কানাডার গণমাধ্যম

মাহবুব ওসমানী

কানাডার গণমাধ্যম অত্যন্ত স্বায়ত্তশাসিত, সেন্সরবিহীন, বৈচিত্র্যময় এবং বেশ আঞ্চলিক। কানাডার মিডিয়া সেক্টরটি খুবই উন্নত তবে এর সাংস্কৃতিক ভাবধারা বিশেষ করে ইংরেজি চলচ্চিত্র, টেলিভিশন শো এবং ম্যাগাজিনে প্রায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছাপ পাওয়া যায়। ফলে কানাডার বহুল সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের দায়িত্ব ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন প্রোগ্রাম, আইন এবং প্রতিষ্ঠান যেমন কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (CBC), কানাডার ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড (NFB), এবং কানাডিয়ান রেডিও-টেলিভিশন এবং টেলিকমিউনিকেশনস কমিশন (CRTC) এর ওপর বর্তায়।

কানাডার সরকারি ভাষা দুটি – ইংরেজি ও ফরাসি। এই উভয় ভাষায় প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রিন্ট এবং ডিজিটাল গণমাধ্যম মূলত ‘মুষ্টিমেয় কর্পোরেশন’ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই কর্পোরেশনগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ হল দেশের জাতীয় সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান, কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (সিবিসি), যেটি দেশীয় সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তু তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, ইংরেজি এবং ফরাসি উভয় ভাষায় নিজস্ব রেডিও এবং টিভি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। সিবিসি ছাড়াও কিছু প্রাদেশিক সরকার তাদের নিজস্ব গণশিক্ষামূলক টিভি সম্প্রচার পরিষেবাও দিয়ে থাকে, যেমন TVOntario এবং Télé-Québec। কানাডার গণমাধ্যম নিয়ে লিখতে গেলে ঢাউস সাইজের একটা বই হয়ে যাবে। তাই আমার এই লেখায় খুব স্বল্প পরিসরে কানাডার গণমাধ্যম নিয়ে আলোচনা করবো।

আপনারা অনেকেই জানেন উত্তর আমেরিকার উত্তরাংশে অবস্থিত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রা­ষ্ট্র কানাডা। ১৯৮২ সালে জারীকৃত কানাডা অ্যাক্ট অনুসারে, দশটি প্রদেশ ও তিনটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত কানাডা সংসদীয় গণতন্ত্র এবং আইনগত রাজ্যতন্ত্র উভয়ই মেনে চলে। পঞ্চদশ শতকের শুরুতে ইংরেজ এবং ফরাসি অভিযাত্রীরা আটলান্টিক উপকূল আবিষ্কার করে এবং পরে এ অঞ্চলে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ফ্রান্স দীর্ঘ সাত বছরের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলস্বরূপ ১৭৬৩ সালে উত্তর আমেরিকায় তাদের সব উপনিবেশ ব্রিটিশদের কাছে ছেড়ে দেয়। ১৮৬৭ সালে মিত্রতার মধ্য দিয়ে চারটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ নিয়ে দেশ হিসেবে কানাডা গঠন করা হয়। কানাডার গণমাধ্যমে মূলত ইংরেজি ও ফরাসি এই দুই ভাষার প্রাধান্য রয়েছে। তবে বহুসংস্কৃতির এই দেশে অন্যান্য ভাষার মানুষও তাদের নিজস্ব সংবাদমাধ্যম চালু করেছে। কানাডায় আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও রয়েছে এমন অনেক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল। ইতোমধ্যে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে সাপ্তাহিক বাংলামেইল। তাদের একটি টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে, নাম এনআরবি টিভি। বাংলা কাগজ, ভোরের আলোসহ আরও বেশ কিছু পত্রিকা টরন্টো থেকে প্রকাশিত হয়। টেলিভিশনের মধ্যে আরও আছে নন্দন টিভি, দেশে বিদেশে, প্রবাসী টিভি, ক্লাইমেট চ্যানেল ইত্যাদি।  

কানাডার সংবাদপত্রের ইতিহাস:

দেশটির আধুনিক সংবাদপত্রের চূড়ান্ত বিকাশে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল ছিল।

১। ‘ট্রান্সপ্লান্ট পিরিয়ড’ বা প্রতিস্থাপন সময়কাল –  

১৭৫০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত ছিল ‘ট্রান্সপ্লান্ট পিরিয়ড’ বা প্রতিস্থাপন সময়কাল। এ সময়টায় সরকারি সংবাদ ও ঘোষণা প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রাথমিকভাবে কানাডায় প্রিন্টিং এবং সংবাদপত্র আসে।

ফরাসি শাসনামলে এই সময়ে কোনো ছাপাখানা ছিল না এবং কোনো ধরনের সংবাদপত্রও ছিল না। তাই মূলত ১৩টি আমেরিকান কলোনি বা উপনিবেশ থেকে সমস্ত সংবাদপত্র ব্রিটিশ উপনিবেশের কাছে এ সময় স্থানান্তরিত হয়েছিল।

যেটি বলছিলাম যে কানাডায় প্রেসের জন্ম হয়েছিল সরকারি নথি মুদ্রণের জন্য যা আসলে সরকারের জন্য এক ধরনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হত। গণমাধ্যমের শক্তি বলতে যা আজ আমরা বুঝি, সে সময় তা ছিল হয়রানি আর ভয় দেখানোর মাধ্যম। ১৭৮৩ সালে আমেরিকান বিপ্লবের পর সরকার বিরোধী মতকে আর স্বাগত জানানো হয়নি। বরং তখন সংবাদপত্র হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদের অনুগত একটি মাধ্যম।

কানাডিয়ান সংবাদপত্রগুলো কেবলমাত্র সরকারি খবর এবং ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রথমদিকের অনেক সম্পাদক ও মুদ্রণকারীদের অনেকেই ছিলেন সরকারি বা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তারা তাদের সংবাদপত্রকে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রচারমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতেন। তারা এ সময় সরকারের নিপীড়নের মুখোমুখিও হয়েছিল। সম্পাদকদের মধ্যে সংবাদপত্রের আদান-প্রদানের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে স্থানীয় সংবাদ এবং কানাডার অন্যান্য স্থান থেকে সামান্য সংবাদই ছাপা হত। ১৭৮০-এর দশকে প্রথম বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হতে শুরু করে। ১৭৮৭ সালের ১২ জুলাই ‘কুইবেক গেজেট’ প্রথম একটি শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপন প্রচার করে। বিজ্ঞাপণটি ছিল এমন –

“For sale, a robust Negress, active and with good hearing, about 18 years old, who has had small-pox, has been accustomed to household duties, understands the kitchen, knows how to wash, iron, sew, and very used to caring for children. She can adapt itself equally to an English, French or German family, she speaks all three languages.”

বাংলা করলে যা দাঁড়ায়-

একজন শক্তসমর্থ নিগ্রো, কর্মঠ এবং ভাল শ্রবণশক্তি সম্পন্ন প্রায় ১৮ বছর বয়সী মেয়ে বিক্রি হবে, যার স্মল পক্স হয়েছিল, যে গৃহস্থালীর দায়িত্ব পালনে অভ্যস্ত, রান্নাঘর বোঝে, কীভাবে ধোয়া, লোহা, সেলাইয়ের করতে হয় তা জানে এবং বাচ্চাদের যত্ন নিতে পারে। সে ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান পরিবারের সাথে সমানভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, কারণ সে এই তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারে।

ঔপনিবেশিক প্রশাসকরা যা প্রচার করতে চেয়েছিল এমন অনেক প্রজ্ঞাপন নিয়ে প্রতিটি প্রদেশে একটি সাপ্তাহিক ‘গেজেট’ প্রকাশিত হত। ১৬৬৫ সাল থেকে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে প্রকাশিত ‘দ্য লন্ডন গেজেট’ এর নামানুসারে ছিল ‘গেজেট’।

এই সময়ে, কোন ‘রাজনৈতিক পরিসর’ ছিল না, কারণ সমস্ত রাজনৈতিক সংবাদ অভিজাতদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকার প্রথম দশকে গণমাধ্যমের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সরকারি বার্তা প্রচার করা – যা আসলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য ছিল এক কল্পনাপ্রসূত ধারণা। ১৮ শতক থেকে ১৯ শতকে প্রবেশের সময়ে, কানাডায় কোন ‘পাবলিক স্ফিয়ার’ বা জন পরিসরের ক্ষেত্র ছিল না। সেজন্য গণমানুষের জন্য কোন পত্রিকাও দেখা যায়নি।

এই শতাব্দীর শুরুতে কাজ করা প্রথম মুদ্রকরা এবং প্রকাশকরা ধীর গতিতে এবং কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে কানাডায় একটি সত্য, স্বাধীন প্রেস তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। এসব ব্যক্তিরা অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে মারধর, জেল, এবং অপরাধী বা রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক মানহানির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার মত অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। যেহেতু প্রথম দিকের ছাপাখানা ঔপনিবেশিক প্রশাসনের একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে প্রকাশিত হত, তাই যে কেউ সরকারি নোটিশ ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশ করার চেষ্টা করলে তাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আদালতের কোন আইন বা বিচার নিয়ে লেখা নিষিদ্ধ ছিল, তাই সেখানে কোন লেখকদের প্রবেশাধিকার ছিল না। এগুলি ছিল ঔপনিবেশিক আইন যা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এরফলে অনেক সাহসী সম্পাদক ও প্রকাশককে ভয়ভীতি নিয়ে জীবনধারণ করতে হয়েছিল। অনেকের বেশ ধার-দেনা হয়েছিল এবং অনেকে হয়েছিল নির্যাতিত।

‘ট্রান্সপ্লান্ট পিরিয়ড’ বা প্রতিস্থাপন সময়কাল – এ সময়টাতে সংবাদপত্রের জন্য উল্লেখযোগ্য যারা ছিলেন তাদের বিষয়ে জানা যাক।  

জন বুশেল (১৭১৫ – ১৭৬১) এবং তার সহযোগী বার্থলোমিউ গ্রিন (১৬৯০ – ১৭৫১) এ দুজন মিলে একটি মুদ্রণ অফিস খোলেন। এখান থেকেই ২৩ মার্চ, ১৭৫২ সালে বুশেল ‘হ্যালিফ্যাক্স গেজেট’ এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন। তিনি একজন স্বাধীন উদ্যোক্তা ছিলেন, সরকারিভাবে তাকে কোন বেতন দেওয়া হয়নি। সরকারি প্রশাসন তাঁকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। সরকার তাই প্রাদেশিক সচিবকে তার পত্রিকার সম্পাদক করে। বুশেল, এমন অনেক বাধার মুখোমুখি হয়ে ঋণগ্রস্থ হয়েছিলেন। এক সময় অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান।

অ্যান্টন হেনরিখ (১৭৩৪ – ১৮০০), জার্মানিতে ব্যবসা শিখে আমেরিকা হয়ে হ্যালিফ্যাক্সে আসেন।  তিনি বুশেলের ‘গেজেট’ এর হাল ধরেন। ১৭৬৫ সালের অক্টোবরে তিনি গেজেটে একটি সম্পাদকীয় ছাপান যাতে পরামর্শ দেওয়া হয় যে নোভা স্কশিয়ানরা যেন স্ট্যাম্প অ্যাক্টের (ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক স্ট্যাম্প কেনা) বিরোধিতা করে। যার ফলে সরকারের প্রতি তার আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় এবং তিনি ম্যাসাচুসেটসে ফিরে যান। এরপর গেজেট বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে তিনি সরকারের ভালো অনুগ্রহে আবার ফিরে আসেন এবং রয়্যাল গেজেট ছাপানোর জন্য পুনরায় দায়িত্ব পান।

উইলিয়াম ব্রাউন (১৭৩৭ – ১৭৮৯) এবং টমাস গিলমোর (১৭৪১ – ১৭৭৩) ফিলাডেলফিয়া থেকে আগত এই দুজন ১৭৬৪ সালে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ‘কুইবেক গেজেট’ চালু করেন। কাগজটি ছিল দ্বিভাষিক এবং সরকার কর্তৃক ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত!

মুদ্রণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অভিপ্রায়ে ফ্রান্স থেকে মন্ট্রিয়লে অভিবাসিত হন ফ্লেরি ম্যাসপ্লেট (১৭৩৪-১৭৯৪)। তবে আমেরিকার প্রতি সহানুভূতিশীল এবং বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের সাথে সম্পর্কের কারণে কিছু ছাপানোর আগেই তাকে সন্দেহের কারণে জেলে পাঠানো হয়েছিল। ১৭৭৮ সালে তিনি কানাডার প্রথম সম্পূর্ণ ফরাসি সংবাদপত্র ‘দ্য গেজেট’ (মন্ট্রিয়ল) ছাপান।

লুই রায় (১৭৭১ – ১৭৯৯) ১৮ এপ্রিল, ১৭৯৩ সালে ‘আপার কানাডা গেজেট’ চালু করেন যা ১৮৪৯ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ১৭৯৭ সালে কিছু উস্কানিমূলক মতামত ছাপানোর পর রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে রায় তার পত্রিকা ছেড়ে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান।

২। ‘পার্টিজান পিরিয়ড’ বা পক্ষপাতমূলক সময়কাল –

১৮০০ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ছিল ‘পার্টিজান পিরিয়ড’ বা পক্ষপাতমূলক সময়কাল। এ সময় প্রকাশক এবং সম্পাদকরা দেশের রাজনীতিতে ক্রমাগত ভূমিকা পালন করেছিলেন। পত্রিকাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেন তারা। কাগজগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ ছিল এবং সম্পাদকরা প্রায়ই স্থানীয় রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করতেন। পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদপত্রগুলো এ সময় জনমতের চাপে ‘শুদ্ধ’ হয়ে ওঠে। প্রেসকে গণতন্ত্রীকরণের জন্য এ সময় বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। মিডিয়াগুলো ১৮৯১ সালে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে রিপোর্ট করার অধিকার লাভ করে।

‘লে কানাডিয়ান’ ছিল একটি ফরাসি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র যা লোয়ার কানাডায় ২২ নভেম্বর, ১৮০৬ থেকে ১৪ মার্চ, ১৮১০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। ‘লোয়ার কানাডা’ বলতে কুইবেক প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং ১৮০৯ সাল পর্যন্ত নিউফাউন্ডল্যান্ড ও ল্যাবরাডর প্রদেশের ল্যাবরাডর অঞ্চলকে বোঝায়। আর ‘আপার কানাডা’ হল অন্টারিও প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং জর্জিয়ান বে ও লেক সুপিরিয়র ঘেঁষা এলাকা। যাইহোক, ‘লে কানাডিয়ান’ এর নীতিবাক্য ছিল: “Nos institutions, notre langue et nos droits”  (আমাদের প্রতিষ্ঠান, আমাদের ভাষা, আমাদের অধিকার)। এটি ছিল ‘পার্টি কানাডিয়ান’ এর রাজনৈতিক মুখপত্র, উদার অভিজাত ও ব্যবসায়ীদের কণ্ঠস্বর। শতাব্দীর শেষের দিকে এটি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পত্রিকাটি ছিল লিবারেলিজমের মূল ভিত্তি।

আপার কানাডার প্রভাবশালী আইনজীবী উইলিয়াম লিয়ন ম্যাকেঞ্জি ১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কলোনিয়াল এডভোকেট’। অন্টারিও প্রদেশের প্রথম স্বাধীন কাগজ হিসেবে এর উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। ম্যাকেঞ্জি হলেন এমন একজন সম্পাদক যিনি তার পত্রিকাকে সেই সময়ের অস্থির রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জন পরিসর তৈরির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

জোসেফ হাউ ১৮২৮ সালে হ্যালিফ্যাক্সের সাপ্তাহিক ক্রনিকলের দায়িত্ব নিয়ে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘অ্যাকাডিয়ান’। এরপর তিনি ‘নোভাস্কোশিয়ান’ও কিনেছিলেন। তার প্রতিবাদী সাংবাদিকতা তাকে নোভা স্কশিয়ার কণ্ঠস্বর করে তোলে। ১৮৩৫ সালে হাউকে তার একটি নিবন্ধের জন্য মানহানির মামলায় জড়াতে হয়। তিনি তার বিচারে একটি মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে যুক্তি দিয়ে কথা বলেছিলেন। যদিও তিনি আইন অনুসারে দোষী ছিলেন, তবে বিচারক তাঁকে বেকসুর খালাস করেছিলেন। বিচারের রায়ের এই সাফল্য তাকে নোভা স্কোশিয়ার লোকাল হিরো করে তোলে। এই সাফল্যই হাউকে প্রাদেশিক পার্লামেন্টে নিয়ে যায় এবং অবশেষে তিনি প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীও হন।

এ সময় আরও বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে হয়। যেমন- হেনরি ডেভিড উইন্টন (১৭৯৩ – ১৮৫৫), যিনি ২৮ আগস্ট, ১৮১৮ সালে নিউফাউন্ডল্যান্ড আসেন। ১৮২০ সালে সেন্ট জোনসের চতুর্থ সংবাদপত্র হিসেবে তিনি Public Ledger and Newfoundland General Advisor প্রতিষ্ঠা করেন। জন রায়ান (১৭৬১ – ১৮৪৭) এবং উইলিয়াম লুইস মিলে ১৮০৭ সালে নিউফাউন্ডল্যান্ডের শুরুর দিকের একটি সংবাদপত্র Royal St. John’s Gazette প্রকাশ করেন। এছাড়া জোসেফ উইলকক্স (১৭৭৩ – ১৮১৪) ১৮০৬ সালে নায়াগ্রা থেকে Upper Canada Guardian; অথবা Freeman’s Journal বের করেন যা ছিল রাজনৈতিক মতামত ও সমালোচনার মাধ্যম।

৩। ‘নেশন বিল্ডিং পিরিয়ড’ বা জাতিগঠনের সময়কাল –

১৮৫০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ছিল ‘নেশন বিল্ডিং পিরিয়ড’ বা জাতিগঠনের সময়কাল। এ সময় কানাডিয়ান সম্পাদকরা কানাডিয়ান সমাজের জন্য একটি সাধারণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছিলেন।

সম্পাদকরা এ সময় সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত ছিল। তবে সরকার নানা গোপন উপায়ে তাদের প্রভাবিত করতে থাকে। যেমন ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদকীয় বিষয়বস্তুকে প্ররোচিত করা এবং সরকারের অনুগত সংবাদপত্রগুলোকে সরকারি বিজ্ঞাপণ দেওয়া। জন পরিসরকে গুরুত্ব দেওয়া সংবাদপত্রগুলি কিছুটা বেশি নিরপেক্ষ ছিল। অবশ্য এ সময় আগের চেয়ে প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে অনেক উন্নতি সাধিত হয়। এই সময়ের কাগজগুলো কানাডিয়ান আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিল।

এবার দেখাযাক এ সময় কী কী প্রভাবশালী সংবাদপত্র ছিল, এবং সেগুলোর পেছনে কাদের ভূমিকা ছিল।

শুরুতেই আসে জর্জ ব্রাউন (২৯ নভেম্বর, ১৮১৮ – ৯ মে, ১৮৮০) এর নাম। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ-কানাডিয়ান সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং কনফেডারেশনের অন্যতম জনক। তার পিতা পিটার ব্রাউনের সাথে ১৮৩৭ সালে স্কটল্যান্ড থেকে টরন্টোতে চলে আসেন তিনি। ১৮৪৩ সালে তারা ‘ব্যানার’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন। তিনি ছিলেন টরন্টো থেকে প্রকাশিত সে সময়ের প্রভাবশালী ‘দ্য গ্লোব’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠা। ৫ মার্চ ১৮৪৪ সালে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে এটি আত্নপ্রকাশ করে। এরপরে ১৯৩৬ সালে ‘দ্য মেইল ​​এন্ড এম্পায়ার’ এর সাথে একীভূত হয়ে ‘দ্য গ্লোব এন্ড মেইল’ ​গঠন করে।

‘দ্য গ্লোব’ এর একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। ব্রাউন অনেক প্রতিযোগীকে কিনে নেন এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পত্রিকাটির কাটতি বাড়িয়েছিলেন। ১৮৬০ সালের মধ্যে এটি কানাডার বৃহত্তম সংবাদপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৮৫০ এর দশকে ব্রাউন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং রিফর্ম পার্টির (কনজারভেটিভ ভাবাদর্শের) নেতা হন। কানাডিয়ান কনফেডারেশন গঠনের লক্ষ্যে তিনি শার্লটটাউন (সেপ্টেম্বর ১৮৬৪) এবং কুইবেক (অক্টোবর ১৮৬৪) সম্মেলনে যোগদান করেন। ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকার ৩টি প্রদেশ – প্রভিন্স অব কানাডা, নোভা স্কোশিয়া এবং নিউ ব্রাউন্সউইক এই কনফেডারেশনের মাধ্যমে একত্রিত হয় যা ১৯৬৭ সালের ১লা জুলাই ডোমিনিয়ন অব কানাডা নামে আত্মপ্রকাশ করে। আমরা যা কানাডা ডে হিসেবে উদযাপন করি।  

১৮৪০ এবং ১৮৫০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের তথ্য প্রদানের জন্য ‘দ্য গ্লোব’ বেশ জনপ্রিয় ছিল।  ব্রাউন তার সম্পাদকীয়তে ক্যাথলিক চার্চ, জেসুইট (‘সোসাইটি অব জিসাস’ এর সদস্য), যাজক, নানারী (ধর্মীয় উপাসনালয়ের সেবাদানকারী) এবং মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের জন্য শহরের আইরিশ এবং ফরাসি ক্যাথলিকদের দোষারোপ করে তীব্র উপহাসপূর্ণভাবে লিখতেন। ১৮৭২ সাল নাগাদ এটি ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র, যেখানে দৈনিক ও সাপ্তাহিকসহ এর প্রচার সংখ্যা ছিল বেশি।

১৮৬৭ সালে জর্জ ব্রাউনের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পায় লিবারেল পার্টি। ১৮৮০ সালের দিকে ‘দ্য গ্লোব’ অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকছিল।

২৫ মার্চ, ১৮৮০ সালে একজন প্রাক্তন গ্লোব কর্মচারী, জর্জ বেনেট, ব্রাউনের অফিসে ঢুকে পড়েন। তাকে সে সময় কোন এক কারণে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তো সে ব্যক্তি একটি প্রশংসাপত্র চেয়েছিলেন যেখানে উল্লেখ থাকবে যে সে পাঁচ বছর ধরে এই কাগজের জন্য কাজ করেছে। ব্রাউন লোকটিকে চিনতে পারেনি, তাই তাকে অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে কথা বলতে বলেন। এ সময় দুই ব্যক্তি তর্কে জড়ালেন এবং বেনেট একটি বন্দুক বের করলেন। ব্রাউন বন্দুকটি ধরেছিলেন, কিন্তু এতে ব্রাউনের উরুতে একটি গুলি লাগে। ব্রাউন সুস্থতার জন্য অফিস ছেড়ে তার টরন্টোর বাড়িতে ওঠেন। তবে ধীরে ধীরে তার পা সংক্রমিত হয়। পরে তার প্রচণ্ড জ্বর হয় এবং প্রলাপ বকতেন। ৯ মে,  ১৮৮০ সালে ব্রাউন তার টরন্টোর বাড়িতে মারা যান। ব্রাউনকে টরন্টো নেক্রোপলিসে সমাহিত করা হয়েছিল। পরে অবশ্য বেনেটকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ফাঁসি দেওয়া হয়।

ব্রাউনের বাসভবন, পূর্বে ল্যাম্বটন লজ নামে পরিচিত এবং এখন জর্জ ব্রাউন হাউস নামে পরিচিত, ঠিকানা 186 Beverley Street, Toronto । এই হাউসটি ১৯৭৪ সালে কানাডার জাতীয় ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে নামকরণ করা হয়। এটি এখন অন্টারিও হেরিটেজ ট্রাস্টের আওতায় একটি সম্মেলন কেন্দ্র এবং অফিস হিসাবে পরিচালিত হয়।

ব্রাউন অন্টারিওর ব্রান্টফোর্ডের কাছে বো পার্ক নামে একটি এস্টেটও কিনেছিলেন। ১৮২৬ সালে কেনা এই স্থানে ব্রাউনের সময় একটি গবাদি পশুর খামার ছিল এবং বর্তমানে এটি একটি বীজ খামার।

টরন্টোর জর্জ ব্রাউন কলেজ (১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। ব্রাউনের একটি মূর্তি কুইন্স পার্কের সামনের পশ্চিম লনে শোভা পাচ্ছে। আরেকটি রয়েছে অটোয়ার পার্লামেন্ট হিলে। 

৪। ‘মডার্ন পিরিয়ড’ বা আধুনিক সময়-

১৯০০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ছিল ‘মডার্ন পিরিয়ড’ বা আধুনিক সময়। এ সময়ে শিল্পের পেশাদারিকরণ এবং জীবনমানের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি ফুটে উঠে।

১৮৭০-এর দশকের শুরুতে প্রতিবাদী প্রকাশকদের মধ্যে ‘মন্ট্রিয়ল স্টার’ এর হিউ গ্রাহাম এবং ‘টরন্টো টেলিগ্রাম’ পত্রিকার জন রস রবার্টসন ছিলেন শ্রমিক শ্রেণির কণ্ঠস্বর। তারা আমেরিকান পেনি প্রেসের মডেলকে অনুসরণ করেন। একটি পক্ষপাতমূলক এবং অপরাধ, কেলেঙ্কারি এবং দুর্নীতির স্থানীয় সংবাদের ওপর জোর দিয়ে সস্তায় সংবাদপত্র বিক্রি করেছিলেন তারা। বিনোদন খবরের কদর ধীরেধীরে বাড়তে থাকে, বিশেষ করে সেলিব্রিটিদের আসা-যাওয়া নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়। খেলাধুলার খবরের প্রতিও পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষিত হয়। তারা তাদের স্থানীয় স্পোর্টসের বিভিন্ন দলের উত্থান-পতনের খবর পড়তে আগ্রহী ছিল। নারী পাঠকদের আকৃষ্ট করতে ফ্যাশন, সাজসজ্জা এবং রেসিপি সম্পর্কিত নিবন্ধ যুক্ত করা হয়। নতুন প্রযুক্তি মুদ্রণকে সস্তা এবং দ্রুততর করেছে, এবং একাধিক সংস্করণকে উৎসাহিত করেছে। ১৮৯৯ সালের মধ্যে ‘মন্ট্রিয়ল স্টার’ দিনে ৫২,৬০০ কপি বিক্রি হয়। ১৯১৩ সাল নাগাদ এর ৪০% সার্কুলেশন মন্ট্রিয়লের বাইরে শুরু হয়। পত্রিকাটি ইংরেজি ভাষার বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।

১৯০০ সালে বেশিরভাগ কানাডিয়ান সংবাদপত্রে ছিল স্থানীয় বিষয়, যা প্রাথমিকভাবে স্থানীয় প্রাদেশিক এবং জাতীয় রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে খবর তুলে ধরতো।

১৯০০ সালের মধ্যে টরন্টো থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের আয়ের তিন-চতুর্থাংশ বিজ্ঞাপন থেকে আসা শুরু হয়। সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠাগুলির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অনুগতভাবে কনজারভেটিভ বা লিবারেল পার্টিকে সমর্থন করেছিল, তবে বাকিগুলি আরও স্বাধীন ছিল। সম্পাদকীয় পাতা কেবল নয়, সংবাদের নির্ধারিত পৃষ্ঠাগুলিতেও ধীরেধীরে বস্তুনিষ্ঠতা এবং সকল দলকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। প্রকাশকরা বিজ্ঞাপনের আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পত্রিকার সার্কুলেশন বজায় রাখতেন।

তবে কোন সংবাদপত্র শুধুমাত্র একটি পক্ষের কাছে আবেদন তৈরি করলে তার সম্ভাব্য পাঠকের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসতো। অন্টারিও এবং কুইবেকে শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধির কারণে সংবাদপত্রের একটি সমৃদ্ধ পাঠকশ্রেণি তৈরি হয়েছিল। ১৯১১ সালের দিকে কানাডিয়ান সংবাদপত্রের জন্য ছিল একটি স্বর্ণযুগ। ১৯১৫ সালে বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলি ‘অডিট ব্যুরো অফ সার্কুলেশন’ প্রতিষ্ঠার কারণে পত্রিকার প্রচার সংখ্যা নিয়ে প্রথমবারের মত নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া শুরু করে। এসব সংস্থাগুলি তখন বিজ্ঞাপনের হার নিয়ে দর কষাকষি করতে পারে। সংবাদপত্রের জন্য ১৯২০-এর দশক ছিল একত্রীকরণ, বাজেট কমানো এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত হওয়ার সময়কাল। ১৯৩০ সাল নাগাদ কানাডার দৈনিকগুলির মাত্র ২৪% ছিল পক্ষপাতদুষ্ট, ১৭% ছিল ‘স্বাধীনভাবে’ পক্ষপাতদুষ্ট, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ ৫০% সম্পূর্ণ স্বাধীন।

গ্লোব এবং মেইল:

১৯৩৬ সালে, টরন্টোর দুটি প্রধান কাগজ ‘দ্য গ্লোব’ (প্রচার সংখ্যা ৭৮,০০০) এবং ‘দ্য মেইল ​​এন্ড এম্পায়ার’ (প্রচার সংখ্যা ১১৮,০০০) একত্রিত হয়। ১৮৯৫ সালে দুটি রক্ষণশীল ঘরানার সংবাদপত্র ‘দ্য টরন্টো মেইল’ এবং ‘টরন্টো এম্পায়ার’ একত্রিত হয়ে নামকরণ করেছিল ‘দ্য মেইল এন্ড এম্পায়ার’। ১৮৮৭ সালে ‘দ্য এম্পায়ার’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন এ ম্যাকডোনাল্ড।

যদিও নতুন ‘গ্লোব এবং মেইল’ টরন্টোর স্থানীয় ব্যবসায় ‘দ্য টরন্টো স্টার’ এর কাছে বাজার হারায়, তবে পত্রিকাটি ন্যাশনাল সার্কুলেশন প্রসারিত করতে শুরু করে। ১৯৫৫ সালে আমেরিকান নিউজপেপার গিল্ডের আদলে পত্রিকাটিতে শ্রমিক ইউনিয়ন করা হয়েছিল।

১৯৮০ সালে কেনেথ থমসনের কোম্পানি ‘থমসন কর্পোরেশন’ এই ‘গ্লোব এন্ড মেইল’ এর মালিকানায় আসে। এ সময় তারা সম্পাদকীয় বা সংবাদ নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনে। যেমন টরন্টো এবং অন্টারিও উপাদানের উপর জোর দেওয়ার যে পূর্ববর্তী নীতি ছিল সেখান থেকে সরে এসে পত্রিকাটির সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, এবং প্রথম পৃষ্ঠাগুলিতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদগুলির ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।

৫। ‘কারেন্ট হিস্ট্রি’ বা বর্তমান ইতিহাস –

১৯৯০ এর দশক থেকে শুরু হয় ‘কারেন্ট হিস্ট্রি’ বা বর্তমান ইতিহাস। এ সময় ইন্টারনেট এসে নতুনমাত্রা যোগ করে। এই যুগে বাইরে থেকে আগ্রহীদের তুলনায় চেইন বা একই প্রতিষ্ঠানের অধীনে অনেক সংবাদপত্রের মালিকানা লক্ষ্য করা যায়।

২০০৪ সালের মধ্যে এমন পাঁচটি বৃহত্তম চেইন প্রতিষ্ঠান ৭২ শতাংশ পত্রিকা এবং ৭৯ শতাংশ সার্কুলেশন নিয়ন্ত্রণ করেছিল। সংবাদ এবং বিজ্ঞাপনের ভূমিকার জন্য ইন্টারনেট একটি বড় হুমকি হয়ে উঠে। এতে নতুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনের আয়ের হ্রাস ছিল বিশ্বব্যাপী। কানাডায়ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং টেলিভিশন থেকে বিজ্ঞাপন স্থানান্তরিত হয় ইন্টারনেট দুনিয়ায়। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনের আয় ২.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১১ সালে ১.৯ বিলিয়নে নেমে আসে। সার্কুলেশনও ক্রমশ কমেছে। সংবাদপত্রের চেইন প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেয়, পৃষ্ঠার সংখ্যা কমিয়ে দেয়, এবং স্টক মার্কেটের বিস্তারিত প্রতিবেদনের মতো চালু থাকা ফিচারগুলোও বাদ দেয়। তারা ইন্টারনেট থেকে বিনামূল্যে সংবাদ পাওয়া বন্ধ করে। ২০১৯ সালে করা ‘রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ জার্নালিজম’ একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সে বছর কানাডিয়ানদের মাত্র ৯% অনলাইন থেকে সংবাদ পেতে অর্থ ব্যয় করে।

The National Post:

কনরাড ব্ল্যাক ১৯৯০-এর দশকে Southam Newspapers কিনে তার জাতীয় সংবাদপত্রের চেইন কোম্পানি ‘হলিঙ্গার ইন্টারন্যাশনাল’ চালু করেন। যার মধ্যে ‘অটোয়া সিটিজেন’, ‘মন্ট্রিয়ল গেজেট’, ‘এডমন্টন জার্নাল’, ‘ক্যালগারি হেরাল্ড’ এবং ‘ভ্যাঙ্কুভার সান’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে এই হলিঙ্গার কানাডার প্রায় ৬০ শতাংশ দৈনিক পত্রিকার মালিকানা অর্জন করে। কনরাড ব্ল্যাক টরন্টোর একটি ব্যবসায়িক কাগজকে National Post এ রূপান্তরিত করেছিলেন। এর সম্পাদকীয় ভাবধারা ছিল কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীল।

ব্ল্যাক ২০০০-০১  সালে ‘ক্যানওয়েস্ট গ্লোবাল’ এর কাছে ‘ন্যাশনাল পোস্ট’ বিক্রি করে দেন। ২০০৬ সালের মধ্যে ‘ন্যাশনাল পোস্ট’ খরচ কমাতে এবং বাজারে টিকে থাকতে এর সার্কুলেশন কমায়। ২০০৮ সাল নাগাদ ‘গ্লোব এবং মেইল’ ​​এবং ‘ন্যাশনাল পোস্ট’ এর দেশব্যাপী সম্মিলিত প্রচার সংখ্যা ছিল ৩.৪ মিলিয়ন।

CanWest:

ম্যানিটোবার ট্যাক্স আইনজীবী, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ ইজি অ্যাস্পার (১৯৩২ – ২০০৩) প্রতিষ্ঠা করেন ‘ক্যানওয়েস্ট’।  ১৯৭৫ সালে একটি স্থানীয় টিভি স্টেশন দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি। এরপর দেশের বৃহত্তম সংবাদপত্রের প্রকাশক তৈরি করেছিলেন, ‘দ্য ন্যাশনাল পোস্ট’ এর মাধ্যমে। ক্যানওয়েস্ট ‘সাউদাম চেইন’ও কিনেছে। এদের মালিকানায় গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এবং ই! টেলিভিশন, সেই সাথে ‘অ্যালায়েন্স আটলান্টিস’ গ্রুপের বিশেষ চ্যানেলও ছিল। একুশ শতকের প্রথম দিকে শীর্ষে থাকা Canada.com ইন্টারনেট পোর্টালের মালিকানাও তারা নেয়, এবং অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্কেও টেলিভিশন ও রেডিওতে তাদের আগ্রহ ছিল। ক্যানওয়েস্ট ২০০৯ সালে দেউলিয়া হয়ে যায়, এবং সংবাদপত্রগুলি ‘পোস্টমিডিয়া নেটওয়ার্ক’ দখল করে নেয়। এ সময় সম্প্রচার মাধ্যমগুলো ‘শ কমিউনিকেশন’ এর কাছে আলাদাভাবে বিক্রি করা হয়।

Postmedia Network:

পোস্টমিডিয়া নেটওয়ার্ক কানাডা কর্পোরেশন একটি বিদেশী মালিকানাধীন কানাডিয়ান-ভিত্তিক মিডিয়ার সমষ্টি, যা পূর্বে ছিল ‘ক্যানওয়েস্ট’। এর প্রাথমিক কার্যপরিধি ছিল ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র প্রকাশনা, সংবাদ সংগ্রহ এবং ইন্টারনেট পরিচালনা। এটি ‘ন্যাশনাল পোস্ট’ এবং ‘ফাইন্যান্সিয়াল পোস্ট’ এর মালিক হওয়ার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। কোম্পানির সদর দফতর টরন্টোর ব্লোর স্ট্রিটের পোস্টমিডিয়া প্লেসে অবস্থিত।

কোম্পানিটির কৌশল হিসেবে ডিজিটাল সংবাদ সংগ্রহ এবং বিতরণে অংশ নেওয়াওকে প্রাধান্য দেয়। এরমধ্যে ওয়েবসাইট সম্প্রসারণ এবং স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটের জন্য ডিজিটাল সংবাদ অ্যাপ সেবা নিয়ে আসে। এটি ২০১৪ সালে আত্মপ্রকাশ করা ‘অটোয়া সিটিজেন’ এর পুনর্গঠন এবং পুনরায় ডিজাইনের মাধ্যমে চালু করে।

পোস্ট মিডিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৬%, বর্তমানে আমেরিকান মিডিয়া গ্রুপ চ্যাথাম অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের মালিকানাধীন।

২০১৮ সাল পর্যন্ত পাওয়া এক তথ্যে দেখা যায় পোস্টমিডিয়া নেটওয়ার্ক ইঙ্ক ও সান মিডিয়ার মালিকানায় রয়েছে মোট ১২১টি পত্রিকা, যারমধ্যে ৩৫টি দৈনিক সংবাদপত্র, ৮৬টি কমিউনিটি পত্রিকা। Torstar Corp./Metroland অধীনে আছে ১০০টি পত্রিকা। এরমধ্যে ১২টি দৈনিক এবং ৭৮টি কমিউনিটি পত্রিকা। ব্ল্যাংক প্রেস লিমিটেড এর আছে ৮৮ পত্রিকার মালিকানা। Snapd Inc. এর আছে ৭২টি পত্রিকা। এরকম আরও বেশ কিছু চেইন প্রতিষ্ঠান আছে যারা সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত।

কানাডিয়ান ক্যাবল কোম্পানি:  

প্রধান কানাডিয়ান ক্যাবল কোম্পানিগুলির মধ্যে রয়েছে Rogers, Shaw, Cogeco, Vidéotron এবং EastLink/Persona। বেশিরভাগ কানাডিয়ান শহরগুলোতে বাজার অনুপাতে শুধুমাত্র একটি ক্যাবল কোম্পানি সেবা দিয়ে থাকে। তবে কয়েকটি শহরে একাধিক ক্যাবল কোম্পানির সেবা পাওয়া যায়। প্রতিটি কোম্পানি বাজারের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে থেকে ব্যবসা পরিচালনা করে। উদাহরণস্বরূপ, হ্যামিল্টনে শুধুমাত্র কোজেকো ক্যাবল, রজার্স ক্যাবল এবং সোর্স ক্যাবল লাইসেন্সপ্রাপ্ত অপারেটর, তবে শহরের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় প্রত্যেকেরই একচেটিয়াভাবে ব্যবসার অধিকার রয়েছে।

যাইহোক, ক্যাবলের বিকল্প হিসেবে দুটি বড় কোম্পানি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে – একটি হল বেল স্যাটেলাইট টিভি, যা BCE Inc. এর একটি বিভাগ এবং Shaw Direct, যা Shaw-এর একটি বিভাগ।

Radio Broadcasting:

কানাডায় এএম এবং এফএম উভয় ব্যান্ডে প্রায় ২,০০০ রেডিও স্টেশন রয়েছে। ২০২০ সালের হিসেবে, কানাডার চারটি বৃহত্তম বাণিজ্যিক রেডিও সম্প্রচার গ্রুপ হল- Stingray Group, Rogers Radio, Corus Radio, এবং Bell Media Radio। যাইহোক, অনেক ছোট ব্রডকাস্টার কোম্পানিও অনেক রেডিও স্টেশন পরিচালনা করে। কানাডিয়ান বাণিজ্যিক রেডিওতে বিভিন্ন ঘরানার সঙ্গীত পরিবেশিত হয়, যেমন- পপ, রক, হিপ হপ, কান্ট্রি, জ্যাজ এবং ক্লাসিক্যাল। অনেক শহরে খবর, খেলাধুলা, টকশো রেডিও এবং ধর্মীয় স্টেশনও পাওয়া যায়। এছাড়াও, অনেক কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্যাম্পাস রেডিও স্টেশন রয়েছে। নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠান হিসেবে কিছু সম্প্রদায়ের কমিউনিটি রেডিও স্টেশন বা খ্রিস্টান রেডিও স্টেশন রয়েছে। কানাডায় আনুমানিক ১৪টি ফুল-টাইম এথনিক বা জাতিগত রেডিও স্টেশন রয়েছে, মূলত মেট্রোপলিটান বাজারকে কেন্দ্রকরে এগুলো প্রাথমিকভাবে টরন্টো, মন্ট্রিয়ল এবং ভ্যাঙ্কুভারে গড়ে উঠেছে।

Canadian Broadcasting Corporation (CBC):

কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন সিবিসি/রেডিও-কানাডা নামে পরিচিতএটি মূলত রেডিও এবং টেলিভিশন উভয়ের জন্যই কানাডিয়ান পাবলিক ব্রডকাস্টার। এটি একটি ক্রাউন কর্পোরেশন যা জাতীয় পাবলিক ব্রডকাস্টার হিসেবে কাজ করে, যার ইংরেজি-ভাষা এবং ফরাসি-ভাষা পরিষেবা ইউনিটগুলি সাধারণত CBC এবং রেডিও-কানাডা নামে পরিচিত।

রেডিও অংশটি প্রতিষ্ঠিত হয় ০২ নভেম্বর, ১৯৩৬ সালে।  আর টেলিভিশন আসে ০৬

সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে। এর প্রধান কার্যালয় সিবিসি অটোয়া প্রোডাকশন সেন্টার, অটোয়া।

CP24:

এটি একটি কানাডিয়ান ইংরেজি ভাষার বিশেষ সংবাদ চ্যানেল যার মালিক বেল মিডিয়া, BCE Inc. এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং বেলের মালিকানাধীন CTV টেলিভিশন নেটওয়ার্কের অধীনে পরিচালিত হয়। চ্যানেলটি ডাউনটাউন টরন্টোর ২৯৯ কুইন স্ট্রিট ওয়েস্ট থেকে সম্প্রচার করে। ৩০ মার্চ ১৯৯৮ সালে এটি চালু হয়।

বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির দেশ এই কানাডা। তাই এর গণমাধ্যমও বেশ বৈচিত্র্যময়। গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। একটি দেশের গণমাধ্যম সে দেশের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জীবনমানের উন্নয়নেও অবদান রাখে। বিশ্বখ্যাত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘যে দেশে সংবাদপত্র স্বাধীন, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না’। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে অন্যতম মেরুদন্ড হলো একটি স্বাধীন, পেশাদার ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম। কানাডার গণমাধ্যমগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

লেখক: মাহবুব ওসমানী, গণমাধ্যমকর্মী ও রিয়েল এস্টেট এজেন্ট