বিশাল কানাডার সাদৃশ্যস্বরূপ এর সাহিত্যের ভান্ডার

অতনু দাশ গুপ্ত

১৬২৮ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত রবার্ট হেইম্যানের ‘কুয়োডলিবেটস’-কে বলা হয় কানাডার প্রথম কাব্যসৃষ্টি। এরপর ১৭৬৯ এর ‘দ্য হিস্ট্রি অব এমিলি মন্টেগু’ – ক্যানলিটের প্রথম উপন্যাস যার স্রষ্টা ফ্রান্সেস মুর ব্রুক। ১৯০৬ সালে টরন্টো থেকে আর্চিবল্ড ম্যাকমার্চি প্রকাশ করেন ‘হ্যান্ডবুক অব কানাডিয়ান লিটারেচার’। কানাডিয়ান সাহিত্য নিয়ে প্রকাশিত প্রথম কোন সহায়ক বই ছিল এটি! এতে তিনি জানাচ্ছেন তখন চারিদিকে শুধু নেই নেই রব! সাহিত্য বলতে কানাডা বুঝতো ব্রিটিশ বা আমেরিকান সাহিত্য। সেই না থাকার অভাব ঘুচাতে ম্যাকমার্চির এ প্রয়াস।

১৯৬৭ সালে কানাডা কনফেডারেশনের শতবর্ষ পূর্তি হলেও সাহিত্য অঙ্গন তখনও খা খা করছে। কানাডার স্কুল-কলেজে তখনও পাঠ্য  হিসেবে পায়নি কানাডীয় লেখকদের গল্প, কবিতা বা উপন্যাস! তবে ক্যানলিটের জাগরণ ঘটে ১৯৬০ এর দশকে। ক্যানলিট শব্দটি প্রথম পাওয়া যায় আল বার্নির রচনায়।

১৯৬২ সালে ‘Can.Lit.’ নামে রচিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে উইলিয়াম ফ্রেন্স গ্লোব এন্ড মেইল পত্রিকায় এই শব্দের প্রয়োগ করেন, ‘All of a sudden, we’ve got CanLit coming out of our ears’।

এমন অসংখ্য না জানা তথ্যের ভান্ডারে ঋদ্ধ লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও সংগঠক সুব্রত কুমার দাসের “কানাডিয়ান সাহিত্য-বিচ্ছিন্ন ভাবনা” বইটি।  মূলত তার কলমের টানে আমরা জানবো কানাডার সাহিত্য জগত সৃষ্টির অতুলনীয় সব কারিগরিদের। তিনি এখানে বেশ সচেতনভাবে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত  কানাডিয়ান কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের সাহিত্যে বিচরণ করার গল্প তুলে ধরেছেন সাবলীলভাবে।

আমরা যদি অন্যান্য নামগুলোর দিকে একটু তাকাই – এলিস মানরো, মার্গারেট অ্যাটউড, এম জি ভাসানজি, রবীন্দ্রনাথ মহারাজ, রহিনতন মিস্ত্রি, ইয়ান মার্টেল, মরডেকাই রিচলার, মেরিয়ান এঞ্জেল, মাইকেল ওনডাডজি, মার্গারেট অ্যাডউড, লরেন্স হিল, ডেভিড এডামস রিচার্ডস, ইজি এডুগন,  মিরিয়াম টাওয়াজ, হেলেন হামফ্রে, মাইকেল ক্রামি এনাদের বাদ দিয়ে বা বিপি নিচল, ডেনিস লি, প্যাট্রিক লেইন, লর্না ক্রোজিয়ার, সুজান মাসগ্রেভসহ আরও অসংখ্য নক্ষত্রকে বাদ দিয়ে তিনি বাকি এমন সব লেখকদের আমাদের সামনে এনে হাজির করেছেন যারা এত তারার জ্বলজ্বলে উপস্থিতির কারণে কিছুটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন।  এক্ষেত্রে তিনি ক্যারল শিল্ডসের একটা কথা উল্লেখ করেছেন, “সেই বইটিই  লেখো, যেটি আসলে পড়তে চাও, কিন্তু তুমি খুঁজে পাওনি!” তিনি ক্যারলের কথার সূত্র প্রয়োগ করে  সব লেখকদের নিয়ে এমন এক মিথস্ক্রিয়া তৈরি করেছেন যার নির্যাস সব পাঠকের নেওয়া বাঞ্ছনীয়।

বহুকাল ধরেই এখানের সাহিত্যঅঙ্গন কানাডীয় সাহিত্যিকদের পাশাপাশি  অভিবাসী লেখকদের পদচারণায়ও মুখরিত হয়েছে। সারা পৃথিবীর লেখকদের নিজেদের কথাই পরবর্তীকালে কানাডীয় সাহিত্য হয়ে গেছে। কবি ও সম্পাদক জিম জনস্টোনের মতো করে বলতে গেলে, “তুমি তোমার কথাই লিখবে। তোমার কথাই হবে কানাডীয় সাহিত্য।” এমন মনে হতে কোন দ্বিধা নেই যে পুরো পৃথিবীর সাহিত্যের আকাশগঙ্গা বয়ে চলেছে এক দেশের ভেতরে!

আমরা সেই বৃহৎ জগতের ছান্দসিক, কাব্যিক, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক  মানুষগুলোর সাথে পরিচিত হব লেখক সুব্রত কুমার দাসের লেখনীর মাধ্যমে । সাহিত্যের কারিগরদের খোঁজার তার এ যাত্রা শুরু হয়েছিল ভ্যালু ভিলেজ থেকে। আর ক্রমেই তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন ওয়ার্ল্ড ভিলেজে। কারণ আমরা এখন পৃথিবীকে গ্লোবাল ভিলেজও বলে থাকি।

মূল বইয়ের মাঝে আমরা মোট আঠাশজন কানাডিয়ান কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের সাহিত্য চর্চা শুরু, তাঁদের উত্থান, সৃষ্টি এবং অর্জন নিয়ে আলোচনা দেখতে পাই। এদের জীবনের জীবনের নানান চমকপ্রদ দিক ও তথ্যের সম্ভারে সমৃদ্ধ এই বইয়ের প্রতিটি পাতা। পাঠকদের সুবিধার্থে  বইটিকে তিন ভাগে ভাগ করলাম – কানাডিয়ান সাহিত্যিক, অভিবাসী কানাডিয়ান,  সবশেষে কবিদের কথা।

আমি নিজে নোভা স্কসিয়ার প্রাণভোমরা হ্যালিফ্যাক্সে আছি মোটামুটি বছর তিনেক হয়ে গেলেও ১৯১৭ সালের ভয়াবহ বিস্ফোরণের গল্পটা জানতে পারি হিউ ম্যাকলেনানের “রাইজিং ব্যারোমিটারের” মাধ্যমে। এই লেখনি দিয়ে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কানাডার চিত্রপটের পাশাপাশি এক বিধস্ত জনপদের ছবি মূর্ত করেছেন যা অজানা ছিল। আর্ট গ্যালারি অব নোভা স্কসিয়ায় গিয়ে আদিবাসীদের সম্পর্কে জানতে পারি যারা মূলত এ দেশে প্রথম পদার্পণকারী মনুষ্যগোষ্ঠী। এদেরকে বিস্তর অংকনের ও লেখার মাধ্যমে আমাদের সাথে পরিচয় স্থাপনের দুরূহ কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে  করেছেন এমিলি কার। একেকজন সাহিত্যিক ভিন্ন ভিন্নরূপে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন সাহিত্য ক্ষুধা বাড়াতে। মাজো ডি লা রচের ১৯২৭ সালে পাওয়া ১০ হাজার ডলারের অতিবৃহৎ আকৃতির পুরস্কারের ঘোষণাই হোক না কেন! তাঁর লেখায় ইতিহাস আর কল্পনার মিশেলে সৃষ্টি হওয়া উপন্যাস “জালনা” ইতিহাস পাঠে আগ্রহী করে এবং সেই সাথে রহস্যময় এক জগতে প্রবেশ করেন পাঠক। একে একে পনেরো পর্বের এ লেখায় যে কোন পড়ুয়াকে মন্ত্রমুগ্ধের মত আবিষ্ট করেছেন তিনি। বাঙালি না হলেও বংশগত পদবি “রয়” পাওয়া গ্যাব্রিয়েল রয়ের মাধ্যমে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী মন্ট্রিয়ল এবং ম্যানিটোবা সমাজের পুনর্গঠনের ঘটনাবলী জানবো। প্রত্যেক লেখকের বই বা রচনা ভিন্ন ভিন্ন জগতে বিচরণের একটা মাধ্যম! জর্জ বাওয়ারিং কবিতা ও সাহিত্যে সমানভাবে পারদর্শীতা দেখিয়ে শ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজন হলেও নতুনত্বের পেছনে ছুটেছেন আজীবন। বর্ণমালা ও শব্দের গভীর অনুসন্ধানের এই একনিষ্ঠ সাধকের লেখা পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য। সাহিত্যের অন্যতম একটি দুরুহ কাজ অবশ্যই অনুবাদকরণ। ভাবতে অবাক লাগে শিলা ফিশম্যান কত অনুপম চিত্রের মত ফরাসি ভাষাকে সমগ্র কানাডাময় ছড়িয়ে দিয়েছেন। সব সাহিত্যিক সুচারু, সুশৃঙ্খলভাবে রচনা করেন না, এনাদের কেউ কেউ প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বিল বিসেটের এলোমেলো ধারার লেখার ধরণ এমনই এক দৃশ্যপট মূর্ত করে সবার জন্য।  কানাডার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিকে বলা হয় গর্ভনর জেনারেল। সে পদে আসীন হওয়া ডেভিড জনস্টনের সুবাদে আমরা কানাডার সমগ্র ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানবো। ভ্রমণের আগ্রহ সবার পাশাপাশি আমারও। একদিকে কোন জায়গায় গিয়ে নতুন করে ইতিহাসকে যেমন জানা যায়, তেমনি সে জায়গার খোঁজ আমাদের মনে নতুন চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। ক্যাথি অসলারের ‘কর্মা’ তেমনই এক উপন্যাস। ষোল দেশ ভ্রমণের মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে তৈরি কাব্যাকারে তাঁর লেখা। হাসির পাশাপাশি বেদনার সহাবস্থান চিরকালীন। ম্যাট কোহেনের কণ্ঠে সে কষ্ট নেয় নান্দনিকতার রূপ।

অভিবাসী হয়েও যারা কানাডায় নিজের স্বদেশী পরিচয় বহনের সাথে সাথে সাহিত্যে বিচরণ করেছেন তাদের কথা তুলে ধরছি এবার। বিদেশ থেকে আগত হলেও এদের মত আমরা সবাই এ দেশকে নিজের দেশ বলি। প্রথমেই সুজানা মোদী, আমাদের তখনকার রক্ষণশীল সমাজে নারীদের অবস্থান দেখিয়েছেন, দাস প্রথার কপাট ভেঙে ফেলার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। স্টিফেন লেকক মনে করিয়ে দিয়েছেন সন্তোষ দত্তের কথা। যিনি আজীবন পেশায় উকিল হলেও অভিনয়ে ছিলেন হাস্যরসের রাজা। রবার্ট সার্ভিসের  রাজ্য ইউকনের পথে। আর তেমন কোন লেখককে এই দূরদেশের স্বর্ণসন্ধানের কাহিনি বলতে দেখা যায় না। এ যেন সিন্দাবাদের সপ্তসিন্ধু জয়ের সেই আশ্চর্য দেশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে গেলে আর কেউ ফেরে না! আর্ভিং লেইটন “And me happiest when I composed poems!” যে প্রসঙ্গেই বলে থাকুন না কেন লেইটনের কবিতার রেশ টেনে বলতে ইচ্ছে হয়, ” And I am the most ecstatic when I play with words!” সাহিত্য অনুরাগীদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন যারা পন্ডিতজন হয়েও অন্যের লেখা নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসেন। সেসব লেখাকে লালন করেন ভিন্ন মাত্রায়,সযত্নে। পিকে পেইজ  এমনই একজন যিনি সকলের রচনাকে এক সুতোর বিনি মালায় গেঁথেছেন। ক্যারল শিল্ডস এমন বই লিখতে বলেছেন যে বই আমরা লাইব্রেরীতে খুঁজতে গিয়ে পাইনি। একটা কয়েক শব্দের লাইনের মধ্যে কত বড় শক্তি লুকিয়ে আছে তা নিজেরাই অনুধাবন করুন আর সাহিত্য চর্চা লয় ব্রতী হন। হ্যারল্ড সনি লাডো এবং প্যাট লোথার আমাকে কবি সুকান্তের কথা মনে করিয়েছেন। যিনি অকালেই আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। দুঃখ গাঁথার এক সাগরে ভাসিয়ে লাডোও জীবনের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্যের ভিন্নরূপ দাঁড় করিয়েছেন। পৌরাণিক চরিত্রদের সাথে পরিচিত হওয়া, এনাদের সাথে কথোপকথন সবসময়ের অভ্যাস। নিজে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এনারা কখনো গত হন না। আমাদের মাঝেই অবস্থান করেন। ভেন বেগামুদ্রের লেখা পড়লে আপনাদেরকেও এমনই মনে হবে। স্বপ্নের ঘোরে নানান কাহিনি দেখেছি, তার অনেকটাই বিস্মৃত হয়েছি কিন্তু ভেন ওটাকেই বেছে নিয়েছেন গতিপথ হিসেবে। প্রতিদিন খবরে আমরা শরনার্থীদের দেশান্তরি হওয়ার পথে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার ঘটনা দেখি আবার ভুলেও যাই! কখনো ভেবে দেখেছেন যাদের সলিলসমাধি হচ্ছে এদের মধ্যে যদি কেউ হন আপনার রক্তের কেউ? টিমা কুর্দির লেখা সেই দৃশ্য তুলে ধরবে। বিরহ জ্বালা নিয়ে লেখনী না কি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে! সত্যি কি না তা নিজেই টিমার লেখা পরখ করে দেখুন।

কবিদের কথায় আসলে “We tend to mean Canada, when we say Pardy” – এ কথাটা বলেছেন জর্জ বাওয়ারিং। এখানে মনে বেশ কিছু প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে – প্রথমত, কেন আল পার্ডিকে লেখক অঘোষিত পয়েট লরিয়েট বলেছেন? দ্বিতীয়ত, মাইকেল ওনডাডজি পার্ডিকে বাজে কবি বলার কারণ? অন্যদিকে আবার তাঁকে জনগণের কবি বলা হচ্ছে। আশা করি এসব প্রশ্ন আপনারা খুঁজে বের করবেন। একজন লেখকের   তীব্র বেদনাদায়ক অধ্যায় থাকে। এমন কি মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ারও স্বাদ জাগে তার। এমনই মিল্টন আর্কন। “My poems are born out of great stuggle of silence ” বলছেন ফিলিস ওয়েব। লিখতে গিয়ে ছন্দ হারিয়েছেন সবাই। মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি আর কলম চলেছে না। মসির শক্তি রহিত হচ্ছে ক্রমাগত। গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়ান নিজের শেষ সময়ের খোঁজ করতে গিয়ে মহাকালের বন্ধু হয়েছেন।

বলেছেন, “আমার শেষ আদেশ হলো আমাকে মরতে দাও!” 

আলোচ্য বইটি আমার কাছে পুরো কানাডার অজানা কিছু সাহিত্যপ্রেমী মানুষের সাথে যোগাযোগ করা ও এর জগতে বিচরণের মাধ্যম মনে হয়েছে।  আশা করবো এর জগৎ আরও উত্তরোত্তর বিস্তৃত হবে পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে আসা সাহিত্য অনুরাগীদের পদভারে।  নতুনকে জানুন, পড়ুন, সবাইকে উৎসাহিত করুন – এই হোক সাহিত্যের ভুবনে পথচলার মূলমন্ত্র।