গ্রন্থালোচনা: ‘গহিন দহনে গাহন’

সুজিত কুসুম পাল

কবি চয়ন দাস ‘দিবা রাত্রি’ পথ চলেছেন ‘সকাল বেলার সূর্যালোকে’। কখনো ‘দুপুর বেলার রৌদ্রতাপে’ কিংবা ‘সন্ধ্যা বেলায় ইমন রাগে’। কালের অভিবাসকে অতিক্রম করে ‘দিন আর রাতের মিলন মেলায়’ নির্মাণ করেছেন ‘শ্যামল ছায়ায় কোমল মায়ায় স্বর্গ সুখের বাড়ি’। পরক্ষণেই কবি তাঁর স্বপ্নের বাড়ি থেকে বের হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন প্রকৃতির মেরুপুরে। ‘প্রকৃতি বাঁচলে বাঁচবে জীবন’ কবিতায় তিনি উদ্বর্তনভাবনায় (সারভাইভাল) উদ্বিগ্ন; প্রকৃতি যেনো উল্টোরথে চড়ে না বসে। তাঁর আশংকা ‘কোনো দিন যদি নদীরা ভাটার টানে সাগরে মিশে ফিরে না আসে’, কিংবা ‘কোনো দিন যদি নাই হয় আর ভোর / রাতের শেষে রাত ছেয়ে দেয় অন্ধকারের ঘোর…’। কবির এই আশংকা সত্যি প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি বিধাতা সমীপে সমর্পণ করেছেন তাঁর ঋণগ্রস্থতার পোটরাঃ

ঘুম ভেঙে দেখি নতুন সূর্য

নতুন আরেক দিন

বিধাতার কাছে বাড়ছে আমার

অনেক অনেক ঋণ।

[‘প্রাণ’]

সাথে সাথে সুজনের সহযাত্রি হিসেবে কাতরতা আর উদ্বিগ্নতার  উদ্ভাস ছড়িয়ে বলেছেন ‘গতরাতে যাঁরা ঘুমোতে গেছে / কতোজন জেগে ওঠে নি!’

কবির বয়নপরিক্রমায় প্রকৃতির কথাই এসেছে ঘুরেফিরে। তিনি সারাক্ষণ বলতে চেয়েছেন প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। সবুজকে তাড়াতে গিয়ে মানুষ অজ্ঞাতসারে কেবল হলুদকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ইমারতের উচ্চতা ঢেকে দিচ্ছে নীলিমার প্রসাধন কক্ষ। ঘাসের গালিচা উজাড় করে দেয়ায় নেমে আসছে অ-কাল যবনিকা ফুস্ফুসের নৃত্যনাট্যে। তাঁর আশংকা, প্রকৃতির প্রতি নির্দয় আচরণ আর যদি না থামে, নিসর্গ তার নন্দনলীলা হারিয়ে ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যাবে নীরবে নিভৃতে; বন্দিত্ব বরণ করবে কাব্যিক কারাগারে। আগামি দিনের পাঠক নিসর্গের সন্ধানে হয়তো পৌঁছে যাবে স্বর্গের নিবন্ধনে।

অরণ্যহীন ধরিত্রী যদি হয়ে যায় জনারণ্য

বন্যরা তবে বিলুপ্ত হবে, মানুষই যে হবে বন্য।

[‘জনারণ্যে বন্য মানুষ’]

চয়নের কাব্যগ্রন্থে একটি কবিতাও বিরচিত হয়নি ভালোবাসার কোনো মানবীকে নিয়ে। প্রকৃতির অস্তিত্বসংকট সদাই তাঁকে ব্যস্ত রেখেছে। তাঁর সারাকাল প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠকাল। কখনো কখনো মনে হয়েছে, শেষবারের মতো কবি বুঝি খুঁজে নিলেন নিসর্গের নিথর অধরখানি। কাব্যিক হাতখানি ক্রমশ বুঝি পৌঁছে গেলো আরও গহীনে সংগোপনে। কেঁপে উঠলো নিমেষে নিথর ক্লীবেজখানি; প্রাণজ পেলবতায় জেগে উঠলো তাপসীর মগ্ন কাঁচুলিখানি।

চয়নের স্বপ্নের বুননকীর্তির চাইতে তাঁর ভাঙা স্বপ্নের ব্যবচ্ছেদ অনেক বেশি চৌকস। পূর্ববেলায় তাঁর স্বপ্নগুলো ‘বিলীয়মান ছায়ার মতো / ঘরে ফেরা পাখির মতো’ মনিবকে জড়িয়ে ধরলেও, পশ্চিমবেলায় এসে ‘তীরবিদ্ধ পাখির মতো প্রাণপণ ডানা ঝাঁপটায়।‘ এই স্বাপ্নিক চয়নের অনেক বেশি মাথাব্যথা আস্ত ব্রহ্মাণ্ড বলয়ের কাঠামো সংক্রান্ত সচলতা নিয়ে। আস্থাহীনতার জ্বরের প্রকোপে তিনি যেনো মাঝে মধ্যেই খেই হারিয়ে ফেলেন। আকাশের তারাগুলো ঝরে যাবে কী না, পর্বতগুলো নিচে নেমে এসে সমতলকে চাপা দেয় কী না কিংবা আগ্নেয়গিরির লাভায় বনভূমি জ্বলে ছাই হয়ে যায় যদি – এই রকম হাজারো ভাবনার পসরা তাঁর কাব্যিক শপিং মলে। কবিতায় বর্ণিত তাঁর কাব্যিক শংকায় পাঠক শংকাব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কবির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করতেই পারেনঃ

হঠাৎ যদি সামনে চলার পথটাই সরে যায় …

মেঘগুলো সব ভেসে না গিয়ে আছড়ে পড়ে মাথায় …

সাগরের জল শুকিয়ে গিয়ে গিরিখাদ হয়ে যায় …

[‘হঠাৎ যদি’]

মানুষের মুখোশের আড়ালে তিনি খুঁজে পান অ-মানুষের অবয়ব। তাঁর আনন্দের দেহখানাকে নিত্যই তাড়িয়ে বেড়ায় বেদনার ছায়া। ‘উদাসী মন’ কবিতায় চয়নের বেদনার ভাণ্ডার অবারিত জলরাশির মতোই অফুরান। প্রেয়সীর খোঁপায় একটি গোলাপ গুঁজে দেয়ার শখ তাঁর চিরকালের। কিন্তু এই কর্মটি সংসাধন করতে গিয়ে কখনো তিনি কামিয়াবি অর্জন করতে পারেন নি। কারণ, অলির হুল প্রযুক্তির পৌরোহিত্যে বৃক্ষের অনেক অন্তর্গত যন্ত্রণার বিনিময়ে পুষ্পের জন্ম হয়। এই কথা মনে করে তিনি বৃন্তের বন্ধন থেকে পুষ্পকে বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে বেদনার্ত হয় ওঠেন। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে ময়ূরের পেখম উন্মোচিত হলেও, চয়নের কাছে বৃষ্টি মানে মেঘের বুক খালি করে নেমে আসা রাশি রাশি সন্তানের অঝোর ধারার কান্না। সাগরের বুকে অজস্র তরঙ্গের আনন্দনৃত্য দেখে পাঠক আনন্দ পেলেও কবি বেদনার্ত হয়ে ওঠেন জোয়ার-ভাটার টানাপোড়নের শিকার সমুদ্রের আজন্ম কার্ডিয়াক ভোগান্তিতে। প্রকৃতির এইসব উপাত্তসমূহের বেদনাকে বরণ করার জন্যে তিনি নিজেও প্রকৃতির অংশ হতে চান। তাঁর ভাবনা; যদি ‘মেঘের চোখের জল’ হতে পারতেন, তাহলে তিনি তাঁর জমাট বাঁধা কষ্টগুলো বৃষ্টির মতো ঝরিয়ে দিতে পারতেন।

হতাম যদি পথের মতো স্থবির,

মাড়িয়ে লোকে পিষ্ট করে ছুটত দিগ্বিদিক;

বুকটা ভেঙে রক্তক্ষরণ হতো,

বুঝত না কেউ যন্ত্রণাটা – ভাবতো কী নির্ভীক। 

[‘মেঘের চোখের জল’]

এতো বিশাল যাঁর বেদনার ভাণ্ডার, তিনি আবার ব্যঙ্গাত্মক বেদনার ককটেল পরিবেশন করার সুযোগটি হাতছাড়া করতে বেমালুম ভুলে গেছেন। শারদীয় উৎসব নিয়ে লেখা ‘করোনাকালে মর্ত্যলোকে উমা’ কবিতায় ‘মা এসেছেন মর্ত্যে কোয়ারেন্টাইনের শর্তে।‘ পৌরাণিক কাহিনি মতে, দুর্গাদেবির ষষ্টি তিথিতে মণ্ডপে এসে পঞ্চম দিন অর্থাৎ দশমী তিথিতে তাঁর মর্ত্যলোক ত্যাগ করার কথা থাকলেও তাঁকে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে চৌদ্দ দিন। জানি, অনেক কষ্টামির বিনিময়ে এমন ব্যঙ্গার্থক ব্যঞ্জনা  সৃজন করেছেন চয়ন তাঁর পাঠকের জন্যে। 

কবির ‘পাড়ি’ কবিতাটি আমার নজর কেড়েছে ভীষণ। এখানে পথ ফুরিয়ে গেলেও পথিকের গন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় না। চয়নকাব্যে, ঝরার মৌসুমে বৃক্ষের ‘রঙিন চিঠি’ চিত্রকল্পটি পাঠকের জন্যে সেরা উপহার বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। 

দেখতে দেখতে বিবর্ণ হবে পাতা

রঙের চমকে ঝলসে যাবে বন

হৃদয় দহনে জ্বলবে বৃক্ষলতা

রঙিন চিঠিতে জানাবে ঝরার ক্ষণ।

[‘পাড়ি’]

‘রঙ’হারা রঙ্গিন পাতা ‘রঙিন চিঠি’ হয়ে জানিয়ে যায় তার ঝরে পড়ার অন্তিম পাঁচালি। প্রদীপ এখানে জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়, কথা  ফুরিয়ে যায় বলতে বলতে। তারপরও, কিছু পথিকের ক্লান্তিবিহীন ভাবনা জাগতিক ভোগ-বিলাস নিয়ে।

পথিক জানে না পথের দৈর্ঘ্য, কতো পথ পাড়ি দেবে

তবু মনে সাধ, যতকিছু পাবে, সবই সে সঙ্গে নেবে।

[‘পাড়ি’]

তুষারকে উপজীব্য করে অনেকেই কবিতা লেখেন। ক্যানাডায় তুষার জমে বরফ হয়। এই জমাট বরফকে গলানোর জন্যে এখানে লবণ ছিটানো হয়। অভিবাসী চয়নের বিস্ময়, লবণে বরফ গলে; তাঁর জানতে ইচ্ছে করে, মানুষের পাষাণ হৃদয় গলে কীসে।

জমাট বরফ লবণ ছোঁয়ায়

জল হয়ে যায় গলে

কুহেলিকা মেঘ কেটে যায়

সূর্য উদয় হলে। …

বন্যপশু স্নেহের ছোঁয়ায়

মানছে আনুগত্য

মানুষ কেনো হয় অ-মানুষ

হারায় মনুষ্যত্ব?

[‘হৃদয় গলে কিসে’]

যাঁদের পাষাণ হৃদয় গলে না, তাঁদের জন্যে তিনি বার্তা পাঠিয়েছেন আরেকটি কবিতায়। তাঁর বিশ্বাস, এইসব অ-মানুষের ডানাহীন হৃদয়গুলো ঘুড়ির মতো উড়তে গিয়ে নিজেদেরকে তাঁরা বিহঙ্গ মনে করে। ডানাবাজি করতে গিয়ে অদৃশ্য সুতোর সাথে নিজেদের বন্ধনের কথা তাঁরা মালুম করতে পারেন না।

ঘুড়ি ওড়ে পাখির ঝাঁকে

যায় উঠে সে উচ্চে কতো

পায় সে বাধা ডোরের সীমায়

হয় না ওড়া ইচ্ছে মতো।

[‘ঘুড়ি ওড়ে সুতোর টানে’]

অতিমারির দহনযজ্ঞের মধ্যেও চয়ন তাঁর কাব্যিক অর্ঘ নিবেদন করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জন্মজয়ন্তীতে। তাঁর প্রতীতি, ‘রবির কিরণে বিশ্ব স্নাত / হৃদয় মননে ন্যস্ত / প্রদোষে যতোই সন্ধ্যা ঘনাক / এ রবি যাবে না অস্ত।‘ নজরুলকে নিয়ে দ্রোহসঙ্গীতঃ ‘সাম্যের গান তাঁর গলে / মৃত্যুক্ষুধার ধরাতলে / বাঁধনহারা মনপ্রাণ / হুংকারে কাঁপে ভগবান।‘

‘গহিন দহনে গাহন’ একটি মারিকালিন কাব্যিক কাহন। চয়ন দাস ও স্বপন দাস ভাতৃদ্বয় এখানে অনুভাবের অধিপতি। তাঁদেরই  অনুভবে আজ পাঠকের কালাতিবাহন। এই গ্রন্থের কোনো পশ্চাদ প্রচ্ছদ নেই। দুই কবিভাইয়ের জন্যে দুটি সন্মুখ প্রচ্ছদবিশিষ্ট এই গ্রন্থে রয়েছে মোট ৬৩টি কবিতা (চয়ন দাসের ৪৩টি এবং স্বপন দাসের ২০টি)। করোনাঝড়ের তাণ্ডব থেকে জীবনতরীকে নিরাপদে উপকূলে পৌঁছিয়ে দেয়ার প্রত্যয় জানিয়ে (কবিতাঃ করোনাকে তাড়াবই) কবি চয়ন দাস উন্মোচন করেছেন তাঁর কাব্যিক অভিযাত্রা। প্রারম্ভিক পর্বে নিজেকে তিনি দৃঢ়চেতা হিসেবে পাঠকের সামনে দাঁড় করালেও, মারিকাল বার বার তাঁর ভ্রমণপথে তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ছয়টি অণু কবিতাসহ মোট ৪৩টি কবিতার মধ্যে তাঁর ৬টি কবিতারই বিষয়ভাবনা মারিজাত।

চয়ন দাসের মতো, স্বপন দাসেরও কাব্যিক যাত্রা শুরু হয়েছে করোনাবিষয়ক ভাবনা নিয়ে বিরচিত ‘করোনা– দিশাহীন মানুষ’ কবিতা দিয়ে। কবি স্বপনের কাব্যসরণির প্রায় প্রত্যেকটা ছাউনিতে রাজনীতির কাম্পিল্য আছে। তৃণমূল পর্যায়ের ছিন্নমূল মানুষের সাথে তাঁর সংযোগ অচ্ছেদ্য। অসাধারণ স্পষ্টবাদী বলেই তিনি বলতে পারেন ‘স্বৈরাচার আমার আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়’। ‘মুজিব শতবর্ষ’ কবিতায় ‘একটি ভাষণ হয়ে গেলো বিরাট অস্ত্রাগার’। ‘যে ক্ষুধা আমায় কাঁদতে তাড়িত করেছিলো / সে ক্ষুধা আমার আজও কমেনি‘ তাঁর ‘কান্না-ক্ষুধা’ কবিতায়। বঞ্চিত প্রলেতারিয়েত সমাজকে নিয়ে তিনি কট্টর আশাবাদী। ‘ভিন্ন দেখা’ কবিতায় অলক্ষ্যে কাঁটা বিধতেই / ওরা আঁতকে ওঠে না, / বরং চিৎকার করে ওঠে, অনুভবে! / নিশ্চয়ই এটা গোলাপ ফুল।‘ স্বপন দাসের শেষ কবিতা ‘আমাকে গচ্ছিত রেখে মুক্ত হলাম’। এই কবিতায় তিনি জগতের সমস্ত মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে অনন্তের কোলে সমর্পণ করেছেন। ‘রিক্ত-মুক্ত-সিক্ত হলাম আমি / আমাকে গচ্ছিত রেখে তোমাতে …।’ তবে, ‘অনুভব’ কবিতার লাইনগুলো পাঠকের কাছে কবির ‘ঝাপ্সা সমাধিটা’ বেদনায় পুনর্বার বিমূর্ত করে তোলেঃ

কভু দীপ নিভে গেলে …

যদি বায়ু নাহি বয় …

যদি ডুবে যায় রবি …

দূর পাহারের বুক চিরে

নদী নেমে এলে ধীরে

তীরে বসে বসে দেখো।

পথের কাহিনি যতো

না-ই যদি জানা থাকে

জানিয়া লইতে চেয়ো।

কবির শুদ্ধ আবেগ, শব্দের বিন্যাস আর ভাবনার অলংকার পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে ক্রমশ ছুটে যাবে, আমার বিশ্বাস, বরফগলা নদীর মতো চিরকালিন বহমানতায়। আজকের আলোচনাটি তখনই পৌছবে প্রথম আলোর নিবিড় আভায়, সংস্করণটি যদি নিঃশেষিত হয় কাংখিত পাঠকপ্রিয়তায়।

গ্রন্থালোচনা: কাব্যগ্রন্থ ‘গহিন দহনে গাহন’, চয়ন দাস ও স্বপন দাস

প্রকাশকালঃ ২০২১

প্রকাশকঃ গল্পকার, ঢাকা, বাংলাদেশ

প্রচ্ছদঃ গল্পকার

মূল্যঃ ২০০ টাকা