ড. জহিরুল ইসলাম: মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক

সুব্রত কুমার দাস

২০১৫ সালের ২১ জুন টরন্টোর বাংলাদেশ সেন্টারে ‘মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়’ এবং ‘একাত্তরের গেরিলা’ নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সেন্টারে ড. জহিরুল ইসলামের গ্রন্থদুটির ওপর আয়োজিত সে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট চিত্রকর গোপেশ মালাকার। আলোচকদের অন্যতম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা হিসেবে দেলওয়ার এলাহী এবং সওগাত আলী সাগরের সাথে আমারও থাকা সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এসব বয়ানের পেছনে আরও কিছু কথা আছে।
কথাটা কষ্টের। সে বছর মে মাস থেকেই শুনছিলাম জহিরভাইয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। শুনতে শুনতে পত্রিকায় পড়তে থাকলাম তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটার কথা। খুব বেশি তিনি যে আমার ঘনিষ্ট ছিলেন তা নয়, শুধু পরিচিত বললেও ভুল বলা হয় না। কিন্তু মনটা বিষাদে ভরে উঠতে শুরু করেছিল। আর সে সময়েই জানতে পারলাম মন্ট্রিয়ল থেকে তাজুলভাই আসছেন জহিরভাইকে দেখতে। তিনি ড্যানফোর্থে এলেন। জানা গেল রাজনৈতিক ছাত্র জহিরকে দেখতে চান গোপেশদাও। অশীতিপর গোপেশদাকে আনতে তাজুলভাইয়ের গাড়িতে চেপে আমাদের ব্রাম্পটন যাত্রা। সেখানে থেকে তিনজনে ফিরে জহিরভাইয়ের বাসায় প্রবেশের আগে যুক্ত হলেন দেলওয়ার এলাহী। সেদিনই প্রথম দর্শন গোপেশদা ও তাজুলভাইয়ের সাথে। কিন্তু মনে হলো কতো চেনা। সেদিনই প্রথমবারের মতো জহিরভাইয়ের বাড়িতে আমার প্রবেশ। ক্যান্সার-ক্লিষ্ট মানুষটির সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা শ্বাসযন্ত্রে অস্বাভাবিকতা নিয়ে একসময় ফিরে আসি। বেড়িয়ে সামান্য হাঁটায় সেদিনই প্রথমবারের মতো পরিচিত দুই জ্যেষ্ঠজনের সাথে অসুন্দর ভাষায় বলি, “টরন্টোতে আমাদের অনুষ্ঠানের শেষ নেই। কথায় কথায় অনুষ্ঠান। অথচ একজন মুক্তিযোদ্ধা যাঁর গ্রন্থ ২০১৪ সালে আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার পেল তাঁকে সম্মান জানানোর যোগ্য মানুষ নেই শহরে।” জ্যেষ্ঠজনেরা সে-অভিমানকে গ্রাহ্য করলেন। সিদ্ধান্ত হলো জহিরভাইকে সমাজের পক্ষ থেকে সম্মান জানানোর ব্যবস্থা করা হবে। ছুঁঁতো বের করা হলো তাঁর বই নিয়ে অনুষ্ঠান ঘোষণা করা হবে। হলোও। আমাদের সৌভাগ্য যে তিনি সে অনুষ্ঠান পর্যন্ত দেহ ধারণ করলেন।

আমরা জানতাম জহিরভাই অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না। পরিকল্পনা ছিল যদি তাঁর শরীর অনুমতি দেয় তাহলে স্কাইপ যোগে তার কিছু কথা শোনার ব্যবস্থা করা হবে। অনুমতি হলো, ব্যবস্থা হলো। তিনি স্কাইপেতে কথা বলতে শুরু করলেন। সেদিন তিনি শ্রোতা-দর্শকদের জন্যে এমন এক দিক-নির্দেশনা দিলেন যা হৃদয়ে খোঁদাই করে থাকার মতো। তিনি বললেন, “বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারীদের মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার ছিলেন নিয়মিত বাহিনীর সদস্য। তারা ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর (পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)সহ অন্যান্য নানা বাহিনীর সদস্য। বাকিরা ছিল গণবাহিনী অর্থাৎ কৃষক-মজুর-ছাত্র-জনতা তথা সাধারণ মানুষ। অথচ আজ মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাসের বয়ান করা হয় সেখানে এই সাধারণ জনগোষ্ঠীর বীরত্বগাথা অনুপস্থিত।” তিনি আরও বললেন, “বর্তমানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর যে সব বই পাওয়া যায় তার অধিকাংশই সামরিক কর্মকর্তা বা এলিট শ্রেণির লোকদের লেখা। ফলে এসব বইয়ে তাদের কথাই বিবৃত হয়েছে। সাধারণ জনমানুষের বীরত্বের উপাখ্যান তেমন একটা এ সব বইয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না।”

তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নিশ্চিত করার জন্যে আরো বেশি বেশি করে লিখতে হবে। উল্লেখ করেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের কেউই আর ষাট বছরের কম বয়সী নন অর্থাৎ আগামী ১৫/২০ বছর পর আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা জীবিত থাকবেন না। তাঁর বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ধরে রাখতে তিনি সকলকে আরো আরো বেশি করে লেখার আহবান জানান। উল্লেখ করা যেতে সেদিন স্কাইপের একপ্রান্তে ওই অনুষ্ঠানের অধিকাংশ দর্শক-শ্রোতার চোখে ছিল জল, অথচ যাঁকে ভেবে ওই জলের উৎসারণ সেই জহিরভাই ছিলেন অবিচল।
তবে এসবের অনেক আগে আরও কথা আছে। জহিরভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল টরন্টোর বহুল পরিচিত বাংলা সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’ অফিসে। দিনটি ছিল ২০১৩ সালের আগস্ট মাসের সম্ভবত শেষ শুক্রবার। অনলাইন নতুনদেশ-এর সম্পাদক সওগাত আলী সাগরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আড্ডায় আরও কয়েকজনের সাথে জহিরভাইও ছিলেন। তখন শহরে আমি নতুনÑ সদ্য আগত। সেদিনের অনুষ্ঠানে যে দু’জনকে কেন্দ্র করে আড্ডার আয়োজন করা হয়েছিল তাদের একজন ছিলাম আমি। এরপর ‘বাংলা কাগজ’-এর প্রকাশক জাহাঙ্গীরভাইয়ের অফিসেই মাঝে মাঝে দেখা হতো জহিরভাইয়ের সাথে। কথা হতো, যদিও কথা কখনই গভীর আন্তরিকতায় গিয়েছে তেমনটি মনে পড়ে না। যেত না কারণ তিনি সবসময় মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাইতেন, কিন্তু বিপরীতভাবে নতুন দেশে এসে আমি তখন দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান খুঁজতে হয়রান।

মাঝে মাঝে ড্যানফোর্থের রাস্তায়ও ড. জহিরুল ইসলাম (১৯৫১-২০১৫) নামে দীর্ঘদেহী মানুষটির সাথে অনেকের মতো আমারও দেখা হতো। বোঝা যেত যৌবনে শরীর ও মনে তেজ ছিল তাঁর। তাঁকে সবসময় খুব মিতভাষী মনে হতো আমার। তাই নিজেকে সাবধানী অবস্থানে রাখতাম সবসময়। জানতে পারি তিনি ১৯৭৩ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট (বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পড়াশোনা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পেরিয়াল কলেজে। বিষয় কীটতত্ত্ব। সেখান থেকেই এমএস এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভ। তাঁকে নিয়ে এভাবেই আমাদের জানাগুলো ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধা ড. জহিরুল ইসলামের গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করছেন লেখক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক

জহিরভাই দীর্ঘদিন ধরে টরন্টো থেকে প্রকাশিত বাংলা কাগজে লিখেছেন। লেখার বিষয়ও মুক্তিযুদ্ধ। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি সেগুলো লিখেছেন। খুব যে সে সময় তাঁর লেখা পড়া হয়েছে তেমনটি নয়। তবে প্রবাসে বসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা চালিয়ে যাওয়ায় তার প্রতি শ্রদ্ধায় মন অবনত হয়েছে সবসময়।

ক্রমে আরও জানতে পারি ছোটবেলা থেকেই রাজনীতিসচেতন জহিরুল ইসলাম ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই যুদ্ধে যোগ দেন। তখন তিনি ঢাকা কৃষি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ভারতের ত্রিপুরায় প্রশিক্ষণ নিয়ে দুই নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং তাদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার। জহিরুল তাঁর দুটো গ্রন্থে দুই নম্বর সেক্টরের কথা বর্ণনা করেছেন। বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ক্ষমতা ও স্বার্থপরতার ভয়াবহ রাজনীতির কথা।

লেখক হিসেবে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে গত শতকের শেষ দশকে। গেরিলাযুদ্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা লিখতে শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে জনকণ্ঠ পত্রিকায় ‘একাত্তরের গেরিলা’ নামে সেটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯৯৫ সালে অনুপম প্রকাশনী সেটি বই আকারেও প্রকাশ করে। পরবর্তীকালে বইটির একটি পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের বইমেলায়। মুক্তিযুদ্ধে দুই নম্বর সেক্টরের প্রাণপুরুষ মেজর হায়দারকে নিয়ে তাঁর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়’ বইটি ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটিই পরের বছর আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে।

জানতে পারি তিনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে কাজ করেছেন দীর্ঘকাল। ম্যানিলায়ও গবেষণা কাজে নিযুক্ত ছিলেন। যখন জানতে পারি ২০১২ সালে ইউপিএল থেকে প্রকাশিত হয়েছিল গবেষণাগ্রন্থ: Rice Pests of Bangladesh; Their Ecology and Management। জহিরভাই সেটির যুগ্ম লেখক ছিলেন। বুঝতে পারি টরন্টোতে গুণী মানুষের প্রশ্রয়ে আমার এবং আমাদের পথচলা।

এবার আবার লেখার ভূমিকাতে চলে যাই। আমাদের সৌভাগ্য যে তাঁকে সম্মান জানাতে আয়োজিত প্রথম সে অনুষ্ঠানের পরেও তিনি প্রায় একমাস শরীর ধারণ করেছিলেন। তাঁকে নিয়ে পেশাজীবী সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি এগ্রিকালচারিষ্ট ইন কানাডা (আবাকান) সে বছরের ৫ জুলাই কৃতী এই মুক্তিযোদ্ধার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করতে পেরেছিল। খুব মনে হতো তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ করে দিয়ে তিনি আমাদেরকে গ্লানি থেকে মুক্ত করতে থাকলেন। শেষে ১৯ জুলাই তিনি নশ্বর এই জগৎ থেকে প্রত্যাবর্তন করেন।
জানা যায় দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং কে. ফোর্সের প্রধান খালেদ মোশাররফকে নিয়ে একটি বই লেখার কাজও তিনি শুরু করেছিলেন। মুত্যুর আগে তাঁর বাসাতে আরও একবার যাবার আমার সুযোগ হয়েছিল। সেদিন আমি একা ছিলাম। অনেকক্ষণ তাঁর বিছানার পাশে বসে কথা হচ্ছিল। তিনি তখন তেজ-শূন্য-প্রায়। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম গবেষণার অনেক কিছুই না-বলার বেদনা তাঁকে বেদনার্ত করছিল। সেই বেদনা বুকে নিয়েই ড. জহিরুল ইসলাম পৃথিবী ত্যাগ করেন।

ড. জহিরুল ইসলাম-এর বইসমূহ

একাত্তরের গেরিলা

মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়