কানাডার জীবন নিয়ে এক বাঙালি মেয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা

 ড. দিলীপ চক্রবর্তী

ইংরেজি প্রবন্ধকার ফ্রান্সিস বেকন  তাঁর  ‘অব স্ট্যাডিজ’ প্রবন্ধে বলেছেন যে, একটা ভালো বই পাঠককে আনন্দ দেয়, তার মানসিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে এবং যোগ্যতা বাড়ায়। ড. ঝর্ণা চ্যাটার্জীর ‘একটি বাঙালি মেয়ের কানাডার জীবন কাহিনী’ পড়তে গিয়ে আমার উপরের কথাগুলো মনে পড়ছিল। বইটি আমার এত ভালো লেগেছে যে বলতে গেলে একদম না থেমে বইটি প্রথমবার আমি শেষ করেছি এবং কয়েকবার থেমে দ্বিতীয়বার শেষ করেছি।

বইটা খুবই সরল ভাষায় একজন মননশীল লেখিকার জীবন যাপনের অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার সহজ বর্ণনা, যার মধ্যে অর্ধ শতাব্দীর বেশি বিদেশে – কানাডায়। অবশ্য সহজ হওয়া কিন্তু খুব সহজ না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, “সহজ হতে নিতি নিতি কহ যে, সহজ হওয়া যায় না তো সহজে।”

একটা প্রাকৃতিক ঝর্ণা যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড় পর্বতের বাধা ডিঙিয়ে চারিদিককে জলস্নাত করে উৎস থেকে মোহানার দিকে ছুটে যায়, ‘ঝর্ণা’ নামধারী এই লেখিকাও নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আনন্দঘন মুহূর্তগুলো আমাদের সাথে ভাগ করে নিতে নিতে জীবন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন। ঝর্ণা দেবী ভাগ্যবতী। জ্ঞানতাপস বাবা পেয়েছেন, প্রাণপ্রতিম ভাইবোনদের পেয়েছেন, নানা দেশের, নানা ভাষার, নানা ধর্মের এবং নানা বয়সের বিভিন্ন মরমীয়া মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন, এবং সর্বোপরি, ওর ‘চিরসখার’ মতন স্বামী পেয়েছেন। এই প্রসঙ্গে আমি অন্য উপলক্ষ্যে লেখা আমার দুটো লাইন একটু পালটে উল্লেখ করছি “সফল নারীর জীবনে পুরুষের নীরব অবদান, ঝর্ণাদেবীর চিরসখা এই কথার জীবন্ত প্রমাণ।” প্রণাম জানাই সেই দেহাতীত আত্মাকে।

বইটি পড়তে পড়তে লেখিকার সংগে আমি এক মার্মিক আত্মীয়তা অনুভব করেছি। আমরা প্রায় সমবয়সী। আমারও আদি নিবাস পূর্ব বাংলা, এবং পরে পশ্চিম বাংলা। আমারও বাল্য এবং কৈশোর কেটেছে রংপুর জেলার মহকুমা শহর গাইবান্ধায়, আমি আজ অর্ধশতাব্দীর বেশী সময় বাংলার বাইরে এবং তার মধ্যে প্রায় দুই দশক কানাডার অন্টারিও প্রদেশের ব্রাম্পটন শহরে। আমিও স্নাতকোত্তর অন্তিম বর্ষে পিতৃহারা, এবং ঝর্ণাদেবীর দাদার মতন আমার ওপরেও অল্পবয়সে ছোট ছোট ভাইবোনেদের দায়িত্ব পড়ে ।

বাংলায় একটা কথা আছে ‘বিন্দুতে সিন্ধু’। আর ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেক বলেছেন,

“To see the world in a grain of sand

And heaven in a wild flower,

To hold infinity in the palm of your hand

And eternity in an hour.”  

এই কথাগুলো মনে পড়ে এই বইটা পড়ার সময়। একটা ছোট বইয়ে,যার পৃষ্ঠা সংখ্যা মাত্র পঁচানব্বই, কত বড় বিশাল জগতের চালচিত্র – কত বিরাট সংখ্যক মানুষের যাপিত জীবনের আলোচনা। বলা যায় বইটি একটি জানালা – যা দিয়ে আমরা বহু মানুষের বহুবিধ কর্মকাণ্ডের ঝলক দেখতে পাই। আরো হালভাবে বলতে গেলে এই বই আয়না, শুধু আয়না বললে ভুল হবে – একটি উত্তল আয়না (convex lens) – নিজের ছোট অবয়বে অনেক বড় দৃশ্য ধারণ করে রাখে।

বইটার আর একটা বড় গুণ হচ্ছে যে এটা পড়ার সময় মনে হয় না কোনো বই পড়ছি – মনে হয় যেন আমি নিজে এই কর্মকাণ্ডের মধ্যমণি। সব কিছুর সংগেই যেন নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারি। এটাই এই বইয়ের অন্যতম সার্থকতা। মানুষ ঝর্ণা চ্যাটার্জীর যে গুণগুলো আমাকে আকৃষ্ট করেছে তা হলো ওর জীবন সম্বন্ধে ইতিবাচক মনোভাব এবং কখনও হার-না-মানার দৃঢ় সংকল্প। উইনিপেগ শহরে কনকনে শীতের সকালে শাড়ি পরে চলার সাথে যার শুরু এবং সারা জীবন ধরে যা ব্যপ্ত। ডিম ছাড়া যেমন ‘অমলেট’ হয় না, তেমনি মানবিক গুণ ছাড়া সাহিত্য হয় না। ঝর্ণা চ্যাটার্জী এই মানবিক গুণের অধিকারী বলেই তিনি ভালবাসেন জীবনকে, জীবিকাকে, ভুবনকে এবং ভুবনবাসীকে – আত্মীয়, অনাত্মীয় নির্বিশেষে, ধর্ম, বর্ণ, জাতি বিচার না করে।

আমার লেখা আমি শেষ করব একটু অভিমান দিয়ে। বইটা পড়ে এর সম্বন্ধে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলব ভেবেছিলাম – এখন দেখি তার অধিকাংশই দুজন আমার আগেই লিখে গেছেন এই বই সম্বন্ধে তাঁদের মূল্যায়নে। এদের ওপরে আমি শুধু অভিমান করতে পারি, রাগ করতে পারি না। কারণ এরা দুজনেই আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো এবং দুজনেই আমার খুব স্নেহের জন – বিদগ্ধ লেখক এবং মননশীল টরন্টোনিবাসী গবেষক সুব্রত কুমার দাস এবং অটোয়ানিবাসী সমাজসেবী ও অনুবাদক সুপর্ণা মজুমদার। সুব্রত লিখেছেন বইয়ের ভূমিকা, আর সুপর্ণা দিয়েছেন ফ্লাপের ভাষা। এটাও কাকতালীয় যে এঁদের দুজনের নামই ‘সু’ দিয়ে শুরু। ‘সু’ মানে ভাল, কিন্তু এই বই সম্বন্ধে আমার মূল্যায়নের স্রোতকে বন্ধ করে দিয়ে এরা কি আমার প্রতি ‘সু’বিচার করেছেন?

শেষে উল্লেখ করে রাখতে চাই, এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতেই – ঢাকার মূর্ধন্য থেকে। নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন তরুণ শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর।

(বইটির মূল্য ১০ ডলার। কানাডায় বইটি পেতে যোগাযোগ করুন সুব্রত কুমার দাসের সাথে। ফোন ৬৪৭-৯০৭-১৪৬৬)