বাংলা কথাসাহিত্য যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য
কাজী শাহজাহান
আধুনিককালে ‘সাহিত্য সমালোচনা’ সৃজনশীল সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কথাশিল্পী তার সৃষ্টিতে গভীর মনোনিবেশ করেন এবং একজন সফল সমালোচক শিল্পীর সৃষ্টিতে বহুমাত্রিক দৃষ্টিনিবদ্ধ করেন। তাই সাহিত্য সমালোচনা নিঃসন্দেহে একটি সিরিয়াস মননশীল কাজ। এ প্রসঙ্গে T.S. Eliot বলেন- Criticism… must always profess an end in view, which, roughly speaking, appears to be the elucidation of works of art and the correction of taste.
একজন আদর্শ সমালোচক তার স্বকীয় সত্তার ওপর ভিত্তি করে সাহিত্যরস আস্বাদন করেন। সুব্রত কুমার দাসের বেলায় তার ব্যত্যয় ঘটেনি। যদিও সুব্রত খুব বিনয়ের সঙ্গে লিখেছেন, ‘আমার জন্য কথাসাহিত্য পাঠের একটি পরম্পরা হলো তা নিয়ে সমালোচনা লেখা।’ সাহিত্য সমালোচক হয়ত কখনও এর বেশি বলার চেষ্টা করেন না।
বাংলা কথাসাহিত্যের যারা সফল সমালোচক তারা যে ধারার সৃষ্টি করেছেন তা দেশ-কাল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতায় সমাসীন। পশ্চিম বাংলাকে বাদ দিয়ে যদি শুধু বাংলাদেশের কথাই বলি- হাতালে দেখতে পাব মুস্তাফা নূরুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সৈয়দ হক, হুমায়ুন আজাদ, আহমেদ রফিক, ওয়াকিল আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, আবুল কাসেম ফজলুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ ও রফিকউল্লাহ খান মননশীল সমালোচনাধর্মী সাহিত্যে তাদের স্ব-স্ব শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করেছেন। এদের পরবর্তীকালে যারা কথাসাহিত্য পড়েন এবং পড়া থেকে লেখায় তাগিদবোধ করেন- তাদের মধ্যে সুব্রত কুমার দাস অন্যতম। তিনি কথাসাহিত্যের একজন নিষ্ঠাবান পাঠক। সুব্রত তার পড়া থেকে কিছু গড়ার তাগিদ অনুভব করেন। ইতোমধ্যে তার কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার যে বইটি সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছে সেটি হলো ‘বাংলা কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য’। প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য প্রকাশনী।
বইটি পড়লে সহজেই অনুমান করা যায় সুব্রত সত্যিই নিরলস বুভুক্ষু পাঠক। সুব্রত পড়াশুনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। পেশা অধ্যাপনা। পড়ান ইংরেজি সাহিত্য। এজন্য হয়তো বা তার অধ্যয়নের সঙ্গে যাকে বহুমাত্রিক দৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যের সমসাময়িক বিভিন্ন ‘Trends’ বিভিন্ন আঙ্গিকে তিনি নিঃসঙ্কোচে বিশ্লেষণ করেছেন। তার এ বইটিতে তিনি বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা ঔপন্যাসিকদের ওপর আলোকপাত করেছেন।
প্রথমে তিনি পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট গল্পকার কমলকুমার মজুমদারের ওপর আলোচনা করেছেন। আমরা জানি, কমলকুমার তার গল্পে শব্দের, বাক্যের প্রেক্ষিত নির্মাণে এক জটিল আবর্তের সৃষ্টি করেন। সুব্রত খুব নিষ্ঠার সঙ্গে কমলকুমারের রচনাকাল, রচনার ইতিহাসপর্ব এবং গল্পগুলোর কাঠামো সুচারুভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। অগ্রসর ও উৎসাহী পাঠক সহজেই তার আলোচনায় মর্মার্থ অনুুধাবন করতে পারবেন।
অতঃপর সুব্রত তুলে ধরেছেন ‘অমিয়ভূষণ মজুমদারের উপন্যাসের ইতিবৃত্ত’। অমিয়ভূষণ মজুমদার (১৯১৮-২০০১) পশ্চিম বাংলার ঔপন্যাসিক। তিনি নাট্যকারও বটে। নাটক দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন; কিন্তু ৩৮ বছরের অধিককাল অমিয়ভূষণ মজুমদার নিরলসভাবে উপন্যাস রচনা করেছেন। সুব্রতের ভাষায়, ‘মানবমন ও সমাজের বিচিত্র অনালোচিত জগতই তার আরাধ্য।’ সত্যি কথা বলতে কি অমিয়ভূষণ মজুমদার মননশীলতা দিয়ে তার আরাধ্য জগতকে চিত্রায়িত করেছেন।
এরপর সুব্রত আলোকপাত করেছেন ‘ননী ভৌমিকের ধূলোমাটি: স্বদেশী যুগের রাজনৈতিক দলিল’-এ বিষয়টির ওপর। জীবনে মাত্র একটি উপন্যাস লিখেছেন ননী ভৌমিক (১৯২১-১৯৯৬)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর বর্তমান শতাব্দীর প্রথম পর্বের বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসের আবরনে এদেশের মাটির রাজনৈতিক চিত্রায়ণ বর্তমান ‘ধুলোমাটি’র আখ্যান হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। উপন্যাসটির বিষয়বস্তু একটি সংগ্রামী মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর চেতনার ক্রমবিকাশ। সুব্রত বিশ্বাস করেন, সাহিত্য ইতিহাসে ননী ভৌমিকের এ উপন্যাস আরও উচ্চ সম্মান পাবে।
গুণময় মান্নার ‘লখীন্দর দিগার’ উপন্যাসটির কাহিনী নিয়ে আলোচনা করেছেন সুব্রত। উপন্যাসটি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে কৃষক সমাজের দাবি আদায়ের আন্দোলনকে পরিস্ফুটনে রচিত হলেও ঔপন্যাসিক কিন্তু সে আন্দোলনের সর্বংসহা নেতাদের কাউকে প্রধান চরিত্র করেননি। তিনি বেছে নিয়েছেন লখীন্দর দিগার নামের একজন সাধারণ কৃষককে। কৃষকদের ভাষা, সংস্কৃতি, ভাবনা, আচারকে আশ্রয় করে রচিত এ উপন্যাস নিশ্চয়ই- একটি ব্যতিক্রম সৃষ্টি। সুব্রত যথার্থই বলেছেন, ‘এদেশীয় জীবনবোধের সত্যিকার একটি চিত্রের জন্য ‘লখীন্দর দিগার’ নিশ্চয়ই খ্যাত হয়ে থাকবে।’
এরপর তিনি শামসুদ্দীন আবুল কালামের (১৯২৬-৯৭) ‘কাঞ্চনগ্রাম’ উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। শামসুদ্দীন আবুল কালাম ইতিহাসকে আশ্রয় করে এ উপন্যাস লিখেছেন। তিনি ইতিহাসের বাইরে কোন অভিমত ব্যক্ত করেননি। সচেতনভাবে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এ উপন্যাসে দেখিয়েছেন। তিনি যে নন্দিত শক্তিমান লেখক তা এ উপন্যাসে আবারও উদ্ভাসিত হয়েছে।
সুব্রতের আলোচনায় কথাসাহিত্যিক অসীম রায়ও সমভাবে স্থান পেয়েছেন। অসীম রায় জনপ্রিয় লেখক হিসেবে জীবদ্দশাতেই পরিচিতি পেয়েছিলেন। অসীম রায়ের ‘একালের কথা’, ‘গোপাল দেব’, ‘দ্বিতীয় জন্ম’, ও ‘নবাববাদী’ উপন্যাসের দিকে তাকালে তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ মিলে। অসীম রায় মানবমনের স্বরূপ সন্ধানে প্রয়াস চালিয়েছেন তার লেখনীর মধ্য দিয়ে।
সৈয়দ শামসুল হকের সব উপন্যাসই সুখপাঠ্য। তবুও সুব্রত বেছে নিয়েছেন ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’। এটি ধর্মীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে একটি তীব্র উচ্চারণ। সৈয়দ হক মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিত এ উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন। সুব্রত লিখেছেন; মুক্তিযুদ্ধ সম্পৃক্ত স্থানিক এ কাহিনীগুলোর ভেতর দিয়ে সৈয়দ হক সঞ্চালন করেছেন সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য, ভাষা ও কাহিনী।
জীবনীমূলক নাটকে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ থাকলেও জীবনীমূলক উপন্যাস রচনার ইতিহাস তেমনটা সমৃদ্ধ নয়। হাসনাত আবদুল হাই জীবনীমূলক উপন্যাস রচনায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। সুব্রতের আলোচনায় এটা অত্যন্ত পরিস্কার যে, হাসনাতের ‘সুলতান’, ‘একজন আরজ আলী’ ও ‘নভেরা’ উপন্যাসে ৩ প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির সীমারেখা যেকোন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
আলোচনার ধারাবাহিকতায় সুব্রত তুলে ধরেছেন মাহমুদুল হকের উপন্যাস ‘অনুর পাঠশালা’, ঔপন্যাসিক আহমদ ছফার ‘পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ’। অতঃপর তিনি আলোচনা করেছেন প্রথাবিরোধী ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আজাদের ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’ এবং ‘সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে’ এ দু’টি উপন্যাস নিয়ে। উপন্যাস দু’টি হুমাযুন আজাদের কাছে বাঙালি পাঠককে আরও অধিক উপন্যাসের প্রত্যাশী করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা’ ও শহীদুল জহীরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’- এ দু’টি উপন্যাস সুব্রত সুচারুভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথমটি বাঙালির আত্মানুসন্ধানের দলিল এবং দ্বিতীয়টি জাদুবাস্তবতায় ধারার জন্য উল্লেখযোগ্য।
এরপর তিনি আলোচনা করেছেন এ সময়ের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নাসরিন জাহানকে নিয়ে। সুব্রত নাসরিন জাহানের উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার দিকটা মূল আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’ ও ‘সোনালী মুখোস’ উপন্যাসে অলৌকিক এক গল্প কাঠামোয় বাক্য বা বাক্যাংশ দিয়ে, কখনও বা ক্ষুদ্র আখ্যান দিয়ে পার্থিব বাস্তবকে একাকার করে দেয়া হয় কল্পলোকের সম্ভাব্যতার সঙ্গে।
পরিশেষে সুব্রত কুমার আলোকপাত করেছেন, জাদুবাস্তবতা ও বাংলাদেশের উপন্যাসের ওপর। এটি তার অবশ্যই সাহসী পদক্ষেপ। তার কারণ ‘Magic Realism’ সম্পর্কে বিদগ্ধ সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদারই এক সময় উৎকণ্ঠিত ছিলেন। মার্কেজ ও কার্পেন্তিয়ার প্রতিষ্ঠিত ‘Magic Realism’ ট্রেন্ডটা বাংলা সাহিত্যে কখন, কীভাবে আসে তার ইতিহাস অনুল্লেখিত। তবুও শহীদুল জহীরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক’ (১৯৮৭) উপন্যাসটি এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা। নাসরিন জাহানের (১৯৬৪- ) তৃতীয় উপন্যাস ‘চন্দ্রলেখায় জাদুবিস্তারও (১৯৯৫) জাদুবাস্তবতার ধারায় একটি শক্তিশালী প্রয়াস। উপর্যুক্ত দু’জনের কাতারে আরও যে একজন সফল স্রষ্টা তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-৯৭)। ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬) জাদুবাস্তবতার বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বৈচিত্রপূর্ণভাবে উপস্থাপন করে তিনি অমর হয়ে আছেন।
পরিশেষে আমরা একথা বলতে পারি, সুব্রত কুমার দাসের এ গ্রন্থটি আমাদের সমালোচনাধর্মী সাহিত্যে নিশ্চয়ই নতুন মাত্রা যোগ করবে। পাঠককে দেবে সাহিত্যরসের নবস্বাদ। পাঠককূল প্রীত হলে সুব্রত কুমার দাসের শ্রম নিঃসন্দেহে সার্থক হবে।
কবি ও প্রাবন্ধিক কাজী শাহজাহান রচতি এই লেখাটি দৈনিক সংবাদের সংবাদ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালের ৮ আগস্ট।