কানাডার কৃষি

জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন

অন্য-বস্ত্র এবং বাসস্থানসহ মানুষের নানান মৌলিক চাহিদার যোগান  আসে কৃষি থেকে। আর তাই, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কৃষি  হয়ে ওঠে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা আজ এই লেখার মাধম্যে পাঠকদেরকে কানাডার কৃষি সম্পর্কে একটি মৌলিক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো। আমরা জানি, পানি , মাটি ও জলবায়ু কৃষির অন্যতম উপাদান। কানাডার কৃষিকে বুঝতে হলে এই তিনটি বিষয়ের আলোকে কানাডার কৃষি সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে এবং সেই  সাথে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত দেশগুলোর জলবায়ু ও ঋতুচক্র বিষয়েও  কিছুটা ধারণা থাকা আবশ্যক। আমরা এই লেখার শুরুতে কানাডার জলবায়ু , ঋতুচক্র, কানাডার ভৌগোলিক অঞ্চলের পরিচিতি, কানাডায় জন্মানো প্রধান প্রধান শস্যসমূহ, কানাডার মৎস্যসম্পদ এবং পশুসম্পদ বিষয়ে আলোচনা শুনবো।

ঋতুচক্রের একেকটি ধাপে জলবায়ুর বৈচিত্রতা কানাডার কৃষিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। উত্তর  গোলার্ধের দেশগুলোর মতো কানাডার ঋতুচক্রে চারটি সিজন লক্ষ্য করা যায়: বসন্ত (spring), গ্রীষ্ম (Summer), ফল (Fall ) বা শরৎকাল (Autumn) এবং শীতকাল (Winter)। কানাডার বসন্তকাল শুরু হয় সূর্য যখন বিষুবরেখা (equator) এর উপরে অবস্থান করে  দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে যা  সাধারণত মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়ে জুন মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে। আলবার্টা, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, সাস্কাচেওয়ান, মানিটোবা প্রভৃতি প্রভিন্সগুলোতে ঠাণ্ডা তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এসমস্ত এলাকায় বসন্ত কালেও শুরুর দিকে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে থাকলেও পরের দিকে প্লাসে চলে আসে। বসন্তকালে  বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় এসময়কে অলিখিতভাবে কানাডার  রেইনি সিজন বলা হয় থাকে যা সামার সিজন পর্যন্ত চলে এবং ফসলের পানির চাহিদা মেতে কিছুটা মেটাতে সক্ষম হয়। শীতের পরপরই শুরু হওয়া বসন্তকালে পাতাবিহীন গাছপালা সবুজ হতে থাকে। সামারের সব্জিবাগানীরা বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে এই বসন্তকালেই টমেটো, বেগুন, সিম, কপি,  প্রভৃতি সবজির চারা তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। দীর্ঘ শীতে ঘরে অবরুদ্ধ থেকে মুক্তি পেয়ে কানাডাবাসী বসন্তকালে বহির্মুখী হতে থাকে যা অব্যাহত  থাকে পুরো সামার ও ফল সিজন হয়ে শীতের আগ পর্যন্ত। 

বসন্তের পরে শুরু হওয়া সামার সিজন শেষ হয় সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে। এসময়ে সূর্য একেবারে উত্তর দিকে চলে যায়। এই সামার সিজনেই সমগ্র কানাডায় কৃষি কাজ একেবারে জমে ওঠে।  হাই ওয়েতে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার পথে দুধারে  ছোট বড়ো সব ক্ষেত খামার, সবুজের সমারোহে চোখ  জুড়িয়ে যায়। কে বলবে এই কিছুদিন আগেও এসব প্রান্তর বরফে ঢাকা ছিল। কানাডার সামারে শহরতলি ও গ্রামঞ্চলের সব্জিচাষিগণ নিজেদের উৎপাদিত চারা দিয়ে কেউবা বাজার থেকে চারা সংগ্রহ করে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় নিজ নিজ খামার ও বাগান সাজাতে মন দেন। বাগান শাকসবজিতে ভরে ওঠে। অপর্যাপ্ত বৃষ্টির কারণে সামারে গড়ে ওঠা শস্য খামারগুলোতে কৃষকেরা সাধারণত স্প্রিংকলার পদ্ধতি অবলম্বন করে সেচের ব্যাবস্থার মাধ্যমে জমিতে ফসলের পানির চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। সামার সিজনে কানাডায় উৎপাদিত প্রধান ফসলগুলোর মধ্যে অন্যতম ফসলগুলোর নাম: গম, বার্লি, ক্যানোলা সয়াবিন এবং নানান ফলমূল ও শাকসবজি। এগুলো নিয়ে পর্যায়ক্রমে পৃথকভাবে  আলোচনা করার সুযোগ থাকবে।  

সামারের পরে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয় শরৎকাল বা ফল সিজন। এসময়ে গাছে গাছে লাল, হলুদ, কমলা প্রভৃতি  রংবেরঙের পাতায় সজ্জিত কানাডা যেন রূপসী রমণীর বেশ ধরে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা করে। ফল সিজনের মাঝামাঝি থেকেই কৃষকেরা সামার সিজনের উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার আনন্দে ফুরফুরে মেজাজে থাকেন। ঘরে ঘরে শাকসবজি ও খাদ্যশস্যের পর্যপ্ততার কারণে কানাডাবাসী উৎসবমুখী হয়ে থাকে। এই সময়টিকে আরও উৎসবমুখর করার জন্যে কানাডায় হ্যালোয়িন উৎসব, থাঙ্কস গিভিং প্রভৃতি উৎসব  উজ্জাপন করা হয়। কৃষকদের চাষকৃত মিষ্টিকুমড়াকে ভৌতিক মুখোশের অবয়ব দিয়ে সাজিয়ে কানাডায় হ্যালোয়িন ডেকোরেশন করা হয়। পরিবার এবং  বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে থাঙ্কস গিভিং পার্টিগুলোতে ডিনারে ট্রাডিশনাল প্রথা অনুযায়ী কানাডিয়ানদের টার্কি খাবার পরে আপেল পাই, পাম্পকিন পাই ডেজার্ট হিসেবে খেতে দেখা যায়। একটি পরিসংখ্যানে দেখে গেছে ২০২৩ সালে প্রায় ১০,৮৮৬ একর জমিতে আবাদ করে পাম্পকিন  হারভেস্ট করা হয়েছিল। Turkey  Farmers  of  Canada এর তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে কানাডাতে ২.১ মিলিয়ন টার্কি শুধু থ্যাংক্সগিভিং এর মৌসুমে  বিক্রয় হয়েছিল এবং একই বছরে ক্রিস্টমাসের সময় বিক্রয় হয়েছিল ২.৭ মিলিয়ন টার্কি। এভাবেই  কানাডাতে  সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে প্রকৃতি কানাডার কৃষিকে সুক্ষ সুতা দিয়ে মালা গেঁথে একদিকে যেমন কানাডিয়ান সংস্কৃতিকে পরের প্রজন্মদের মাঝে পরিচয় ঘটিয়ে দেন , আবার কৃষক ও ব্যাবসায়ীদের মুনাফার সুযোগ  করে দিয়ে কানাডার কৃষককে আরও উজ্জীবিত করে তোলেন।

এবার আলাপ করা  যাক, শীতকাল নিয়ে। বাহির থেকে অনেকেরই ধারণা থাকে কানাডা হচ্ছে শীতের দেশ। এই শীতের দেশে আবার কৃষি? তবে একথা ঠিক,  ডিসেম্বরের থেকে শুরু হয়ে মার্চ মাসব্যাপী এই শীতকালে কানাডার পর্যন্ত ঝিমিয়ে থাকে, তবে থিম থাকে না। কানাডার  প্রেইরি অঞ্চলে উইন্টার হুইট বা শীতকালীন গম চাষ বেশ জনপ্রিয়। ফল সিজনে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে কৃষকেরা বীজ বপন করে থাকেন। শীতের বরফের আগেই চারা গজিয়ে বরফের নিচে থিতু হয়ে থাকে। দীর্ঘ শীতের ঠান্ডা তাপমাত্রায় এসমস্ত চারাগুলোর মাঝে Vernalization সম্পন্ন হয় যা পরবর্তীতে বসন্তের শুরুর দিকেই দ্রুত ছড়া গজিয়ে (Panicle Initiation) দ্রুত ফল দিয়ে থাকে। একটি সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০২২ সালে সমগ্র কানাডাতে ৩৩.৮ মিলিয়ন টন গম উৎপাদিত হয়েছিল যার ৯২% এসেছিলো ফল সিজনে বোপনকৃত গম থেকে এবং বাকি ৮% এসেছিলো উইন্টার হুইট থেকে।

আবহাওয়া ও জলবায়ুর আলোকে কানাডার কৃষি সম্পর্কে এতক্ষণে আমরা খানিকটা মৌলিক ধারণা পেলাম। এবার আসুন একটি ট্যাকনিক্যাল টার্ম ‘biome ‘ এর আলোকে কানাডার কৃষিকে একটু জেনে নেই। এই ‘biome’কে আবার ইকোসিস্টেম বা ইকোরিজিয়ন হিসাবেও অবিহিত করা হয়ে থাকে। ‘biome’ হচ্ছে একটি বিশেষ জিওগ্রাফিক এলাকা যার গাছগাছড়া, মাটি এবং বন্যপ্রাণী বৈচিত্রতা দিয়ে আরেকটি এলাকা থেকে  এটিকে আলাদা করে রাখে। সমগ্র পৃথিবীকে মোট পাঁচটি প্রধান  biome এ ভাগ করা হয়ে থাকে : জলজ (aquatic), তৃণভূমি (grassland), বন (forest), মরুভুমি (desert) এবং তুন্দ্রা অঞ্চল (Tundra)। এগুলোর মধ্যে তৃণভূমি, এবং তুন্দ্রা অঞ্চল কানাডার কৃষির সাথে সম্পর্কিত। আসুন, এব্যাপারে বিস্তারিত আরেকটু আলাপ করা যাক। 

Biomes  of  Canada বিষয়ক এক ওয়েবসাইট অনুযায়ী কানাডাকে biomes ভিত্তিক মোট পাঁচটি ১৬টি  অঞ্চলে ভাগ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান পাঁচটি অঞ্চল  হচ্ছে : বোরিয়াল বনভূমি  (Boreal ফরেষ্ট), মরুভুমি (Dessert), তৃণভূমি (Grasslands), নাতিশীতোষ্ণ পর্ণমোচী বনভূমি (The Temperate Deciduous Forest), নাতিশীতোষ্ণ রেইনফরেস্ট (the Temperate Rainforest) এবং তুন্দ্রা (Tundra)। বোরিয়াল বনভূমি হচ্ছে কানাডার বৃহত্তম biome যার ব্যাপ্তি   মোটামুটিভাবে সমগ্র কানাডার ৫০% এলাকা। এই এলাকা Yukon এবং নর্থ ব্রিটিশকলাম্বিয়া থেকে নিউফাউন্ডল্যান্ড এবং ল্যাব্রাডোর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই এলাকার বনভূমিতে যে সমস্ত গাছগাছালি দেখতে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, pine, spruce,  larch, fir, popler এবং birch। 

শীতের দেশ কানাডাতেও যে মরুভুমি রয়েছে তা হয়তো অনেকেরই অজানা।  আর এটি রয়েছে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার Osoyoos  এলাকায়। এখানে তাপমাত্রা সামারে ৪০ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত ওঠে আবার শীতকালে শূন্যের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সে. নেমে যায়। বৃষ্টিপাত সারাবছরই মাত্র ৩০০ মিমি। এই মরুভূমিতে কৃষিকাজের প্রসার নেই। ধুধু মরুভূমিতে গাছপালা বলতে আছে শুধু ক্যাকটাস ও  ঋষি গুল্ম। নাতিশীতোষ্ণ রেইনফরেস্ট (The Temperate Rainforest) নামক আরেকটি biome রয়েছে যা ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রভিন্সের উপকূলবর্তী  এলাকা নিয়ে গঠিত। ওক, ম্যাপল, বিচ, হিকরি, চেস্টনাট প্রভৃতি গাছগাছাড়ি এই এলাকায় দেখা যায়। 

তৃণভূমি (grassland) অঞ্চল কানাডার প্রেইরি প্রভিন্সসমূহ অর্থাৎ মানিটোবা , সাস্কাচেওন এবং  আলবার্টা প্রভিন্সের দক্ষিণ  অঞ্চল নিয়ে গঠিত। তুন্দ্রা অঞ্চলের মতো এখানেও জীববৈচিত্র্য দেখতে পাওয়ায় যায়। এই তৃণভূমির উল্লেখ্যযোগ্য অবদান হচ্ছে এখানে মাটিতে বিপুল পরিমানে কার্বন জমা করে রেখে স্বাস্থ্যকর জলবায়ু সৃষ্টি করে আসছে। কানাডার কৃষিতে এই তৃণভূমির আরো একটি বিশেষ অবদান হচ্ছে এখানে জন্মানো ঘাস ও লিগুম জাতীয় গাছপালা কানাডার বিপুল গবাদিপশুর  খাবারের যোগান দিয়ে থাকে ।

নাতিশীতোষ্ণ পর্ণমোচী বনভূমি (The Temperate Deciduous Forest) কানাডার পূর্বদিকের প্রভিন্সগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। এই বিশাল বনভূমির মাটিতে পরে থাকার পাতাগুলোর decomposition এর কারণে গাছপালাগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কানাডার তুন্দ্রা অঞ্চল ইউকন, উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল, নুনাভুট, উত্তর-পূর্ব ম্যানিটোবা, উত্তর অন্টারিও, উত্তর কুইবেক এবং উত্তর ল্যাব্রাডর নিয়ে গঠিত। এসব এলাকার বিস্তৃত অনুর্বর সমতল ভূমিতে বোরো বৃক্ষরাজি দেখতে পাওয়া যায় না। খুব অল্প সময়ের সামার সিজন এবং ভূমির অনুর্বরতা কারণে কৃষিকাজ তেমন একটা জোড়ালো না। 

কানাডার কৃষি বিষয়ক আলোচনায় এই পর্যায়ে আমরা জেনে নিব কানাডায় জন্মানো প্রধান প্রধান শস্যসমূহ সম্পর্কে।  প্রথমেই যে ফসলের নাম উঠে আসে তা হচ্ছে ক্যানোলা। Canola council of Canada এর ওয়েবসাইট https://www.canolacouncil.org/ থেকে জানা যায় কানাডাতে ৫০ বছর ধরে চাষকৃত এই ফসল ক্যানোলা বর্তমানে কানাডার একটি অন্যতম শস্য। কানাডাতে  লাভজনক এবং কানাডার কৃষিতে ব্যাপক সমাদৃত এই ফসলটি উৎপাদনকারী (growers), বীজ উন্নয়নকারী (seed  developers), বীজ প্রক্রিয়াজাতকারী (seed  processors) এবং বীজ রপ্তানিকারী সবাই মিলে কানাডাতে প্রতি বছর ২৯.৯ বিলিয়ন ডলার আয় সৃষ্টি করে থাকেন। সরিষা জাতীয় ফসলের বোটানিক্যাল পরিবারের নাম হচ্ছে Brassicaceae (Cruciferae)। এই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ক্যানোলা ফসলে সরিষা থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ইউরিক এসিড কম থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্যে  জন্য অনেক উপকারী। Canadian oil, low acid শব্দগুলোর প্রথম অক্ষরগুলি সাজিয়ে canola নামকরণ করা হয়েছে। সরিষা ফুলের মতো আকর্ষণীয় হলুদ বর্ণের এই ফুল থেকে সরিষা গাছের মতোই ফল (pod) সৃষ্টি হয় যার ভিতরে ক্ষুদ্রাকৃতি কালো বর্ণের ক্যানোলা বীজ থাকে। এই বীজগুলো  ক্রাশ করে ক্যানোলা ভোজ্যতেল Canola oil নামে বাজারজাতকরণ করা হয় যা বিগত কয়েক দশক ধরে কানাডার কৃষিতে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে।

কানাডীয় সবচেয়ে বেশি পরিমানে দানাদার ফসল (grain crop) হিসেবে যে ফসলের চাষ করা হয় তা হচ্ছে ‘গম’।  ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে গম উৎপাদনে সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে ৫ম স্থানে রয়েছে কানাডা। কানাডায় গম চাষকে কেন্দ্র করে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফার্ম গড়ে উঠেছে  এবং প্রতি বছরে ত্রিশ মিলিয়ন মেট্রিক টন গম উৎপাদিত হয়ে থাকে যা নিজ দেশের ব্যাহার ছাড়াও  বহির বিশ্বে রপ্তানি করা হয়।

উইন্টার হুইট সম্পর্কে আমরা আগে কিছুটা ধারণা পেয়েছি। উইন্টার হুইট ছাড়াও  কানাডার কৃষকগণ আরো বহু শ্রেণীর গম চাষ করে থাকেন যার মধ্যে ওয়েস্টার্ন কানাডার প্রভিন্স যেমন মানিটোবা, সাস্কাচুয়ান, আলবার্টা প্রভৃতি প্রভিন্সগুলোতেই দশ শ্রেণীর এবং  ইস্টার্ন কানাডাতে সাত শ্রেণির গম আবাদ করতে দেখা যায়। এসবের মধ্যে তিনটি বিশেষ্য শ্রেণির গমের উল্লেখ করা যাতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে  Canada Western Red Spring (CWRS) যা বসন্তকালে চাষ করা হয়।  উচ্চমানের প্রোটিনের জন্যে এই শ্রেণীর জমি বিশেষ জনপ্রিয়। এই শ্রেণির গম দিয়ে ব্রেড, নুডলস ইত্যাদি তৈরি করা হয়। অন্টারিও, কুইবেক, এবং আটলান্টিক প্রভিন্সগুলোতে Canada Eastern Soft Red Winter (CESRW) wheat শ্রেণির গম আবাদ করা হয়। এই জাতের গম স্টেম রেস্ট রোগ প্রতিরোধী এবং এই শ্রেণীর গম দিয়ে  কেক, সিরিয়াল, ক্রেকার্স, বিস্কিট ইত্যাদি তৈরী করা হয়। Canada Western Amber Durum (CWAD) নামের উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের আরেক শ্রেণির গম রয়েছে যা পাস্তা তৈরির জন্যে পৃথিবীব্যাপী বেশ জনপ্রিয়। মানিটোবা, সাস্কাচুয়ান , আলবার্টা প্রভিন্সগুলোতে প্রতিবছর পাঁচ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে এই শ্রেণীর জমির চাষ করা হয় যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়ে থেকে। 

বার্লি অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল, যা কানাডায় গমের পরেই দ্বিতীয় দানাদার ফসল (grain crop) হিসেবে  ব্যাপক ভিত্তিতে চাষ করা হয়। কানাডায় প্রতিবছর নয় মিলিয়ন টন বার্লি উৎপাদিত হয় যা কানাডাকে পৃথিবীর মধ্যে ৫ম বৃহত্তম বার্লি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবি পরিচিতি এনে দিয়েছে। এছাড়াও, বার্লি মল্ট রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে কানাডা ৩য় বৃহত্তম দেশ। সুপ্, স্ন্যাক্স, সিরিয়াল, বিয়ার মদ  প্রস্তুতিতে বার্লির ব্যবহার ছাড়াও  পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যর্লি ব্যাপক হরে ব্যাবহৃত হয়।

গম ও বার্লির পরে Corn বা মেইজ কানাডার ৩য় বৃহত্তম মূল্যবান  শস্য। সরকারি একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে ২০১১ সালে কানাডা ১০.৭ মিলিয়ন টন উৎপাদনের মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বে ১১তম স্থানে ছিল। কর্ন কানাডার প্রায় সব প্রভিন্সেই উৎপাদিত হলেও প্রায় ৯৬% উৎপাদিত হয় ইস্টার্ন কানাডার প্রভিন্সগুলোতে, ৬৩% উৎপাদিত হয় ওন্টারিওতে, এবং ৩৩% উৎপাদিত হয় কুইবেকে।

পশুসম্পদ (livestock) কানাডার কৃষির আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য সফলতার দিক যা ব্যাপকভাবে কানাডার অর্থনীতি, খাদ্যের যোগানে ভূমিকা রেখে আসছে। পশুসম্পদভিত্তিক কানাডাতে বিভিন্ন ধরণের  খামার দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, গবাদিপশু খামার (cattle farm) যেখানে মাংস এবং দুগ্ধ উভয়ই উৎপন্ন হয়; শুকরের খামার (pig farm), হাঁস-মুরগির  খামার (poultry farm ) যেখানে মাংস ও ডিম উভয়ই উপন্ন হয়। এ ছাড়াও  ভেড়া, ছাগল, শুকুরের  ফার্ম পুরো কানাডা জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। Canadian  cattle  Association এর ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে কানাডার জিডিপি-তে বছরে চব্বিশ মিলিয়ন ডলার শুধুমাত্রগবাদি পশু সেক্টর থেকেই  আসে।

শস্য এবং পশুসম্পদের মতো কানাডার কৃষিতে মৎস্যসম্পদ বা  ফিসারিজ এর অবদানও উল্লেখ্যযোগ্য। কানাডার কোল ঘেঁষে  আটলান্টিক, প্রশান্ত এবং আর্কটিক মহাসাগরের উপকূলরেখা বয়ে গেছে যা সামুদ্রিক মাছ শিকারের এক বিরাট ভান্ডার। সামুদ্রিক মাছগুলোর মধ্যে যে মাছগুলো বেশি পাওয়া যায় সেসব হচ্ছে cod, haddock, halibut, tuna, salmon, shellfish (lobster, crab, shrimp)  ইত্যাদি। মেরিন ফিসারিজ এর মতো ফ্রেস ওয়াটার ফিসারিজও কানাডার ফিসারিজ সেক্টরকে সমৃদ্ধ করেছে। সরকারি হিসেবে অনুযায়ী কানাডায় যত লেক রয়েছে (৫৬৩টি লেক ১০০ বর্গ কিলোমিটারের উপরে) পৃথিবীর মধ্যে অন্যকোনো দেশে তা নেই। লেক, নদী ও উপত্যকার ফ্রেস ওয়াটারে পাওয়া মাছগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো: trout, walleye, pike, and whitefish ইত্যাদি। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০২১ সালে কানাডার জিডিপি তে ফিসারিজ সেক্টর থেকে এসেছে ২.৬ বিলিয়ন ডলার।

https://agriculture.canada.ca/en/sector/overview ঠিকানার সরকারি ওয়েবসাইট থেকে আরেকটি চমৎকার তথ্য দিয়ে আজকের এই লেখাই উপসংহার টানবো। বাহির থেকে কানাডার শীত নিয়ে আতংকিত হয়ে যারা ভাবছেন এই ঠান্ডার দেশে কৃষির অস্তিত্ব নেই, তাঁরা হয়তো শুনে অবাক হবেন, ২০২২ সালে সমগ্র কানাডার এগ্রিকালচার এন্ড এগ্রি-ফুড -সিস্টেম ২.৩ মিলিয়ন ব্যাক্তিকে চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছিলো যা হিসেবে দাঁড়ায় কানাডাতে প্রতি নয় জনের একজন,  ১৪৩.৮ বিলিয়ন ডলার এর ক্ষেত্র তৈরি করেছিল  যা কানাডার জিডিপির ৭%। সুতরাং, অনুমান  নয়, আসুন প্রচন্ড ঠান্ডার চ্যালেঞ্জের মাঝেও উন্নত প্রযুক্তির দেশ কানাডার কৃষি সম্পর্কে আরও অবাক করা সব তথ্য জেনে নিয়ে কৃষকদের উৎসাহ দেই, ‘এগিয়ে যাও কানাডার কৃষি’। 

সহায়ক সূত্র

  1. https://www.turkeyfarmersofcanada.ca/
  2. https://www.statista.com/statistics/453587/area-of-pumpkins-harvested-in-canada/#:~:text=This%20statistic%20shows%20the%20area,pumpkins%20harvested%20the%20previous%20year.
  3. https://www.statcan.gc.ca/o1/en/plus/3107-winter-wheat-grain-grows-beneath-snow
  4. (https://www.canada.ca/en/services/environment/our-environment/nature-based-climate-solutions/grasslands.html)
  5. https://whataboutwheat.ca/canadian-wheat/wheat-in-canada
  6. //www.allianceseed.com/varieties/canada-western-amber-durum/
  7. (https://cerealscanada.ca/barley/#:~:text=Canadian%20farmers%20produce%20roughly%20nine,variety%20of%20trade%20related%20issues.
  8. https://www.canada.ca/en/environment-climate-change/services/water-overview/sources/lakes.html