বহির্বিশ্বের অজানা রবীন্দ্রনাথ
প্রবীর বিকাশ সরকার
একজন মানুষের কতখানি ধৈর্য, প্রেম এবং অভিনিবেশ থাকলে পরে এমন একটি গ্রন্থ রচনা করা যায় রবীন্দ্রনাথ: কম–জানা, অজানা পাঠ না করলে অনুধাবনে সক্ষম হতাম না। গ্রন্থটির কলেবর ১০৪ পৃষ্ঠা মাত্র কিন্তু মনে হয় একটি বিশাল পৃথিবীকে ধারণ করে আছে! কিছু কাগজের মধ্যে এত বড় একটা অজানা রবীন্দ্র-নিখিলটাকে ধারণ করিয়ে রাখার কৃতিত্ব বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাসকে দিতেই হবে! তাঁকে বিশেষভাবে সাধুবাদ জানাই এই কারণে যে, কম-জানা, অজানা রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক প্রসঙ্গগুলোকে গ্রন্থাগার ও ইন্টারনেট থেকে খুঁজে খুঁজে সেচে এনে যে মহাধৈর্যের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন তাতে করে আমরা যারা রবীন্দ্রনাথকে একটু বেশিই ভালোবাসি তাদের জন্য এক মহার্ঘ্য। গতানুগতিক রবীন্দ্র-গবেষণার দিকে মানুষের এখন ঝোঁক কম। কিন্তু তারাও মনে হয় আনন্দিত হবেন এই নবআবিষ্কারের ভাণ্ডার পেয়ে। নিঃসন্দেহে রবীন্দ্র-ইতিহাস গবেষক সুব্রত কুমার দাস বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অজস্র তথ্য তুলে এনে রবীন্দ্রজগৎকে যেমন বিস্তৃত, সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি করেছেন বৈচিত্র্যময়।
তবে গ্রন্থটি পাঠ করে আমার যেটা মনে হয়েছে, এর নামকরণ হওয়া উচিত ছিল বহির্বিশ্বের অজানা রবীন্দ্রনাথ কারণ কিছু সংখ্যক প্রবীণ ব্যক্তি ও গবেষক ছাড়া বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের কাছে গ্রন্থভুক্ত ১২টি প্রবন্ধের অধিকাংশই অপঠিত-অজানা অর্থাৎ তথ্যগুলো নতুন সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। লেখক নিজেই একাধিকবার বলছেন, রবীন্দ্রজীবনীতে এগুলোর প্রসঙ্গ নেই, কোনো-কোনোটার কিছু ক্ষীণ বা অস্পষ্ট আভাস আছে মাত্র। কাজেই যারা রবীন্দ্রজীবনী পাঠ করেছেন বা করবেন এবং যারা ভবিষ্যতে গবেষণায় ব্রতী হবেন তারা এই নতুন তথ্যগুলো পেয়ে আরেক রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কারের যৌথ আনন্দ-রসে আপ্লুত হবেন। বোধ করি এখানেই লেখকের সার্থকতা।
যুগধর্মের চাহিদানুযায়ী গ্রন্থটি ইংরেজিতেও রচিত হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। বিশ্বায়নের কারণেই হোক অথবা বাঙালি জাতিকে একটা নাড়া দেবার জন্যই হোক গ্রন্থটির গুরুত্ব অত্যন্ত অপরিসীম। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ একাধারে ভারতীয় এবং বিশ্বজনীন কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি বাঙালি। যদিওবা তাঁর আদি পূর্বপুরুষরা বাঙালি ছিলেন না, ছিলেন কাশ্মির তথা পাঞ্জাবের অধিবাসী কুশারি গোত্রের ব্রাহ্মণ। ভাগ্যান্বেষণে পূর্ববাংলায় এসে বসতি গাড়েন পরে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী হন। রবীন্দ্রনাথ বাঙালিত্বের ভেতর দিয়ে সমগ্র ভারতসভ্যতাকে অবলোকন করেছেন। এই বাংলা অঞ্চলের গ্রামীণ সভ্যতার প্রভাবই তাঁকে বিশ্বসম্মান ছিনিয়ে আনতে উদ্বুদ্ধ করেছিল বললে কি অতিরিক্ত শোনাবে?
ভারতবর্ষে প্রথম বিশ্বায়ন তথা প্রাচ্য-প্রতীচ্যর বিনিময় গড়তে চেয়েছিলেন আধুনিক ভারতের আদিপিতা শিক্ষা-সংস্কারক পণ্ডিত রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৭-১৮৩৩)। তারপরে এলেন স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) প্রাচীন ভারত সভ্যতার প্রথম আধুনিক ভাষ্যকার এবং বিশ্বায়নের দ্বিতীয় রূপকার হিসেবে। এই দুজনের গভীর প্রভাব পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর। কৈশোরে কবির স্বগৃহেই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আবহ, লন্ডনে অবস্থানের নাতিদীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তীকালে বিদেশি জ্ঞানীগুণীর সঙ্গে ভাববিনিময় তাঁকে বিশ্বায়নের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। তাঁরই ফলশ্রুতি শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতী। এবং এই বিশ্বভারতীর কারণেই রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন উপমহাদেশের প্রথম বিশ্বায়নের অগ্রপথিক।
আর অন্যদিকে একই এশিয়ার প্রথম শিল্পোন্নত রাষ্ট্র জাপানে বিশ্বায়নের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা পণ্ডিত ওকাকুরা তেনশিন (১৮৬২-১৯১৩), যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই অর্থে দুজনকে এশিয়ার প্রথম সাংস্কৃতিক কূটনীতিকও বলা যেতে পারে। তাঁরা যে বিশ্বায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার মূল বাণীই বিধৃত আছে তাঁদের দুটি কালজয়ী গ্রন্থ যথাক্রমে ওকাকুরার দি বুক অব টি এবং রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিতে। এবং দুটো গ্রন্থই প্রথম ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল, দি বুক অব টি আমেরিকায় ১৯০৬ সালে আর গীতাঞ্জলি লন্ডনে ১৯১২ সালে। মাতৃভাষায় না হয়ে ইংরেজিতে হওয়ার কারণ আর কিছু নয় উন্নাসিক এবং যুদ্ধপ্রিয় শ্বেতাঙ্গ সমাজের সমকক্ষ হওয়া। সমকক্ষ না হলে বিশ্বায়ন সম্ভবপর নয় এটা তাঁরা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। আরও একটি অনুচ্চারিত অর্থ ছিল: সমাজে শান্তি বজায় না থাকলে বিশ্বায়ন বলি, আন্তর্জাতিকতাবাদ বলি, বিশ্বজনীনতা বলি কিংবা মানবতাবাদ বলি কিছুই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। বাস্তবতা এখানেই যে পণ্যিক বাণিজ্য ও অস্ত্রতৈরির ব্যবসায়িক বিশ্বায়নই আমাদের চোখে পড়ছে বড় প্রকটরূপে, শান্তির বিশ্বায়ন বহু দূরে। যে কারণে এই দুটি গ্রন্থের চাহিদা ক্রমবর্ধমান, পক্ষান্তরে চিরকালীন।
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে পাশ্চাত্য, এশিয়া ও মধ্যএশিয়ায় আদৃত হয়েছিলেন তার ইতিহাস রবীন্দ্রজীবনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি যা জরুরি প্রয়োজন নিশ্চিত করছে ইংরেজিসহ একাধিক ভারতীয় ভাষায় অনুবাদের। কারণ রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় কবিও বটেন! সম্ভবত লেখকের অন্তরে এই চিন্তাটিও আগেভাগেই ছিল। কাজেই মেদহীন গ্রন্থটির গুরুত্ব কেন এত বেশি এই সময়ে আশা করি পাঠক তা বুঝতে সচেষ্ট হবেন বলেই এতকিছু বলা, অহেতুক লেখককে প্রশংসা-প্রশস্তির চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে এই আলোচকের নেই কারণ আলোচক কাজে বিশ্বাসী, কথায় বিশ্বাসী নয়।
১২টি প্রবন্ধ যথাক্রমে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ১৯১৩, বিস্মৃত এক রবীন্দ্র-ভাষ্যকার, রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী, রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনী, রবীন্দ্র-গল্পগ্রন্থের প্রথম অনুবাদ, নিউ ইয়র্ক টাইমস–এ নোবেল পুরস্কার ও রবীন্দ্র প্রসঙ্গ নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন–এ নোবেল পুরস্কার ও রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রনাথের একটি অজানা সাক্ষাৎকার, অস্ট্রেলিয়ার পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার সংবাদ, রবীন্দ্রনাথের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ পরিকল্পনা, আমেরিকায় রবীন্দ্র অস্তিত্বের সংকট: হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা এবং পোয়েট্রি পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ। এগুলোর কিছু আলোচকের পাঠ করার সুযোগ হয়েছে সম্প্রতি পত্রিকার বদৌলতে।
প্রতিটি প্রবন্ধই নাতিদীর্ঘ তা সত্ত্বেও লাইনে লাইনে চমকপ্রদ তথ্যে ঠাসা। লেখক শুধু যে বিদেশি পত্রপত্রিকা বা গ্রন্থ থেকে অনুবাদ করেছেন তা নয়, বহু সময় বিনিয়োগ করেছেন বিষয়কে পাঠকের কাছে স্বচ্ছ-সহজবোধ্য করার লক্ষ্যে আনুষঙ্গিক ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদিও খুঁজে দেখার নিমিত্তে। প্রবন্ধ এমনই একটি রচনা যে তাকে চমকপ্রদ ও আদরণীয়ও করতে হবে। এ ক্ষেত্রে লেখকের কোনো ক্লান্তি বা গা-ছাড়া ভাব নেই।
প্রথম প্রবন্ধেই ১৯১৩ সালে তৎকালীন বাঘা-বাঘা সাহিত্যিকদের নাম নোবেলের প্রস্তাব তালিকায় থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের দরবারে প্রায় অচেনা অজানা এক কবি প্রাচ্যের বৃটিশ উপনিবেশ ভারত থেকে বিশ্বস্বীকৃতি ছিনিয়ে আনার অজানা ঘটনার ইতিহাস পাঠ করে আশ্চর্য হই! খোদ সুইডেনের খ্যাতিমান কবি কার্ল গুস্তাফ হেইডেন ভন স্টাম (১৮৫৯-১৯৪০) এর নাম তালিকায় থাকা সত্ত্বেও তিনি ব্যর্থ হন; পরে ১৯১৬ সালে নোবেল অর্জন করেন সাহিত্যে। সুব্রতবাবু বিস্ময়কর সংবাদ দিচ্ছেন যে, ১৯০১ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ভারত থেকে আরও একাধিক নাম প্রস্তাব করা হয়েছে নোবেলের জন্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথই ছিলেন আপাত শেষ। পাঠক প্রবন্ধটি পাঠ করলে জানতে পারবেন সেসময় নোবেল অর্জনের মতো মেধাযোগ্য আরও বাঙালি ছিলেন ভারতে।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর বলে বিবেচিত হয়েছে এই আলোচকের। একেবারেই অজানা অধ্যায় রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। বিশ্বখ্যাত তুখোড় সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ এবং জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী বিনয়কুমার সরকার (১৮৮৭-১৯৪৯) এর গবেষণায় রবীন্দ্রনাথ। তরুণ বয়স থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণামূলক রচনা লেখা শুরু করেন। নির্মোহ-চুলচেরা বিশ্লেষক এবং বহির্বিশ্বে রবীন্দ্র-ভাষ্যকার হিসেবে তিনি আজ বিস্মৃত। তাঁর রচিত ১৯১৪ সালে কলকাতায় প্রকাশিত রবীন্দ্র-সাহিত্যে-ভারতের বাণী গ্রন্থটি হচ্ছে রবীন্দ্রসাহিত্য আলোচনার প্রথম পথিকৃৎ বলে লেখকের দাবি। লেখক আরও জানাচ্ছেন যে, বিনয়কুমার কর্তৃক বাংলা, ইংরেজিতে লিখিত এবং ফরাসি, জার্মান, ইতালি ভাষায় অনূদিত একাধিক গ্রন্থে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ বিদ্যমান। জীবিতকালে এই পণ্ডিত ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সুইটজারল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, জাপান, চিন, মিশর প্রভৃতি দেশে প্রদত্ত বিভিন্ন বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে বারংবার রবীন্দ্র-চিন্তা ও দর্শনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। সম্ভবত বহিবির্শ্বে রবীন্দ্রনাথের এত প্রচার আর কোনো ভারতীয় লেখক, গবেষক করেছেন বলে এই আলোচকেরও জানা নেই।
তৃতীয় প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী যিনি লিখে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়েও রবীন্দ্র-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে কথিত আছে তিনি আমেরিকা প্রবাসী বরিশালে জন্ম অধ্যাপক বসন্তকুমার রায়। বঞ্চিত হওয়ার কারণ কবির অনুমতি ব্যতিরেকে অতিকথনদোষে দুষ্ট গ্রন্থ লেখা। যদিওবা লেখক সুব্রত কুমার দাস তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, প্রকৃতপক্ষে তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্কই ছিল। ১৯১৫ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি, এখন একেবারেই দুর্লভ। অজানা অনেক তথ্য এই প্রবন্ধের প্রাণ।
চতুর্থ প্রবন্ধে লেখক বলছেন, রবীন্দ্রজীবনী লিখেছেন প্রশান্তকুমার পাল (১৯৩৮-২০০৭) এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৮৫) কিন্তু রবীন্দ্র-শিষ্য ও শান্তিনিতেনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক অজিতকুমার চক্রবর্তীও (১৮৮৬-১৯১৮) একটি রবীন্দ্রনাথ নামে জীবনী লিখেন যা ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয়। লেখক আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর নাম সর্বাগ্রে স্মরণযোগ্য। কিছু কবিতা তৎকালীন ইংরেজি মডার্ন রিভিউ পত্রিকসহ লন্ডনের পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, অনুবাদক হিসেবে তাঁর নাম ছিল না। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল অজিতকুমারের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
পঞ্চম প্রবন্ধে রয়েছে আরও একজন কৃতী বাঙালির কথা যিনি আজ বিস্মৃত। চট্টগ্রামের আইনজীবী ও সাহিত্যিক রজনীরঞ্জন সেন (১৮৮৭-১৯৩৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগ্রন্থের প্রথম ইংরেজি ভাষার অনুবাদক। রবীন্দ্রনাথের ১৪টি গল্পের অনুবাদ করে তিনি যে গ্রন্থের জন্য প্রশংসিত হন সেই গ্রন্থের নাম Glimpses of Bengal life। গ্রন্থটি একসঙ্গে মাদ্রাজ ও চট্টগ্রামে প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। তাঁর সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আরও নানা অজানা তথ্য লেখক সন্নিবেশিত করেছেন।
ষষ্ঠ প্রবন্ধটিও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন প্রভাবশালী দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বেশকিছু আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নোবেল পাওয়ার পরপরই। এটা একটা বিরল সম্মান তৎকালীন সময়ে। চমৎকার সব অজানা তথ্য লেখক এই পত্রিকার পুরনো সংখ্যা ঘেঁটে লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর তারিখে পত্রিকায় শিরোনাম ছিল: Nobel Prize given to a Hindu poet। উপ-শিরোনাম ছিল: This year’s Literature Award / Conferred on Rabindranath Tagore of Bengal। সংবাদে সেই বছর এই প্রথম একজন অ-শ্বেতাঙ্গ কবিকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করলেও আর বিশেষ কিছু ছিল না। বরং কবির পরিবার ও আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে তথ্য ছিল বেশি। যেমন ১৮৭৫ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব মিউজিক প্রাপ্ত কলকাতার পাথরঘাটায় জন্ম ঠাকুর পরিবারের আত্মীয় বাংলার প্রথম সঙ্গীতবিশেষজ্ঞ শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের নাম প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, শৌরীন্দ্রমোহন ১৮৭৭-৭৮ সালের দিকে জাপানের মেইজি সম্রাট মুৎসুহিতোকে (১৮৫২-১৯১২) ঐতিহ্যবাহী তিনটি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র উপহার হিসেবে প্রেরণ করে জাপানের সঙ্গে বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। ১৯১৬-২৯ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কবির আত্মীয় জাপানে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত সন্দ্বীপ ঠাকুর জনৈক জাপানি নারীকে বিয়ে করে এখন জাপানেই শিক্ষকতা ও গবেষণা করছেন। যাহোক, এই পত্রিকাতেই এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ভারত একদিন স্বাধীন হবেই! ভারত স্বাধীন হয়েছে তাঁর মৃত্যুর মাত্র ৬ বছর পরেই।
সপ্তম প্রবন্ধটি নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন পত্রিকায় রবীন্দ্র প্রসঙ্গ নিয়ে প্রকাশিত অজানা তথ্যাদি নিয়ে লিখিত। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত কবিকে নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যেগুলো রবীন্দ্রজীবনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি রাখে নতুন প্রজন্মের জন্য।
অষ্টম প্রবন্ধে ১৯১৬ সালের ২৯ অক্টোবরে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একজন বিশিষ্ট কবি Joyce Kilmer কর্তৃক গৃহীত রবীন্দ্রনাথের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল যার সন্ধান কোনো রবীন্দ্র-ইতিহাসে নেই। লেখক সাক্ষাৎকারটির বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেছেন। নিঃসন্দেহে একটি দুর্লভ আবিষ্কার।
নবম ও দশম প্রবন্ধ দুটিতে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ সুদূর অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল সেখানকার জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে এইসব দুর্লভ তথ্যাদি সন্নিবেশিত হয়েছে। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন বক্তৃতা দেবার জন্য কবি। একাধিকবার পরিকল্পনা করা সত্ত্বেও তিনি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে জীবদ্দশায় পা রাখতে পারেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে শক্তিশালী একটি বিরুদ্ধগোষ্ঠী তৎপর ছিল। কবি অবশ্য বির্তকের উর্ধ্বে ছিলেন না।
একাদশ প্রবন্ধটিও একটি তাৎপর্যপূর্ণ রচনা। বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে ঠাকুর পরিবার গভীরভাবেই জড়িত। রবীন্দ্রনাথ তো অবশ্যই। তাঁর ভাইপো ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতেই স্বদেশী আন্দোলনের জন্ম। ১৯০২ সালে ওকাকুরা তেনশিন সুরেন্দ্রনাথকে এই আন্দোলনে উদীপ্ত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময় প্রতিবাদী হিসেবে রাজপথেই ছিলেন। বেশকিছু দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন যার একটি আজ বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত। মনেপ্রাণে তিনি বৃটিশ শাসনের অবসান চাইতেন। সুতরাং ইংরেজরা তাঁর অপ্রিয়ভাজন হবেন এটাই স্বাভাবিক। ইংরেজ-বিদ্বেষী রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে জাপানে এসে পাশ্চাত্য-অনুসারী জাপানের তীব্র সমালোচনা করেন। অন্যদিকে জাপানের কট্টোর জাতীয়তাবাদীদের কর্মকাণ্ডকে কটাক্ষ করে তাঁদেরকে খেপিয়ে তোলেন, যাঁরা মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু, হেরেম্বলাল গুপ্ত, এ এম সাহাই, এ এম নায়ার, তারকনাথ দাস, সত্যেন সেন, মৌলবী বরকতউল্লাহ, রামাকৃষ্ণসহ অনেক বিপ্লবীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিলেন। আবার এইসব প্রবাসী বিপ্লবীদেরকে গোপনে সমর্থনও দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বিপ্লবী হেরেম্বলালের জীবনী থেকে এই তথ্য জানা যায়। রাসবিহারী বসুর সঙ্গে একাধিকবার জাপানে সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁর শ্বশুরবাড়িতেও আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। এইসব কারণে ১৯১৬ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় যান কুখ্যাত হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। প্রবাসী পাঞ্জাবিদের গঠিত গদর দলের সদস্যরা তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। একজন সদস্য খুনও হয়। এই ঘটনারই চমৎকার সব অজানা তথ্য সুব্রত কুমার দাস তুলে এনেছেন। উল্লেখ্য যে, একসময় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মার্কিনীরা মাতামাতি করলেও ১৯২৯ সালে কানাডা থেকে আমেরিকায় প্রবেশের সময় তাঁর ভ্রমণসচিব অধ্যাপক অপূর্ব চন্দ কবির পাসপোর্ট হারিয়ে ফেললে ইমিগ্রেশন অফিসাররা নোবেলজয়ী কবিকে নগ্নভাবেই লাঞ্ছিত করে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কবি দেশে ফেরার পথে জাপানে বিরতি নেন। এই ঘটনার কথা শুনে তাঁর জাপানি জাতীয়তবাদী ভক্তরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ইবারাকি প্রদেশের মিতো শহরে কবিকে জোর করে নিয়ে গিয়ে বক্তৃতাদানে বাধ্য করে।
দ্বাদশ প্রবন্ধটি আমেরিকার প্রাচীন কবিতাপত্র পোয়েট্রিতে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ ও প্রতিবেদন সম্পর্কে লিখিত। তাতেও অনেক দুর্লভ তথ্যাদি জানা যায়। কলকাতার কবি শ্যামলকান্তি দাশ সম্পাদিত কবিসম্মেলন সাময়িকীর পুজো সংখ্যাতে আলোচ্য পোয়েট্রি পত্রিকাতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ হয়েছে। পোয়েট্রির মতন মর্যাদাসম্পন্ন পত্রিকায় কবির কবিতা প্রকাশ বা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা আমাদেরকে গর্বিত করে।
এইসব দুর্লভ তথ্যের বাইরে আরও তথ্য থাকার কথা লেখক নিজেই ব্যক্ত করেছেন। আমরা আশা করবো সেগুলোও তিনি অনুসন্ধান করে এই গ্রন্থটিকে আরও সমৃদ্ধ করবেন।
প্রবীর বিকাশ সরকার : জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক
কালি ও কলম, ঢাকা, মার্চ, ২০১২