কানাডা আমার দেশ
ষড়ঋতুর দেশ থেকে চার ঋতুর দেশে এসে পৌঁছলাম। একটু অবাক ভাবনা মাথার ভিতরে ছয় ঋতু না হয়ে চার ঋতু হয় কীভাবে! তখন শীতের শেষ,ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা তুষার পড়ে আছে এখানে ওখানে। বসন্ত শুরু হয়ে গেছে কিন্তু হাড় কাঁপিয়ে দেয়া শীত। শীতের দেশ হিসাবেই জানতাম কানাডাকে। এমন তুষার আবৃত শীতের সাথেই অভ্যস্থ হয়ে উঠতে হবে। অথচ কিছুদিন যেতে না যেতে দেখলাম বসন্তবাহার। এমন বসন্ত কখনও দেখিনি আর। এত ফুল ফুটে এত পাখি গায় এখানে। আমাদের দেশে বসন্তের ফুলগুলো ম্রিয়মান মলিন ধূসর ধুলায় ঢাকা। অথচ কানাডায় চকচকে রঙের বাহার। পাতাবিহীন গাছে শুধু ফুল ।
বসন্ত কেটে যেতেই গ্রীষ্মের দেখা পেলাম। শীতের দেশে তুমুল উষ্ণতা, সবুজের ছোঁয়া চারপাশ। এত সবুজ – এতো বাংলাদেশের সবুজকেও হার মানিয়ে দেয়। তারপর পেলাম এক অদ্ভুত ঋতু যাকে বলা হয় ফল। শরৎকাল অটাম, চারপাশ লালে লাল হলুদের ছড়াছড়ি অপূর্ব সুন্দর। এমন সুন্দরের সাথে আগে দেখা হয়নি কখনও। অতঃপর শীতের বাতাসে, তুষার বরফ চারপাশ শুভ্রতার ধবল আলোয়ানে ঢাকা। এই শীতল ধবল পৃথিবীর মায়ায় প্রেমে পড়ে গেলাম। সে দেশটির নাম কানাডা।
অনেক যুগ আগেই এই দেশটির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। দেশটিতে পৌঁছালাম – তখন সাথে নিয়ে এলাম নিজের ভাবনা, শিল্প সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধর্ম, পারিবারিক শিক্ষা, চেতনা।
এসবের বাইরে অন্য দেশের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানা ছিল না তেমন কিছু। বইয়ে পড়া তাত্ত্বিক কিছু জ্ঞান ছাড়া।
একটা অচেনা ভূখণ্ডে একটা অচেনা ভাষার জগতে, অচেনা মানুষের মাঝে আস্তে আস্তে মিশে যেতে থাকলাম। শিক্ষা পেলাম অনেক নতুন কিছু, জানলাম বৈচিত্র্যময় অন্য জীবনের কথা। যা চির চেনা পরিচিত জীবনের নিয়মের মতন নয়। কিছুটা বইয়ে পড়া জ্ঞানের মতন।
আমাদের অনেক ভালো শুধু মাকাল ফলের মত অথবা মুখোশে ঢাকা মুখের মত কিন্তু অচেনা দেশটিতে পেলাম, সত্যিকারের সততার চিহ্ন। প্রতি পদে পদে শিখলাম সহজ সাবলীলতায় কীভাবে সমস্ত কাজগুলো সম্পন্ন করা যায় একা। কোন কাজে কারো সাহায্য দরকার হয় না শুধু নিজেকে জানতে হয় নিয়মগুলো। প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা অফিসের পদগুলো দখল করে আছেন তারা নিয়োজিত মানুষের সেবায়। নিজের উদ্যোগে এগিয়ে যেতে হয় এখানে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আছে কত সংস্থা।
পরিচিত হলাম বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে। ছোটখাটো একটা পৃথিবী মনে হয় আমার কাছে কানাডা দেশটাকে। কত ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ এই দেশে বসবাস করে। অনেক দেশের মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া এত সহজ নয়, সব দেশে যাওয়া এবং তাদের সংস্কৃতি জানা সম্ভব নয়। কানাডায় এসে পেয়ে গেলাম ভিন্ন দেশের ভিন্ন মানুষের পরিচয়। নানা দেশের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, উৎসব, আনন্দ, বেদনার বিষয়ে জানার সুযোগও হলো।
কানাডার নিয়ম হলো তুমি তোমার দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধারণ করে কানেডিয়ান হও। আমেরিকা যেমন বলে তুমি কোন দেশের মানুষ সেটা জরুরী নয়। তুমি আমেরিকান হয়ে উঠো নিজের রুটস পরিচয় ভুলে।
কানাডা একটি উদার দেশ। মানবিক দেশ। বিপদগ্রস্ত মানুষের আশ্রয়ের দেশ। যেখানে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা সমান, মানুষের মতো। এখানে কোন রকমের পার্থক্য নেই ভিন্নদেশ, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন বর্ণ, ভিন্ন সংস্কৃতি বা ভিন্ন লিঙ্গর। এছাড়াও আছে বিভিন্ন মানুষের নানা ধরনের মানসিক বিষয়ে সমান মর্যাদার সুযোগ যা আগে কখনো কোথাও দেখিনি। একই দেশের মানুষ আমরা নিজেদের যাচাই করি নানা গোত্রের মানুষ হিসাবে। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সব মানুষ এক মানুষ পরিচয়ে পরিচিত কানাডায়।
এখানে সময়ানুবর্তিতায় বাঁধা জীবনযাপন। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে সময় একটা ভীষণ রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া কাজের, নিয়ম এবং শৃঙ্খলা মেনে চলে যে যার নিজস্ব দায়িত্বে। কাজে অবহেলা করে চাকরিতে টিকে থাকা সম্ভব না। যে কোন সময় ছাটাইয়ের চিন্তা থাকে। এছাড়া যত ভালো কাজ দেখাবে তত স্বীকৃতি, প্রশংসা পাওয়ার সাথে আয়ের হিসাব এবং যোগ্যতার মাপকাঠি বাড়তে থাকে, বয়সের চেয়ে জ্ঞানের মূল্যায়ন বেশি।
প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিন্ন দেশের মানুষের আচরণ এক হয়ে ওঠে সাদা, কালো,পীত, বাদামী বর্ণের মানুষের নেই কোন পার্থক্য। তবে পার্থক্য আছে যোগ্যতার। অনেকেই এই দেশে এসে ভাবে আমি তো অনেক উচ্চশিক্ষিত; ডাক্তার, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইন বিশেষজ্ঞ এবং আরও নানা ধরনের পেশায় উচ্চপদস্থ পদে কর্মে নিয়োজিত ছিলাম নিজ দেশে। প্রথম অবস্থায় এই দেশে এসে সবাই মনে করেন তারা সেই যোগ্যতায় কাজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু কানাডা এমন একটি দেশ এখানে এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং নিয়মকে সবার উপরে রেখেছে। কাজেই যে কোন দেশ থেকে এসে সরাসরি সেই পর্যায়ে কাজ পাওয়াটা সম্ভব না কারো জন্য। যেকোনো মানুষকে নিজেকে যোগ্য পরিচয়ে তৈরি করে নিতে হয় এই দেশের মান অনুযায়ী।
এখানে দেশীয় মানসিকতায় অনেকেই ভয়াবহভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং কানাডাকে অভিযুক্ত করতে থাকেন কারণ এই দেশের নিয়ম গুলো নিয়ে তাদের সমস্যা হয়। কিন্তু একটি দেশের নিয়ম যখন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয় এবং একই উচ্চতায় সেটা জানা হয় তখন সবার মধ্যেই সেই কাজের মানসিকতা সুন্দর এবং সুষ্ঠুভাবে হয়। কাজেই যারা দেশীয় মনোভাব পরিবর্তন করতে পারেন না তাদের জন্য কানাডা একটি কঠিন জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। যতই তারা অভিযুক্ত করেন কানাডাকে সঠিক মর্যাদা না পাওয়ার জন্য। কানাডা কাউকে ডেকে নিয়ে আসে না। নিজের প্রয়োজনে এবং ইচ্ছায় মানুষ কানাডায় আসে।
তাই যারা নিজেকে মানিয়ে এদেশের শিক্ষায়, শিক্ষা ব্যবস্থায় নিজেকে শিক্ষিত করে নিয়মমাফিক নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন যোগ্য নাগরিক হিসাবে তারা উন্নতি করতে পারেন খুব সহজে।
কানাডার নিয়মে যে কোনো মানুষ নিজের দেশ থেকে এসে এই দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। আশ্রয় গ্রহণকারী একটি মানুষ হিসাবে জীবন যাপন করে এই দেশে প্রথম দিন থেকেই। যদিও তার নাগরিক বা আবাসিক অবস্থানের মর্যাদা নাও থাকে। যতদিন পর্যন্ত তার সমস্যা, আইনের মাধ্যমে সমাধান না হয় ততদিন সে এবং তার পরিবার অন্যান্যদের মতন সমস্ত সুযোগ পেয়েই এই দেশে থাকতে পারে।
কোর্টে কেইস নিস্পত্তির মাধ্যমে কেউ আবাসিক অবস্থান পায় কেউ ফিরে যায় নিজের দেশে। তবে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার আগে অনেকগুলো ধাপে সুযোগ দেওয়া হয় তার সমস্যা সঠিক প্রমাণ করে এই দেশে থাকার। জীবন যাপনের জন্য যে অসুবিধাগুলো নিজের দেশে সঠিকভাবে তা প্রমাণ করতে পারলেই নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়ার শুরু হয়। কারো সময় লাগে এক বছর কারো বা বিশ বছর। কাজেই একজনের হিসাব দিয়ে অন্যজনকে ভাবা ঠিক না। প্রতিটি মানুষের কানাডায় থাকার প্রক্রিয়া ভিন্ন। কিন্তু সেই পর্যন্ত সেই মানুষটি কানাডায় মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার সকল সুবিধাই ভোগ করতে পারে। সেই মানুষ বা পরিবার শুধু কানাডার বাইরে যাওয়া এবং রেসিডেন্সি না পাওয়া ছাড়া।
কানাডা একটি আশ্রয়দাতা দেশ। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে বিপর্যস্ত মানুষ অথবা রাজনৈতিক, পারিবারিক নির্যাতনে অত্যাচারিত মানুষের আশ্রয় কানাডা। আশ্রয় চাইলেই আশ্রয় পাওয়া যায় না। বেশ কিছু নিয়ম-কানুন এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রমাণ করতে হয় নিজ দেশে থাকার সমস্যা। আবার অনেক মানুষকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে কানাডা সরকার নিজ দায়িত্বে তুলে নিয়ে আসে। এভাবে আশ্রয় পাওয়া মানুষের পাশাপাশি, ইমিগ্রেশন নিয়ে এই দেশের আবাসিক নাগরিক হয়ে চলে আসারও নিয়ম আছে। যার জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন হয়। অর্থ দিয়ে কিনতে পারা যায় কানাডার নাগরিকত্ব। যা সম্ভব খুব ধনী মানুষের পক্ষেই। সাধারণ মানুষ সবার জন্য তাই উন্মুক্ত আছে আশ্রয় চাওয়া। অনেকে নিজের শেষ সম্বল শেষ করে, নিয়ে নেন এই দেশের অভিবাসন। একটাই ইচ্ছা থাকে মানুষের, এক জীবনে সুন্দর একটা নিয়মের দেশে সুন্দরভাবে বাঁচা। সন্তানদের উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করার সুযোগ পাওয়া।
কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়া, কানাডায় মানুষ সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াটি পৃথিবীর সব দেশের মানুষের জন্য খোলা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা বর্ণ জাতির মানুষ আসে কানাডায়।
হাজার হাজার মানুষকে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ থেকে কানাডা নিজ খরছে এই দেশে নিয়ে আসে। এই দেশে কর্ম সংস্থার মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিশোধ করতে হয় সরকারের ঋণ, আবাসন পাওয়া নতুন মানুষদের। যা তাতক্ষণিকভাবে সরকার তাদের জন্য খরচ করেছে, তাদের সমস্যা সমাধান করার জন্য। ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ইরাক, সিরিয়া, আফগানীস্থান,ইউক্রেন এমন কী মায়ানমারের প্রচুর মানুষ এই দেশে আসার সুযোগ পাচ্ছে যুদ্ধবস্তার জন্য।
যারা এই দেশে এসে থাকার সুযোগ চায়, এই দেশে নাগরিক হয়ে উঠতে না পারলে বা রিফিউজী হয়ে আছে তার জন্য তাকে আলাদাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় না কখনও। বরঞ্চ তাকে তার পরিবারকে সন্তানকে শিক্ষা এবং চিকিৎসার সমস্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়, নিজেকে উন্নত করার সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। বয়স্কদের জন্য আছে ভাষা এবং সংস্কৃতি শিখার জন্য ফ্রি স্কুল। কাজের জন্য নিজেকে যোগ্য করার জন্য ট্রেনিং সংস্থা যা অনেক ক্ষেত্রেই বিনামূল্যে এবং সরকারিভাবে পরিচালিত হয়।
আবার কিছু ক্ষেত্রে সরকারী ঋণ দেয়ার প্রকল্প আছে। নিজেকে শিক্ষায় উন্নত করে যোগ্য কাজ পাওয়ার যোগ্য করার সব রকমের সুযোগ দেওয়া হয়। ঋণ নিয়ে পড়ালেখা করার।
অমানুষের জীবন যাপন করছে মানুষ – বাংলাদেশসহ এমন অনেক দেশ আছে পৃথিবীতে। যেখানে নিজের দেশে থেকেও মানুষ নাগরিক সুবিধা পায় না। কে খাওয়ার পাচ্ছে, শিক্ষা, চিকিৎসা পাচ্ছে তা দেখা হয় না। সরকারের দায়িত্ব সরকারের কার্যক্রমে অনেক সময়ই পড়ে না।
কানাডার নিয়মে এ দেশে আশ্রয় গ্রহণ করা মানুষদেরকে খাওয়া, পড়া, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষার সুবিধা সরকারিভাবে দিয়ে থাকে। পাঁচ বছর পর্যন্ত একজন মানুষকে নতুন নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এই পাঁচ বছর পর্যন্ত সে প্রতিদিন নিজেকে উন্নয়ন করে শারীরিক মানসিক পরিবেশের সাথে এবং যোগ্য নাগরিক হয়ে ওঠে সরকারের অনেক সুযোগ সুবিধা পেয়ে।
বাচ্চাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, হাই স্কুল পর্যন্ত একদম বিনামূল্যে। সন্তানকে স্কুলে না পাঠানো একটি অপরাধ কানাডায়। বাচ্চারা বইয়ের বোঝায় না ডুবে নিজের মনের বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষা লাভ করে এখানে। পাঠের পাশাপাশি যোগ্য করে তোলা হয় বাচ্চাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড এবং খেলাধূলায়। আগ্রহ অনুযায়ী নিজেকে বিকাশ করার সুযোগ পায় বাচ্চারা মুখস্ত বিদ্যার পাঠের বদলে।
স্কুল শেষে দারুণ ভাবে আগ্রহী শিক্ষার্থীরাই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। দুটো বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সাথে কঠিন ভাবে জড়িত এক অধ্যবসায়, অন্যটি উচ্চব্যয়। স্কুলের হালকা চালের পড়ালেখার পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কঠিন পড়ালেখা চালাতে পারে না অনেক শিক্ষার্থী। প্রথম বর্ষে অনেক সময় অর্ধেক শিক্ষার্থী পড়া ছেড়ে দেয়। আবার কলেজের কারিগরী শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যারা সহজে সেটা শেষ করে কাজে লেগে পরে।
বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ব্যয় বহুল শিক্ষা, অনেক পরিবার বহন করার সক্ষমতা রাখে না। কিন্তু এখানেও শিক্ষা ঋণ দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের যা পড়া শেষে কাজ পেয়ে ধীরে ধীরে শোধ করতে হয়।
এই সুযোগ না থাকলে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারত না কানাডায়।
ঠিক তেমনি নিজের বাড়িতে থাকার জন্যও ব্যাংকের ঋণ নিয়ে, মানুষ আনন্দে প্রতি মাসের মর্টগেজ দিয়ে যায় এবং নিজের বাড়িতে থাকার আনন্দ উপভোগ করতে পারে সুযোগ আছে বলে।
এই সুবিধাগুলো একজন মানুষের জীবন সহজ সুন্দর হয়ে উঠে তখনই যখন সে সব জেনে বুঝে সঠিকভাবে নিয়মগুলো কার্যকরী করতে পারে। আবার অনেকে সঠিকভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রন না করতে পেরে গোছান জীবন অগোছালও করে ফেলে। শীর্ষ পর্যায় থেকে হোমলেস জীবন কাটায়।
অনুন্নত অনেক দেশের মানসিকতায় অনেক মানুষের মনে, উচ্চপদস্থ মানুষদের ধরাধরি করে সুযোগ সুবিধা আদায় করে অন্যদের আগে নিজের কাজটি করে নেওয়ার প্রবণতা আছে। কানাডায় সাধারণ জনগণ প্রত্যেকেই নিয়মমাফিক সমস্ত সুযোগ সুবিধা পায়। ব্যাংকে বা ডাক্তারখানায় বা যে কোন অফিসে, এক লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সবাইকে একজন অফিসার এবং একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী বা একজন শিক্ষক, চিকিৎসক বা একজন ছাত্রকে। ক্রমিক অনুযায়ী সবাই কাজ করার সুযোগ পায়। ঠেলাঠেলি বা ধরা ধরি কোন প্রয়োজন হয় না। ‘আমি কে’ চিনিস এই ধরনের মাতব্বরীর নিয়ম নেই। অন্যের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে উচ্চপদস্থ সুবিধ নিয়ে বা ঘুষ দিয়ে কোন কাজ করার প্রয়োজনে এখানে পড়ে না । নিজের প্রয়োজনটা বুঝিয়ে দিলে সমস্ত কিছুই সুন্দরভাবে হয়ে যায়। মানুষের সেবা দেয়ার জন্য অফিসে চাকরিরত মানুষগুলো বসে থাকে।
যে কোন অফিসিয়াল কাগজপত্রের জন্য আবেদন সেটা ইমিগ্রেশন করার জন্য হোক বা ড্রাইভিং লাইসেন্স রিনিউ করার জন্য হোক অথবা অন্য যে কোন কাজ হোক, নিজেই করতে পারবেন সব কাজ। কাউকে ধরাধরী করার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু অনুসরন করতে হবে নিয়মগুলো।
যোগ্যতা দেখাতে পারলে সেই যোগ্যতার মর্যাদা এখানে পাওয়াই যায়। যারা এদেশে আসে তাদের চেয়ে, তাদের সন্তানরা যারা এই দেশের শিক্ষায় শিক্ষিত হয় তাদের মধ্যে ভিন্ন প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সন্তানরা কোন কিছু রাখ ঢাক পছন্দ করে না। তারা সমস্ত কিছুই সুন্দরভাবে করতে চায় যদিও অনেক কমিউনিটির মাধ্যমে নানা রকম বিচ্ছিন্নতা নানা রকম সংকীর্ণ মনোভাব ধীরে ধীরে এখন ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে। যা বাঞ্ছনীয় নয়। অনিয়মের চেয়ে নিয়মের চলাটাই পছন্দের এমন একটা দেশে। ইমিগ্রেশনে অনেক বাছাবাছি করে নিয়ে আসা বা রাখা মানুষদের মধ্যে কিছু নীতিহীন মানুষ ঢুকে যায়। যাদের কারণে কিছু অনিয়মও ঢুকে যাচ্ছে এ দেশের নিয়ম কানুনে। যা হতাশার, ভীতির। নষ্ট মানুষের পাল্লায় পরে সুন্দর নিয়ম কানুন নষ্ট হয়ে যাক এমনটা কখনো চাই না।
এদেশে এসে দেখলাম আবাসিক এলাকার মাঝে মাঝে সবুজ ভূখণ্ড। বাচ্চাদের, বড়দের অখণ্ড খেলাধুলার সুযোগ সেখানে। ঘরে থাকা কুকুরটিকে নিয়ে হাঁটতে যাওয়ার জন্যও পার্ক আছে। মানুষ নয় শুধু পশু পাখির জন্য ভাবনা ছড়ানো।
এখানে আরও একটি বিষয় দেখলাম প্রতিটি পাড়ার একটি লাইব্রেরি। অসংখ্য বই সেখানে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে এবং বিভিন্ন ভাষার উপরে। কত ধরনের ভিডিও অডিও, অনেক গল্প অনেক ছবি সাজানো লাইব্রেরি ভর্তি। পছন্দমত বই, ওডিও ভিডিও একটা লাইব্রেরি কার্ড থাকলে তুলে বাড়ি নেওয়া যায়। নিজের পছন্দের বইটি না পেলে লাইব্রেরিতে জানিয়ে দিলে তারা সে বইটি লাইব্রেরিতে আনিয়ে জানিয়ে দেয় সংগ্রহ করার জন্য।
এত বই পড়েছি এখানে আসার পর। অনেক বছর দেশে থেকে অনেক বই কিনেও সেই বই পড়ার সময় সুযোগ করতে পারিনি। অথচ অনেক কাজ একা করার পরও বই পড়ার অবসর ঠিক পেয়ে যেতাম নিয়ম মতন সব কাজের সুযোগ থাকার জন্যই।
উঠান পরিষ্কার করি নিজের হাতে বা যখন ঘরের ভিতরে রান্না করি নিজের আয়োজনে সেখানে কোন সাহায্যকারী থাকে না। গাড়ি চালানোর জন্য কোন ড্রাইভার থাকে না । গাড়িও পরিষ্কারও করতে হয় নিজেকে।
প্রতিটি কাজ নিজে করার মতো একটা মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়। প্রতিটি কাজ নিজের এবং এই কাজগুলো নিজের হাতে করার মধ্যে কোন লজ্জা নেই। অথচ আমাদের মানসিকতা তৈরি ছিল এগুলো আমার কাজ নয়। এগুলো কাজের লোক করে দিবে। এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়াও আমার কাজ না। এই মানসিকতা নিয়ে যারা থাকতে চায় তাদের জন্য কানাডা নয়। প্রতিটি পর্যায়ে জীবনের প্রয়োজনে নিজের সমস্ত কাজ যোগ্যতায় করতে পারাটাই কানাডার নাগরিক হয়ে ওঠার যোগ্যতা।
হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স একজন রোগীর সেবা প্রদান করেন। সেখানে পাশে বসে থাকার জন্য কোন পরিবারের সদস্যের প্রয়োজন হয় না। খাওয়া থেকে ওষুধ, পরীক্ষা নিরীক্ষা সমস্ত কিছুই হাসপাতালে পাওয়া যায়। পরিবারের লোকজন ইচ্ছে করলে থাকতে পারে, না থাকলেও কোন সমস্যা হয় না একজন রোগীর দেখ ভাল করা হাসপাতালের সদস্যদের দায়িত্ব পরে।
বয়স্ক এবং শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা সম্মান। শিশু যে হবে আগামী দিনের নাগরিক এই দেশের জন্য কাজ করবে। আর বয়স্ক যারা এই দেশকে উন্নত করেছেন, নিজের মেধা শ্রম দিয়ে এতদিন। এই দুই প্রজন্মকে দেখভালের জন্য আলাদা তহবীল আছে সরকারের কোষাগারে।
এখানে মানুষ প্রশংসা করে, ধন্যবাদ দেয়, কিছু ভুল হলে সরি বলে। মার্জিতভাবে কথা বলে প্লিজ শব্দটি খুব বেশি উচ্চারিত হয়। ভাষার মাধ্যমে ব্যবহার প্রকাশ পায়।
এছাড়া লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, যে কোন বিষয়ে গুণসম্পন্ন মানুষকে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে মূল্যায়ন করা হয়। গুণবান মানুষের যত্ন করা যেন রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব। তেমনি যে সমস্ত মানুষের জন্ম হয়েছে শারীরিক বা মানসিক কোন ধরনের খুঁতসহ তাদের অবহেলা নয় বরং তাদের জন্য আছে বিশেষ ব্যবস্থা। প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্য তৈরি আছে এই দেশের নিয়ম।
কানাডার মতন একটা দেশে না আসলে কখনও জানা হতো না পুলিশ জনগনের বন্ধু।
নিজেদের জীবন বিপন্ন করে যারা মানুষের সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত তাদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান রেখেছে কানাডা। যারা দেশ রক্ষায় জীবন দিয়েছে সেই ভ্যোনারেবোল সৈন্যদের, যে মর্যাদায় আন্তরিকতায় এই দেশে মনে করা হয় তা দেখে নিজের দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভেবে খুব দুঃখ পাই।
কানাডায় সরকার পরিবর্তন হয়, দল পরিবর্তন হয় কিন্তু জনগনের জন্য করা নিয়মগুলো বদল হয় না। খুব সামান্য পরিমান নিয়ম কখনো কোন সরকার পরিবর্তন করে প্রয়োজনে।
আদিবাসীরা হাজার হাজার বছর ধরে এখন পর্যন্ত কানাডায় বসবাস করে আসছে। ওরাই কানাডার মূল অধিবাসী। ষোলো শতকের শুরুতে, ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা আটলান্টিক উপকূলে বসতি স্থাপন করে। তাদের যুদ্ধের ফলস্বরূপ, ফ্রান্স ১৭৬৩ সালে উত্তর আমেরিকায় সমস্ত উপনিবেশের অধিপত্য ছেড়ে দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে পহেলা জুলাই ১৮৬৭ ক্যানাডা দেশটি জন্মগ্রহণ করে। কনফেডারেশনের মাধ্যমে তিনটি ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকার উপনিবেশের মিলনের সাথে, কানাডা চারটি প্রদেশের একটি ফেডারেল আধিপত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাজ্যের সাম্রাজ্য বিস্তার এবং স্বায়ত্তশাসন বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। যা ১৯৩১ সালের ওয়েস্টমিনস্টারের সংবিধানে নিয়ন্ত্রতি হয়।
১৯৮২তে কানাডা যুক্তরাজ্যের সংসদের আইনি নির্ভরতা ছিন্ন করে। যুক্তরাজ্যের রানী, রাজাকে সম্মান করা ছাড়া বাকি সব নিয়ম, সিদ্ধান্ত কানাডা স্বাধীনভাবে নিজে নেয়।
সরকারের স্বচ্ছতা, জীবনযাত্রার মান, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, উদ্ভাবন, শিক্ষা এবং লিঙ্গ সমতার আন্তর্জাতিক পরিমাপে অত্যন্ত উচ্চে রয়েছে কানাডার অবস্থান।
বিশ্বের দীর্ঘতম উপকূলরেখা সহ মোট আয়তনের ভিত্তিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সীমানা বিশ্বের দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক স্থল সীমান্ত। সময়ের হিসাবে এই বিশাল দেশ ছয়টি সময়ে বিভক্ত।
অত্যন্ত সুন্দর উত্তর আমেরিকার একটি দেশ কানাডা। দশটি প্রদেশ এবং তিনটি অঞ্চলে বিভিক্ত।
আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর এবং উত্তর দিকে আর্কটিক মহাসাগর এই তিন সাগরের মাঝে,বৈচিত্রে ভরপুর এই দেশটির নাগরিক হিসাবে নিজেকে গর্বিত ভাবি। অত্যন্ত সুন্দর মনোরম পরিবেশের সাথে স্বচ্ছ নিয়মের সহজ জীবনে, বেঁচে থাকার আনন্দ দিয়েছে এই দেশটি।