বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য
মনিরুল ইসলাম
লেখক মাত্রেই সমগ্রতাস্পর্শী হতে সচেষ্ট থাকেন। অবশ্য যেমন- তেমন লেখক নন: যিনি ধারণ করেন এবং রূপায়নের প্রক্রিয়াকে ব্যাপকতায় দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত সুব্রত কুমার দাস রচিত ‘বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য’ প্রবন্ধগ্রন্থটি পড়ে অন্তত তাই মনে হয়েছে।
যাদুবাস্তবতার বিষয়টি বাংলা কথাসাহিত্যে সাম্প্রতিক এবং নতুন হলেও এর চর্চা, চর্যা ও আলোচনার গণ্ডিটি সীমিত পরিসরে আর থাকেনি। গ্রন্থটির শিরোনামে যাদুবাস্তবতা বিষয়টি নজর কাড়লেও লেখকের উদ্দেশ্য কেবল এর মধ্যে সমীকৃত নয় বরং আরো বিস্তৃৃত পরিসরে বাংলা সাহিত্যের বহু ধারিক ও বহুধা বিভক্ত বিষয়গুলোকে গবেষণাধর্মী বর্ণনায় তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন লেখক। বাংলা কথাসাহিত্যের অপ্রচলিত ধাপটাকে যেমন এখানে প্রমূর্ত মনে হয়, অন্যদিকে স্বল্পএজ অথচ ঋদ্ধিমান শিল্পপ্রকরণে আবিষ্ট এমন দু’একজন এই আলোচনায় স্থান পেয়েছে: যা পাঠককে নতুনত্বের স্বাদ দিতে সক্ষম হবে।
লেখকদের মধ্যে যেমন সতত নিরীক্ষাপ্রবণতা লক্ষণীয়, তেমনি সুব্রত কুমার দাসের প্রবন্ধশৈলীতেও এই নিরীক্ষাধর্মীতা লক্ষ করবার মতো। লেখক যখন স্বকণ্ঠে বলেন, বর্তমান গ্রন্থভুক্ত, ‘সকল লেখক বা আলোচিত গ্রন্থগুলোর মূল ঐক্য ভালোলাগা। কৃত্যটি দীর্ঘ সময়ের। তাই আলোচনাগুলোর ধাঁচ, গভীরতা ও বিশ্লেষণও বহুধা’ তখন সূচিপত্রের দিকে চোখফেরানি অনিবার্য হয়ে ওঠে। মোট চৌদ্দজন ঔপন্যাসিককে নিয়ে একমলাটে গ্রন্থন, সেইসঙ্গে ‘যাদুবাস্তবতা ও বাংলাদেশের উপন্যাস’ প্রবন্ধটি নিঃসন্দেহে পাঠকের কাছে যাদুবাস্তবতা সম্পর্কে তাত্ত্বিক দিকটিকে যেমন উন্মোচিত করবে, তেমনি বাংলাদেশের উপন্যাসে যাদুবাস্তবতার বিষয়টির ধারাক্রম সম্পর্কেও সম্যক ধারণা লাভে সহায়তা করবে।
সুব্রত কুমার দাসের লেখার বহুধা বিশ্লেষণ তাকে আর দশজন প্রাবন্ধিক থেকে সহজেই আলাদা করে। আমাদের অতি পরিচিত সৈয়দ শামসুল হক, মাহমুদুল হক, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, সেলিনা হোসেন, হাসনাত আবদুল হাই এবং নাসরীন জাহানের পাশাপাশি ওপার বাংলার ব্যতিক্রমী লেখক কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, অজনপ্রিয় অথচ শক্তিমান অসীম রায়কে আমরা প্রত্যক্ষ করি নবীন পাঠকের দৃষ্টিতে। মজার ব্যাপার হলো সুব্রত এমন কিছু ঔপন্যাসিকের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আলোচনা করেছেন যারা খুব বেশি পাঠকসমাদৃত কিংবা পরিচিত নন। অথচ নির্মাণশৈলীতে অনন্য প্রতিভার অধিকারী। যেমন ননী ভৌমিক, গুণময় মান্না, শহীদুল জহির বোদ্ধা লেখক ও পাঠকের কাছে বহুলশ্রুত হলেও নতুন পাঠকের কাছে এঁদের কীর্তি সুব্রত কুমার দাসের কর্মসমীক্ষণেই পাদ-প্রদীপের আলোয় এসে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সন্দেহ নেই।
কমলকুমার মজুমদার (জ. ১৯১৪) থেকে নাসরীন জাহান (জ. ১৯৬৪) – প্রায় পঞ্চাশ বছরের (জন্মের দিক দিয়ে) একটি সেতুবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন সুব্রত কুমার দাস। অর্ধ-শতকের সীমানায় যাঁরাই একটু সিরিয়াসধর্মী কাজ করেছেন তাঁদের নিয়েই সুব্রত কুমার সাজাতে চেয়েছেন তাঁর গ্রন্থসূচি। যদিও এ আলোচনায় স্থান পাননি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, শওকত আলী এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। অন্তত এই পাঁচজন ঔপন্যাসিকের আলোচনা না থাকায় গ্রন্থটিকে অসম্পূর্ণ মনে হয়। তবে প্রাবন্ধিক গ্রন্থ শুরুতে ১৯৯৪ থেকে ২০০১ পর্যন্ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধের সংকলন হিসেবে গ্রন্থটিকে চিহ্নিত করার আভাস দিয়েছেন। আর প্রাবন্ধিকের মতে, কথাসাহিত্য পাঠের একটি পরম্পরা যেহেতু সমালোচনা লেখা, সেক্ষেত্রে আমরা ধরে নিই, উপযুক্ত লেখকদের সম্পর্কে প্রাবন্ধিকের পাঠ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়নি, কিংবা তিনি অন্যদের সম্পর্কে লেখার চেষ্টা প্রক্রিয়াধীন রেখেছেন।
সুব্রত কুমার দাস চমক দিতে পছন্দ করেন। প্রবন্ধের মধ্যেও যে চমক দেওয়া যায় এটি তার স্বভাবগত এবং বৈচিত্র্যপ্রয়াসীও। যেমন আমরা যেখানে অপ্রচলিত ভাষায় শব্দটি কোনো প্রকার চিন্তা ভাবনা ছাড়াই ব্যবহার করতাম, সুব্রত কুমার সেখানে প্রথম প্রবন্ধটির শিরোনাম দিয়েছেন এভাবে- ‘না প্রচলিত ভাষায় বাংলা কথাসাহিত্য ও কমলকুমার মজুমদার’। লেখকের এই ন-প্রচলিত ভাষায় বাংলা কথাসাহিত্যের ওপর যথেষ্ট আগ্রহ লক্ষ করা যায়, বিশেষত কমলকুমার মজুমদার ও অমিয় ভূষণ মজুমদার –এর ওপর তার দুটি দীর্ঘ লেখা তারই ইঙ্গিত প্রদান করে। অবশ্য তাঁর এই দুটো লেখাই যথেষ্ট তথ্যবহুল ও প্রায় পূর্ণঙ্গতাস্পর্শী। এই গ্রন্থের প্রায় লেখাগুলোই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হবার কারণে তথ্যসূত্র বা প্রাসঙ্গিক তথ্য দেয়া সম্ভব হয়নি, এটি বেশ বোঝা যায়। ফলে এ লেখাগুলো প্রাবন্ধিকের শ্রমলব্ধ প্রচেষ্টা হলেও গবেষণাধর্মিতা কিছুটা হলেও খর্ব করে। কেবল দুটো লেখা, ‘কথাসাহিত্যিক অসীম রায়’ এবং ‘যাদুবাস্তবতা ও বাংলাদেশের উপন্যাস’-এ তথ্যসূত্র নির্দেশ করা হয়েছে। লেখা দুটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সাহিত্য পত্রিকা’ ও ত্রৈমাসিক ‘সুন্দরম’-এ প্রকাশিত হবার কারণে হয়তো বা লেখক এগুলোকে গবেষণার ধাঁচটি দিতে চেষ্টা করেছেন। অবশ্য অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে লেখকের প্রথম লেখাটি কমলকুমার মজুমদারকে নিয়ে লেখা, যা ত্রৈমাসিক ‘সুন্দরম’ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তথ্যসূত্র সংযোজিত হয়নি। অথচ লেখাটি বেশ সমৃদ্ধ এবং বাংলা সাহিত্যে না-প্রচলিত কথাসাহিত্যের ওপর চমৎকার আলোচনা সন্দেহ নেই।
সুব্রত কুমার দাসের প্রবন্ধসংকলনে যাঁরা আলোচিত হয়েছেন তাঁদের অনেকেই পূর্ণতা পেয়েছেন, অনেকের সামগ্রিক সাহিত্যকীর্তি পাঠককে উদ্বুদ্ধ করতে পারে তাঁদের উপন্যাস পড়ার ক্ষেত্রে। কারো কারো আবার আংশিক আলোচনা এমন কি একটি মাত্র উপন্যাস নিয়ে আলোচনাও স্থান পেয়েছে। এ কথা সত্য যে স্বল্প পরিসরে অনেক কিছু দেবার চেষ্টা থাকলেও তা অনেক সময় হয়ে ওঠে না।
কমলকুমার মজুমদার, অমিয় ভূষণ মজুমদারের বিষয় ও ভাষার সতত নিরীক্ষা, ননী ভৌমিক, গুণময় মান্নার শেকড় সন্ধানী মানুষের ইতিবৃত্ত, অসীম রায়ের জীবনঘনিষ্ঠ সমাজ বাস্তবতার পাশাপাশি শামসুদ্দীন আবুল কালামের হাজার বছরের ইতিহাস রূপায়িত চিরায়ত বাংলার ‘কাঞ্চনগ্রাম’, সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধের কথামালা ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ হাসনাম আবদুল হাই-এর জীবনীমূলক উপন্যাসসমূহ, মাহমুদুল হকের বিষয়-বৈচিত্র্য, ভিন্নধারার লেখক আহমদ ছফার সাধারণ জীবনের ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনা, প্রথাবিরোধী হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস, সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র বাঙালির আত্মানুসন্ধান সেসঙ্গে অধুনা আলোচনার বিষয়বস্তু যাদুবাস্তবতা নিয়ে নাসরীন জাহান ও শহীদুল জহিরের উপন্যাস নিয়ে সুব্রত কুমার দাস যে গ্রন্থ রচনায় ব্রতী হয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
‘গ্রন্থটি সম্পর্কে আর দু’ একটি কথা না বললেই নয়। না- প্রচলিত ভাষায় বাংলা কথাসাহিত্য ও কমলকুমার মজুমদার প্রবন্ধে অমিয় ভূষণকে নিয়ে প্রায় দেড় পৃষ্ঠা আলোচনা রয়েছে। পরের প্রবন্ধটিই অমিয় ভূষণ মজুমদারের উপন্যাস সম্পর্কিত আলোচনা আর এখানে এসে মনে হয় আলোচনাটি অতৃপ্তি নিয়ে শেষ হয়ে গেল অনেকটা ছোট গল্পের মতো। অবশ্য ধী-দীপ্ত সুব্রত কুমার শুরুতেই পৌন:পুনিকতার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন, সম্ভবত নিজের মধ্যেই কিছুটা সংশয় চিল বলে।
কিছু বানানগত অশুদ্ধি ও মুদ্রণ প্রমাদ এড়াতে পারলে ভাল হত। যাদুবাস্তবতার বিষয়টি বাংলা সাহিত্যে নতুন, এ নিয়ে ব্যাপক লেখালেকি চোখে পড়ে না, এর সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ এই গ্রন্থের মাধ্যমেই মেটানো সম্ভব। সুব্রত কুমার দাসের কৃতিত্ত্ব এখানে যে উপন্যাস-এর মতো বিশাল ক্ষেত্র নিয়ে তিনি কাজ করেছেন এবং তার মধ্য থেকে সিলেকটেড অথচ বহুমাত্রিকতায় ঋদ্ধ, নিরীক্ষাধর্মী সিরিয়াস উপন্যাস ও ঔপন্যাসিক নিয়েই তাঁর স্বকীয় বাণী ভঙ্গি নির্মাণের চেষ্টা। কাজটি কঠিন ও দুরূহ সন্দেহ নেই।
এমন একটি গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ‘ঐতিহ্য’ ধন্যবাদ পেতে পারে। তবে হাশেম খানের প্রচ্ছদটি নান্দনিকতার ছোঁয়া পেয়ে যে অসাধারণ হয়ে উঠছে-তা বলাই বাহুল্য।
কবি ও গবেষক মনিরুল ইসলাম রচিত এই আলোচনাটি মাসিক শিক্ষাবার্তায় ২০০২ সালের মে সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল।