কাব্যগ্রন্থ “মনকল্প”: একটি পাঠ পর্যালোচনা
সঙ্গীতা ইয়াসমিন
কবি আপন খেয়ালে তার মনের একান্ত ভাবনাগুলি যখন বর্ণিল-স্বপ্নিল-সুবাসিত বর্ণের শব্দফুলে গেঁথে দেন তখনই সেটা হয় কবিতা। আর রিণি রিণি শব্দমালার সেই কবিতা হয়ে যায় পাঠকের সম্পত্তি, তখন আর সেটি কবির নিজস্ব সম্পদ নয়। আর এভাবেই কোনো কোনো কবি হয়ে ওঠেন কালজয়ী; তাদের লেখা উত্তীর্ণ করে যায় কাল-সময়-যুগ, দৃষ্টান্ত হয়ে রয়। কবিরা আসলে শব্দের যাদুকর; শব্দের কারিগর। কবি রূদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ নিজেকে শব্দ শ্রমিক বলতেন। একটি সহজ সরল উপস্থাপনাকে গভীর উপলব্ধি দিয়ে অনুভবের যে বিষয়টি তা হয়তো সকলেই পারেন না; আর পারেন না বলেই সকলেই কবি হয়ে ওঠেন না, বরং কেউ কেউ কবি হন। এখানেই অন্য দশজনের সাথে কবিদের পার্থক্য! সাদা চোখে দেখা আর কানে শোনার মধ্যে কবিদের যে উপলব্ধি, যে অনুভূতি মূর্ত হয়ে খেলা করে তাকে কল্পনার সম্মিলনে শব্দ শিল্পের যে মালাটি গ্রন্থিত হয়, পাঠকের ভালবাসায় শেষতক সেই মাল্য কবির গলেই পরানো হয়। খুব ব্যাকরণগত বিবেচনায় দেখলে এর উপমা, কাব্যময়তা, ছন্দ, আর শব্দচয়নের যে শৈল্পিক ব্যঞ্জনা তাই প্রকৃত অর্থে একটি নিটোল বক্তব্যকে সহজ ধারায় সহজ গতিতে টেনে নিয়ে যায়। বেঁধে রাখে পাঠককে, ডুবিয়ে দেয় অথৈ আনন্দরাশিতে, কিম্বা বিশদ বেদনার ঘণ নীলজলে।
“মনকল্প” শেখর ই গোমেজ এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ; মনকল্পে রচিত কবিতাগুলি নিঃসন্দেহে তাঁর মনের একান্ত ভাবনা, কিছু আত্ম-জিজ্ঞাসা, কিছু দর্শন, বিশ্বাস আর সঙ্কটাপন্ন সময়ে একজন সচেতন মানুষ হিসেবে তার ভেতর ঘরের মানুষটির আকুল আবেদন। কবির অন্তরাত্মা যেভাবে গেয়ে ওঠে কবির মনও ঠিক একই ব্যঞ্জনায় আবর্তিত হয় তখন; কখনও উচাটন হয় মন। দেশ, দেশমাতৃকার মানুষ, আর তাদের সংগ্রামের পাশে নিজেকে কল্পনা করে, তাদের দুঃসময়ে পাশে থাকার প্রত্যয়ে, বিদেশ বিভূঁঁইয়ে থেকে নিজেরই অবচেতনে নিজের মাটি আর মানুষের জন্য যে ভালোবাসা সেসবই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে। লেখায় আমরা তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, পুরোনো পৃথিবীতে ফিরে যাবার বাসনা, উজানে নাও বাইবার এক দূর্দমনীয় প্রত্যয় লক্ষ করেছি যা প্রকৃতপক্ষে কবিরই আপন স্বত্তা। আমাদের সমাজ মানসের যে ক্রম অধঃপতন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে শেকড়ের সাথে বিচ্ছিন্নতার যে টান তিনি অনুভব করেছেন হৃদয়ের তন্ত্রীতে তাকে কবি সহজভাবে নিতে পারেননি। তিনি একে আদর্শের ইউটার্ন বলেছেন, বলেছেন নক্ষত্রের পতন, আর এই সব আদর্শের সমর্পন, নক্ষত্রের পতন তাকে এতোটাই হতাশাগ্রস্থ করেছে কখনও তিনি এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেছেন, তাকে এখন আর কোন কিছুই স্পর্শ করে না, তিনি যেন অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছেন। “এখন আমায় ছোঁয় না কিছু, নিন্দা স্তুতি-দুঃখ জ্বালা, মান-অপমান অবহেলা।”
কখনও তিনি নিজেকে এসবের ভেতর থেকে গুটিয়ে রাখতে গিয়ে বলেছেন, “যদি পারি বিন্দু হব, চোখে পড়ে না এমন একটি বিন্দু হব।” আবার তিনি নিজের ভেতরেই আগুনের উপলব্ধি টের পেয়েছেন, বলেছেন – “আমার অবিশ্বাস অবিনাশি, অক্ষয়, তাই আমি নির্ভয়, হোক যত না রক্তক্ষয়।” শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগরের মনোরম অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদের ছোট্ট এই কাব্যগ্রন্থে মোট ৩৮টি কবিতা আছে, যা কেবল তিনি মনের আনন্দে নিছক কবিতার খাতা লেখার তাগিদেই লিখেছিলেন। ইতোমধ্যে এই কবিতাগুলোই পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে। এই কবিতায় আধুনিক কবিতার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে সব কবিতায় রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য, একটি সুস্পষ্ট ছবি, যা ছাপ ফেলে যায় পাঠকের মনে, নীরবে-নিঃশব্দেই।
কবি তার ছায়াসঙ্গীর কথা বলেছেন, বলেছেন, উল্টোরথে হাঁটার কথা, বলেছেন বিপ্লবের-জাগরণের কথা। সময়ের সাথে চেতনায় যে সঙ্কট তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজেকে অভয় দিয়েছেন, কখনও হতাশা গ্রাস করেছে তাঁকে, আবার উজানে নাও বাইবার ডাক দিয়েছেন তিনি নিজেই। এসবই তার ভেতরের টানাপোড়েন। তার নিজস্ব চেতনার জগত, কল্পনার ছায়াসঙ্গীর সাথে নিত্য কথোপকথন। আর সে কারণেই এই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ “মনকল্প” এর যথার্থতা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন আবৃত্তি শিল্পী। সংস্কৃতিপ্রেম তথা কাব্যপ্রেমই কবি শেখরকে কবিতা লেখায় উৎসাহিত করেছে। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে এই লেখার নিখুঁত শব্দের বুনট, সাবলীল উপস্থাপনা, অলঙ্কার-উপমার সমাহার, সুন্দরের আবেদন; সব মিলিয়ে একটি সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টা, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়! শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাব্যপাঠের পরে দেখা যাবে ধীরে ধীরে একটি ব্যক্তিস্বত্তা সুস্পষ্ট হয়েছে, শেকড়ের সন্ধানেই যার ক্রমাগত যাত্রা তিনি কবি শেখর ই গোমেজ। আমি তার এই প্রথম কাব্যগ্রন্থ “মনকল্প” এর বহুল পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করি।
পরিশেষে যে কথাটি না বললেই নয়, বিএলআরসি (বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার) এর কাছে কৃতজ্ঞতা; যে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। বিএলআরসি’র যাত্রার প্রথম বছরে নিজেদের প্রকাশনার আওতায় পাঁচটি পুস্তকের মধ্যে একটি ‘মনকল্প’।
সঙ্গীতা ইয়াসমিন, টরন্টো, কানাডা।
লেখাটি বিএলআরসি (বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার) সাহিত্য পত্রিকার ২০১৬ সালের সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত।