদ করার জন্য আরও বেশি আগ্রহী হই।“ একটি চড়ুইর মৃত্যু কবিতাটি
নিখুঁত নির্মাণ ওরএত ভাল লাগে যে সেখান থেকেই বইয়ের নামটি তিনি দিয়েছেন। ওর মনে হয় যে অনেক কিছু লেখার মধ্যে একটি বা দুটি লেখা দারুণ হয়ে ওঠে এবং এই কবিতাটি ওর কাছে সেরকম শ্রেষ্ঠ একটি কবিতা মনে হয়েছে।
৮৫ পৃষ্ঠার বই – বইটিতে ৮৪টি কবিতা আছে যা একটি বিশাল কাজ মনে হয় । ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ এবং বিশেষ করে কবিতায় কাব্য অনুভূতি ধারণ করে অনুবাদ করা কঠিন একটি কাজ। সেই কাজটি খুব সুচারুরূপে অনুবাদক করেছেন। এবং আমরা দারুণ কিছু কবিতা বাংলায় পড়ার সুযোগ পেয়েছি ।
বইয়ের প্রথম কবিতাটি এখানে দিলাম।
জলের মতো
যখন পিচ ফলের রোমহর্ষক দৃঢ়তা
অশরীরী যৌনতাকে প্রাধান্য দেয়
তখন পুরাতন নস্টালজিয়া হৃদয় আপ্লুত করে
বয়স ভারে ন্যুব্জ স্বচ্ছ ঢেউয়ের আঘাতে
দুর্বল নুড়ি পাথরের মত
কানে কানে আকুতি জানায়।
শত কল্পনা সত্বেও
ফিস ফিস করে বলা
শব্দগুলো ছিল জলের মত
যদিও তা অনন্তকালের কোন প্রতীক ছিল না
ক্লান্ত, মৃত্যুবরণে অক্ষম
রুপালি আয়নায় প্রতিচ্ছবির প্রতি দয়াবান
এক জীবনের সমানেই পুরাতন।
মম কাজীর প্রিয় কবিতার প্রথম কয়েকটা লাইন দিলাম
একটি চড়ুইয়ের মৃত্যু
চড়ুইয়ের দেহের মুচড়ে যাওয়া নাচ, সূক্ষ্ম
যন্ত্রনা, যখন সে তার আহত কাঁধে কামড় দেয়ার চেষ্টা করে।
ঘূর্ণায়মান ভাবে ভেসে থেকে, সংক্ষিপ্ত কল্পনারত ওরা
এবং পতিত অবতরণ – অতঃপর অপেক্ষা হাঁপানো
এই কবিতাটি যখন অনুবাদকের প্রিয় হয় তখন ওকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ থাকে ন। তিনি কঠিনকে ভালোবাসেন এবং সেখান থেকে তুলে আনতে চান মনি মানিক। শুধু ছোট কবিতা নয় বেশ বড় কবিতাও আছে বইয়ে।
বইটি মম কাজীর দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী নারী, কাজী রেহানা হোসেনকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
মম কাজীর লেখা কবিতা পড়ে আমার মন ভরে উঠল। সাথে ইংলিশ কবির বাংলা কবিতা পড়ার সুযোগ পেলাম ওর উদ্যোগে।
ওর আরো লেখা প্রকাশিত হোক, বাংলা ভাষায় সমৃদ্ধ সাহিত্য লেখা হোক।
আমি খুবই অবাক হয়েছি মমর শব্দ প্রয়োগ দেখে। যতদূর জানি মম অনেক দিন থেকে বাংলাদেশের বাইরে আছেন এবং কানাডায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করেছেন। অনেক অল্প বয়স থেকে দেশ থেকে দূরে অবস্থান করছেন। তারপরও ওর শব্দ চয়ন অনেক সমৃদ্ধ। ও সাহিত্য ভুলে যাননি। ভাষার প্রতি ভালোবাসাই ওকে সুন্দর সাহিত্যের ভাষার প্রতি নিয়োজিত রেখেছে বলে আমি মনে করি।
আপনারা যারা কবিতা এবং অনুবাদ কবিতা পড়তে ভালোবাসেন আশা করি তাঁরা বইমেলায় মূর্ধন্য প্রকাশনির স্টল থেকে বইটি সংগ্রহ করবেন।