নজরুল-বীক্ষা এবং আমি

রাজিউল হাসান

২০১৩ সালের ’অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আমার জন্য বিশেষ এক গ্রন্থমেলা। অন্যান্য গ্রন্থমেলায় আমার প্রবেশ ঘটত শুধুমাত্র একজন পাঠক হিসেবে. কিন্তু এবার প্রবেশ করেছি লেখক হিসেবেও। সাহিত্যের প্রতি টান এবং লেখার মাধ্যমে সমাজ, সংসার, দেশকে বদলে দেয়ার অঙ্গীকার নিয়েই আমার লেখক জীবণের শুরু। অস্ত্রের চেয়ে কলমের শক্তি লক্ষগুণ- একথা বিশ্বাস করি মনেপ্রাণে। আর একারণেই কলম ধরা। আমার প্রথম সৃষ্টি ’অনুরণন’। কিন্তু মানুষের হৃদয় বড় দূর্ভেদ্য দূর্গ। সে হৃদয়ে সহজ প্রবেশ শুধুমাত্র ভাগ্যবানের পক্ষেই স্বম্ভব; আমার মত আম-জনতার না- এ কথা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগল না। যে দুয়েকজন আমার উপন্যাস পড়ল, তারা প্রশংসা করল আর যারা আমার নাম জানে না, আমাকে চেনে না, তারা প্রত্যাখ্যান করল। এই প্রত্যাখ্যান এখনও অব্যাহত।

সাহিত্যের ভূবনে আমি এক নতুন বাসিন্দা। বড়ছোটো অনেক সাহিত্যিক, সমালোচক, প্রাবন্ধিক, কবির নাম জানা থাকলেও, চেনা থাকলেও, তাঁরা চেনেন না আমাকে। চেনার প্রয়োজনও নেই। আর একারণে তাঁদের সান্নিধ্য পাওয়া দূরহ। একা একাই গ্রন্থমেলায় এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই আমি। লেখক আড্ডায় বড় বড় সাহিত্যিক-কবি আসেন, আড্ডা দেন, চলে যান। ফিরেও তাকান না কেউ আমার দিকে। এত অসহায়ত্ব জীবনে কখনও অনুভব করিনি। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে মেলার তৃতীয়দিন বন্ধু, কবি বরুন কুমার বিশ্বাসের ফোন এলো। জানতে পারলাম, সে গ্রন্থমেলায়। দ্রুত পৌঁছালাম সেখানে। বরুনের সাথে দেখা করার সুবাদে পরিচয় হল এমন একজনের সাথে যিনি বর্তমানে সাহিত্যে আমার পথিকৃত। অধ্যাপক সুব্রত কুমার দাস স্যার। সাধারনত দেখা যায়, বড় মাপের মানুষগুলো ছোট মানুষদের সাথে সহজ থাকেন না। কিন্তু স্যার ভিন্ন মানুষ। নিজে থেকে সরল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে এগিয়ে এলেন আমার সাথে হাত মেলাবেন বলে। জানি না, উনি জানতে পারলেন কিনা, খুব সহজেই একজন মানুষের হৃদয় জয় করে নিলেন। একেই বুঝি বলে মন জয়ের ম্যাজিক!

গ্রন্থমেলার চতুর্থদিনে স্যারের উৎসাহ পেয়ে তাঁর হাতেই নজরুল মঞ্চে উন্মোচিত করতে সামর্থ হলাম আমার উপন্যাস “অনুরণন” এর মোড়ক। এই মোড়ক উন্মোচনের ঠিক এক ঘণ্টা আগে একই স্থানে বিখ্যাত নজরুল সাধক এবং নজরুল অন্তপ্রান মুস্তফা জামান আব্বাসী স্যারের হাতে, নজরুল গবেষক ড. খালেদা বেগম এবং কল্যান মজুমদারের উপস্থিতিতে উন্মোচিত হয় অধ্যাপক সুব্রত কুমার দাস স্যারের গবেষনাগ্রন্থ ’নজরুল-বীক্ষা’ এর মোড়ক। আমার তখন নজরুলময় সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, কবি নজরুল পৃথিবীতে না থেকেও তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করছেন আমাদেরই মাঝে; নজরুল যেন জীবিত! মোড়ক উন্মোচনের দিনই গ্রন্থটি আমার হাতে চলে আসে।

সাধারনত সেসব অসহিষ্ণু পাঠকের কাতারে আমিও পড়ি, যারা প্রবন্ধ, গবেষনাগ্রন্থ, সমালোচনা পড়তে স্বচ্ছন্দবোধ করে না। এসব পড়তে অনেক ধৈর্য্য লাগে, যা আমার সামান্যতমও নেই। কিন্তু স্যারের প্রতি প্রবল আকর্ষনের কারনেই হোক বা অন্য কোন কারনেই হোক, ’নজরুল-বীক্ষা’ আমি পড়তে শুরু করলাম। ভেতরে ঢুকতেই গ্রন্থটিকে বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভক্ত দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সাধারনত এমন ধরনের গবেষনাগ্রন্থে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একাধারে আলোচনা চলতে থাকে। ফলে ধৈর্যের চ্যুতি ঘটাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে এমনকিছু ঘটবে না বলে ভাল লাগায় ভরে গেল মন।

গ্রন্থটির প্রথম পরিচ্ছেদ “দেবকোটাঃ নেপালের নজরুল”। এখানে নেপালের বিদ্রোহী কবি লক্ষ্মীপ্রসাদ দেবকোটা, যিনি মহাকবি উপাধিতে নন্দিত এবং বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। অবাক বিস্ময়ে পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, আমরা শুধু সমালোচনায় মূখোর বাংলার কবিসাহিত্যিকগণ বহিঃবিশ্বের কবিসাহিত্যিক দ্বারা প্রভাবিত। যেমন, নজরুলের কাব্য ভাবনায় শেলী এবং বায়রনের মত বিপ্লবী কবিদের প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন গবেষকগণ। পক্ষান্তরে লক্ষ্মীপ্রসাদ দেবকোটার সৃষ্টিতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে কিডস যেমন প্রভাব বিস্তার করে আছেন, ঠিক তেমনি নজরুলের প্রভাব কোন অংশেই কম নয়। আমি মনে করি, এ তথ্য রীতিমত এক বিস্ময়কর আবিস্কার। এ পরিচ্ছেদে কবি নজরুলের ’বিদ্রোহী’ এবং মহাকবি দেবকোটার ’পাগল’ কবিতাদ্বয়ের তূলনামূলক আলোচনার পাশাপাশি তাঁদের জীবন এবং অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি সংক্ষিপ্ত পরিবেশে এবং স্বল্পভাষায় গভীর আলোকপাত করা হয়েছে।

গ্রন্থটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ “বিনয় সরকারের নজরুল-মূল্যায়ন”। এই পরিচ্ছেদ নিয়ে কথা বলার আগে বিনয় সরকারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার প্রয়োজনবোধ করছি। বিশ্বপরিব্রাজক বিনয় কুমার সরকার ছিলেন অত্যন্ত উচ্চমানের সাহিত্যানুরাগী, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, গবেষক। তিনি এমন একজন বাঙ্গালী পন্ডিত যাঁর আমেরিকা, চীন, জাপান, জার্মান, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন শহর থেকে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন ইংরেজী গ্রন্থ। এসব গ্রন্থের মাঝে উল্লেখযোগ্য- ১৯১২ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Science of History and The Hope of Mankind, বাংলাতে প্রকাশিত ঐতিহাসিক প্রবন্ধ এবং সাধনা, The Science of Education and The Inductive Method of Teaching Series, The Aids to General Culture Series, ১৯১৬ সালে চীন থেকে প্রকাশিত Love in Hindu Literature এবং The Beginning of Hindu Culture as World Power, আমেরিকা থেকে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ The Bliss of a Moment এবং জার্মানির বার্লিন শহর থেকে রচিত ও প্রকাশিত The Futurism of Young Asia ইত্যাদি। জাপান, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ ভ্রমনের ওপর তাঁর রয়েছে বাংলা ও ইংরেজী প্রত্যেকটি ভাষায় মুদ্রিত ১২ হাজারের অধিক করে মোট ২৮ হাজার পৃষ্ঠা রচনা ছাড়াও ফরাসি, জার্মানি ও ইতালিয়ান ভাষায় রচিত গবেষনাগ্রন্থ। তিনি ছিলেন আটটি ভাষায় দক্ষ পন্ডিত।

The Futurism of Young Asia গ্রন্থের Currents in the Literature of Young India অধ্যায়ে তিনি তৎকালীন সময়ে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে মুসলমান লেখকদের আবির্ভাবকে বর্ননা করেছেন। উদাহরনস্বরূপ টেনেছেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং ’বিদ্রোহী’ কবিতাকে। নজরুলকে নিয়ে বিনয় সরকারের ভাবনা এখানেই থেমে থাকেনি। তাঁর চোখে নজরুল ছিলেন প্রিয়কবি হুইটম্যানে এবং রবীন্দ্রনাথের সংমিশ্রণ। “বিনয় সরকারের বৈঠকে” গ্রন্থে তাঁর জীবনভর অর্জিত জ্ঞানরাজির সংক্ষিপ্ত একাট রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রশ্নোত্তরের আকারে রচিত সে গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে কখনো ইঙ্গিতে, কখনো বিশদভাবে বিশবার নজরুলকে টেনেছেন। আমার মতে, বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্নভাবে নজরুল এবং তাঁর সৃ্িষ্টকে বিভিন্ন আঙ্গিকে মূল্যায়ন করলেও বিনয় সরকারের সেরা উক্তিগুলোর মাঝে অন্যতম হল,“নজরুল আধুনিক বাংলাকাব্যের যুগপ্রবর্তক”। এত তরুন একজন লেখক প্রবীন একজন পন্ডিতের দ্বারা মূল্যায়িত হওয়ার ঘটনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদে এসে লেখক ফরিদপুরের ইতিহাসের সাথে কবি নজরুলের সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে তিনি বিভিন্ন রেফারেন্স, বিশেষ করে প্রানতোষ চট্টোপাধ্যায় এবং পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের রচনা এবং স্মৃতীচারণের প্রতি আলোকপাত করেছেন। কথাপ্রসঙ্গেই চলে এসেছে গান্ধীজির সাখে কবির পরিচয়ের ঘটনা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে সম্পর্ক, বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেনের প্রসঙ্গ। এবং সেই সাথে আলোচিত হয়েছে ফরিদপুরে নজরুলের সাহিত্যকর্ম ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উল্লেখযোগ্য দিক। এ পরিচ্ছেদে এক নতুন নজরুলের সাথে পরিচয় ঘটবে পাঠকের, তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশের ধারনা মিলবে এবং ফরিদপুরের ইতিহাসে নজরুল কতখানি স্থান জুড়ে আছেন, তার একটি সম্যক ধারনা মিলবে। এ স্থানে এসে পাঠক নিজেকে হারাবে ইতিহাসের পটভূমিতে। সহজ এবং প্রাঞ্জলভাষায় গুরুগম্ভীর বিষয় বর্ননার এক অনন্য সাধারন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন লেখক এই পরিচ্ছেদে।

চতুর্থ পরিচ্ছেদে এসে লেখক সেই সব সমালোচকের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন, যাঁরা প্রশ্ন তোলেন কবি নজরুলের ইংরেজী ভাষা এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যজ্ঞান নিয়ে। এখানে লেখক মোবাশ্বের আরী, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, শান্তিপদ সিংহ প্রমুখের উদ্ধৃতি, স্মৃতীচারণসহ কবির লেখা কিছু চিঠিপত্রের উল্লেখ করেছেন। প্রমানস্বরূপ চুলচেরা বিশ্লেষন করেছেন কবির বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম ও ঘটনাকে। লিপীবদ্ধ করেছেন কবির আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত ইউরোপীয় বিভিন্ন প্রখ্যাত সাহিত্যিককে। অনেকেই মনে করেন, কবি নজরুল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের তেমন সুযোগ পাননি বলে বিশ্বসাহিত্য থেকে অনেকাংশেই বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তাঁদের ধারনা কতখানি ভূল, তা এই পরিচ্ছেদে পাঠক বুঝতে পারবেন; সেই সাথে উপলব্ধি করবেন, কবি কতখানি জ্ঞানের আঁধার। উদাহরনস্বরূপ গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদের একটা ছোট্ট অংশ হুবহু তুলে ধরছিঃ ’বর্তমান বিশ্বসাহিত্য’ (১৯৩২) রচনার সমসাময়িককালে নজরুলের ব্যাপক পাঠ্যাভ্যাসের এক অজানিতপূর্ব বিবরণও পাওয়া যায় শান্তিপদ সিংহের বইতেই। উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ মনে হলেও এর তথ্যের গুরুত্ব বিচার করে পাঠক আশা করি ক্ষমা করবেন। শান্তিপদ সিংহ জানান:

কবি তখন বিবেকানন্দ রোডের একটা পুরোনো ভাঙ্গা বাড়িতে থাকেন। প্রায় রোজই যাই। আমি এমন একটা বড় লাইব্রেরির সদস্য; দুহপ্তার ওপর টলষ্টয়ের Resurrection বইটা এনেছিলাম। ইচ্ছা ছিল যাবার পথে বইটা বদলে নিয়ে যাব। কিন্তু কোন কারণে কবি বইটা আমার হাত থেকে নিয়ে দেখতে লাগলেন।

বললাম ওটা আর পড়তে হবে না! অনেক সময় নেবে শেষ করতে বরং এক চাল খেলি। দুজনে খেলতে বসলাম! তাঁকে অত্যন্ত অন্যমনস্ক দেখলাম। খেলার মাঝে মাঝে বইটার পাতা উল্টে যাচ্ছে। দাবা তিনি ভাল খেলতেন এবং আমার খেলার শিক্ষাগুরু ছিলেন। হেরেই যেতাম। কখনো হারাতে পারিনি। সেদিন কিন্তু দুবাজি খেলায় অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে ড্র করতে হয়েছিল।

দ্বিতীয় বাজি খেলার পর বইটা নিয়ে তিনি উঠে গেলেন। আমিও অন্য ঘরে চলে গেলাম। চলে আসবার সময় দেখলাম কবি বইটা নিয়ে বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে বসে আছেন।

আমি বললাম- যাচ্ছি। কোন জবাব না দিয়ে তিনি ঘাড়টা একটু কাত করলেন। অথচ আমি চলে আসবার সময় যাচ্ছি বললে খাঁক করে উঠতেন, সে কিরে! এত শিগগীর? তা কাল আসছিস তো?

তার পরের দিন যেতে পারিনি। তার পরের দিন যেতে কোন কিছু বলবার আগে সেই বইটা আমাকে দিয়ে বললেন, এটা বদলে আর একটা বই আনবি।

বইটা পড়তে আমার প্রায় দু’হপ্তা লেগেছিল। ২/১ দিনের মধ্যে সেটা পড়ে ফেললেন। সন্দেহ হল। জিজ্ঞাস করলাম, পুরো বইটা এর মধ্যে পড়েছ? বললেন- কালই শেষ হয়ে গিয়েছিল। মনে করেছিলাম তুই আসবি, এটা বদলাবার জন্য দিয়ে দেবো।

আমার অবিশ্বাস হলো। পরীক্ষা করবার জন্যে বইটা খুলে শেষের দিকের একটা জায়গা পড়ে জিজ্ঞাস করলাম এটা কোন ঘটনার পর বলতো? তিনি যা হুবহু বললেন শুনে আশ্চর্য হলাম। বইটা আমি ভাল করেই পড়েছিলাম। দেখলাম তিনি তাহার চেয়েও ভাল পড়েছেন। এটা অবশ্য টাট্কা পড়া বলে মনে থাকার কথা। কিন্তু আমার মনে হয় দ’চার বছর পরেও পরীক্ষা করলে তিনি হুবহু তা বলতে পারতেন।

প্রতিভাবান লোকদের কথাই আলাদা।

এর আগে কবি একদিন বলেছিলেন যে দু-চারখানা বই বাদে তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্যের কিছু পড়েননি।
সেই থেকে দু-চার দিন অন্তর আনতে লাগলাম ডস্টয়ভস্কি, টলস্টয়, গর্কী, ভিক্টর হিউগো, টুরগেনীভ, মোঁপাসা, প্রভৃতি নাম করা লেখকের বই। আর তিনি মুড়িমুড়কি খাওয়ার মত সব পড়ে শেষ করতে লাগলেন। কিছু ইংরেজি কাব্যের বইও এনে দিয়েছিলাম।

এদিকে আমার লাইব্রেরিতে আর কোন বই পাচ্ছি না এক শেক্সপিয়ার ছাড়া। তাও কখানা এনে পড়তে দিলাম। ব্যাপার একই। এ দাঁতভাঙ্গা শব্দের লেখাও একদিনেই শেষ।

একদিন বললেন, “কইরে, আর বই আনছিস না কেন?” বললাম- এই ক’মাস ধরে যা খেয়েছ তা হজম করা হোক। দেখি কবি বেশ ক্ষুণœ হলেন। আমি তখন সত্য কথা বললাম যে তেমন বই আর আমাদের লাইব্রেরিতে নেই। কবির তখন ইংরেজি বই পড়বার একটা নেশা ধরে গেছে। ইংরেজি বই পেলে আর রক্ষা নেই। রাত ফুটো করে শেষ না করে ছাড়তেন না। এমন কি হুইলার স্টল থেকে ছ’ পেনি সংস্করণের বইও তিনি ভাল করে পড়তেন। এতে বাড়িতে একটা অশান্তি এসেছিল কিছুদিন- কবির øান, খাওয়া, শোয়া নিয়ে। এ নিয়ে আমাকেও কিছু বাক্যবান সইতে হয়েছে বই এনে দিই বলে।

কবি বললেন- কাল থেকে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে যাবেন। আমি বললাম- না, যেতে হবে না। আমি সে বন্দোবস্ত করেছি। বই বাড়িতেই পাবে।

তারপর আমার এক বন্ধুর সাহায্যে অনেক জায়গা থেকে চিনির বলদের মত এনে পড়িয়েছি।

এমন একদিন এলো ইংরেজি, রুশ, ফরাসী সাহিত্যের প্রায় সব বইই তিনি পড়ে ফেললেন। যেমন তেমন করে নয়, সত্যিকার পড়ার মত করে পড়া।

এভাবেই লেখক এই পরিচ্ছেদে বিভিন্ন ঘটনার বর্ননা করে, বিভিন্ন প্রমান উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন, নজরুল মোটেই ইংরেজি ভাষা এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে দূরে ছিলেন না, উপরন্তু তিনি ছিলেন পন্ডিত।

একইভাবে লেখক গ্রন্থটির বাকি পরিচ্ছেদগুলোতে নজরুল এবং তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা করেছেন। সুপাঠ্য এই গ্রন্থটি মোট এগারটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত।

এবার আমার অনুভূতি প্রসঙ্গে আসা যাক। গ্রন্থটি পড়ে একাধারে যেমন অভিভূত, মুগ্ধ আমি এবং সেই সাথে কিছুটা অসন্তুষ্ট। প্রতিটা পরিচ্ছেদে যখন নজরুলের বিশেষ এক দিক নিয়ে মেতে উঠছিলাম, ঠিক তখনই উপসংহারে পৌঁছে যাচ্ছিলাম। স্বল্প পরিসরে আলোচনার এটা একটা সীমাবদ্ধতা। গ্রন্থটিতে যে এগারটা পরিচ্ছেদ রাখা হয়েছে, লেখক চাইলে তার প্রতিটি নিয়ে একেক গবেষনাগ্রন্থ প্রকাশ করতে পারতেন; নজরুল সাহিত্যকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে পারতেন। তবে সুপাঠ্য এই গ্রন্থটি নজরুলভক্ত, গবেষক এবং সাধারন পাঠকের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ। এখানে নজরুলকে এমনভাবে বর্ননা করা হয়েছে যা বেশিরভাগ পাঠকের অজানা। গ্রন্থটির প্রতিটা পাতায় পাঠক রোমাঞ্চিত হবেন নতুন এক নজরুলকে পেয়ে। এটি প্রকাশের মাধ্যমে লেখক নজরুল গবেষনার এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন। অধ্যাপক সুব্রত কুমার দাস স্যারের কছে আমার অনুরোধ থাকবে, এইভাবেই তবে আরও বিশদ আকারে ভবিষ্যতে গবেষনার মাধ্যমে নজরুলকে পৌঁছে দেবেন আপামর জনতার কাছে এবং নজরুল সাহিত্যকে করবেন আরও সমৃদ্ধ।

কালি ও কলম, ঢাকা, এপ্রিল ২০১৩