বাদল ঘোষের কাব্যগ্রন্থ “সহাস্য উল্লাসে আজীবন” অকপট স্পষ্টতার উচ্চারণ
সামিনা চৌধুরী
অপুর্ব কাব্যময়তার মধ্য দিয়ে সমকালীন জীবনের নানা জটিলতার মাঝে চমৎকার আর সহজ আশাবাদ প্রকাশ করে কেউ কেউ কবিতা লিখতে পারেন। বাদল ঘোষ তেমনি একজন কবি। তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, আশাবাদ, অধ্যাত্ববাদ, প্রবাস জীবনের অনন্য নিঃসঙ্গতা এবং স্মৃতি। তাঁর কবিতার অপূর্ব চিত্রকল্প পাঠককে অবলীলায় বেড়াতে নিয়ে যাবে দূরের কোন স্টেশনে অথবা ভালবাসামাখা কোন গ্রামে অথবা বরফের একাকী কোনো শহরে।
ইংরেজ কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘কবিতা আনন্দ দিয়ে শুরু হয় কিন্তু জ্ঞান দিয়ে শেষ হয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যখন একটি আবেগ তার চিন্তা খুঁজে পায় এবং সেই চিন্তা প্রকাশের জন্যে শব্দ খুঁজে পায়, তখন সেটি কবিতা হয়ে ওঠে।‘ তাই কবিতা পাঠকের মনকে আন্দোলিত করে এবং একই সংগে কবিতা শেষে পাঠক কোনো বার্তা পেলে সেই কবিতা পড়াটাকে সার্থক মনে করেন।
কাজেই সমকাল ও সমকালীন দর্শনের প্রতিফলন কবিতায় থাকে। থাকে সমকালের টানাপোড়েন। বাদল ঘোষের কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে সমকাল ও দর্শন। এই অস্থির সময়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষই সবচেয়ে বেশি অসহায়। মানুষকে বদলাতে হয় প্রতিনিয়ত আর মানুষের দামই সবচেয়ে কম। তাই ‘মানুষ’ কবিতায় কবি বলেন, ‘সভ্যতার কৃত্রিম পলিশ পেয়ে মানুষেরা শোকেসে সাজানো আজ / ডায়মন্ডের সমূহ নেকলেসকে মানিয়েছে হার!’
বাদল ঘোষের কবিতায় উঠে এসেছে নারী স্বাধীনতাও। তাঁর উচ্চারণে নারীর প্রেমিকা রূপটির পাশাপাশি শক্তিমান রূপ আমরা পাই। ‘লালটিপ বিরাট আগুন’ কবিতায় পাঠক পাবেন বঞ্চনার বিরুদ্ধে নারী জাগরণের মন্ত্র। কবি যেন উজ্জীবিত করার জন্যই বলেন,
‘মা দুর্গার দশটা হাত নয়, তোমার দু’হাতই যথেষ্ট
সব জঞ্জাল ঝেটিয়ে বিদায় করার
আগুনের কি দরকার?
কঠিন সাহসে তুমি আর একবার জেগে ওঠো
দেখবে তখন মরণ আগুনও পথ পাবে না যে পালাবার।’
১৮ দশকের ইংরেজ কবি পি বি শেলী বলেন, কবিতা কল্পনার চিত্রকল্প। আমরা দেখি যে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম অনুসঙ্গ রুপকল্প। কবিতায় কল্পনার পাখায় থাকে ছবি আর গল্প। কল্পনার পাখা যতদূরে যায়, কবিও তত সার্থক হয়ে ওঠেন। আলোচিত বইটিতে কিছু কবিতা আছে যেগুলোতে ছেলেবেলার নস্টালজিয়ার ছবি পাওয়া যায়। আরও কিছু কবিতা আছে যেখানে কবি প্রবাস জীবনের নিঃসঙ্গতার কথা লিখেছেন। এই কবিতাগুলোতে চমৎকার দৃশ্যকল্প পাওয়া যায়।
যেমন ‘মানব-আনন্দ’ কবিতাটি। যেখানে বালক বেলায় দল বেঁধে ট্রেন দেখার গল্প আছে। বালকেরা তীর্থের কাকের মত অপেক্ষায় থাকে কখন আসবে দৃশ্যমান দৈত্যের মতন ট্রেন। সেই ট্রেনের ধাতব সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে কত রকমের মানুষ – কেউ ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরে, কেউ বা অতিথি, আবার কখনো চোখে স্বপ্ন নিয়ে কোন লাজুক বঁধু নেমে আসে।
উচ্ছল বালকের চোখে সেই সব অজানা ট্রেনযাত্রীদের জীবনের গল্প আঁকা হয়ে যায়। সেই কল্পিত জীবনের গল্পে কখনও বা বালকের তুলির আঁচরের বিশ্লেষণ চলে। কিন্তু তারপর জীবনের পথ বেঁকে গেলে বালক বেলার খেলা ফেলে সবাই চলে যায় দূরে। কেউ বা অন্য কোন দেশে। কিন্তু বালকবেলার সেই মানুষ দেখার খেলা মনের ভেতরে রয়ে যায় অসমাপ্ত। কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠক তাঁর নিজের বালকবেলাটা খুঁজে পাবেন।
‘জলের বিচিত্র কামকলায়’ নামে আরেকটি কবিতা আছে যেখানে কবি বাদল ঘোষ কানাডার প্রবল তুষারপাতের বর্ণনায় বলেছেন, ‘চিকন দানার মত শুকনো সাদা জল/ওড়ে সুতীব্র বাতাসে/কখনো জানলার কাঁচের শার্সিতে/ভেসে ওঠে সুস্পষ্ট মোহন টেরাকোটা প্রতিকৃতি।’ তুষারপাতের নতুন এই বর্ণনা পাঠকের চোখে খুব স্পষ্ট একটা ছবি এনে দিতে পারে আর এখানেই কবির সার্থকতা।
বইটির নাম “সহাস্য উল্লাসে আজীবন।” নামটি পড়লেই মনে হয় জীবনভর আনন্দে থাকার জন্য বাদল ঘোষ বুঝি পাঠকদের আহ্বান করছেন। কবিতার নামের মাঝে মন ভাল করা সুর। একইভাবে তাঁর কবিতাগুলোও খুব আশা জাগানিয়া। বইটির প্রেমের কবিতায়, কিংবা দেশের কবিতায় এমনকি কারো স্মরণে শোকগাঁথার কবিতায় বাদল ঘোষ আমাদের আশার কথা শুনিয়েছেন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নিয়ে তিনি লিখেছেন,
‘বিদায় বেলায় সেদিনের সেই সুনীল আকাশ জড়িয়ে নেবেন
নবীন -বাদল ঘ্রাণ; আর তখনই যিশুর অপার আশির্বাদে
বৃষ্টির ফোঁটায় উঠবেই জেগে নতুন স্বপ্নের মোহন সকাল!’
এই ‘বাদল ঘ্রাণ’ যেন বাদল ঘোষের নিজেরই কবিতা; আর সেই কবিতা আনবেই নতুন সকাল, করবে নতুন কবিতার যুগের সূচনা। কি দারুণ আশার কথা!
অথবা ‘চাঁদের আনন্দে নাচি’ কবিতায় যেন নজরুলের সৃষ্টি সুখের উল্লাসের মতোই বলেছেন, ‘মৃত্যুর দাঁতালো নখর যেখানে রোজ/ ঘরের চৌকাঠে সুস্পষ্ট আঁচড় কেটে যায়!/আমাদের জটিল স্বপ্নরা ক্রমে তবু উচ্চকিত।’
বইটির নামের মতই কবি জীবনের বেদনা সরিয়ে দিয়ে জীবনকে উদযাপন করতে চেয়েছেন।
বাদল ঘোষ খুব সচেতন একজন কবি। খুব স্পষ্ট উচ্চারণে, অকপটে আর খুব সোজা করে করে তিনি সাদা কে সাদা আর কালো কে কালো বলতে পারেন। তাঁর কবিতায় আমরা পাই সমকালীন জীবন ও সমাজের টানাপোড়েন। পাই অসম অর্থনৈতিক বন্টনের চিত্র। জয় গোস্বামী ‘আমরা তো অল্পে খুশি’ কবিতায় লিখেছিলেন,
‘আমরা তো সামান্য লোক।
আমাদের ভাতের পাতে
লবণের ব্যবস্থা হোক।’
সেই ভাবে বাদল ঘোষ তাঁর ‘সকালটা দীর্ঘতর’ কবিতায় লিখেছেন,
‘রাত্রি এসে কড়া নাড়ে অভুক্ত দুয়ারে
প্রেম আর অপ্রেমের পেণ্ডুলামে দোলে চারিদিক।’
আবার ‘সময়ের উড়ন্ত ঘোড়ার পিঠে’ কবিতায় তাঁর বলা ‘ক্ষুধার্ত জীবন প্রেম এক বাড়তি বিলাসিতা’ পংক্তিগুলো পড়তে পড়তে পাঠক ঘুরে আসবেন সুকান্ত ভট্টাচার্য্য এর ‘পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’র পংক্তিমালায়।
মহৎ কবিতা শুধু কল্পনার চিত্রকল্প তৈরি করে না, বরং নিয়ন্ত্রণ করে তারুণ্য প্রবাহ, নিয়ন্ত্রন করে বিপ্লব, নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ। কবিতা নিরাময়ের লক্ষ্য নিয়ে বিভেদ চিহ্নিত করে। আর একারনেই কোন কোন কবি এক লাইনেই অমর হয়ে আছেন। এই অস্থির সময়ে, নকল মানুষের যুগে চারিদিকে যখন সবই মেকি তখন বাদল ঘোষ তাঁর ‘মুখ ও মুখোশ’ কবিতায় বলেন,
‘উত্তাপবিহীন বিনিদ্র প্রহর, মুখ নয়
মুখোশই জেগে থাকে
আর মুখোশই যায় বিজয়ের তালিকায়। ‘
বই এর ভুমিকায় কবি ও সাংবাদিক নাসির আহমেদ লিখেছেন বাদল ঘোষ অধ্যাত্ববাদে বিশ্বাসী । এই বিরাট পৃথিবীর অপার রহস্যের বর্ণনায় বাদল ঘোষ নিজেও সত্য ও অকপট । এই উদাহরণ পাই তার
‘ঈশ্বর দর্শন’ কবিতায় যেখানে তিনি বলেছেন অমাবস্যার অন্ধকারে ঈশ্বর দেখা যায় না। আবার
‘জ্যোৎস্নালোকিত রাতে
কোথায় ঈশ্বর থাকেন – জানিনা
নাকি ঘনঘোর অন্ধকারে মিশে থাকে
কৃষ্ণ নামে দর্শন দেবে না বলে।’
দেখা না গেলেও ঈশ্বর আছেন আলো বা অন্ধকারে, এই সহজ সত্যের কি চমৎকার কাব্যিক প্রকাশ। ঈশ্বর তো দেখা যায় না কখনো অন্ধকারে বা আলোতে! তবু আছেন।
প্রেমের কবিতা লেখেননি, এমন কবি বোধহয় পাওয়া যাবে না। বাদল ঘোষও লিখেছেন এবং প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বইটিতে প্রকাশিত প্রেমের কবিতাগুলোতে প্রেমের গুঞ্জনের চেয়ে প্রত্যয় আর প্রত্যাশা বেশী। কবিতায় প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়ের চেয়ে সুন্দর দিন নির্মাণের স্বপ্ন বেশি।
‘ভালোবাসার টনিক’ কবিতায় কবি যখন বলেন ‘একশো বছর বাঁচতে পারি, হাজার বছর আরো দীর্ঘ পরমায়ু যদি ভালবাসতে পারো।’… এ যেন হাজার বছর কীভাবে বাঁচা যাবে, তারই পরিকল্পনা।
‘আজ কি ফোটাবে ফুল’ শিরোনাম এর কবিতাটিতেও পাই উজ্জ্বল আগামীর আশার উচ্চারণ। কবির ভাষায়,
‘আবারও ফোটাও ফুল গোলাপি রঙিন/ ভালবাসা জাগানিয়া ঝলমলে দিন।’
সহাস্য উল্লাসে আজীবন বইটিতে প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা, দ্রোহের কবিতা, দেশের কবিতা, কিছু মানুষের স্মৃতির জন্য লিখা কবিতা, স্বকাল ও সমকাল নিয়ে কবিতা আর কিছু দর্শন ভাবনার কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রতিটি কবিতা সুলিখিত। কবিতার বাক্য বিন্যাস ও শব্দ চয়নে নতুনত্ব ও মুন্সিয়ানা প্রশংসা করার মতো। কবিতায় বলা গল্প আর দৃশ্যকল্পগুলো খুব স্পষ্ট।
কবিতাগুলো পড়তে পড়তে পাঠক দেখতে পাবেন, শুনতে পাবেন এবং কবিতার ভাবনাগুলি পাঠকের মাথায় খেলতেও থাকবে। বইটির ভূমিকায় কবি ও সাংবাদিক নাসির আহমেদ যথার্থই লিখেছেন “শিশুসাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে বাদল ঘোষের সাহিত্য চর্চার শুরু হলেও তিনি কবি হিসেবে সমান প্রতিভাবান।“
কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, “প্রশান্তির আবেগের স্বতঃসফূর্ত স্ফুরণকে কবিতা বলে“ অর্থাৎ মনের আবেগ যখন ভাষায় রূপ নেয় তখন সেটা কবিতা। কৰিতা আবেগ থেকে এলেও এটি পাঠককে চিন্তার খোরাক দেয় , এতে থাকে রূপক, উপমা, চিত্রকল্প, ছন্দ, কখনও কখনও গল্পও। পাশাপাশি কবিতা পাঠককে করে প্রজ্ঞাবান। এসব বিষয়াবলী বিবেচনায় “সহাস্য উল্লাসে আজীবন” বইটি খুব সফল একটি রচনা।
মার্কেটিং বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী বাদল ঘোষ টরন্টো শহরে শিক্ষকতা পেশায় কাজ করছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর কুড়িটির অধিক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। নিভৃতচারী এই লেখক চার দশক ধরে সাহিত্য চর্চা করছেন এবং ‘তিন বাংলা সম্মাননা’ সহ বেশকিছু সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২২ সালে টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অফ অথরস (টিফা) তে তিনি একজন লেখক হিসেবে আমন্ত্রণ লাভ করেন।
বইটির প্রকাশ কাল ২০২৩। প্রকাশক দি রয়েল পাবলিশার্স। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। হলুদ কমলা সবুজ আর নীল পটভূমিতে এক নৃত্যেরত অবয়ব। মনে হচ্ছে বেদনার সব নীল উজ্জ্বল হলুদ আর কমলা আনন্দে দূর হয়ে যাচ্ছে এই উল্লাস নৃত্যে। মনভাল করা একটা প্রচ্ছদ।
বাদল ঘোষকে তাঁর নতুন প্রকাশিত বইটির জন্য শুভেচ্ছা জানাই। একজন সাহিত্যিক হিসেবে তিনি পাঠকদের জন্য আরও লিখবেন সে শুভকামনা করে তাঁর কবিতার লাইন দিয়েই বলি ‘সহাস্য পতাকা হতে সহাস্য উল্লাসে আজীবন সটান দাঁড়িয়ে আছি তোমার স্বাগত প্রত্যাবর্তনের পথে।’
সামিনা চৌধুরী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। সরকারি কলেজে অধ্যাপনাকালে বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে যুক্ত হন ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশে-বিদেশে সামিনার মোট নয়টি পিয়ার রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে কানাডায় অভিবাসী সামিনা পাঁচ বছর ধরে টিডি ব্যাংকে কাস্টমার কেয়ার বিভাগে কাজ করছেন।