ফুল নিয়ে কথা
প্রকৃতিকে যদি আমরা একজন মূক ও বধির চিত্রকর মনে করি, যিনি কথা বলেন বা শোনেন না, শুধু আপনমনে নানা রকমের ছবি এঁকে যান তাহলে বেশ হয়। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে আমরা প্রকৃতিকে ধর্ম বলে মেনে নিয়েছি কারণ প্রকৃতির মাঝেই মানুষের জীবন বিবর্তিত হয়ে থাকে। একাগ্রচিত্তে লক্ষ করলে প্রকৃতির মাঝে কতগুলি শাশ্বত গুণ দেখা যায় যেমন সে নিরাসক্ত, নির্মোহ আর নির্বিকার। কিন্তু এসব অনাসক্তি সত্ত্বেও সে নিরন্তর কর্মরত। এই সনাতন কর্মধারা অনিবার ও অশেষ। আমরা যদি গভীর দর্শন সমৃদ্ধ দৃষ্টিতে দেখি তাহলে ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির অবিরাম সৃষ্টির খেলা দেখতে পাই। সে প্রাণী, স্থাবর এবং জঙ্গমে নানা প্রকাশের মাঝ দিয়ে সৃষ্টি আর প্রলয়ের ছাপ রেখে যাচ্ছে। তার পরম ধর্ম প্রকাশের মাঝে। নানা রূপে ও ভাবে সে সতত প্রকাশেই নিরত। তার সব প্রকাশই নান্দনিক যা আমাদের মন, অনুভব ও চিন্তাকে নানাভাবে আন্দোলিত আর হিল্লোলিত করে। এই প্রকাশগুলির মাঝে ফুল অন্যতম। এই ফুল জগতের বুকে প্রকৃতির এক অবিনাশী নান্দনিক কাজ যা আমরা সবাই ভালোবাসি।
অনুমান করা হয় কানাডায় বসন্তকালে মানুষের নিজ পরিচর্যায় সাত বিলিয়ন ফুল ফুটে থাকে। বনেজঙ্গলে আর পথের ধারে আপনমনে ফুটে ওঠা কোটি কোটি ফুলের হিসাব এখানে ধরা হয়নি। এই যে আনুমানিক হিসাবটি এটি আমাদের ফুলের প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহের প্রমাণ। অন্যকোন দেশে তা করা হয় কি না আমি জানি না। আমার নিজের ছোট বাগানটিতে মোটামুটি হিসাব করে দেখেছি সেখানে এখন প্রায় নানা রঙের ৩০০ গোলাপ আর কয়েক হাজার ছোট বড় ফুলের সমারোহ বর্তমান। এদের বিভিন্ন রঙ, আকৃতি ও মনমোহিনী সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। শীতপ্রধান অঞ্চলে বসন্তের অবস্থান খুব লম্বা সময়ের জন্য হয় না বলে তুষার গলে যাওয়ার সাথে সাথে ফুলেরা প্রচণ্ড শৈত্যে জমে যাওয়া ভূমি থেকে খুব দ্রুত জেগে উঠে নিজেদের প্রকাশ করতে উদগ্র হয়ে উঠে। এবং এদের জীবনকালও খুব দীর্ঘ হয় না বলে এরা স্বল্পজীবী শিশুর মতোই আমাদের মন ও চেতনাকে আঁকড়ে ধরে রাখে।
প্রকৃতির মাঝে এমন অনেক জিনিষ আছে যার জন্য আমরা চিরকাল তার কাছে কৃতজ্ঞ। ফুল তাদের মাঝে অন্যতম। হাজারও রকমের ফুল, তাদের নানা বর্ণ আর সুগন্ধ আমাদের জীবনকে এক সুন্দর অর্থ দেয়। এতে জগতের আর আমাদের চারিপাশের পরিবেশ মনোরম হয়ে উঠে। আমরা ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে কবিতা রচনা করি। প্রিয়জনকে উপহার দেই আর দেবতাকে অর্ঘ্য দান করে থাকি। প্রতিটি ফুল নীরব প্রকৃতির নান্দনিক মনের প্রকাশ।
ফুল দিয়ে বরবধূ একে অন্যকে বরণ করে হৃদয়ের কোমল অনুভূতিকে প্রকাশ করে থাকে। মানুষ ফুল দিয়ে মালা গাঁথে, সুগন্ধি তৈরি করে আর ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে আমাদের দান করে। আমরা অসুস্থকে ফুলের শোভা দিয়ে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করি এমনকি মৃতকেও ফুল দিয়ে সম্মানিত করে থাকি। ফুল আমাদের চেতনার এক পরম নান্দনিক সাক্ষী। ফুল মানুষের মাঝে জীবন চেতনাকে বাড়িয়ে দেয়।
ফুলের নানা রঙ আর অদ্ভুত সৌন্দর্য প্রকৃতির আর সৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক পরম আর রহস্যজনক শক্তিকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। যে শক্তি নীরব কিন্তু সদা কর্মরত। অনাদিকাল থেকে এই অদেখা নান্দনিক শক্তি মানুষের তার পদধ্বনি রেখে যাচ্ছে। তার কর্ম অনিবার আর অশেষ।
জগতের সব অঞ্চলেই নানা ঋতুতে নানা রকম ফুল দেখা যায়। তবে আমরা কানাডায় ফুলের যে সতর্ক পরিচর্যা করি তা লক্ষণীয়। এর কারণ ফুল ফোটার সময়টি আমাদের জন্য খুব সংক্ষিপ্ত। কঠিন শীত আর তুষারের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে আমাদের মন প্রাকৃতিক লীলার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। আমি একবার হল্যান্ডে টিউলিপের উৎসব দেখতে গিয়েছিলাম। যার নাম কিউকেনহফ। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে দলে দলে মানুষ আসে সেই উৎসবে যোগ দিতে। যাকে নিয়ে এই অনিন্দসুন্দর উৎসব সে কিন্তু নীরব তার এই চেয়ে থাকাতেই আনন্দ।
অনুমান করা হয় আমাদের এই ধরাধামে প্রায় চার লক্ষেরও অধিক ফুলের প্রজাতি রয়েছে যারা এই গ্রহের বৈচিত্রময় বিভিন্ন জলবায়ুতে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে প্রস্ফুটিত হয়ে আমাদের আনন্দ দান করে থাকে। ফুল হচ্ছে উদ্ভিদের মাতৃ জঠর। এখান থেকেই বনরাজির জন্ম ও বৃদ্ধি। অনেক ফুল আছে যারা অন্যান্য ফুলের চেয়ে অধিক মূল্যবান বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যেমন, কাডুপুল ফ্লাওয়ারকে বলা হয় অমূল্য। জুলিয়েট গোলাপের দাম তিন মিলিয়ন ডলার। প্রতিটি সেঞ্জেন নঙ্কে অর্কিডের দাম দুই লাখ নব্বই হাজার ডলার, প্রতিটি গোল্ড অব কিনাবালু অর্কিডের দাম সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার। আর এক পাউণ্ড সাফ্রন ক্রোকাসে দাম ১৩ থেকে ১৬ শ ডলার।
Kadupul Flower – Priceless.
Juliet Rose – £3 million. …
Shenzhen Nongke Orchid – $290,000 per flower. …
Gold of Kinabalu Orchid – $5,500 per flower. …
Saffron Crocus – $1,300 – $1,600 per pound.
অনেক বছর আগে আমি একবার কারাকোরাম পর্বতমালায় ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সেখানে পাহাড়ে পর্বতে নানা অচেনা ফুল দেখে অবাক হচ্ছিলাম দেখে আমার স্থানীয় সাথী আমাকে তাদের রাজার বাড়িতে নিয়ে যায়। প্রাসাদটি জনশূন্য তবে বাগানটি খুব যত্নে রাখা। সেখানে দশটি শ্বেত পাথরের টেবিল ও চেয়ার পাতা আর প্রতিটি টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে আছে অতি বৃহৎ আকারের লাল ও সাদা গোলাপের ঝাড়। এতো বড় গোলাপ আমি আজ পর্যন্ত কোথাও দেখিনি। নিঃশব্দ পর্বতের কোলে অবিরল ধারায় বয়ে যাওয়া ঝর্ণার কুলু কুলু রবের মাঝে প্রকৃতির এই লীলা জীবনকে আনন্দে ও ভাবনায় পরিপূর্ণ করে। এমন লাল গোলাপ দেখেই বুঝি উর্দু কবি লিখেছিলেন, হে হৃদয়বান মানুষেরা তোমরা গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখ প্রতিটি রঙিন ফুল আমারই হৃদয়ের রক্তে রাঙানো।