পাহাড়চূড়া ছোঁয়ার গল্প ‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’
সামিনা চৌধুরী
সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর চিৎকারে যন্ত্রণা থাকে … নাকি থাকে আনন্দ? এই প্রশ্নের কোন সর্বজনগৃহীত উত্তর জানা না গেলেও একথা অনস্বীকার্য যে সৃষ্টিতে আনন্দ থাকলেও তার শুরুটা হয় যন্ত্রণা দিয়ে। সেই যন্ত্রণা কিছুটা প্রকাশিত হয়, কিন্তু অনেকটাই আবার অজানা থেকে যায়। নতুনদেশ কানাডাতে বাস করতে আসা তমাল আর তিথির নতুন জীবন গড়ার আনন্দ-বেদনা, জয়-পরাজয় আর পাওয়া না-পাওয়ার গল্প নিয়ে উপন্যাস জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিনের ‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’। দেশে-বিদেশে, অতীতে বা বর্তমানে জীবন কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কন্টকময় পথে হেঁটে রক্তাক্ত পায়ে যারা উঠে দাঁড়ায়, তারাই পাহাড়চূড়া ছুঁতে পারে। হিন্দি প্রবাদ আছে ‘যো জিতা ওহি সিকান্দার’। নতুন দেশে বাস করতে আসা অভিবাসীদের তাই সকল বৈচিত্র্য মেনে নিয়ে, সকল আঘাত সহ্য করে এগুতে হয় এবং একই সাথে নিজেকে গড়ে নিতে হয় নতুন করে। তখনই কেবল স্বপ্ন রূপ নেয় বাস্তবতায়।
একশো পঁচাত্তর মিলিয়ন বছর আগে নিউলিথিক যুগে যাযাবর মানুষ খাদ্যের সন্ধানে যখন এক আবাস থেকে অন্য আবাসে ছুঁটে বেড়াতো, মানব অভিবাসন প্রক্রিয়া মূলত তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। কৃষি সভ্যতা শুরু হবার পর মানুষ একই এলাকায় বাস করতে চাইলেও কখনও স্বেচ্ছায় আবার কখনও অনিচ্ছায় অভিবাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। যুদ্ধ, নির্বাসন, দাসব্যবসা, মানবপাচার, জাতিগত নির্মূল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী প্রভৃতিসহ আরো বিভিন্ন কারণে মানুষ দেশান্তরী হয়ে ঘর বেঁধেছে অন্য দেশে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধকালীন গণহত্যা এবং এতদসংক্রান্ত সৃষ্ট সংকট অভিবাসনের উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। বর্তমান সময়ে আফগানিস্তান সংকট, সিরিয়ার যুদ্ধ, ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভৃতি সংকটেও মানুষ দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়াও অনুন্নত দেশগুলো থেকে উন্নত জীবনের আশায় অথবা আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করার জন্য বা নিরাপত্তাহীনতার কারণে মানুষ উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসী হিসেবে আসছে। উন্নত দেশগুলো তাদের নিম্নগামী জনসংখ্যা বৃদ্ধিহারের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার জন্য অভিবাসী গ্রহণ করে থাকে। ১৮৬৭ সালে কনফেডারেশন গঠনের পরে অভিবাসী গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক গতি বজায় রাখার জন্য কানাডা অভিবাসী গ্রহণের সুনির্দিষ্ঠ নীতিমালা প্রণয়ন করে। ২০২১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় যে কানাডার প্রতি চারজন মানুষের একজন অভিবাসী, যা কনফেডারেশনের পর থেকে কানাডায় এবং জি-৭ দেশগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ। এইভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে কানাডায় আসা হাজারো অভিবাসীদের মধ্যে থেকে লেখক জাকারিয়া এক তরুণ দম্পতিকে বেছে নিয়েছেন তার উপন্যাস ‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’-এর গল্পের জন্য। এই দম্পত্তি তাদের চাকরি ছেড়ে একমাত্র পুত্রকে নিয়ে স্বপ্নের দেশ কানাডায় আসে বুক ভরা প্রত্যাশায়।
নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে অভিবাসীরা যখন নতুন কোন দেশে বসতি তৈরি করেন, তখন তারা দেশ ছেড়ে এলেও দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সংগীত, সাহিত্য সাথে করে নিয়ে আসেন এবং চর্চা করে যান। আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৯৪০ সালে কিউবাতে বসতি স্থাপন করেন। ১৯৫২ সালে তাঁর মহান রচনা ‘দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সী’ প্রকাশিত হয় এবং পরের বছর তিনি এই উপন্যাসটির জন্য পুলিৎজার পুরস্কার ও নোবেল পুরস্কার পান। উপন্যাসটি কিউবার প্রেক্ষাপটে একজন বৃদ্ধ জেলে সান্তিয়াগোর জীবন সংগ্রাম ও জীবন দর্শন নিয়ে লেখা হয়েছিল। কানাডীয় চাইনিজ লেখক লিন্ডা রুই ফেং তাঁর উপন্যাস ‘সুইমিং ব্যাক টু ট্রাউট রিভার’ উপন্যাসে চিনের ছোট গ্রামে কন্যা জুনিকে একা রেখে আমেরিকাতে অভিবাসী হয়ে আসা বাবা মোমো আর মা ক্যাশিয়ার সংগ্রামের গল্প লিখেছেন। এই উপন্যাসটির জন্য তিনি স্কোশিয়া ব্যাংক গিলার পুরস্কার পেয়েছেন। আবার প্রবাসী বাংলাদেশি লেখকেরা মূলধারার কানাডীয় সাহিত্য নিয়েও আলোচনা করে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। লেখক সুব্রত কুমার দাসের ‘কানাডীয় সাহিত্য: বিচ্ছিন্ন ভাবনা’ গ্রন্থে মূলধারার ২৮ জন কানাডীয় লেখকদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করেছেন, যেখানে মূল ধারার এইসব লেখকের লেখার বিষয়বস্তু, তাঁদের দর্শন ও জীবনের অনেক গল্প উঠে এসেছে। একইভাবে কানাডাতে আসা বাংলাদেশি লেখকদের রচনায় কানাডীয় জীবনের গল্প পাওয়া যায় যেখানে কানাডায় আসা প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসীদের সুখ, দুঃখ, আনন্দ,বেদনার গল্প উঠে আসে; পাওয়া যায় নতুন এই দেশে টিকে থাকার বিভিন্ন কৌশল ও পরামর্শ, জানা যায় অভিবাসীদের আবেগ আর মনোজগতের আখ্যান। সালমা বাণীর লেখা ‘ইমিগ্রেশন’ উপন্যাসের মূল চরিত্র কবিরের পাশাপাশি রবি, দিলদার, চুন্নু চৌধুরী, মিলিসহ আরও অনেকগুলো জীবনের গল্প আছে, যারা এই নিঃসঙ্গ, অনিশ্চিত প্রবাসে টিকে থাকার জন্য নানান ফন্দিফিকির, সুলুকসন্ধান করতে থাকে। জসিম মল্লিকের ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম, উপন্যাসে দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী অভিকের চিন্তা ভাবনায় বারবারই নতুন দেশে আসা তার বাবা-মায়ের সংগ্রামের গল্প পাওয়া যায়। শহীদ খোন্দকারের ‘ভুলসত্য’ উপন্যাসে কানাডায় পড়তে আসা এক তরুণীর আবেগের গল্প লিখেছেন। একইভাবে, লেখক জাকারিয়া ‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’ উপন্যাসে কানাডায় সদ্য আসা অভিবাসী তমাল আর তিথির এই পরবাসে টিকে থাকার সংগ্রামের গল্প লিখেছেন।
অটিস্টিক শিশু তিতাসের উন্নত চিকিৎসার স্বপ্ন নিযে তরুণ দম্পতি তমাল ও তিথি কানাডা আসে। বন্ধু পরাগ তাদের এয়ারপোর্ট থেকে এনে ভাড়া করা বেজমেন্টে থাকার ব্যবস্থা করে এবং তার বসের সাথে কথা বলে তমালের জন্য ফ্যাক্টরিতে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু ফ্যাক্টরি কাজে অভ্যস্ত না থাকার কারণে তিনদিনের মধ্যে তমাল ফ্যাক্টরির চাকরি হারায়। এদিকে স্কুলে খেলার সময় একটা বাচ্চাকে ‘নিগ্রো’ বলার কারণে তিতাসের স্কুলের প্রিন্সিপাল তমাল তিথিকে ডেকে পাঠান এবং কানাডিয়ান সংস্কৃতির খুব উজ্জ্বল এবং সম্মানিত বিষয় ‘ব্ল্যাক হেরিটেজ ও হিস্ট্রি’ নিয়ে আলোচনা করেন, যে বিষয়টি বাংলাদেশে বড় হয়ে ওঠা একজন মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নতুন। এদিকে দেশ থেকে আনা অর্থ প্রায় শেষ হয়ে এলে তমাল-তিথি সোশ্যাল এসিস্টেন্সের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরে। এরকম একটা অবস্থায় বেজমেন্টের আশ্রয় ছেড়ে বন্ধু পরাগের ফ্ল্যাটে সাবলেট থাকা শুরু করলে পরাগের সাথেও তমালের দূরত্ব তৈরি হয়। চাকরি হারানো, বাচ্চার স্কুলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ, সোশ্যাল এসিস্টেন্স নেয়ার তথাকথিত লজ্জা, পরাগের সাথে সম্পর্কের অবনতি – এই সবকিছু মিলিয়ে তমাল ও তিথির স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং একদিন ধৈর্য হারিয়ে তমাল তিথির গায়ে হাত তুলে ফেলে। ফলে তাকে তিন মাস জেলেও থাকতে হয়। জেল থেকে ফিরে আসার পর তমাল তিথি দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু দেশেও তাদের জীবনে নেমে আসে কঠিন সময়। উন্নত দেশের উন্নত জীবন ছেড়ে দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মীয় স্বজনদের হতাশ করে; তিথির ইউনিভার্সিটির সহকর্মীদের সন্দিহান করে তোলে; তমালের জন্য নতুন চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পরে। এমন একটি সময়ে তাদের একমাত্র সন্তান তিতাস সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়।
আত্মীয় স্বজনের অবহেলা, চাকরির যুদ্ধ, একমাত্র সন্তানের অকাল বিয়োগ ব্যাথা, দেশের দূষিত আবহাওয়া, অনিয়ম ইত্যাদি আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ধরলে তমাল আর তিথি অনুভব করে দেশে বা বিদেশে নতুন করে জীবন শুরু করা সমান কঠিন। তাই তারা আবার কানাডায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমবার আসার অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে তমাল-তিথি নতুন করে সব কিছু শুরু করে। অল্প সময়েই একটি কন্যা সন্তানের বাবা-মা হয় তারা। তিথি রায়ার্সন ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি পেয়ে যায়। অন্যদিকে তমাল রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী হিসেবে সফল হয়। সাজনো বাড়ি, দামি গাড়ি, সুখ, সচ্ছলতায় কাটে জীবন। বাঙালি কমিউনিটিতে তাদের অনেক বন্ধুও হয়। এমনকি, যে পরাগের সাথে প্রথমবার এসে মনোমালিন্য হয়েছিল, সেই পরাগও তমালের ক্যান্সার ধরা পড়ার পর তমালকে দেখতে আসে, সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। জীবন জীবনের নিয়মে বয়ে যায়। তমাল পৌঁছে যায় জীবনের সমাপ্তিতে। আর তিথিও পৌঁছায় জীবন সায়াহ্নে। একমাত্র নাতি অহনার মিষ্টি কথায় কেটে যায় দিন আর রাতজুড়ে থাকে জীবনসাথী তমালের স্মৃতি কথা।
‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’ উপন্যাসে কানাডায় নতুন অভিবাসী হিসেবে আসা চরিত্র তমাল ও তিথিকে দেখা যায় নতুন দেশে মানিয়ে নিতে সংগ্রাম করছে, কখনো বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে; হতাশ হচ্ছে, আবার কখনো আশাবাদীও হয়ে উঠছে। একমাত্র ছেলে তিতাসের কারণে একবার স্কুলে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরী হলেও, তিতাসের মৃত্যুর পর স্কুলের সহপাঠী এবং প্রতিবেশীদের সমবেদনা জ্ঞাপন তাদের সান্তনা দিয়েছিল। লেখকের ভাষায়, ‘জাতি, বর্ণ, ধর্ম ভুলে মানুষ মানুষের জন্য এই সমবেদনা প্রকাশ তমাল তিথিকে বিমোহিত করলো’ (পৃ ১৫৬)। আবার কখনও চাকরি বা অন্য কারণে কোনো অনিশ্চয়তা দেখা দিলে হতাশার সাগরে ডুবে গিয়ে তমাল বলে উঠে, ‘বুঝলে তিথি প্রবাসে পরগাছা হয়ে থাকার কোনোই মানে হয় না, তার চেয়ে চলো দেশের ছেলে দেশেই ফিরে যাই’ (পৃ ৯৪)। উপন্যাসে কানাডায় আসা পুরনো অভিবাসী বাংলাদেশীদের চিত্রও তুলে ধরেছেন লেখক। এসব বাংলাদেশী অনেকেই নতুনদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, আবার অনেকেই নতুন ইমিগ্র্যান্টদের উপহাস তাচ্ছিল্য করেন। আবার অনেকে নিজে না জেনে প্রবাস সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেন। ফলে অনেক নতুন ইমিগ্র্যান্ট ভয় পেয়ে পাকাপাকি ভাবে দেশে চলে যান। লেখকের ভাষায়, ‘অথচ, সহানুভূতি, সঠিক পরামর্শ অথবা একটুখানি গাইড পেলেই হয়তো প্রবাসে অনেক নিউ কামারদের জীবন সহজেই বদলে যেতে পারে’ (পৃ ৭৯) ।
এই সবগুলো চরিত্র কানাডায় থাকা পাঠকদের খুব চেনা এবং বাস্তব। এই গল্পগুলো যেন পাঠকের নিজের জীবনের সংগ্রাম আর সফলতার গল্প। ‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে কানাডার সর্বাধিক পঠিত সাপ্তাহিক ‘বাংলামেইল’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। কাজেই বাংলামেইল পত্রিকার প্রধান নির্বাহী এবং এনআরবি টেলিভিশনের সিইও শহিদুল ইসলাম মিন্টু উপন্যাস প্রকাশকালীন সময়ে পাঠকের এই প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে পেরেছেন। তিনি বইটির সামনের ফ্ল্যাপে লেখককে একজন ‘সমাজ বিশ্লেষক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে লিখেছেন, ‘…এভাবে পাঠকের সঙ্গে কানেক্ট হতে পারা, এটাই জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিনের অনেক বড় সাফল্য।’
‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’ উপন্যাসে কানাডীয় অভিবাসী জীবনের চমৎকার দিকগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। নায়াগ্রা বেড়াতে গিয়ে ছোট্ট তিতাস পানিতে ডুবে গেলে ডুবুরীদের দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা এবং হেলিকপ্টার এম্বুলেন্স সার্ভিসের বর্ণনা আছে যেটি অনেকের কাছেই চলচিত্রের গল্প মনে হতে পারে, কিন্ত কানাডায় এটা খুব বাস্তব। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার বা হিলারির এভারেস্ট বিজয় বা ইউকুন টেরিটারিতে সুকুম জিমের সোনা আবিষ্কারের প্রতিটা গল্পেই সাহসিকতার জয় হয়েছিল। তেমনি কানাডীয় অভিবাসনজীবন সাহসী মানুষদের জন্য যার সাথে প্রয়োজন অনেক ধৈর্য। লেখকের ভাষায়, ‘প্রকৃতি সাহসীদের পক্ষে কাজ করে। ভাগ্য বদলানোর আশায় দেশের আত্মীয় স্বজনের মায়া ত্যাগ করে … তাতে প্রকৃতির সম্ভবত সায় ছিল’ (পৃ ১৬০)। কিন্তু এই পরবাসে সংসার চাকরি গুছিয়ে নিতে সময় লাগে। কারো অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগে, আবার কারো বেশি সময় লাগে। কিন্তু বিষয়টি সোনার হরিণ নয়। বিষয়টি বোঝাতে লেখক একটি চীনা উপকথা বলেছেন যেখানে একটি পাহাড়ের ছায়ার কারণে জমির ফসল ঠিকমত রোদ পেত না। একদিন এক কৃষক সেই পাহাড় কাটতে শুরু করলে গ্রামের মানুষেরা তাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছিল। উত্তরে সেই কৃষক বলেছিল, ‘আমি জানি আমি এই পাহাড় কাটা শেষ করতে পারবো না, আমি শুধুমাত্র শুরু করলাম, আমার ছেলে আরেক ধাপ কাটবে, তারপর তার ছেলে, তার ছেলে, একদিন সত্যি সত্যিই পাহাড়টি কাটা শেষ হবে, জমিতে পর্যাপ্ত আলো আসবে’ (পৃ ১৮১)। দেশের শিকড় উপড়ে ফেলে বিদেশের নতুন মাটিতে ডালপালা ছড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন অবশ্যই একদিন বাস্তবে ধরা দেয়, কিন্তু সেজন্য সেই চীনা কৃষকের মতো অটল বিশ্বাসে প্রথম ধাপটি কাটতে হয়।
‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’ বইটি প্রকাশ করেছে সপ্তর্ষি, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৩। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান। প্রচ্ছদে একটি নীল মুখায়বব ঘিরে সাদা আকাশে একটি প্লেন। নীল মুখে নতুন অভিবাসীর যন্ত্রনা ফুটে আছে আর মুখাবয়বের চোখটিতে বিষণ্নতা। বিমান উড়ে যাওয়া সাদা আকাশ ভবিষ্যৎ আশার আলোর দিশা। তাঁর লেখা জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘হোমলেস’, ‘জোসনা ম্যানশন’, সিঙ্গেল মাদার’ প্রভৃতি। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন। ইতিমধ্যে পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’ উপন্যাসটি কানাডীয় বাঙালি সাহিত্যের নতুন ধারায় একটি উজ্জ্বল সংযোজন। লেখকের জন্য শুভকামনা।
……………
সামিনা চৌধুরী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। সরকারি কলেজে অধ্যাপনাকালে বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে যুক্ত হন ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশে-বিদেশে সামিনার মোট নয়টি পিয়ার রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে কানাডায় অভিবাসী সামিনা পাঁচ বছর ধরে টিডি ব্যাংকে কাস্টমার কেয়ার বিভাগে কাজ করছেন।