কানাডার প্রকৌশল, কারিগরী ও প্রযুক্তি উন্নয়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

রতন সাহা

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই প্রকৌশল বা কারিগরী বিষয়ে জ্ঞান অর্জন কিংবা এর প্রয়োজনীয়তা জনমানসে অনুভূত হয়েছে। কিন্তু এর স্বরূপটা কেমন হবে তার কোন প্রকৃতরূপ উদঘাটিত হবার প্রয়োজনীয় অনুঘটক হিসেবে কোন বিষয়ের এককরূপ মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের পরিধিতে অনুধাবন করার সম্যক ধারণা তৈরি হবার কোন পন্থা তখনও তৈরি ছিল না। তবে সময়ের সাথে সাথে মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজনীয়তাগুলি দীর্ঘভাবে অনুভূত হয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে স্বল্প পরিসরে হলেও মানুষ তার চিন্তা, মননে ও কারিগরী ভাবধারায় তা বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা নিরন্তর অব্যাহত রেখেছে। একই সূত্রের হাত ধরে সহস্র সহস্র বছর ধরে মানুষ ক্রমশঃ তাদের মৌলিক এবং প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলি চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়েছে। সেই নিরিখে এবং সার্বিক প্রয়োজনে মানুষ তাদের জীবন উন্নয়নের মানসে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রকৌশল ও কারিগরী বিদ্যাকে সম্পৃক্ত করার ধারা অব্যাহত রেখেছে এবং সেই সাথে এর উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছে। অতি প্রাচীনকাল থেকে শুরু হওয়া এসকল কর্মযজ্ঞে পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতা তাদের নিজ নিজ সময়ে বৃহত্তর পর্যায়ে প্রকৌশলগত উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে এবং তারই হাত ধরে প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ নিয়ে আমাদের আজকের এই চলমান পৃথিবী। যুগ যুগ ধরে চলমান সকল শ্রেণির প্রকৌশল ও কারিগরী শিক্ষার উন্মেষ, উন্নয়ন এবং ব্যবহার একবিংশ শতাব্দীর এই লগ্নে প্রযুক্তি প্রক্রিয়াটি একটি বৈশ্বিক শিল্পবিপ্লবের ধারক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

প্রযুক্তির আদি ইতিহাস এবং ইহার উৎকর্ষ সাধন শতাব্দী বা বলা যেতে পারে সহস্রাব্দ প্রাচীন একটি ব্যবহারিক সংস্কৃতির ধারক। মানুষ প্রয়োজনীয়তার নিরিখে দৈনন্দিন জীবনের চাহিদাগুলি মিটানোর লক্ষ্যে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে থাকে। কানাডিয়ান প্রকৌশল বা কারিগরী বিষয়গুলিকে তার উৎকর্ষতার ভিত্তিতে মূলত দুটি বৃহৎভাবে ভাগ করা করা যেতে পারে। প্রথমটা হলো কানাডায় ইউরোপীয়ান সেটেলমেন্টের পূর্বেকার অবস্থা এবং এর পরবর্তী অবস্থা। আমরা প্রযুক্তি এবং কানাডিয়ান শিল্প বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই যে.যোগাযোগ ব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তি, তাপ ও শক্তি, পাবলিক ওয়ার্কস ও পাবলিক সার্ভিসেস, খাদ্য সামগ্রী ও তার উৎপাদন ব্যবস্থা বিষয়ক ব্যবস্থগুলিকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে প্রকৌশল ও প্রযুক্তির ধারাবাহিক উন্নয়ন। সময়ের হিসেবে কানাডায় যে সকল প্রযুক্তির পরিব্যাপ্তি ঘটেছে তাহা মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উৎসকৃত এবং বিশেষ করে ইউরোপ থেকে ঐ সকল প্রযুক্তি এসেছে এবং শুধুমাত্র স্বল্প সংখ্যক প্রযুক্তির উৎস স্থল হল কানাডা। বর্তমান সময়ে ব্যবহৃত প্রযুক্তির মধ্যে তারা হলো ‘দ্য কানাডা আর্ম’, ‘কর্ডিয়াক পেসমেকার’, ‘আইম্যাক্স’, ‘ওয়াকি-টকিস’, ‘এ্যালকালাইন ব্যাটারী’, ‘ইনসুলিন’, ‘গ্লোবাল টাইম জোনস’ নামক যুগান্তকারী আবিষ্কারসমূহ। এছাড়া ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর দুটি উল্লখযোগ্য ব্যবহারিক মাইলস্টোন টেলিফোন ও লাইটবাল্ব কানাডাতেই আবিষ্কার হয়।

পৃথিবীর বয়স এবং উন্নয়নের নিরীখে সময়ের স্তরগুলিকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন যুগ হিসাবে কিছুটা আক্ষরিক অর্থে এবং কিছুটা রূপক অর্থে ব্যবহার বা আখ্যায়িত করেছেন। ঐ সকল যুগের নামগুলি সময়ভিত্তিক আবিষ্কারের সাথে সম্পৃক্ততা রেখে করার চেষ্টা করেছে বলে অনুমিত হয়। এটা এমনভাবে বলা যেতে পারে যে, কোন আবিষ্কারের সাথে যোগসূত্র রেখে কোন বিশেষ সময়ের নামকরণ করা হলেও পরবর্তী কোন যুগান্তকারী আবিষ্কারের সময়টাকে নতুন কোন সময়ের অন্তর্ভুক্ত না করে পূর্ববর্তী সময়ের নামটাকেই গ্রহণ করা হয়েছে। আমেরিকা কিংবা কানাডায় ইউরোপীয়ানদের আগমন পূর্বরর্তী সময়ে যে সকল সময়ের স্তর কিংবা যুগ হিসাবে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে স্টোন এজ: ফায়ার – খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০০ সন থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ; এজ অব সয়েল: ১৬০০ – ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ; স্টীম এজ: ১৬৩০ – ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ; আরলি ইলেকট্রিক এজ: ১৮০০ – ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ; বিংশ শতাব্দী: ১৯০০ – ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ এবং একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময় পর্যন্ত : ২০০০ – ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ। যুগে যুগে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রধান উন্নতির নির্ণায়ক এবং নিয়ন্ত্রক হিসাবে নির্ধারিত হয়ে আছে যা মানব উন্নয়নের সূচক হিসেবে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত।

বিভিন্ন সূত্র মোতাবেক জানা যায় উত্তর গোলার্ধের এই প্রান্তিক এলাকায় মানুষ আনুমানিক ১২০০০ বছর পূর্বে মানুষ বর্তমান সাইবেরিয়া এলাকা থেকে একটি প্রাচীন ল্যান্ড ব্রীজের মাধ্যমে আলাস্কায় আগমন করে বর্তমানে যার নাম বেরিং সাগর এবং তারা ক্রমান্বয়ে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমশ সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে (দ্রষ্টব্য: নীচের ছবি)। এই এলাকায় যাহাদের আমরা ফার্স্ট নেশান বা ইন্ডিয়ান হিসাবে অভিহিত করি তারাসহ মেটিস এবং ইনউইট জাতিগোষ্ঠী এই প্রচন্ড শীত এলাকায় নিজেদের জীবন রক্ষা, খাদ্য সংগ্রহ , যাতায়াত সুবিধা এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে শুরু করে এবং নানান কৌশল আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়ে উঠে।

ছবি নং-১: সাইবেরিয়া-আলাস্কা প্রাকৃতিক ল্যান্ড ব্রিজ

এরই ফলস্বরূপ ক্রমান্বয়ে তারা কায়াক ও ক্যানো, ইগলু, টিপি বা কোনিকাল টেন্ট, স্নো সুজ, মোকাসিনস বা চামড়ার সাহায্যে তৈরি হিলছাড়া স্লিপার, লংহাউজ, পালিশেডস, ডগশ্লেডস, টোবগানস, রেড রিভার কার্টস, জন্তুর হাড় কিংবা ধাতু নির্মিত বিভিন্ন টুলস ও শিকারের যন্ত্রপাতি যাহা এখানকার অধিবাসীদের মাছ ধরা এবং পশু শিকার কাজে প্রভূত সাহায্য করে।

অন্যদিকে প্রাথমিকভাবে ফ্রান্স থেকে এবং পরবর্তীকালে ব্রিটেন থেকে ইস্টার্ন কানাডায় আগত অভিযানকারী ও অভিবাসীরা ক্রমান্বয়ে এই এলাকার আদিবাসীদের নিকট থেকে এ সকল টুলস, যন্ত্রপাতি, দেশীয় নৌকা ও বরফ উপযোগী স্থলবাহন, শীত উপযোগী বিশেষ ধরনের ঘরবাড়ি নির্মাণের কৌশল সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে। এর উল্টোপিঠে কানাডার আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিও ইউরোপীয় ভাবধারার প্রযুক্তি ও কারিগরী বিষয়গুলি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করে এবং কানাডার বাস্তবতায় ওই সকল প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেষ্ট হয়ে উঠে। আদিবাসীদের নিজস্ব প্রযুক্তি ও অধিকতর উন্নত ইউরোপীয়ান প্রযুক্তির মিশেলে কানাডার পরিপ্রেক্ষিত ও চাহিদার বিবেচনায় এটি একটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হয়। এই সমস্ত পদক্ষেপগুলি সময়োপযোগী হওয়ায় নিত্যনতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় যাহা ক্রমান্বয়ে আদিবাসী ও অভিবাসীদের জীবনচর্চা অধিকতর সহজ হয়ে উঠে। এই সকল প্রকার প্রযুক্তির উন্নতি ও ব্যবহারের ফলে পাথরের দূর্গ , সমুদ্র বা নদী বন্দর নির্মাণ, গভীর নৌপথ আবিষ্কার ও উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। নৌ পরিবহন ক্ষেত্রে এইসকল প্রযুক্তি গ্রহণ, সংস্কার ও আবিষ্কার বড় জাহাজ কিংবা অন্যান্য নৌযান চলাচল ও মালালমাল পরিবহনে ব্যাপক সুবিধা তৈরি করে। এছাড়াও জলাভূমি অপসারণ বা নিষ্কাশনেও প্রযুক্তির ব্যবহার নৌপরিবহনে যথেষ্ট সফলতার ভূমিকা রাখে। প্রধান পরিবহন মাধ্যম হিসাবে নৌপথ ব্যাপক উৎসাহ তৈরি করে এবং স্থানীয়ভাবে নির্মিত প্রিন্স উইলিয়াম নামের একটি বৃহদাকার স্টিম বোট ততদিনে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইউরোপীয়ান ধাঁচের শিল্প নির্মাণে কানাডা ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করে এবং এর অংশ হিসাবে উড পাল্প থেকে কাগজ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাগজকল প্রতিষ্ঠা হয়। সে সময় পরিবহন ক্ষেত্রে গতি আনতে আটলান্টিক কোষ্টের বিভিন্ন স্থানে সেলবোট নির্মাণের জন্য শিল্প কারখানা গড়ে উঠে। স্টিম বোট নির্মাণের ফলে ওই এলাকার প্রধান নদী এবং হ্রদগুলিতে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়। এ ছাড়া পরিবহন ও যাতায়াতের সুবিধার্থে সেখানে বিভিন্ন খাল খনন করা হয় এবং ওই খনন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় টুলস ও যন্ত্রপাতি স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা শুরু হয়। স্টিমবোটের জন্য স্থানীয়ভাবে কিছু ইঞ্জিনও তৈরি করা হয়। সেখানে রেল লাইন এবং টেলিগ্রাফ লাইনও নির্মাণ করা হয় যা সার্বিকভাবে ওই সকল এলাকায় বসতি স্থাপনের অনুকূল অবস্থা তৈরি করে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সাবমেরিন টেলিগ্রাফ ক্যাবলের এর মাধ্যমে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড ও ব্রিটিশ আইল্যান্ডের মাঝে সংযোগ স্থাপিত হয়।
ক্রম পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর সাফল্য এবং উন্নয়নে দেশটিতে ব্যাপক উন্নয়ণ ঘটায় এবং শিল্প ক্ষেত্রে প্রবল উৎসাহ পরিলক্ষিত হয় যা প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও তার বাস্তব ব্যবহারের দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি গভীর দিক নির্দেশনা প্রদান করে। সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ইউনিভার্সিটি অব নিউ বার্নসউইকে কানাডার প্রথম ইঞ্জিনিয়ারং ফ্যাকাল্টি খোলা হয়।

ছবি নং-: ২ ফ্যাকল্টি অব ইঞ্জিনিয়ারিং -দ্য ইউনিভার্সিটি অব নিউ বার্ণসউইক

ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বেসিক শাখা অর্থাৎ সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রক্যাল, কেমিক্যাল ইঞ্ছিনিয়ারিং এর পাশাপাশি সায়েন্স ফ্যাকাল্টির সাথে যৌথভাবে জিওলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়রিং ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়। এই বিভাগটি প্রকৌশল শিক্ষায় সংযুক্ত হবার কারণে ভূমি, ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং অন্যান্য রিসোর্স সম্পর্কে জানার এবং গবেষণা করার ক্ষেত্রটি বহুলভাবে প্রসারিত হয়। কানাডার ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, পানি ও খনিজ সম্পদ সম্পর্কিত বিবিধ বিষয়ে জ্ঞানার্জন এবং এর প্রয়োগ দেশটির আর্থ সামাজিক উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখে। একই সাথে বিবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রনের জন্য সরকারি রেগুলেটরি সংস্থা এবং কমিশন গঠন করা হয়। ইউনিভার্সিটি অব নিউ বার্নসউইকে ইঞ্জিনিয়ারং ফ্যাকাল্টি চালু করার পর হতে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত কানাডার টেকনোলজিক্যাল উন্নতির ক্ষেত্র ও প্রাতষ্ঠানিক কাঠামো দ্রুত প্রসারিত হয় যার কিছু সময়ভিত্তিক উদাহরণ নিচে উল্লিখিত হল:

খ্রিস্টাব্দ – ১৮৭৯ : স্ট্যন্ডার্ড টাইম

খ্রিস্টাব্দ – ১৮৮০: বেল টেলিফোন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা

খ্রিস্টাব্দ – ১৮৮০: ইলেকট্রিক পাওয়ার

খ্রিস্টাব্দ – ১৮৮০: কোল কোম্পানি

খ্রিস্টাব্দ – ১৯০১-০২: নিকেল ও আ্যলুমিনিয়াম কোম্পানি

খ্রিস্টাব্দ – ১৯০৩: মাইনিং ইন্ডাস্ট্রি
খ্রিস্টাব্দ – ১৯০৪: দ্য রেজিমেন্ট অব রয়্যাল হঞ্জিনিয়ার্স প্রতিষ্ঠা

খ্রিস্টাব্দ – ১৯০৬: হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার কমিশন গঠন

খ্রিস্টাব্দ – ১৯০৯: কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাউন্ডারি ওয়াটার ট্রিটি সম্পাদন
খ্রিস্টাব্দ – ১৯১০: দ্য স্টিল কোম্পানি অব কানাডা প্রতিষ্ঠা
খ্রিস্টাব্দ – ১৯১১: দ্য রয়্যাল কানাডিয়ান নেভির প্রতিষ্ঠা
খ্রিস্টাব্দ – ১৯১৪: দ্য ডোমিনিয়ন কোল কোম্পানির প্রতিষ্ঠা
খ্রিস্টাব্দ – ১৯১৪: ডিপার্টমেন্ট অব হাইওয়েস প্রতিষ্ঠা

বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে বা বলা যেতে পারে প্রথম বিশ্বযু্দ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে যে সকল প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটেছে তা মূলত যুদ্ধে ব্যবহারের অস্ত্রশস্ত্র ট্যাংক, বিমান ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার ব্যবহারকে ঘিরে একটা সীমাবব্ধতর মধ্যে আটকে ছিল। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষে পরাশক্তি দুটির অন্যতম মার্কিন যক্তরাষ্ট্র যুদ্ধাস্ত্র ছাড়াও অন্যন্য প্রকৌশল বিষয়ে অনেক গবেষণায় নিয়োজিত হয় এবং অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের তারা জনক হয়ে উঠে। প্রতিবেশী দেশ হিসাবে কানাডা আয়তনে বড় হওয়া সত্বেও অপেক্ষাকৃত কম জনসংখ্যা ও ছোট অর্থনীতির কারণে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কানাডিয় প্রকোশলী ও প্রযুক্তবিদগন উদ্ভাবন করেছেন এবং ঐ সকল প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়নে সফলতা লাভ করেছেন। ওই সকল গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কয়েকটি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।

কানাডার্ম: স্পেস শাটলে ব্যবহৃত এটি একটি ম্যানুপুলেটর সিস্টেম যা কতগুলি রোবোটিক মেকানিক্যাল আর্ম সমন্বয়ে নির্মিত জিরো গ্র্যাভিটিতে স্পেস শাটলের পে লোড বিষয়ক যাবতীয় কর্মকান্ড সম্পন্ন করে। কানাডার্ম নামক এই রোবোটিক আর্ম কানাডার একটি আধুনিক আবিষ্কার এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সীর প্রকৌশলীরা ১৯৮১ সালে এর ডিজাইন এবং নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে। এটা রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে পরিচালনা করা হয় এবং স্পেস মিশন শেষে শাটলের সাথে পৃথিবীতে ফিরে আসে। ইউএস নির্মিত স্পেস শাটলগুলিতে কানাডা আবিষ্কৃত এই রোবোটিক আর্ম ব্যবহার করা হয়।

কর্ডিয়াক পেসমেকার: হৃদযন্ত্রের অনিয়মিত হার্টবিট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি ছোট সার্জারীর মাধ্যমে বুকে পেস মেকার সংস্থাপন করা হয়। পেসমেকার হল একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা হৃৎপিণ্ডকে দ্রুত বীট করার জন্য অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক আবেগ সরবরাহ করে। একট ছোট ধাতব বাক্সে একটি পালস জেনারেটর এবং একটি ব্যাটারি সহযোগে তাহা মানব শরীরে সংস্থাপন কর হয়। ইলেকট্রনিক চিপ হার্টের স্পন্দন অনুধাবন করে এবং তারপর স্বাভাবিক হার বজায় রাখার জন্য সেই অনুযায়ী বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়। জন হপস নামের একজন কানাডিয়ান বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী, কানাডার ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলে কর্মরত অবস্থায় ১৯৫০ সালে কার্ডিয়াক পেসমেকার আবিষ্কার করেছিলেন।

আইম্যাক্স: বিশেষায়িত ক্যামেরা, ফিল্ম রোল, থিয়েটার আর প্রজেক্টরের সমন্বয়ে তৈরি এক বিশেষ ধরনের সিনেমা নির্মাণ প্রযুক্তির নাম আইম্যাক্স – যা কিনা ‘ম্যাক্সিমাম ইমেজ’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। বিভিন্ন থিয়েটারে প্রচলিত ফিল্ম স্ক্রিনের তুলনায় আইম্যাক্স স্ক্রিনে ২৬ শতাংশ বেশি ‘ভিউয়িং স্পেস’ বা দৃশ্যমান পর্দা থাকে, যার ফলে সিনেমা উপভোগের মাত্রা বেড়ে যায়। এছাড়াও আইম্যাক্স থিয়েটারগুলো ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করতে ডুয়াল প্রজেক্টর কাজে লাগায়। পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের ভাষায় যা কিনা পর্দা ‘অদৃশ্য হয়ে যাওয়া’। কানাডিয়ান গ্রা ফারগুসন, রোমান ক্রয়টর, রবার্ট কের, এবং উইলয়াম সি শ’১৯৬৭ সালে আইম্যাক্স কযপোরশনের পক্ষে এই টেকনোলজি আবিষ্কার করেন।

ওয়াকি টকিস: তারবিহীন ভাবে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের সাথে যোগাযোগ করার একটি যন্ত্র বা মাধ্যমকেই ওয়াকিটকি বলে। যেটি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদানে সাহায্য করে। ওয়াকিটকির মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যাক্তিদের সাথে একই সময়ে যে কোন ধরনের বার্তা আদান প্রাদান করা যায় ও যে কোন ধরনের যোগাযোগ করা যায়। ওয়াকি-টকি ১৯৩৭ সলে কানাডিয়ান ডন হিংস উদ্ভাবন করেছিলেন। একই সময়ে অন্যান্য উদ্ভাবকদের দ্বারা অনেক অনুরূপ ডিভাইস তৈরি করা হয়েছিল। সিএমএন্ডএস-এর জন্য কাজ করার সময় হিংস তার পোর্টেবল রেডিও সিগন্যালিং সিস্টেম তৈরি করেছিলেন।

এ্যলকালাইন ব্যাটারী: ১৯৪০ সালে কানাডিয়ান উদ্ভাবক লু উরি রুবন সেলে মারকারী অক্সাইড এর পরিবর্তে ম্যাঙ্গানিজ ডাই অক্সাইড ব্যবহার করে এলকালাইন ব্যাটারী তৈরী করেন।

গ্লোবাল টাইম জোনস: স্যার স্যানফোর্ড ফ্লমিং ১৮৭৬ সালে কানাডিয়ান রেলওয়েতে একজন ইঞ্জিনীয়ার হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন অবস্থায় স্ট্যান্ডার্ড টাইমের কনসেপ্ট উদ্ভাবন করেন। কথিত আছে সময়ের হেরফের বুঝতে না পেরে তিনি ট্রেন ফেল করেছিলেন।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে যখন কানাডায় প্রথাগত শিক্ষা চালু হয় তার প্রেক্ষাপটে দেশটিতে ও ইউরোপে ক্রমশ প্রযুক্তি ও প্রকৌশল ক্ষেত্রে উন্নততর গবেষণার একটি আধুনিক রূপরেখা তৈরি হয়ে যায়। এই সময়টিতে স্ব স্ব ক্ষেত্রে শিক্ষিত গবেষক, প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদগণ নতুন নতুন কারিগরী উদ্ভাবন এবং ব্যবহৃত প্রযুক্তির উন্নয়নে উল্লখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যার ফলে মানুষের দৈনন্দিন আর্থ-সামাজিক জীবন ব্যবস্থা আধুনিকতার ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। এই সকল উন্নতির কিংবা উন্নত প্রযুক্তির ভালো-খারাপ দুটো দিকই রয়েছে বিশেষ করে সামরিক ক্ষেত্রে এর নির্বিচার ব্যবহার মানবতার একটি দুঃসহ অভিজ্ঞতার ধারক বাহক হিসেবে পরিগণিত হতে পারে কিন্তু এ সকল আবিষ্কার নির্দ্বিধায় মানুষের কল্যাণেই সর্বাত্মক অবদান রেখে যাচ্ছে।

রেফারেন্স:

১। কানাডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং -এর ইতিহাস, এ থাম্বনেল স্কেচ। এন্ড্রু এইচ উইলসন, এফসিএই।
২। হিস্টোরী অব ই ইঞ্জিনিয়ারিং । নরম্যান আর.বল