ভুল শরীরে বসবাস
ভুল তো ভুলই। জীবমাত্রই ভুল করতে পারে। মানুষ যদি ভুল করে, আর সে ভুল সে বুঝতে পারে, সে ভুল শুধরানোর সুযোগটি তাকে করে দেয়া উচিত। অনেক সময় নিজে ভুল না করেও, পারিবারিক কিংবা সামাজিক চাপে পড়ে মানুষকে ভুল জীবন যাপন করতে হয়। তাদেরকে অভিশাপ না দিয়ে, খারাপ মন্তব্য না করে, আসুন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই। উন্নত বিশ্বে মানুষ যত সহজে এ ব্যাপারটিকে মেনে নেয়, আমাদের তৃতীয় বিশ্বের মানুষেরা সেই বিষয়গুলো সাধারণত ততটা সহজভাবে মেনে নেয় না। কেউ ভুল ঝেড়ে ফেলে একটি উন্নততর জীবন বেছে নিতে চাইলে, তাতে সহজে সহযোগিতা করে না। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, কেউ যখন ভুল স্বীকার করে, তখন সে অন্যদের সমালোচনার নির্মম শিকার হয় বিধায় অনেকেই মনের জ্বালা মনেই সয়ে যায়, কারো সাথে শেয়ার করে না, সাহায্যও চায় না।
জীবন একটাই, আর সে জীবনে সকলেরই অধিকার আছে সুখী হবার। মানুষ ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে, অপ্রিয় সেক্টরে কাজ করে, ভুল সংসারে জীবনাতিপাত করে, এই পর্যন্ত কিছুটা হলেও মানুষ আজকাল মেনে নিয়েছে। কিন্তু ভুল শরীরে বসবাস করছে বললে, তা মেনে নেয়ার মতন উন্নত মনমানসিকতা আজো আমাদের সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সামাজিকভাবে আপনার শরীরের বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ, যেমন হাত-পা, চোখ, নাক, কান, সকল কিছু নিয়েই আপনি অবলীলায় কথা বলেন। আর তা বলে থাকেন নিঃসংকোচে। যা কিছু দৃশ্যমান, তা নিয়ে কথা বলতে আপনি একটুও দ্বিধান্বিত হন না, কিন্তু দ্বিধান্বিত হন সেই সব কিছু নিয়ে কথা বলতে, যা দৃশ্যমান নয়, কিন্তু ধুঁকেধুঁকে জ্বলছেন আপনি তা দ্বারা। আমরা জাতি হিসেবে এক্ষেত্রে খানিকটা পিছিয়ে আছি বৈকি! আমরা অভ্যস্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া বোঝা মেনে নিতে, বয়ে যেতে, কিন্তু তবুও মুখ বন্ধ রাখতে। কিন্তু এভাবে তিলে তিলে ক্ষয়ে যায় অনেক প্রাণ। উত্তর আমেরিকায় মানুষজন আজকাল এই বিষয়ে আর শুধু মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, এবং এই বিষয়ে কথা বলবার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। আর তাই LGTBQ এখন আর বিস্ময়জনক কিছু নয়, এটি স্বাভাবিকতার গতি পেয়েছে।
এখন এমনই এক সময় যখন কেনেডিয়ান সমাজ শুধু লাল কিংবা সবুজের গণ্ডি পেরিয়ে বের হয়েছে পঞ্চাশ রকমের সবুজের সন্ধানে, মেনে নিয়েছে সেই সব বৈচিত্র্যের উপস্থিতিকে।। একটা সময় সবুজ মানে আমরা শুধু আমাদের মাতৃভূমির পতাকার রঙের মতন সবুজকেই বুঝতাম, কিন্তু আমরা এখন সবুজের অনেক শেডের কথা জানি, আবিষ্কার হয়েছে পঞ্চাশ রকমের ভিন্ন ভিন্ন সবুজ। এই যেমন সেলাডন বলতে আমরা বুঝি বিবর্ণ-ধূসর, হলুদাভ একটি সবুজ রঙকে। আবার শুধুমাত্র হলুদাভ-সবুজ রঙকে আমরা বলি লাইমগ্রিন। চিরহরিত বৃক্ষের সাথে নাম মিলিয়ে রয়েছে এভারগ্রিন কালার, আবার আরেক রকমের প্রাণবন্ত হলুদাভ সবুজ রয়েছে, যাকে বলা হয় এমেরাল্ড। এভাবে শুধু একটুখানি হলুদাভ সবুজেরই যদি এতগুলো নাম আর বৈচিত্র্য থাকে, তবে ভেবে দেখুন সবুজের আরও কত রকমভেদ হতে পারে।
যাহোক, প্রসঙ্গে ফেরা যাক, এই নানান রকমের সবুজের বৈচিত্র্যের মতনই সেক্স আর জেন্ডারেও অনেক বৈচিত্র্য থাকে। একটা সময় আমরা শুধুমাত্র নারী, পুরুষ, আর তৃতীয় লিঙ্গ, কিংবা হিজড়া বলেই রকমভেদ করতাম। সেইটি আসলে শোভন নয়। বর্তমানে এই বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষণা, পরীক্ষা, নিরীক্ষা, হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে LGBTQ একটি প্রচলিত টার্ম এখন।
LGBTQ এর L দ্বারা বোঝানো হয়, সাধারণভাবে তাদেরকে, যারা নিজেদেরকে লেসবিয়ান (Lesbian) বলেই আইডেনটিফাই করেন। আরও সহজভাবে বললে দাঁড়ায়, লেজবিয়ান হলেন তারাই, যারা নারী হয়েও অন্য নারীর প্রতিই আকর্ষণ কিংবা যৌন দুর্বলতা বোধ করেন, তাদের সাথেই সংগমে লিপ্ত হন।
আবার LGBTQ এর G দ্বারা বোঝান হয়, সাধারণভাবে তাদেরকে, যারা নিজেদেরকে Gay বলে আইডেনটিফাই করেন। বিশদভাবে বলা যায়, সাধারণত দুজন পুরুষ যখন একে ওপরের সাথে যৌন আকর্ষণ বোধ করেন, তাদেরকেই সমাজ সাধারণত সমাজ ‘গে’ বলে সংজ্ঞায়িত করে থাকে।
এদিকে, LGBTQ এর B দ্বারা বোঝানো হয়, সাধারণভাবে তাদেরকে, যারা নিজেদেরকে bisexual বলেই আইডেনটিফাই করেন। এই বাই সেক্সুয়ালরা কখনো নারী, আবার কখনো বা পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। কখনো বা এরা একই সাথে পুরুষ এবং নারী উভয়ের প্রতিই যৌন আকর্ষণ বোধ করেন, কিংবা সম্পর্কে লিপ্ত হন।
LGBTQ এর T দ্বারা বোঝানো হয়, সাধারণভাবে তাদেরকে, যারা নিজেদেরকে transgender বলেই আইডেনটিফাই করেন। এই ট্রান্সজেন্ডারের বিষয়টি সবচে জটিল। হয়ত আপনি দেখলেন, জন্মসূত্রে সকল প্রকার নারী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করল কেউ, আপনি তাকে খেলবার জন্য পুতুল কিনে দিলেন, মেয়েদের পোশাক আশাক কিনে দিলেন। কিন্তু গোপনে আপনি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন, সে বরং ফুটবল খেলতে বেশি পছন্দ করছে, চুল বড় না করে, বারবার কেটে ফেলছে, পুতুল নিয়ে না খেলে বল খেলছে। আরও নানানভাবে জানান দিচ্ছে যে, মেয়ে নয় সে নিজেকে একজন ছেলে হিসেবে দেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আবার উল্টোটিও দেখা যায়। অনেক সময়তেই দেখা যায় যে, ঠিকঠাক সব পুরুষালি শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেও অনেকে নিজেকে নারীদের রূপে দেখতে বেশি ভালবাসে। মেয়েদের মতন করে হাঁটা, চলা, কথা বলা দেখে আমরা তাদেরকে না বুঝেই অনেক সময় ‘লেডিস’ বা অন্য অনেক রকমের বাজে বিশেষণে সঙ্গায়িত করে থাকি। আমরা আসলে নিজেরাই বুঝি না যে, আমরা তাদের প্রতি কতটা অবিচার করছি।
আমার এক সহপাঠী ছিল, যে বাংলাদেশে থাকাকালীন কোনদিনই তার পরিবার কিংবা সমাজকে বোঝাতে পারেনি যে সমাজের দৃষ্টিতে পুরুষ হলেও সে আসলে মনেপ্রাণে ভীষণ মেয়ে। আমরা যখন একটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের টিচার ছিলাম, দেখতাম যে সে ব্রেক টাইমে ছেলে শিক্ষকদের সাথে না ঘুরে, বরং নারীশিক্ষকদের সাথে বসে লাঞ্চ করতে, রেসিপি শেয়ার করতে বেশি ভালবাসত। ভালবাসত রান্না করতে, শাড়ি-চুরির গল্প করতে, আর সেসব নিয়ে নারী শিক্ষয়িত্রীরা কতটাই না তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতো! এ ভুল, বড্ড বড় ভুল। অবশেষে সে একদিন আমাদের ছেড়ে, ইউরোপে গিয়ে একজন নারী হিসেবে জীবন যাপন করে। আজ তার সোশাল মিডিয়ার টাইমলাইনে গিয়ে দেখতে পাই, কিভাবে দুচোখকে কাজল দিয়ে ভরিয়ে, সুন্দর একটি শাড়ি শরীরে জড়িয়ে, মেকআপ করে, সে সম্পূর্ণ সুখি আর পরিতৃপ্ত একটি জীবন যাপন করছে।
আচ্ছা, মানুষের জীবন তো একটাই, সবাইকে যার যার মনের মতন করে বাঁচতে দিলে সমস্যাটা কোথায়? কেন আমরা ভেবেই নেই যে, আপনার চিংড়ি মাছ প্রিয় হলে, তা আমারও প্রিয় হতেই হবে? কেন আমরা ভাবি যে, দেখতে ছেলে হলেই তাকে চুল ছেটে ছেলেদের মতন করেই চলতে হবে? অবশ্য উন্নত দেশগুলো এসবের ধার ধারে না। আমাদের শুধু একটু নিজেদের বদলাতে হবে। আমি নিজেও অনেক সময়েই এই বিষয়টিতে ভুল কাজ করে ফেলি। এতো এতো ট্রেনিং, সেমিনার এটেন্ড করবার পরেও। এই যেমন, আমার এক ক্লায়েন্টের নাম ‘কায়েল’। জন্মসূত্রে তার নাম ছিল জেনি। আমি ফাইলে দেখলাম তার নাম ‘জেনি’, তার প্রোফাইল ভালো করে পড়ে, আমি যখনই তার সাথে কাজ শুরু করলাম, সে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল যে, জন্মসূত্রে আমার যাই নাম হোক না কেন, তুমি আমাকে ডাকবে ‘কায়েল’ বলে, অন্য কিছু বলে ডাকলে আমি কিন্তু জবাব দিব না। এবং সে তাই করলো। তার অবশ্যই অধিকার আছে নিজের ইচ্ছে মতন নিজের জীবনটিকে সাজানোর, কিন্তু আমরা অনেক বোকামো করে বসি, সব্বাইকে একই কুকি কাটার দিয়ে কাটতে চাই, বুঝতে চাই না তাদের মন কি যে চায়।
এই যেমন, জেনি যেদিন প্রথম বিহেভিয়ার থেরাপি নিতে এলো আমার কাছে, সেদিনই তাকে দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছে, পঞ্চাদশি জেনির অনেক অনেক স্বপ্নের কথা শুনে বেশ লেগেছে আমার দৃষ্টিতে দেখা ‘মেয়েটিকে’। কিন্তু দ্বিতীয় সেশনে, যেই না দেখলাম, সেই কোমর পর্যন্ত গড়ানো, রেশমি চুলগুলো ছেঁটে একেবারে ববকাট দিয়ে এসেছে, আমার নিজের মনটিই খারাপ হয়ে গেলো। এরপরের সেশনে দেখলাম, সে আগের মতন আর সেক্সি স্কারট পরে এলো না, বরং জিন্স আর শার্ট পরে এলো, আর আমাকে জানালো যে, সে হরমোনের ট্রিটমেন্ট শুরু করেছে, যাতে করে তার ব্রেস্ট ধীরে ধীরে সমতল হয়ে যায়, আর কিছু পুরুষালি ব্যাপার বেড়ে ওঠে, আমি কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে বড্ড সেকেলে আর অনাধুনিক বলেই মনে হচ্ছিল। এরপর অবশ্য তার পরিবারের সাথে কথা বলে বেশ আশ্বস্ত হয়েছিলাম। পরিবার জানিয়েছিল যে, অবশেষে তারা তাদের সন্তানের মুখে হািস দেখতে পেয়েছে অনেক বছর সাধনার পর। জানতে পেলাম যে, শৈশব থেকেই জেনি কখনোই সুখি ছিল না। যখন কোন উৎসবে তার ভাইয়েরা টিশার্ট আর জিন্স গিফট পেত, আর তার জন্য থাকত লং ড্রেস, সে মন খারাপ করে, সেই ড্রেস ফেলে রাখত। উৎসবের দিনে বরং ভায়েদের পুরনো জিন্স চেয়ে নিয়ে পরত। আর আজ সে মন খুলে বলতে পারছে যে, এতকাল তার ছিল ভুল শরীরে বসবাস। সে মনে প্রাণে একজন ছেলে, আর হরমোন চিকিৎসা করে, সে নারী বৈশিষ্ট্যগুলো অতিক্রম করে যতই না বক্ষের মালভূমি কে সমতল করতে পারছে, কোমল নারীর তুলতুলে গালে পুরুষালি গোঁফদাড়ি গজাতে পারছে, ততই যেন সে তার গন্তব্যে পৌঁছানোর সুখ পাচ্ছে। আজ সে সুখী, কারন তার বক্ষ সমতল। সে স্বপ্ন দেখে একটি নারী সঙ্গী পাবার, নিজেকে সে পুরুষ ভাবে। আমাদের কি আসলেই সেই অধিকার আছে যে, কেউ নিজেকে পুরুষ ভেবে আনন্দ পেলে তাকে জোর করে একটি নারী দেহে আঁটকে রাখবার? তার একটিমাত্র জীবনের সকল আনন্দ কেড়ে নেবার?
অবশেষে বলব, LGBTQ এর Q দ্বারা বোঝানো হয়, সাধারণভাবে তাদেরকে, যারা নিজেদেরকে questioning, and/or queer বলে সনাক্ত করেন। এই টার্মটি বেশ জটিল, কেবল নারী বা পুরুষ এর কোনো দলেই নিজেদের এরা ফেলতে চান না, এরা নিজেদের আইডেন্টিটি নিয়ে এখনো সন্দিহান। এরা আবার লেইসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার, কিংবা গৎবাঁধা যেকোনো প্রকার শুধুমাত্র নারী/ পুরুষ কিংবা বাইনারী ক্যাটেগরির বাইরেই স্বীয় অবস্থান অনুভব করেন। তারা নারী হয়েও কখনোবা নিজেকে অন্য নারীর প্রতি আকর্ষিত অনুভব করেন, অথবা একই সাথে আকর্ষণ অনুভব করেন কোন পুরুষের প্রতি। আবার উল্টোটাও দেখা যায়। আবার এমনও দেখেছি এই জীবনে যে, একজন পুরুষ বিয়ের আগ পর্যন্ত জানতেনই না যে তিনি আসলে পুরুষ সঙ্গই বেশি উপভোগ করেন। তার বিয়ে হল, বাসরও হল। তারপরই তিনি আসলে বুঝতে পারলেন যে, তিনি আসলে নারী নন, পুরুষের সান্নিধ্যেই আকর্ষিত বোধ করেন বেশি। তারপর যা হল, সে দুঃস্বপ্নেরই মতন। তিনি স্ত্রীর সাথে রাত কাটানোর চাইতে পুরুষ বন্ধুদের সাথেই রাত কাটাতে লাগলেন। আবার আরেক নারীকে দেখা গেলো, ঘরে স্বামীকে যতখানি সময় দেন, একইভাবে বাইরে অন্তরঙ্গ সময় কাটান অন্য এক নারীর সাথে। নিজেই বুঝে উঠতে পারেন না, তিনি আসলে কি চান! তিনি এখন কুইয়ার স্টেজেই আছেন।
আমার এই লেখার সারমর্ম হল, ছেলে দেখালেও সবাই ছেলে, কিংবা মেয়েদের মত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্ম নিলেই সবাইকে ছেলে কিংবা মেয়ে হিসেবে ধরে নেয়া উচিত নয়। তাদের নিজেদেরকে বুঝে উঠবার সুযোগ দিন, নিজেদেরকে আবিষ্কার করবার সুযোগ দিন। কোনরকম পারিবারিক কিংবা সামাজিক চাপ প্রয়োগ না করে, নিজেদের মতন করে নিজেদের জীবন যাপন করতে দিন। কারণ, দিনশেষে জীবন একটিই, আর এই এক জীবনে সবারই অধিকার রয়েছে কিছুটা সুখী হবার, কেবলমাত্র পরিবার কিংবা সমাজের জন্য নয়, নিজের জন্য বাঁচার।