‘নিভৃত পূর্ণিমা’: দিনের আলোয় রাতের তারার গল্প

সামিনা চৌধুরী

মানুষের পুরোটা জীবন জুড়ে কি একটাই গল্প থাকে?  নাকি জীবনের বাঁকে বাঁকে  গল্প থাকে? এই প্রশ্ন পাঠকেরা হয়তোবা করেন না, কিন্তু একজন ঔপন্যাসিক এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান তার উপন্যাসে। অনেক চড়াই উৎরাই,  অনেক চাওয়া পাওয়া,  অনেক ঘাত প্রতিঘাত ঠেলে এগিয়ে চলা জীবনের কোথাও কোথাও  লুকানো থাকে আনন্দ বা বেদনা, যা হয়তো দেখা যায় না কিন্তু সেই আনন্দ বেদনার গল্প কেউ কেউ  পুষে রাখে হৃদয়ের মখমলের কৌটায়। সেই গল্প মানুষের মনের নিভৃত কোঠায় পূর্ণিমার অপার্থিব জোৎস্না ছড়িয়ে যায়। পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন, “ধরো কোন একদিন যদি খুব দূরে ভেসে যাই/ আমারও সোনার কৌটো ভরা থাকবে প্রতিটি দিনের/ এইসব ঘন রঙে, বসন্ত বাতাসে, বৃষ্টি জলে।/ যখন তখন খুশি ওয়াটার কালারে আঁকা ছবিগুলো/ অম্লান ধাতুর মতো ক্রমশ উজ্জ্বল হবে সোহাগী রোদ্দুরে।“ রেফাত আল হামিদ তার ‘নিভৃত পূর্ণিমা’ উপন্যাসে মনের ভেতর যত্ন করে পুষে রাখা সেই সোনালী ভালোবাসার গল্প বলেছেন যা মানব-মানবীর মনে হাজার বছর ধরে একই রকম উজ্জ্বল থাকে এবং স্মৃতির অম্লান ধাতুর ছোঁয়ায় ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়।   

উপন্যাসের মূল পুরুষ চরিত্র রুপু। ঢাকাতে পড়াশুনা এবং বেড়ে ওঠা।  টরন্টোতে রুপুর স্ত্রী এবং দুই ছেলে থাকে এবং সেই সুবাদে বছরে দুই তিনবার রুপুকে ঢাকা টরন্টো লম্বা ভ্রমণ করতে হয়। উপন্যাসের মূল নারী চরিত্র  কোলকাতায় বাস করা রিনি । রিনির স্বামী আর দুই সন্তানও টরন্টোতে থাকে। ফলে রিনিকেও বছরে দুই তিনবার  কোলকাতা টরন্টো যাওয়া আসা করতে হয়। রিনির স্কুল জীবন কেটেছে ঢাকায় সেখানে রুপুর সাথে সে একই ক্লাসে পড়তো। সেই কিশোর বেলায় রিনির মনে রুপুর জন্য তৈরী হয়েছিল প্রগাঢ় ভালবাসা। কিন্তু রুপু তার নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের টানাপোড়েনে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে সেই ভালবাসায় সাড়া দেয়নি। তারপরও রিনির মনে সেই কিশোর বেলার প্রেম রয়ে যায় তাজা গোলাপের মত। রুপুও ভোলেনি রিনিকে। স্কুল শেষ করে সংখ্যালঘু রিনির পরিবার তাকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেয়। সেখানে কলেজ শেষ করে রিনি ইঞ্জিয়ারিং পেশায় কাজ করতে থাকে। বিয়ে করে সংসার শুরু করে। এদিকে সংসারের হাজারো প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে রুপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষে চাকরি জীবন শুরু করে। রুপু রিনি দুজনেই যখন তাদের মধ্যবয়সে পৌঁছে, তখন হঠাৎ একদিন ক্যাথি প্যাসিফিকের ফ্লাইটে টরন্টো থেকে দুজনেই উড়াল দেয় একই দিনে। রুপুর গন্তব্য ঢাকা আর রিনির কোলকাতা। হংকং এয়ারপোর্টে দুজনেরই দীর্ঘ যাত্রা বিরতি। এই বিরতিতে রবীন্দ্রনাথের রেলগাড়ীর কামরায় ‘হঠাৎ দেখা’র মত  দুজনের দেখা হয়। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে এসে শুরু হয় দুজনের আলাপ। মনের আগল খুলে দুজনেই বলে যায় তাদের হৃদয়ের যত না বলা কথা। তারা বুঝতে পারে ‘রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।‘ 

আধুনিক কালের খুব জনপ্রিয় সাহিত্যরূপ উপন্যাসের আভিধানিক অর্থ হলো উপযুক্ত বা বিশেষ রূপে স্থাপন। ঔপন্যাসিক মানুষের জীবনের গল্পগুলোকে বিশেষ একটা সময় ও স্থানে উপস্থাপন করেন আর উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমিতে সমগ্র মানবজীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি আঁকেন। ঔপন্যাসিক রেফাতের  ‘নিভৃত পূর্ণিমা’ উপন্যাসের সময়কাল শুরু হয়েছে ১৯৪৭ এর দেশভাগের আগে যখন রুপুর দাদাজান এবং নানাজান পরস্পরের বোনকে বিয়ে করে কোলকাতার ভবানীপুরে বাড়ি কিনে সংসার শুরু করে। রুপুর দাদা এবং নানা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ১৯৪৮ এ রুপুর দাদা এবং নানা যখন ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে যখন রুপুর বাবার বয়স ১২ বছর।  নতুন দেশে এসে এই দুই পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন এবং সময়ের নিয়মে পরিবারের ছেলে মেয়েদের বেড়ে ওঠা, তাদের শিক্ষা, চাকরি বিয়ে এসব গল্পও বলেছেন লেখক। কাজেই উপন্যাসটিতে রুপুর নিজের ও তার বাবা-মায়ের গল্পের পাশাপাশি রুপুর মামা খালা এবং মামাতো ভাইবোনদের গল্পও উঠে এসেছে। অন্যদিকে রিনির পরিবার অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন। তাদের আদি বাড়ি  চট্টগ্রামে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলেও  ৪৭ পরবর্তী সময়ে রিনির পরিবার বাংলাদেশেই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে রিনির ছোট পিসি শুভ্রাকে পাক হানাদাররা তুলে নিয়ে গেলে পরিবারটি ধীরে ধীরে দেশ ছাড়তে শুরু করে।  পরিবারের একাংশ দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায় ৭১ সালেই। তারপর ১৯৭৬, ১৯৮৭, ১৯৯২ এ বঙ্গবন্ধু হত্যা, বাংলাদেশে ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোর পুনর্বাসন, বাবরি মসজিদ দাঙ্গা প্রভৃতি পটভূমিতে ধীরে ধীরে রিনির কাকা ফুপুরা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পারি দেয়। কাজেই উপন্যাসটিতে  স্বাধীনতার পর দেশ ছেড়ে সুইডেনে চলে যাওয়া এবং সেখানে একজন চিত্র শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া রিনির ছোট পিসি শুভ্রা এরিক্সন, রিনির অন্যান্য কাকা মামাদের গল্পও পাঠক জানতে পারবেন। সেই সাথে জানতে পারবেন বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে কীভাবে রিনির কাকা পিসিরা একে অন্যের হাত ধরে নতুন জীবন সংগ্রামের পথে এগিয়ে গিয়েছে। এছাড়াও আছে রুপুর জীবনে প্রথম নারী শিউলিবুর গল্প, রিনির জীবনে প্রথম পুরুষ অর্ণবের অনুভূতির কথা, খান বাহাদুর পরিবারের ছেলে মহসিন দাদুর গল্প, নানীজানের অকৃতদার বড়ভাইয়ের সারা জীবন বিয়ে না করে থেকে যাওয়ার কাহিনি, রিনির বন্ধু হায়দারাবাদের মুসলমান ছেলে জামসেদের পরিবারের সংখ্যালঘু নিগ্রহের বেদনার আখ্যান, রুপুর নানাজানের কেয়ারটেকার রহমত চাচার অসুখী দাম্পত্যের দীর্ঘশ্বাস … এমনি আরও অনেক গল্পে ঠাঁসা উপন্যাস ‘নিভৃত পূর্ণিমা’। রুপু রিনির মিষ্টি ভালবাসার গল্পের পাশাপাশি এই এতগুলো মানুষের জীবনের গল্প ঔপন্যাসিক রেফাত মহাকাব্য লেখকের মত অসামান্য    মুন্সিয়ানায় লিখেছেন। 

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ধর্মের ভিত্তিতে অনেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষকে যেমন ভারতে চলে যেতে হয়েছিল, তেমনি অনেক মুসলমান মানুষকেও বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে চলে  যেতে  হয়েছিল ভারত থেকে। ব্রিটিশ রেডক্রসের তথ্যানুযায়ী সেই সময় ১৪ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুহারা হয়েছিল৷ এই দেশত্যাগের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুল্য দিয়েছেন সেই জেনারেশনের মানুষেরা। বাংলা সাহিত্যে সেই সময়ের অনেক গল্প অনেক উপন্যাস আমরা পড়েছি। সেই সময়ের অন্তপ্রবাহ ছিল প্রত্যাশিত যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল। এরপর ১৯৭১ সালে আরেকটা বড় ধরনের অন্তপ্রবাহ হয়েছিল। ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজির তথ্যানুযায়ী ১৯৭১ সালে ১০ মিলিয়ন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষকে গনহত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি লুট হওয়ার ভয়ে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল যাদের বেশির ভাগই ভারতে গিয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক পালা বদলের কারণে এই অন্তপ্রবাহ ১৯৭৬, ১৯৮৭ এবং ১৯৯১ তেও চলমান ছিল। বর্তমান সময়ে যুদ্ধ বা ধর্মীয় দাঙ্গা না থাকলেও মানুষ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কারণে দেশ ছেড়ে পারি দিচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে। কাজেই ভারত বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ প্রতিবছর কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে অভিবাসী হয়ে পারি দেয়। ‘নিভৃত পূর্ণিমা’ উপন্যাসের চরিত্রগুলো সকলেই কোনো না কোনো কারণে দেশান্তরিত হয়ে অন্য কোনো দেশে জীবন সংগ্রাম করেছে। রুপুর নানাজান, নানীজান, নানীজানের অকৃতদার ভাই, রুপুর বাবা, মামা রিনির কাকা, মামা, পিসি সকলেই ফেলে আসা স্মৃতি নিয়ে এগিয়ে গেছে জীবনের নতুন পথে। এমনকি রুপু এবং রিনিও স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ এবং ভারত ছেড়ে পারি দিয়েছে কানাডায়, সেখানেও হয়তো তাদের পরের প্রজন্ম তৈরি করবে অন্য কোন নতুন গল্প। ‘নিভৃত পূর্ণিমা’ উপন্যাসটিকে  তাই বলা যায় একঝাঁক দেশান্তরী মানুষের আনন্দ বেদনার আখ্যান।   

আধুনিক প্রেমিক প্রেমিকারা খুব সচেতন হয়। ভালোবাসার পূর্ণতার আগে তারা নিজের যোগ্যতার পরিমাপে নিশ্চয়তা খোঁজ করে। সেভাবে দেখলে ‘নিভৃত পূর্ণিমা’র রিনি রুপু আধুনিক প্রেমিক প্রেমিকার উদাহরণ। তাই ভালবাসার মানুষকে খুঁজে নিয়ে নিজের করে পেতে চেয়েছিল কি-না রিনির এই প্রশ্নের উত্তরে রুপু বলে, ‘হয়তো খুঁজেছি মনে মনে। হয়তো নিজের হীনমন্যতার জন্যই ভেতরে ভেতরে চেয়েছি যেন কখনো খুঁজে না পাই পাই।‘ একটি সার্থক উপন্যাসে কাহিনি, ঘটনা, চরিত্র, বর্ণনাভঙ্গি, সংলাপ, ভাষা ইত্যাদির মাধ্যমে মূলত লেখকের জীবনদর্শন ও জীবনানুভূতিই প্রকাশ পায়। আধুনিক মানুষ রেফাত জানেন যে বর্তমান সময়ে প্রেমের আবেগের চেয়ে বাস্তবতা অনেক বেশি জরুরী। ভালোবাসা থাকলে কষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে। তাই কিশোরবেলার নিষ্পাপ ভালবাসা হৃদয়ের মখমলের কৌটোয় থাকলেই হয়তো নিরাপদ। রিনির ছোট কাকীর ভাষায়, ‘খুব ভালোবাসার মানুষগুলোই কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন ভঙ্গ এদের দিয়েই হয়।‘      

আমেরিকান কবি এজরা পাউন্ড তার ‘আ ফিউ ডোন্টস বাই এন ইমেজিস্ট (A  Few Don’ts by an Imagist )’ প্রবন্ধে চিত্রকল্পের সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘ চিত্রকল্প বুদ্ধি আর আবেগের সমন্বয়ে পাঠকের মনে তাৎক্ষণিক একটি ভাবনা তৈরী করে।‘  অর্থাৎ কোনো কবিতা বা গল্প বা উপন্যাস পড়ার সময় লেখাটিতে উপস্থাপিত চিত্রকল্প পাঠকের মনে স্থান বা সময়ের একটা ছবি তৈরি করে, যা পাঠক মনের চোখে দেখতে পান। সাহিত্যের সফল চিত্রকল্প পাঠককে পঞ্চেন্দ্রিয়র অনুভূতি দিতে সক্ষম। বাংলা উপন্যাসে চিত্রকল্পের ব্যবহার খুব সমৃদ্ধ।  ‘নিভৃত পূর্ণিমা’ উপন্যাসে পাঠক দেখতে পাবেন ভবানীপুরের উঁচু পাঁচিল ঘেরা একটি বাড়ি, যার সদর দরজায় লোহার পাল্লার গেট, পাশে মার্বেল পাথরের সিঁড়ি, শিউলি ফুলের ডিজাইন করা সাদা মোজাইকের মেঝে। যে বাড়ি ছেড়ে রুপুর দাদা আর নানা ৪৭ এর দেশভাগের সময় চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে।

ঔপন্যাসিক রেফাতের লক্ষ করার ক্ষমতা এবং সেটা পুঙ্ক্ষানুরূপে বর্ণনা করার অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে। বইটিতে পাঠক এয়ারপোর্টের নিখুঁত ছবি দেখতে পাবেন। লেখকের ভাষায়, ‘ট্রান্সফার ডেস্কটার সামনে ছোট্ট একটা কিউ, যদিও ডেস্কটাতে ইমিগ্রেশনের কেউ আসেনি তখন পর্যন্ত।… সাদা রঙের শার্ট, ব্ল্যাক স্কার্ট আর হ্যাট পড়া দুটো মেয়ে ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে ট্রান্সফার ডেস্কটায় বসল।‘  খুব স্বাভাবিক একটা এয়ারপোর্টের ছবি ভেসে আসে যেখানে এয়ারপোর্ট কর্মীরা পৌঁছার আগেই যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। 

‘নিভৃত পূর্ণিমা’ গ্রন্থটি প্রকাশ  করেছে অন্যপ্রকাশ এবং প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। প্রচ্ছদে প্রবাহিত জলে কচুরিপানা ভেসে যাওয়ার ছবি। জলের একপাশে কালো মত পাড়ের আভাস। জলে হালকা নীল আকাশের ছায়া। বইটির পেছনের প্রচ্ছদে লেখক নিজেই মানবজীবনকে কচুরিপানার সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘ভাসতে ভাসতেই এই মানবজীবন এক সময় বহু প্রতীক্ষিত ভালবাসার সান্নিধ্যে আসে, ভালবাসা তাদের স্পর্শ করে যায় তীরের নুয়ে পড়া গাছগুলোর মতন।‘ ‘নিভৃত পূর্ণিমা’ উপন্যাসের গল্পটির সাথে খুব মানানসই প্রচ্ছদ।

চমৎকার এই উপন্যাসটি পাঠকের হাতে তুলে দেবার জন্য রেফাত আল হামিদকে অভিনন্দন জানাই।