টরন্টোর উদ্যমী বাঙালি অসিত কুমার দত্ত

সুব্রত কুমার দাস

অসিত দত্তের জন্ম হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মাস আগেই। তারিখটা ছিল ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। অসিত  মনে করতেন তখন থেকেই যমরাজা তাঁর মুত্যুর বোতামটি টেপার জন্যে প্রস্তুত। কিন্তু চিত্রগুপ্ত নাকি দৌঁড়ে এসে যমকে দেখিয়েছিলেন, অসিতের অনেক কাজ করবার রয়েছে – খাতায় নাকি তেমনটিই লেখা রয়েছে। রহস্যজনকভাবে বেঁচে যাওয়া সেই মাংসপিণ্ড বড়ো হবার সাথে সাথে শুরু করেন দাপট ছড়াতে। পরিবারের ও সমাজের ওই প্রজন্মের সকলের প্রিয় অসিত ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠেন দাপুটে মেঝদা।

তারুণ্যের শুরুতেই জন্মভূমি ভারত থেকে গেছেন জার্মানি। যদিও অসিতের পূর্বপুরুষের বাস ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। ১৯৬৭ সাল থেকে কানাডায় থিতু হলেও অস্থির অসিত ভ্রমণ করেছেন সত্তরের বেশি দেশ। মোটর হোম চালিয়ে টরন্টো থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ডে গেছেন চারবার। নিজে যেমন ব্যবসা করে আয় করেছেন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার, তেমনি টরন্টোর বাঙালি সমাজের জন্যে নিয়েছেন একের পর এক উদ্যোগ।

মহানায়ক উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়া দেবীর সাথে অসিত কুমার দত্ত

সেই ১৯৭১ সালে ত্রিনিদাদে গেছেন ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট খেলা দেখতে। ছবি তুলেছেন বিশ্বখ্যাত স্পিনার বিষেন সিং বেদি এবং মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের সাথে। ১৯৭৯ সালে টরন্টোতে মহানায়ক উত্তমকুমারের ভ্রমণের সময়ে পালন করেছেন বিপুল দায়িত্ব। ১৯৮৬ সালে প্রখ্যাত লেখক শংকর টরন্টো এলে অসিত ছিলেন লেখকের নিত্যসঙ্গী যার লেখ্যরূপ ‘জানা দেশ অজানা কথা’।

২০০৩ সালে মুত্রথলিতে অসিতের ক্যান্সার ধরা পড়ে। অস্ত্রোপচার করে সেটি থেকে মুক্ত হতেই মাথায় অস্ত্রোপচারের দরকার হয়ে পড়ে আবার। সবশেষে ২০১৮ সাল থেকে হাঁড়ের মধ্যে কর্কট নিয়েও দাপিয়ে ব্যবসা করে চলেন হুইল চেয়ার এবং লাঠিসর্বস্ব মানুষটি।

পুত্র, কন্যা ও স্ত্রী ছন্দা দত্তের সাথে অসিত কুমার দত্ত

চুরাশি বছর বয়সে সুব্রত কুমার দাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার কথা: টরন্টোর বাঙালিদের কথা’। সে-গ্রন্থের প্রকাশনা এবং পাঠ-উন্মোচন শেষে তিনি আকাঙ্ক্ষা করতেন নতুন করে চিন ও সেন্ট্রাল আমেরিকা ভ্রমণের। কলকাতায় যেতে চাইতেন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করে উত্তাল কয়েকটা দিন কাটাতে। পানামার সেই পাহাড়চূড়ায় উঠতে চাইতেন যেখান থেকে একই সাথে দেখা যায় আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের জলরাশি। স্বপ্ন দেখতেন অন্টারিওতে হাউজিং নিয়ে নতুন প্রকল্প বানাতে। নিরত বাঞ্ছা করতেন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা চেনাজনদের মধ্যে যারা অর্থকষ্টে রয়েছেন তাদেরকে কষ্ট থেকে সামান্য হলেও মুক্ত করতে। এভাবেই যমরাজাকে বসিয়ে রেখে চিত্রগুপ্তের খাতায় লেখা দায়িত্বগুলো সেরে চলেছিলেন টরন্টোর উদ্যমী বাঙালি অসিত কুমার দত্ত।

কিন্তু মানুষকে একসময় থামতেই হয়। উদ্যমী বাঙালি অসিত থেমেছিলেন ৮৪ বছর বয়সে ২০২৪ সালের ৪ মে।