কানাডীয় শিক্ষাব্যবস্থা – প্রাথমিক স্কুল

মানসী সাহা

বহুজাতিক দেশ কানাডার শিক্ষাব্যবস্থা সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। শিক্ষা এমন একটি আলোকিত বাতিঘর যা কিনা শিক্ষার্থীদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এবং সঙ্কীর্ণ দিগন্তের বাইরে স্বপ্ন দেখিয়ে ভবিষ্যতের আলোকিত পথগুলোকে চিহ্নিতকরে অনায়াসে। শ্রেণীকক্ষে যে জ্ঞানের বীজ বপন করা হয় তা সৃজনশীলতার সাথে লালন করে, সমালোচনামূলক চিন্তাধারার দক্ষতা দিয়ে গড়ে তোলা হয় একটি সুসজ্জিত বাগান। যে বাগান শিক্ষার আলোকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে দেশকে বৌদ্ধিক পুঁজি দিয়ে শক্তিশালী করে তোলে। এটি এমন রূপান্তরকারী শক্তি যা নাগরিকদের একাডেমিক শিক্ষার বাইরে, দায়িত্ববোধ, অধ্যবসায়, ন্যায়বিচার এবং সহানুভূতির মতো মূল্যবোধকে উদ্বুদ্ধ করে যা শিক্ষার্থীদের সচেতন এবং সক্রিয় নাগরিক হয়ে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে। 

আদিবাসীদের দেশ কানাডায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবে পারিবারিক ও সামাজিক প্রৌঢ়রা নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দান করতেন গল্প বলার মাধ্যমে, ঘরে বসে। সতেরো শতকের গোড়ার দিকে কানাডায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় নিউ ফ্রান্সে ফরাসি মিশনারিদের দ্বারা প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তাঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল আদিবাসীদের খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত করা। আঠারো শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশদের বিজয়ের সাথে সাথে ব্রিটিশ শিক্ষাগত মডেল এবং স্থানীয় চাহিদার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রদেশ জুড়ে শিক্ষা ব্যবস্থার বিপুল পরিবর্তন ঘটে। অন্টারিও প্রদেশে ১৮৭১ সালে বাধ্যতামূলক স্কুল আইন প্রবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয় যেখানে জরিমানা চালু করে বাবা-মায়েদের বাধ্য করা হয়েছিল যে সাত থেকে বারো বছর বয়সের মধ্যে বাচ্চাদের বছরে অন্তত চার মাস স্কুলে পাঠাতে হবে। উনিশ শতকে শিল্প বিপ্লব, সাক্ষরতা এবং নাগরিক দায়িত্বের উপর ক্রমবর্ধমান জোর দিয়ে চালিত জনশিক্ষার উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ এবং প্রমিতকরন হতে দেখা যায়। বিশ শতকের প্রথম দিকে বেশিরভাগ কানাডীয় শিশু স্কুলে ভর্তি হওয়া শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফেডারেল এবং প্রাদেশিক সরকারের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, দ্বিভাষিক শিক্ষা নীতি প্রবর্তন এবং আদিবাসী শিক্ষাকে একীভূত করার প্রচেষ্টা সহ আরও সংস্কার আনা হয়। বর্তমানে কানাডার শিক্ষাব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তি, বহুসংস্কৃতি এবং উচ্চ মানের একাডেমিক শিক্ষার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যা দেশের বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। 

কানাডীয় প্রাথমিক শিক্ষা শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মজবুত ভিত্তি স্থাপন করে যা একাডেমিক এবং ব্যক্তিগত উভয় বিকাশের উপর জোর দেয়। কিন্ডারগার্ডেন থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার এই শ্রেণিগুলোতে ভাষা শিল্প, গণিত, বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের মতো মূল বিষয়গুলোতে আলোকপাত করা হয়। তার পাশাপাশি শারীরিক শিক্ষা, শিল্পকলা (চারুকলা, নাচ, ও সংগীত) এবং প্রযুক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাঠ্যক্রমটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় রাখার উপর বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছে যাতে করে কানাডার বহুসাংস্কৃতিক সমাজকে প্রতিফলিত করে। সম্প্রতি আদিবাসীদের সংস্কৃতি সংরক্ষণের গুরুত্ব স্বীকার করে কানাডীয় শিক্ষাব্যবস্থায় আদিবাসী শিক্ষার প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষকরা বিভিন্ন শিক্ষার শৈলী এবং সৃজনশীলতাকে মাথায় রেখে আকর্ষণীয় পরিবেশ গড়ে তুলে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক কৌশলের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করেন। শিক্ষার্থীদের স্কুলের প্রতি আগ্রহী করে তোলার উদ্দেশ্যে বহিরঙ্গন শিক্ষা সহ, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সহযোগিতা এবং যোগাযোগের দক্ষতা বিকাশের উপর জোর দেয়া হয়।

কানাডার শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে আর শেষ হয় জুন মাসে। দশ মাসের এই শিক্ষা শেষে প্রতিটি শিক্ষার্থী তাদের সমবয়সি সহপাঠীদের সাথে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তালিকাভুক্তি করাবার জন্য চার বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা জুনিয়র কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়। জুনিয়র ও সিনিয়র এই দুই বছরের কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার পর প্রথম শ্রেণিতে তারা ভর্তি হয়। স্কুলে ভর্তি হবার জন্য স্কুলের এলাকার মধ্যে বসবাসের প্রমাণ, যেমন ইউটিলিটি বিল বা ভাড়া চুক্তির কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। পিতামাতাদের অবশ্যই সন্তানের জন্ম সনদপত্র এবং স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মান পূরণের জন্য আপ-টু-ডেট টিকাদান রেকর্ড দেখাতে হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের একটি কাঠামোগত এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের শিক্ষাগত যাত্রা শুরু করার সুযোগ দান করে।

শিক্ষাদানের পরিবেশটি আনন্দময় এবং জ্ঞানমণ্ডিত করার জন্য একজন আদর্শ শিক্ষক অপরিহার্য। কানাডার প্রাথমিক শিক্ষকরা তরুণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত যাত্রা এবং ব্যক্তিগত বিকাশ গঠনে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করে। গণিত, ভাষা শিল্প, বিজ্ঞান এবং সামাজিক অধ্যয়নের পাশাপাশি কলা, শারীরিক শিক্ষা এবং প্রযুক্তির মতো মূল বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে একটি বিস্তৃত পাঠ্যক্রম পড়ানোর দায়িত্ব তাদের। শ্রেণি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাবিদরা দশ মাসের শিক্ষাবর্ষের জন্য একটি শ্রেণির শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে বিভিন্ন ভাবে লেসন প্ল্যান তৈরি করেন যেন সমস্ত শিক্ষার্থী বিষয়গুলোর পাঠ সহজেই বুঝতে পারে। যেহেতু একজন শিক্ষক তার শ্রেণির সব বিষয় পড়ানোর দায়িত্বে থাকেন তাই তাঁকে সব বিষয় গুলোতেই পারদর্শী হতে হয়। একাডেমিক নির্দেশনার বাইরে, প্রাথমিক শিক্ষকরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রেণীকক্ষের পরিবেশ, সামাজিক দক্ষতা, মানসিক সুস্থতা এবং শিক্ষা অর্জন করার প্রতি শিক্ষার্থীদের ভালবাসা ও আগ্রহ তৈরি করে। শিক্ষকরা পিতামাতা এবং অভিভাবকদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাতে তাদের সন্তানদের অগ্রগতি সম্পর্কে তাদের অবগত রাখাসহ তারা কীভাবে তাদের সন্তানদের অগ্রগতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে এবং যেকোন সমস্যা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হলে কীভাবে সম্মিলিতভাবে সমাধান করা যায়। ক্রমাগত পেশার বিকাশের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কানাডীয় প্রাথমিক শিক্ষকরা নতুন শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জ এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে তাঁরা নিয়মিত অংশগ্রহন করেন বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা, ও সম্মেলনে যা কিনা হতে পারে স্কুল ভিত্তিক, বোর্ড ভিত্তিক, অথবা প্রদেশ ভিত্তিক। “Teaching is learning” এই মতবাদে বিশ্বাসী শিক্ষকেরা গবেষণামূলক এ সব বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণে নিযুক্ত হয়ে শেখে নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি, শ্রেণীকক্ষ পরিচালনার কৌশল এবং আনেন শিক্ষাগত প্রযুক্তিতে অগ্রগতি। বলা বাহুল্য, অন্টারিও কলেজ অফ টিচার্স – এর লাইসেন্স প্রাপ্ত শিক্ষকরাই কেবলমাত্র কানাডীয় স্কুলে শিক্ষকতার জন্য নিযুক্ত হন। শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশাসনিক দল স্কুলগুলোর মসৃণ এবং কার্যকরী পরিচালনা নিশ্চিত করতে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই দলে সাধারণত প্রিন্সিপাল, ভাইস-প্রিন্সিপাল, অফিস স্টাফ এবং অন্যান্য প্রশাসনিক পেশাদাররা অন্তর্ভুক্ত থাকে। আর জ্যানেটর যারা কিনা স্কুলটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিক্ষা দানে সহায়তা করে। 

মূল্যায়ন হল কানাডার স্কুল সিস্টেমের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ যা শিক্ষার গুণগতমান এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। সাধারণত ডায়াগনসটিক, ফরমেটিভ ও সামেটিভ এই তিনটি ধাপে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। প্রাথমিক ভাবে ডায়াগনসটিক মূল্যায়ন দ্বারা শিক্ষকরা নির্ধারণ করেন শিক্ষার্থী কতটুকু জানে আর তার উপর ভিত্তি করেই লেসন প্ল্যান বা  নির্দেশনা তৈরি করেন। সেই লেসন প্ল্যান অনুযায়ী শিক্ষা দান করার সময় ফরমেটিভ মূল্যায়নটি করা হয় আর নির্ধারণ করা হয় যে শিক্ষার্থীর সাফল্যের জন্য যে পথটি তৈরি করা হয়েছে তা সঠিক এবং তা কার্যকরী হচ্ছে। চূড়ান্ত বা সামেটিভ মূল্যায়নটি করা হয় নির্দিষ্ট পাঠের শেষে এবং এই মূল্যায়নটি থেকে যাচাই করা হয় লেভেল ১ থেকে ৪ পর্যন্ত কোথায় শিক্ষার্থীর অবস্থান। উল্ল্যখ্য যে, ৪ হল A এর সমতুল্য এবং ক্রমানুসারে B, C, D ব্যবহৃত হয় গ্রেইড নির্ধারণের জন্য। উপরন্তু, মূল্যায়নের তথ্য স্কুল এবং শিক্ষা কর্তৃপক্ষকে পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, সম্পদ বরাদ্দ এবং নীতি প্রণয়ন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। ক্রমাগত মূল্যায়নের মাধ্যমে, কানাডিয়ান স্কুল সিস্টেম উচ্চ শিক্ষাগত মান বজায় রাখে, এবং শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব ও সামগ্রিক শিক্ষাগত ফলাফলকে উন্নত করার চেষ্টা করে। ক্লাসরুম অ্যাসাইনমেন্ট, পরীক্ষা, প্রকল্প এবং প্রমিত প্রাদেশিক মূল্যায়নের সমন্বয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়। শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব এবং উন্নতির জন্য ক্ষেত্রগুলোর প্রতিক্রিয়া জানাতে রিপোর্ট কার্ডের নিয়ম চালু করা হয়। শিক্ষকরা পাঠ্যক্রমের বিষয়গুলো ছাড়াও শিক্ষার্থীর কাজের অভ্যাস ও শেখার দক্ষতা নিয়ে রচনা আকারে বিস্তারিত রিপোর্ট কার্ড তৈরি করেন। এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড একাউন্টিবিলিটি অফিস (EQAO) মূল পর্যায়ে পড়া, লেখা এবং গণিতে শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স পরিমাপ করার জন্য প্রদেশ-ব্যাপী মূল্যায়ন করা হয় তৃতীয়, ষষ্ট, ও নবম শ্রেনিতে এবং শুধুমাত্র পড়ার দক্ষতার উপর পরীক্ষা হয় দশম শ্রেনিতে।

স্কুলগুলো মূলত পরিচালিত হয় স্কুল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত বাজেটের ভিত্তিতে। স্কুল বোর্ডগুলো প্রাথমিক শিক্ষার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা নিশ্চিত করে যে স্কুলগুলোর কার্যকর স্বাভাবিক ভাবে চলছে এবং প্রাদেশিক শিক্ষাগত মান পূরণ করছে। প্রতিটি স্কুল বোর্ড নির্বাচিত ট্রাস্টিদের দ্বারা পরিচালিত হয় যারা কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করেন এবং নীতি, বাজেট এবং কৌশলগত পরিকল্পনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। তারা স্কুলের কর্মীদের নিয়োগ, স্কুলের সুযোগ সুবিধাগুলো বজায় রাখা এবং বিভিন্ন সংস্থান এবং প্রোগ্রামগুলোর সঠিক ভাবে সব শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে তা নিশ্চিত করে। স্কুল বোর্ডগুলো আরও যে কাজটি করে থাকে তা হল স্কুলের সঙ্গে অভিভাবক, ছাত্রছাত্রী এবং কমিউনিটির কোন সমস্যার সৃষ্টি হলে তার সমাধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলোতে সহায়তা করা। মিনিস্ট্রি অফ এডুকেশনের সাথে সমন্বয় করে স্কুল বোর্ডগুলি নিশ্চিত করে যে স্থানীয় স্কুলগুলো প্রাদেশিক প্রবিধানগুলো মেনে চলে এবং সেইসঙ্গে তাদের কমিউনিটির অন্যান্য চাহিদাগুলোকেও পূরণ করে। সর্বোপরি, তারা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যেখানে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক সাফল্য এবং ব্যক্তিগত গুণাবলী গুলো অর্জন করে সম্পূর্ণ ভাবে নিজেদের বিকশিত করতে পারে।

প্রাথমিক শিক্ষায় বাবা-মায়েরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সক্রিয়ভাবে তারা তাদের সন্তানদের শিক্ষাগত সাফল্য এবং সামগ্রিক বিকাশে অবদান রাখে। তাদের সম্পৃক্ততা অনেক ধরনের হতে পারে যেমন অভিভাবক-শিক্ষক সম্মেলনে যোগদান, স্কুল ইভেন্টে অংশগ্রহণ করা, ক্লাসরুমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়মিত সহায়তা করে শিক্ষার্থীদের পড়ার ফ্লুয়েন্সি বৃদ্ধি করা, শিক্ষা সফরে সহায়তা করা, বাড়িতে পাঠানো প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে সহায়তা করা, এবং বাড়িতে শেখার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা। স্কুলের পাঠ্যক্রম সম্পর্কে অবগত থাকা পিতামাতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যা কিনা অনেক পিতামাতার অজানা। মিনিস্ট্রি অফ এডুকেশন ওয়েবসাইটে থাকা সম্পূর্ণ পাঠ্যক্রমটি সবার জন্য উন্মুক্ত। শ্রেণীকক্ষে বা স্কুল কমিটিতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত হয়ে অভিভাবকেরা শিক্ষার পরিবেশ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারেন। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব চাহিদা পূরণ, শিক্ষাগত ফলাফলের উন্নতি, শিক্ষার মূল্য এবং সুশীল সমাজ গড়ে তোলার পেছনে পিতামাতা এবং স্কুলগুলোর মধ্যে এই সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের কোন বিকল্প নেই। 

কানাডীয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার অন্যতম সৌন্দর্য হল যে একজন শিক্ষার্থীর শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধকতা শিক্ষার অন্তরায় হয় না। প্রতিটি ছেলেমেয়ে শিক্ষা লাভের যোগ্য এখানে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থাটি শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র সহায়তা এবং সংস্থানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে যাতে সবার জন্য শিক্ষার সুষ্ঠু প্রবেশাধিকার নিশ্চিত থাকে। এই সিস্টেমটি অন্তর্ভুক্তি নীতির মাধ্যমে একটি বিশেষ সহায়ক দলের দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের মূলধারার শ্রেণীকক্ষে একীভূত করার লক্ষ্যে বিশেষ প্রোগ্রাম এবং পরিষেবা প্রদান করা হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য ব্যক্তিগত শিক্ষা পরিকল্পনা (Individual Learning Plans – IEPs) তৈরি করা হয়। যে দলটি একসাথে কাজ করে তাদের মধ্যে থাকে শ্রেণি শিক্ষক, শিক্ষা সহকারি, মনোবিজ্ঞানী, স্পিচ-ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজিস্ট, অকোপেশানাল থেরাপিসট, সমাজকর্মী, নার্স, ও প্রসাশন। স্পিচ-ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজিস্টরা শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের বা কমেউনিকেশন চ্যালেঞ্জের জন্য সাহায্য করে।  সমাজকর্মীরা মানসিক এবং সামাজিক সহায়তা প্রদান করে সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করে যা একজন শিক্ষার্থীর শেখার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। একসাথে স্কুল সহায়ক দল শিক্ষক, পিতামাতা এবং প্রশাসক একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং লালনশীল শিক্ষামূলক পরিবেশ তৈরি করতে সহযোগিতা করে যা প্রতিটি শিক্ষার্থীর অনন্য চাহিদা পুরনে সহায়তা করে।

কানাডীয় সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কোন বেতন প্রদান করতে হয় না। দ্বিভাষী দেশ কানাডায় অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ফরাসি বা ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাতে পারে। যে অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদেরকে প্রাইভেট স্কুলে রেজিস্ট্রেশন করার সিদ্ধান্ত নেন তাদেকে বেতন প্রদান করতে হয়। কোন কোন অভিভাবক তাদের সন্তানদের বাড়িতে শিক্ষা দান করেন যাকে হোম স্কুলিং বলা হয়।

কানাডীয় পাঠ্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা সম্পর্কীত শিক্ষা। পাঠ্য বহির্ভূত কার্যকলাপগুলো কানাডীয় শিক্ষাব্যবস্থায় অতন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ। এখানে স্পোর্টস প্রোগ্রামগুলোতে শিক্ষার্থীদের দলগত খেলা যেমন সকার, বাস্কেটবল এবং ভলিবলের পাশাপাশি সাঁতার এবং ট্র্যাক এবং ফিল্ডের মতো ব্যক্তিগত খেলাগুলোতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়। এই ক্রিয়াকলাপগুলো শারীরিক সুস্থতা, টিমওয়ার্ক এবং খেলাধুলার প্রচার ও প্রসারে সহায়তা করে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মূল্যবান জীবন দক্ষতা যেমন শৃঙ্খলা, অধ্যবসায় এবং লক্ষ্য তৈরি করতে শেখে। আর্টস অ্যান্ড কালচারাল ক্লাবগুলো শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতাকে উৎকর্ষীত করে। স্কুলগুলোতে প্রায়ই ভিজ্যুয়াল আর্ট, সঙ্গীত, নাটক এবং নৃত্যের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শিক্ষার্থীরা ব্যান্ড, গায়কদল, থিয়েটার প্রোডাকশন এবং আর্ট ক্লাবে যোগ দিয়ে বাড়াতে পারে তাদের শৈল্পিক দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস। একাডেমিক ক্লাব এবং প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতা সুগভীর করার সুযোগ করে দেয়। গণিত ক্লাব, বিজ্ঞান মেলা, বিতর্ক দল, কোডিং ক্লাব এবং রোবোটিক্স ক্লাবগুলো শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিগত মান বাড়াতে উত্সাহিত করে এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে উন্নীত করে।

কানাডীয় শিক্ষাব্যবস্থা হল একটি শক্তিশালী এবং গতিশীল কাঠামো যা সমস্ত শিক্ষার্থীদের উচ্চ-মানের শিক্ষা প্রদানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। শিক্ষার সু-গঠিত স্তর, বৈচিত্র্যময় পাঠ্যক্রম, সহায়ক শিক্ষার পরিবেশ, অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশেষ প্রোগ্রাম, পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যকলাপ এবং কমিউনিটির সম্পৃক্ততা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সাফল্য এবং ভবিষ্যত সুনাগরিক হবার জন্য প্রস্তুত করে। শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত দক্ষাতার সাথে প্রস্তুত করে একটি পরিবর্তিত বিশ্বে  নিজেদেরকে তথা দেশকে সঠিক পথে পরিচালনার দিক নির্দেশনা প্রদান করতে।