পাঠ পর্যালোচনা: আমার সময় আমার পথ

সঙ্গীতা ইয়াসমিন

আকবর হোসেনের “আমার সময়: আমার পথ” বইটি পড়তে গিয়ে অনুভূতির হাজার দুয়ার খুলে যায়। প্রকৃত অর্থে এই পুস্তকের পর্যালোচনা করা খুব সহজ কাজ নয়; এতো বহুমাত্রিক চিন্তা-চেতনার কথা বিধৃত হয়েছে এই গ্রন্থে যা পুরোপুরি তুলে আনাও অনেকাংশে কঠিন। এটি একপ্রকার আত্মজীবনী, আবার পুরোপুরি আত্মজীবনী নয়ও। বইয়ের নামকরণের দিকে খেয়াল করলেই সহজে বোঝা যায় যে এটি কোন সাধারণ গল্প বা উপন্যাস নয়। এসেছে লেখকের একান্তই নিজের ভাবনা, যা অতি সাধারণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে জন্মলাভ করেও লেখকের হৃদয়ে গেঁথে গিয়ে এই বইয়ে জায়গা করে নিয়েছে; এবং পেয়েছে দুইমলাটের ঠিকানা।

এই গ্রন্থে শতাধিক ছোট ছোট ঘটনার বর্ণনা রয়েছে; অনেকটা ডায়েরি লেখার মতনই, যা পাঠ করার পরেই মূলতঃ উপলব্ধিতে আসে যে এটি আকবর হোসেন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, মূল্যবোধ, সমাজ-দর্শন, ধর্ম-দর্শন, ও সামাজিক সংস্কার-রীতিনীতি বিষয়ে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গী তার একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছেন এই বইয়ে। সেখানে দেশপ্রেম, রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমও বাদ যায়নি। উপরন্তু তাঁর পড়াশোনা ও জানাশোনার সীমারেখা বহুদূর অবধি বিস্তৃত সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

এই বইয়ের বিষয়বস্তুগুলিকে মোটাদাগে তিনটি ভাগে ভাগ করলে দেখা যায় প্রথমতঃ তিনি তার বাল্যকাল থেকে শুরু করে এই সাতষট্টি বছরের জীবনে ঘটে যাওয়া নানাবিধ ঘটনার মাঝে জগত সংসার, মানুষ ও মানুষের সাথে তার আত্মার যে গভীর সম্পর্ক সেটি তুলে ধরেছেন, দ্বিতীয়তঃ ঈশ্বর ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে তার ব্যক্তিগত অবস্থান এবং সভ্য সমাজে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা সম্মন্ধে আলোকপাত করেছেন এবং তৃতীয়তঃ জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের এই জীবনকালে তার অতি সাধারণ নির্মোহ নির্লোভ জীবনযাপনে বিশ্বাস এবং প্রকৃতিবাদী আচরণ। আর এই তিনটি বিষয়ের আলোচনায় তিনি অত্যন্ত সুদক্ষ কারিগরের মত তার নিপুণ হাতে তৈরি করেছেন অনেক গল্পকথন; যা কখনও কখনও শুরু হয়েছে বিখ্যাত কোন কবিতার উক্তি কিংবা গানের লাইন দিয়ে; এবং অতি সাধারণ থেকে শেষটায় অসাধারণে পরিণত হয়েছে। কখনো তিনি হয়তো তার রচনার শুরুতে রবীন্দ্রনাথের কোন একটি গানের চরণ উদ্ধৃত করেছেন, এবং তার অন্তরালে বেদনা আর সমর্পনের যে ভাব লুকিয়ে রয়েছে সেকথা আমাদের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে সে আলোচনা করেছেন। তাঁর কাব্যপ্রেমে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ, মাইকেল মধুসুদন ছাড়াও বিখ্যাত উর্দু কবি, পশতু কবিসহ ইংরেজ কবিদের কবিতায় বিশিষ্টতা পেয়েছে। এছাড়াও রাগসঙ্গীত, গজল, ভজন, কীর্তনসহ সঙ্গীতের নানান শাখার নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তিনি তাঁর এই গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। আর এতে করেই তাঁর চরিত্রে জ্ঞান অন্বেষণের যে তৃষ্ণাকাতরতা রয়েছে সেটি প্রমাণিত হয়। এবং বোঝা যায় তার দেখার যে দৃষ্টি তা কেবল দেখা নয়, তাঁর শোনা কেবলই কানে শোনা নয়, গভীর উপলব্ধি রয়েছে সেসব দেখায়, শোনায়।

তিনি তার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লাহোরের এক পেশাদার নাচের শিল্পী যাদেরকে একসময় বাইজী নামে ডাকা হত তার জীবনের অনেক গোপন বেদনার কথা কত সহজ করে উপস্থাপন করেছেন, এবং সেখানে সেই বাইজীর কোনরূপ অসম্মান না করেই তিনি সেটি বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রিয় দোস্ত মোহাম্মদ যিনি স্ত্রীকে হারিয়ে তাঁর সমাধি পার্শ্বে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় রত ছিলেন দীর্ঘ জীবন; অতঃপর সে সমাধির কাছে বসা অবস্থায়ই তাঁর মৃত্যু হয়, আর এই মৃত্যুকে তিনি অতি সাধারণ মৃত্যু হিসেবে দেখেননি, বরং বিশ্বাস ও নির্ভরতার প্রতি মানুষের যে অমোঘ টান তারই প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছেন সেখানে। তাঁর লেখনীতে তাঁর প্রিয় বান্ধবীর সাথে তাঁর যে স্মৃতির কথা উঠে এসেছে সেটিও চিরচঞ্চল মানব-মানবীর প্রেমকে ছাড়িয়ে এক অনন্য প্রেমের পরশের দিকে নিয়ে যায় পাঠককে অতি সহজভাবে।

বস্তুতঃ সারাজীবন ধরে লেখকের দেখা, প্রত্যক্ষণ, ভাবনা, বোধ, উপলব্ধি, এবং অনুভবকে লেখক সাজিয়েছেন এক অদৃশ্য সুতোর বন্ধনে। আর তার সংসারে থেকেও সন্ন্যাসীর যে জীবন তিনি যাপন করেছেন সেই যাপিত জীবনের দুঃখ-প্রেম, শোক-স্বপ্ন, আশা-ভালোবাসার কথাই তিনি তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে। এই পুস্তকের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে একজন চিন্তাশীল মানুষের চেতনার কথা, আছে তার বেদনার কথা, আছে ভালোলাগা-ভালোবাসার কথা। এই বই পড়ে হৃদয়ের গভীরে এক ধরনের বোধ তৈরি হবে, এক প্রকার অনুভব গ্রাস করে রাখবে যে কোন পাঠককে। তার বোধের সমস্ত স্বত্তা জুড়ে এক নির্মোহ শীতল ভাবাবেশ তৈরি করবে; যা তার চিন্তার জগতকে প্রসারিত করবে নিঃসন্দেহে একথা বলা যায়।

তার লেখায় বিচ্ছিন্নভাবে হলেও অসাম্প্রদায়িকতা, স্বদেশপ্রেম, আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, মহান ভাষা আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের কথা উঠে এসেছে। এসব টুকরো টুকরো লেখনীগুলোর মধ্যে আমরা একজন সচেতন, সংবেদনশীল, নিরাসক্ত নির্মোহ ব্রহ্মচারীকেই দেখতে পাই; তিনি লেখক নিজেই। তাঁর ভাষার দখল এবং গঠনশৈলী অতি সাধারণ পাঠকের জন্য খানিকটা দুর্বোধ্য মনে হলেও হতে পারে। তবে তাঁর স্বভাবসুলভ উপস্থাপনা তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বকীয়তাকেই প্রমাণ করে। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) থেকে। মনোরম প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। 

লেখকের জন্য অনিঃশেষ শুভকামনা ও শ্রদ্ধা। এই পুস্তকের বহুল পাঠক প্রিয়তা প্রত্যাশা করছি, সেই সাথে বিএলআরসি-র জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

সঙ্গীতা ইয়াসমিন, টরন্টো, কানাডা।

(লেখাটি বিএলআরসি সাহিত্য পত্রিকার ২০১৬ সংখ্যা থেকে সংক্ষেপিতভাবে পুনর্মুদ্রিত।)