নজরুল বিষয়ক দশটি প্রবন্ধ: ছোট পরিসরে বড় কাজ

মোজাফফর হোসেন

জন্মসূত্রে সম্প্রদায়গত ঐক্যের কারণে কবি নজরুলের প্রতি আবেগজাত ভালবাসা যতটা দৃশ্যমান, তাঁর সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাজাত অনুশীলন সে অনুপাতে একেবারেই হিসাবের মধ্যে আনার মতো নয়। হিসাবের গণ্য হলে নজরুলের সব সৃষ্টিকর্ম বাজারে সহজলভ্য হতো। তাঁর সাহিত্যাদর্শ ও জীবনদর্শন শিক্ষিত (সার্টিফিকেটধারী অর্থে) লোকজনের কাছে পরিচিত থাকত। প্রয়োজন পড়ত না ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে নজরুল ভক্তি প্রদর্শনের প্রজ্ঞাপনের। প্রয়োজন যা পড়ে তা হলো সাহিত্যামোদীর মন নিয়ে বা গবেষকের মন নিয়ে নজরুল সাহিত্য পাঠের। তরুণ গবেষক-সমালোচক-সাহিত্যামোদী সুব্রত কুমার দাস ‘নজরুল বিষয়ক দশটি প্রবন্ধ’ লিখে এই সত্যটিই প্রমাণ করলেন। নজরুল বিষয়ে তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত এই বইটি নজরুলের সাহিত্য বিষয়ে দশ দিগন্ত উন্মোচক।

লেখকের অনুসন্ধানী দৃষ্টি খুঁজে পেয়েছে নজরুলের গল্প-উপন্যাসে বহুবিধ অভিনবত্ব। যেমন ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’। কোন বাঙালী মুসলমানের লেখা প্রথম গল্প, সৈনিক জীবননির্ভর গল্পগুলোতে (হেনা, ব্যথার দান, রিক্তের বেদন ইত্যাদি) বাঙালী জীবনে যুদ্ধের পটভূমি দেখানোর ব্যাপারে নজরুল ছিলেন অগ্রপথিক। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের আনসার বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাম্যবাদী চরিত্র। ‘বাঁধনহারা’ সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে প্রথম আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ইত্যাদি তথ্য। নজরুল সম্পর্কে লেখকের দৃঢ়প্রত্যয়ী ঘোষণা, মাত্র উনিশটি গল্প এবং তিনটি উপন্যাসে তিনি এমন অনেক স্বাক্ষর রেখেছেন যা পূর্বসূরি, এমনকি সমসাময়িক শক্তিমান কথাসাহিত্যিকদের রচনাতেও দেখা যায়নি। ‘নজরুলের রচনায় ইউরোপীয় সাহিত্যের উল্লেখ’ পড়লে জানা যায় নজরুলের বিদেশী সাহিত্য পাঠের বিস্তৃত জগতকে। আরও জানা যায়, তাঁর জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখা ইংরেজী জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে। নজরুলের সাহিত্যচিন্তায় ক্রমপ্রকাশমান ‘সুন্দর’-এর সন্ধান নিতে হলে এ বিষয়ে লেখাটি অবশপাঠ্য। ‘ফরিদপুরে নজরুল’ প্রবন্ধটি না পড়লে ভাবাই যেত না যে, নজরুল “অন্তত সাতবার ফরিদপুরের জেলা শহর ও অন্যান্য স্থানে যান।” ফরিদপুরের সৈয়দ আবদুর রব এবং তাঁর ‘মোয়াজ্জিন’ সম্পর্কিত যে সব তথ্য লেখক সংগ্রহ করেছেন, তা তো ডুবুরির মুক্তা কুড়ানোর মতো কাজ। ‘নজরুল-সাহিত্যে রবীন্দ্র রচনার ব্যবহার’ প্রবন্ধটি পড়লে বিদ্রোহী কবির জীবনে বিশ্বকবির প্রভাব এবং এই দুই পূজ্য ব্যক্তিত্বের পারস্পরিক আন্তরিক সম্পর্কের বিষয়টি আমাদের জানা হয়ে যায়। মাত্র একুশ/বাইশ বছর বয়সে নজরুলের শিক্ষা বিষয়ক কয়েকটি প্রবন্ধের ওপর আলোকপাত করে সুব্রত বলেছেন, এগুলোতে প্রমাণ হয়, “শিক্ষা জিনিসটির প্রকৃত স্বরূপ… তিনি বুঝতে ভুল করেননি।” সবকিছুই দ্রুতি এবং সংক্ষেপণের যুগে পরিসরে ছোট অথচ বক্তর্বে গভীর পুস্তকে সঙ্কলিত এমন একটি প্রবন্ধের নাম “মৃত্যুক্ষুধার প্রথম পরিচ্ছদ পর্যালোচনা” যা পড়লে উপন্যাস জুড়ে যে শৈল্পিক কারুকাজ ছড়িয়ে আছে তার পরিচয় পেতে পাঠকের অসুবিধা হয় না।

মোট কথা, সুব্রত কুমার দাসের নজরুল বিষয়ক দশটি প্রবন্ধ” পুস্তকটি ৮০ পৃষ্ঠার পরিসরে লিখিত হলেও তা মোটেই অগভীর নয়। এটি লেখকের দীর্ঘ অনুশীলন ও গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টির ফসল। লেখার মুন্সিয়ানায় এটি ছোট পরিসরে বড় কাজের দৃষ্টান্ত। ‘নতুন ধারা’ প্রকাশিত এ বইটির মূল্য মাত্র আশি টাকা-যা আগ্রহী পাঠকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই। পাঠকদের এটাও জানাই, সুব্রত সব্যসাচীর মতো দু’হাতে লেখেন- ইংরেজী ও বাংলায়। নজরুল বিষয়ে তাঁর বেশ কিছু ইংরেজী লেখাও আমরা প্রায়ই পেয়ে থাকি। এসব কাজ কিন্তু তাঁর সবেমাত্র শুরু।

জনকণ্ঠ ১৪ মে ২০০৪