কানাডীয় চলচ্চিত্র
বেশ কয়েক বছর আগে কানাডার একটি কাহিনিচিত্র দেখে চমকে উঠেছিলাম। ‘আটানারজুয়াট: দ্য ফাস্ট রানার’ নামের ছবিটি দেখার আগ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল হলিউডি ছবির জৌলুস ও দাপটের কাছে কানাডার ছবি দাঁড়াবার যোগ্য নয়। কিন্তু এই ছবিটি দেখার পর আমার সেই ধারণা ভেঙে গেলো। ছবিটির কাহিনির অভিনবতা এবং নির্মাণের চমৎকারিত্ব আমাকে মোহিত করে দিলো।
ছবির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে কানাডার বরফাচ্ছাদিত তুন্দ্রা অঞ্চলে আদিবাসী ইনুইট কমিউনিটিতে একটি রোমান্টিক টানাপোড়েনকে কেন্দ্র ক’রে, যা একসময় মর্মান্তিক এক ট্র্যাজেডিতে রূপ নেয়। জাখারিয়াস কুনুক পরিচালিত এই ছবিটি ইনুইট আদিবাসীদের ভাষা ইনুকটিটুটে নির্মিত প্রথম ছবি। এর আগে এই ভাষায় কোনো ছবি নির্মিত হয়নি এবং এই ছবিতে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁরা সবাই ইনুইট। একটি দৃশ্যে দেখা যায় এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র আটানারজুয়াট হিমাংকের নিচে তাপমাত্রায় নগ্নদেহে দৌড়াচ্ছে, প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। সে যেন পালাতে চাইছে তার এতদিনের যাপিত জীবন থেকে। সে যেন পিছনে ফেলে যেতে চাইছে সকল প্রতারণা ও বেইমানিকে। কোনো কোনো ছবির বিশেষ কোনো দৃশ্য মনে গেঁথে যায়। এই দৃশ্যটি তেমনি একটি দৃশ্য। পিচ্ছিল বরফের উপর দিয়ে দৌড়ানোর এই দৃশ্যটি কী অসাধারণ মুন্সিয়ানায় ধারণ করা হয়েছে! ভাবলে অবাক হ’তে হয়। দৃশ্যটি দেখে ‘আটানারজুয়াটঃ দ্য ফাস্ট রানার’ ছবির এই নামের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়।
‘আটানারজুয়াট: দ্য ফাস্ট রানার’ ছবিটি দেখার পর কানাডীয় চলচ্চিত্রের প্রতি আমার কৌতুহল ও আকর্ষন বেড়ে যায় এবং একে একে কানাডীয় নির্মাতাদের ছবিগুলো দেখতে শুরু করি। যেসব চিত্রনির্মাতার ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি এবং বার বার দেখেছি তাঁরা হোলেন ডেভিড ক্রোনেনবার্গ, আতোম ইগোয়ান, সারা পলি প্রমুখ। ক্রোনেনবার্গের ‘শিভারস’, ‘র্যাবিড’, ‘ক্র্যাশ’; ইগোয়ানের ‘এক্সোটিকা’, ‘দ্য সুইট হিয়ারআফটার’, ‘ক্লো’ এবং সারা পলির ‘আওয়ে ফ্রম হার’ ও ‘ওমেন টকিং’ ছবিগুলো কানাডীয় ছবির ইতিহাসে একেকটি মাইলস্টোন হয়ে আছে।
হলিউডে ছবি নির্মাণ করে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন এমন কয়েকজন কানাডীয় চিত্রনির্মাতার কথা না বললেই নয়। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই যাঁর নামটি আসে তিনি হচ্ছেন নরম্যান জিউইসন। টরন্টোয় জন্মগ্রহণকারী জিউইসন হলিউডে বেশ কয়েকটি ছবির সফল নির্মাতা। তাঁর ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ইন দ্য হিট অফ দ্য নাইট’, ‘ফিডলার অন দ্য রুফ’, ‘মুনস্ট্রাক’, ‘জিসাস খ্রাইস্ট সুপারস্টার’, ‘দ্য হারিকেইন’ প্রভৃতি। ছবিগুলো বক্সঅফিসে যেমন হিট হয়েছে, তেমনি চিত্রসমালোচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসাও কুড়িয়েছে। তিনি ছবি নির্মাণ করেছেন মূলত বিতর্কিত ও জটিল সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে। জিউইসন তিন তিনবার শ্রেষ্ঠ পরিচালক ক্যাটেগরিতে অস্কার নমিনেশন পান। তিনি ১৯৮৮ সালে টরন্টো শহরে গঠন করেন চলচ্চিত্র বিষয়ক শিক্ষালয় কানাডিয়ান ফিল্ম সেন্টার।
হলিউডে নয়া ফিল্ম-টেকনোলজি ব্যবহার করে ব্যবসাসফল ও বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো সব ছবির নির্মাতা হচ্ছেন আরেকজন কানাডীয়, তাঁর নাম জেমস ক্যামেরন। তাঁর পরিচালিত ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘দ্য টারমিনেটর’, ‘অ্যালিয়েন্স’, ‘দ্য অ্যাবিস’, ‘ট্রু লাইস’, ‘টাইটানিক’ ও ‘আভাটার’। তিনি ‘টাইটানিক’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালকের অস্কারে ভূষিত হন। এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ ছবি ও শ্রেষ্ঠ ফিল্ম এডিটিং ক্যাটেগরিতেও অস্কার পায়। হলিউডে গিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন এমন আরো দু’জন কানাডীয় চিত্রনির্মাতা হচ্ছেন পল হ্যাগিস ও জেসন রেইটম্যান। বেশ কয়েকজন কানাডীয় অভিনেতাও হলিউডের সিনেমায় অভিনয় করে বিশ্বনন্দিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম অগ্রগণ্য তাঁরা হোলেন খ্রীস্টফার প্লামার, ডোনাল্ড সাদারল্যান্ড, জন ক্যান্ডি, উইলিয়াম শাটনার, লেসলি নেলসন, ড্যান অ্যাকরয়েড, মাইকেল জে ফক্স, জিম ক্যারী, কিয়ানু রীভস, ম্যাথিউ পেরি, মাইক মাইয়ার্স, রায়ান রেনল্ডস, রায়ান গসলিং, রেইচেল ম্যাকঅ্যাডামস প্রমুখ।
কানাডীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এখানে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়েছিলো উনিশ শতকের শেষের দিকে। জেমস ফ্রীয়ার নামের এক চিত্রনির্মাতার ‘টেন ইয়ার্স ইন ম্যানিটোবা’ ছবিটিকে কানাডায় নির্মিত প্রথম ছবি বলে গণ্য করা হয়। এটি একটি প্রামাণ্যচিত্র যা যুক্তরাজ্যে মুক্তি পায় ১৮৯৮ সালের এপ্রিলে। ম্যানিটোবা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে তোলা দৃশ্যাবলির ফুটেজ দিয়ে ছবিটি নির্মাণ করা হয়। ম্যানিটোবা প্রদেশে ইমিগ্রান্টদের আকৃষ্ট করাই ছিল এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য।
এরপর যে ছবিটির কথা জানা যায় সেটি একটি কাহিনিচিত্র, নাম ‘ইভানজেলিন’। ছবিটি চিত্রায়িত হয় ১৯১৪ সালে, চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগে। এটি ছিল একটি ড্রামা ফিল্ম। এডুয়ার্ড পি সুলিভান ও উইলিয়াম কাভানোহ পরিচালিত এই ছবির চিত্রনাট্য রচিত হয় একটি কবিতা থেকে। ‘ইভানজেলিন’ শীর্ষক কবিতাটির রচয়িতা যুক্তরাষ্ট্রের কবি হেনরী ওয়ার্ডসওয়র্থ লংফেলো। কবিতাটি তিনি রচনা করেন ১৮৪৭ সালে। এই ছবির পরিচালকদ্বয় এবং প্রধান চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেন তাঁরা সবাই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের। আর পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন কানাডীয় অভিনেতারা। ছবিটি প্রথম প্রদর্শিত হয় নিউইয়র্ক শহরে। পরে কানাডার নোভা স্কোশিয়া প্রদেশের হ্যালিফ্যাক্স শহরে ছবিটি দেখানো হয়। এরপর কানাডা ও আমেরিকা জুড়ে ছবিটির প্রদর্শনী চলে। এই ছবির প্রযোজনা সংস্থার নাম কানাডিয়ান বায়োস্কোপ কোম্পানি, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১২ সালে। ছবিটির নির্মাণ ব্যয় ছিল ৩০ হাজার ডলার। ‘ইভানজেলিন’ ছবিটির কথা একটু বিস্তারিতভাবে বললাম এই কারণে যে, কানাডার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ছবিটিকে একটি উল্লেখযোগ্য ছবি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এটিকে কানাডায় নির্মিত প্রথম কাহিনিচিত্র বলেও কেউ কেউ গণ্য করেন।
কানাডার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যাঁর নামটি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখিত তিনি ব্রিটিশ তথ্যচিত্রের জনক জন গ্রিয়ারসন। ১৯৩৮ সালে কানাডীয় সরকারের আমন্ত্রণে কানাডায় এসে ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অফ কানাডার নেতৃত্ব তিনি গ্রহণ করেন। গ্রিয়ারসনের নেতৃত্বে কাজ শুরু করেন কয়েকজন প্রতিভাবান তথ্যচিত্র নির্মাতা। তখন কানাডীয় তথ্যচিত্র নির্মাতাদের বহু ছবি দেশে বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে এবং পুরস্কারেও ভূষিত হয়। সেসময় তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম ও স্বল্পদৈর্ঘের অ্যানিমেটেড ছবি বলতে কানাডাকেই বোঝাতো। জন গ্রিয়ারসনের সার্থক উত্তরসূরিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে যাঁকে গণ্য করা হয় তাঁর নাম নরম্যান ম্যাকলারেন। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডে জন্ম নেয়া একজন কানাডীয় চিত্রনির্মাতা। তথ্যচিত্র ও অ্যানিমেটেড ছবিতে তিনি যে মননশীলতা ও শৈল্পিক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তার জন্য তিনি কানাডীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
কানাডীয় চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য বিশ শতকের ষাটের দশক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এর আগে বেশ কিছু তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘের ছবি নির্মিত হলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো কাহিনিচিত্র নির্মিত হয়নি। কিন্তু ষাটের দশকে কয়েকজন চিত্রনির্মাতা গোটা দশেক ভালো কাহিনিচিত্র নির্মাণ করেন। এই দশটি ছবির মধ্যে আটটি ছিল ফরাসি ভাষায় এবং দু’টি ইংরেজিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কাহিনিচিত্রের উৎকর্ষ সাধনের জন্য ১৯৬৭ সালে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয়েছিলো কানাডিয়ান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বা সি এফ ডি সি। সি এফ ডি সি কাহিনিচিত্রের নির্মাতাদের তখন নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছিলো। সত্তরের দশকে মূলত সি এফ ডি সি’র সহায়তায় বেশকিছু ভালো ছবি তৈরি হয়েছিলো। তারমধ্যে দু’টি ছবির নাম না করলেই নয়। একটি ডন সেবিব পরিচালিত ইংরেজি ছবি ‘গোয়িং ডাউন দ্য রোড’, অপরটি ক্লদ যুত্রা পরিচালিত ফরাসি ছবি ‘মন অঙ্কল আঁতোয়ান’।
কানাডীয় কাহিনিচিত্রের ইতিহাসে উজ্জ্বল একটি নাম হচ্ছে জাঁ পিয়ের লেফ্যেভর। তিনি ফরাসি ভাষায় বেশকিছু ছবি নির্মাণ করেন। একসময় ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর ছবি নিয়মিত প্রদর্শিত হোতো। তাঁর ‘লে দ্যারনিয়্যার ফিঁয়াঁসাই’ এবং ‘লো ভিয়ো পেই উ র্যাঁবো এ মর’ ছবি দু’টি কানাডীয় কাহিনিচিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। এই দু’টি ছবির মধ্যে তিনি প্রথমটি নির্মাণ করেন ১৯৭৩ সালে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৭৭ সালে। তাঁর দু’জন সহযোগী ডেনিস আর্কান্ড ও গিলেস কার্লে পরবর্তীকালে বেশকিছু ভালো কাহিনিচিত্র নির্মাণ করেন।
বিশ শতকের আশির দশকে কানাডার চলচ্চিত্র-শিল্পে বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান চিত্রনির্মাতার আবির্ভাব ঘটেছিলো। তাঁদের মধ্যে যাঁরা অগ্রগণ্য তাঁরা হোলেন ফিলিপ বোরোস, বিল ম্যাকনিলিভার, স্যান্ডি উইলসন, আতোম ইগোয়ান, লেয়া পুল, রক ডেমের্স প্রমুখ। সর্বগ্রাসী মার্কিন বাণিজ্যনীতি ও হলিউডের সিনেমার দাপটকে অগ্রাহ্য করে তাঁরা তখন বেশকিছু ভালো ছবি নির্মাণ করেন যা কানাডায় তো বটেই, সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়। তাঁদের সেই পরম্পরাকে এই একুশ শতকে বহন করে চলেছেন সারা পলি, জাখারিয়াস কুনুক, জেভিয়ার ডোলান, মাইকেল ডাউস, ডানিয়েল রোবি ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত দীপা মেহতার মতো দক্ষ চিত্রনির্মাতারা। তাঁদের ছবিগুলো এখানকার সিনেমাহলগুলোতে হলিউডের ছবির পাশাপাশি দোর্দন্ড প্রতাপে চলে এবং বিশ্বের চলচ্চিত্র-অঙ্গনে প্রশংসিত ও সমাদৃত হচ্ছে।