ঝর্না চ্যাটার্জী : একজন বিদুষীর গল্প

দেলওয়ার এলাহী

দেখতে দেখতে কানাডাতে আসার ত্রিশ বছর হয়ে গেল। অথচ, মনে হয় এই তো সেদিন, সেপ্টেম্বর মাসের এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরে লণ্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে, পুরো সময়টা আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে এসে সেদিন বিকেলেই টরন্টো পিয়ারসন্সে নামলাম। সময় কত দ্রুত চলে গেল! কত প্রিয় মুখ, কত প্রিয়জন, কত শ্রদ্ধেয়জন এই পৃথিবী থেকেই চিরতরে হারিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন সারাজীবন বহন করে রাখার জন্য অমূল্য সব স্মৃতির সম্ভার!

এইসব প্রিয় মুখের স্নিগ্ধ সান্নিধ্যের কথা মনে হলে কিছু ভালো লাগে না৷ কবিতার বইগুলো খুলে পড়তে ইচ্ছে করে না। গল্পপাঠে মন বসে না। গানের সুরলগ্ন লহরি কানে আরাম দেয় না৷ এক ধরনের উদভ্রান্তের অশান্তি প্রাণের স্বস্তিকে তাড়াতে থাকে। লোক সমাগমের কোলাহল থেকে নিজেকে যত আড়াল করেই রাখি না কেন, নিজের কাছ থেকে তো পালাতে পারি না! অতএব, ধ্যানমগ্ন পাঠক হয়ে কোন কিছু আর পড়তে পারি না। সময় কাটানোর জন্য বই খুলে সামান্য কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পড়লেই মন চলে যায় গোয়ালিয়রে তানসেনের সমাধীস্থলে। মন বলে সুর সম্রাটের সমাধীর বেদীতে বসে ঠুমরী গাইছেন বড়ে গোলাম আলী খাঁ- ইয়াদ পিয়া কি আয়ে….! এই গানটির কথা মনে হলেই কানে একটা ঝংকার অনুরণিত হতে থাকে- ওস্তাদ রাশিদ খানের উদাত্তকণ্ঠ মনে রেখেও, লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে সেই অসামান্য ঠুমরী – বালমা আনারি মান বায়ে……! আহা! সাধে কি আর বড়ে গোলাম আলী আপসোস করে বলেছিলেন – একটিবার যদি সুর লাগাতে কোথাও ভুল করতি রে বেটি!

এভাবে কি আর পড়া হয় কিছু! অশান্তি গোছাতে ফের টেনে নিই ‘অর্ধেক জীবন’। শক্তি, সুনীল, শরৎ, সন্দীপন, তারাপদ রায় প্রমুখের উদ্দাম ও সৃষ্টিশীল সময়ের কোন কোন গল্প পুনর্বার পড়তে খারাপ লাগে না৷ এই প্রসঙ্গে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটা মজার গল্প মনে পড়ছে। শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের নাতি। পেশায় বিলাতফেরত হিসাবরক্ষক। নেশায় সাহিত্যিক। শরৎ বাবুর নির্বাচিত গল্পের ছোট্ট বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখছেন- ‘কোন কোন পাঠক-সমালোচক আমার কয়েকটি গল্পকে বাংলা হাসিত্যের স্থায়ী সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এতে আমার কোন আপত্তি নেই!’

ঐ যে বললাম নিবিষ্ট মনে পাঠের স্পৃহা জাগছিল না। কিছু গল্পের গদ্য, কিছু গানের লহরি, কিছু কবিতার পঙক্তি বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে কোনরকম সময়কে যাপন করছিলাম। এরকম সময়ে সেদিন সন্ধ্যায় প্রিয়জন বাবু সুব্রত কুমার দাস আমাকে দুটো বই উপহার দিলেন। একটি আমাদের প্রিয় মম কাজী অনূদিত কবিতার বই, অন্যটি ঝর্না চ্যাটার্জী রচিত – একটি বাঙালি মেয়ের জীবন-কাহিনী। সুব্রত কুমার দাসের মতো আমারও বিস্ময় ও আপসোস লাগে এই বিদুষীর নাম আগে জানলাম না কেন! তাঁর লেখা কেন আগে খুঁজে বের করে পড়তে পারলাম না!

সেই ষাটের দশকে, যখন কানাডার কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই একজন বাঙালি নারী ছাত্রও ছিলেন না, যিনি শীত-গ্রীষ্মে শাড়ি পরিহিত হয়ে ক্লাস করেছেন। একজন বাঙালি নারী কীভাবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পরিবেশে নিজের সংস্কৃতিকে বজায় রেখে নিজেকে ধীরে ধীরে মানানসই করে তুলছেন সবই ঝর্নাদি এই বইয়ে উল্লেখ্য করেছেন। সেই সময়ের মন্ট্রিয়াল, অটোয়া শহরে বাঙালি খাবারের দুস্পাপ্যতা। রাজনীতি, কুইবেক আলাদা রাজ্য হবার আন্দোলন, এই আন্দোলনকারীদের হয়ে দুজন রাজনৈতিক নেতাকে কিডন্যাপ। একজনকে হত্যা। পিয়েরে ট্টুডোর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অসামান্য জনপ্রিয়তা, বৃটেনের রানীর কাছ থেকে কানাডার জন্য ঐতিহাসিক দলিল চুক্তিতে স্বাক্ষর আদায়। চাঁদে মানুষের অবতরণ সহ আরো কত কিছু আছে এই বইটিতে! ব্রায়ান মালরোনির পদত্যাগের পর কানাডায় প্রথম কোন নারী প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব আরো কত কী! ঝর্না চ্যাটার্জী তাঁর জীবনের এমন আরো অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনীকে এই বইয়ে বিধৃত করেছেন – যা অনায়াসে এই বইয়ের গল্পের বিস্তারে আরো একশত পৃষ্ঠা বর্ধিত করে বর্ণনা করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। এখানেই ঝর্না চ্যাটার্জীর পরিমিতিবোধের কুশলতা ও পারঙ্গমতা। ঠাসবুনটের নিবিড় গদ্যের জমিনকে তিনি বাহুল্যবর্জিত রেখেছেন।

গল্প যত রোমাঞ্চকর ও আকর্ষণীয়ই হোক না কেন, লিখিত রূপে এর প্রকাশ হলে, ভাষাচিত্রের সাবলীলতা ও বিশুদ্ধতা এর রস সঞ্চারে কিংবা বিস্তারে প্রধান ভূমিকা পালন করেই। একজন কথাসাহিত্যিক ক্রমে ক্রমে এই ভাষাচিত্রের নিপুণ ব্যবহারে হয়ে ওঠেন শিল্পী। কথাশিল্পী কিংবা ভাষাচিত্রী। ঝর্না চ্যাটার্জীর গদ্যকুশলতা ও ভাষার বুনন বিস্ময়কর রকমের সাবলীল, অনায়াস ও তাঁর অধীন। কতটুকু চর্চা বা দখল থাকলে এরকম অনায়াস কুশলতা অর্জন করা যায়, ভাবলে অবাক হই এজন্য যে, তাঁকে নিয়ে কেন কোন আলোচনা আমার নজরে আসেনি! মীজান রহমান কি ঝর্না চ্যাটার্জী সম্পর্কে কিছু লিখেছিলেন! তাঁদের কি পারস্পরিক আলাপ ছিল!

৩.

একজন সুব্রত কুমার দাস সাহিত্যের প্রতি কী যে মমতা ও ভালোবাসার যাদু দিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে আমাদের মতো না জানা বা একেবারেই কম জানা সাধারণ মানুষের সামনে এনে পরিচয় করিয়ে দেন একজন দীলিপ চক্রবর্তীকে, একজন কমলা মুখোপাধ্যায়কে, একজন মম কাজীকে, একজন ঝর্না চ্যাটার্জীকে। ঝর্না চ্যাটার্জীর এই বইখানি পড়ে শেষ করলাম এইমাত্র। একটি আশা মনের মধ্যে উঁকি দিল- তিনি তাঁর পারিপার্শ্বিক জীবনে দেখা ও ভালো করে জানা সৃষ্টিশীল মানুষদের নিয়ে বিস্তারিতভাবে লিখবেন। ঝর্না চ্যাটার্জীর বইটি বহুল পঠিত হোক।