কানাডায় সুরসঙ্গম

সোনালী রায়

সংস্কৃতির অন্য যে কোনো শাখার মতো সঙ্গীত এবং তার বিবর্তন  সমাজ এবং বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত। কানাডার সাঙ্গিতিক ঐতিহ্য গঠনে প্রাথমিকভাবে নেটিভ কানাডিয়ান, আইরিশ, ব্রিটিশ ও ফরাসি প্রত্যেক জাতির অভিবাসীদের অবদান অনন্য ও অনস্বীকার্য। ভৌগোলিক অবস্থানের নৈকট্যের কারণে মার্কিন সংস্কৃতির প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী কালে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ কানাডায় অভিবাসী হয়ে এসে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেছেন। এভাবেই বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গমস্থল হয়ে উঠেছে কানাডা। ফিরে দেখা যাক কীভাবে নেটিভ কানাডিয়ানদের দেশ থেকে কানাডা হয়ে উঠলো  বিশ্বমানবের দেশ এবং বিশ্বসঙ্গীতের  আধার।

নেটিভ কানাডিয়ান মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফার্স্ট নেশন গোষ্ঠী মূলত বেশ কিছু উপগোষ্ঠীর সমন্বয় , যাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সাঙ্গিতিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান – যদিও বেশ কিছু সাদৃশ্যও লক্ষ্য করা যায়। যেমন সঙ্গীতের উপলক্ষ্য, যা সামাজিক বা পারিবারিক হতে পারে। সামাজিক অনুষ্ঠানে নাচ ও বাদ্যযন্ত্রের (rattle, ড্রাম) ব্যবহার করা হয়। পারিবারিক অনুষ্ঠানে কণ্ঠসঙ্গীতই মূল উপাদান। এরা নিজেদের বাদ্যযন্ত্র নিজেরাই তৈরি করত। জন্তু জানোয়ারদের শিং, লাউ জাতীয় উদ্ভিজ্জ পদার্থ, এমন কি বিশেষ কিছু গাছের বাকল দিয়ে তৈরি হতো তাদের বাদ্যযন্ত্র। এদের কাছে সঙ্গীত পবিত্রতার প্রতীক। ইনুইট গোষ্ঠী মূলত কানাডার উত্তরাঞ্চলের অধিবাসী। এদের সঙ্গীত নৃত্য প্রধান।  শিকার, জুয়াখেলা, আবহাওয়া এ সবে অনুকূল পরিস্থিতির কামনাই ছিল এদের সঙ্গীতের মূল উৎস। বিংশ শতাব্দী থেকে এদের সঙ্গীতে স্কটিশ ও আইরিশ নাবিকদের এবং আমেরিকার লোকসঙ্গীত (country music) এর প্রভাব  লক্ষ্য করা যায়।

 ইউরোপিয়ান অভিবাসীদের আগমনের পর বেশ কিছু সময়ের জন্য নেটিভ কানাডিয়ানদের সঙ্গীতের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এর চূড়ান্ত পরিণাম নির্ভর করেছে নানা বিষয়ের ওপর, যেমন – আপেক্ষিক লোকসংখ্যা, অভিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক, নেটিভ কানাডিয়ানদের  প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদি । 

সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে ফরাসিদের কানাডায় আসার শুরু। তাদের আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ কানাডার সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হতে শুরু করে। ইউরোপিয়ান বাদ্যযন্ত্রের প্রচার, ইউরোপিয়ান সঙ্গীত শিক্ষার প্রচার ও প্রসার এই সময়ে শুরু হয়। 

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ফরাসি ও নেটিভ কানাডিয়ানদের যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এর ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয় এবং সাংস্কৃতিক উন্নতি ব্যাহত হয়। কিছু প্রতিভাবান সঙ্গীত রচয়িতা তখনও তাদের কাজ অব্যাহত রাখেন, যদিও তাদের জীবিকা নির্বাহের  জন্য অন্য বৃত্তি খুঁজে নিতে হয়। এই সময়ে প্রচলিত গীত বা নৃত্য লোকমুখে ছড়িয়ে যাওয়ার চল ছিল, এক প্রজন্ম শিখে নিতো তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে। লিখিত বা মুদ্রিত সঙ্গীতের তেমন কোন চল ছিল না, মানুষ তার প্রয়োজন ও উপলব্ধি করেনি। ব্যতিক্রম ছিল অভিজাত  শ্রেণি যারা সঙ্গীত শিক্ষা বা সঙ্গীত সৃষ্টিকে উন্নত রুচির পরিচায়ক হিসেবে মনে করতেন এবং মুদ্রণ ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। মুদ্রণ শিল্প ততদিনে ইউরোপে যথেষ্ট সমৃদ্ধ, কিন্তু কানাডায় এই শিল্পের প্রসার হয় অনেক পরে, উনিশ শতকে। যুদ্ধ শুরুর  কয়েক বছর পর থেকে নিয়মিত  সংগীতানুষ্ঠান সাংস্কৃতিক পটভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। অপেরা ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে।  কানাডার নিজস্ব অপেরা মঞ্চস্থ হয় এই সময়ে।   

উনিশ শতকের প্রথম দিকে  বিপুল সংখ্যক  ব্রিটিশ ও আইরিশ  কানাডায় চলে আসে এবং বসবাস শুরু করে। এই অভিবাসনের সঙ্গে সঙ্গে কানাডিয়ান সাঙ্গিতিক পরিমণ্ডল প্রসারিত হতে থাকে। বিখ্যাত সঙ্গীত লিপির মুদ্রণ শুরু হয় সঙ্গীত  শিক্ষাপদ্ধতির একটি আবশ্যক অঙ্গ হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হতে লাগলো নতুন নতুন সঙ্গীত। সাময়িক পত্রিকা, স্থানীয় সংবাদপত্রে সেই সব সঙ্গীত প্রকাশিত হতে লাগল।  উনিশ শতকের মাঝামাঝি গ্রামোফোন যন্ত্রের   উদ্ভাবন ও জনসমাজে প্রচলনের অল্প সময়ের মধ্যেই সঙ্গীত মুদ্রণের পাশাপাশি রেকর্ড ও প্রকাশিত হতে শুরু হয়। বিশিষ্ট কানাডিয়ান সুরস্রষ্টা রবার্ট নেথেনিয়াল ডেটের সৃষ্ট বহু সঙ্গীত  ব্রিটিশ ও মার্কিন শিল্পীদের পরিবেশনায় এই সব রেকর্ডে প্রকাশিত হয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে যে কোনো যুদ্ধই অনেক সৃষ্টিশীলতার জন্ম দিয়েছে। কানাডাও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক কানাডিয়ান গীতিকারদের দ্বারা রচিত ও প্রকাশিত হয় বহু গান  যেগুলি বাণিজ্যিক সাফল্যও লাভ করে। সামরিক বাহিনীতে তৈরি হয় কুচকাওয়াজের উপযুক্ত গান যা উদ্দীপনা  বাড়িয়ে দেয় সৈনিকদের মধ্যে। পাশাপাশি তৈরি হতে থাকে কানাডার প্রথম নিজস্ব রেকর্ড লেবেল কম্পো কোম্পানি। শুরু হয় কানাডার প্রথম রেডিও স্টেশন। কিছুদিনের মধ্যেই রেডিও স্টেশনের সংখ্যা একটি থেকে বেড়ে হয় ৩৪। সেই সঙ্গে শুরু হয় জ্যাজের জনপ্রিয়তা। এই সময়ে উঠে আসা উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যান্ড Winnipeg Jazz Babies এবং Westmount Jazz Band of Montreal। এর অব্যবহিত পরেই প্রচারের আলোয় আসেন Ellis McLintock, James Davidson, Mart Kenney মানের জ্যাজ শিল্পীরা। ১৯৩০ এর গ্রেট ডিপ্রেশনের  সময়ে  অধিকাংশ কানাডিয়ানদের পছন্দের তালিকার প্রথম সারিতে ছিল সুইং – এক বিশেষ ধরণের জ্যাজ  সঙ্গীত। এই সময় থেকেই জনপ্রিয়তার নিরিখে  কানাডিয়ান  সঙ্গীত মার্কিন সংগীতের সমতুল্য বিবেচিত হয়। কানাডিয়ান অপেরা আন্তর্জাতিক অপেরা হাউসে প্রদর্শিত হয়। অপেরা গায়িকা পোর্শিয়া হোয়াইট আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন এবং কানাডা গভর্নমেন্ট কর্তৃক জাতীয় উপাধিতে ভূষিত হন।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কানাডিয়ান ব্যান্ডের বিকাশ শুরু হয় প্রাথমিকভাবে স্কুল ব্যান্ড থেকে।  স্কুল পর্যায়ে বাদ্যযন্ত্র শিক্ষার প্রচলন ব্যান্ডের অগ্রগতির একটি বড়  কারণ।  রক এন্ড রোল কিশোর আইডল  Paul Anka র গাওয়া “Diana”  যা  সঙ্গীত ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রির একটি অন্যতম উদাহরণ। আমেরিকার বিখ্যাত  রক এন্ড রোল গায়ক   Ronnie Hawkins ১৯৫৮ এ  কানাডায় পাকাপাকিভাবে চলে আসেন এবং  এখানকার  রক এন্ড রোল জগতের মধ্যমনি হয়ে ওঠেন। 

ষাটের দশকের শেষে আমেরিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক রাষ্ট্রনীতির  কারণে  সাধারণ মানুষের মধ্যে যে অসন্তোষ ও অস্থিরতা দেখা দেয় তারই প্রতিফলন দেখা যায় তৎকালীন সঙ্গীত জগতেও।  গানের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে  ভিয়েতনামের যুদ্ধ, সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, নারীবাদের উত্থান। এই সময়ে  কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে  আইনি শর্ত আরোপ করা হয় এই মর্মে যে  AM রেডিও স্টেশন থেকে নির্বাচিত ৩০ শতাংশ গান  কানাডিয়ান বিষয় নির্ভর হতে হবে।  একই মর্মে  কানাডিয়ান একাডেমী অফ ফাইন আর্টস থেকে জুনো   অ্যাওয়ার্ডস চালু করা হয় কানাডিয়ান শিল্পীদের উৎসাহিত ও বিকাশের সহায়তা করার  জন্য।

 বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষের জীবন যাত্রার মান ও গতি বদলায়। আশির দশক তেমনটাই  প্রত্যক্ষ করলো, সেই সঙ্গে আরো দেখলো যুব সংস্কৃতির বড় পরিবর্তন। হিপ হপ সংস্কৃতির আধিপত্য ঘটলো সমাজে।  আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলো সেই সময়ে, মিউজিক ভিডিওর প্রচলন যা সংগীতশিল্পীদের সুযোগ করে দিলো শ্রোতাদের কাছে তাদের সৃষ্টিকে পৌঁছে দেবার। বিংশ শতকের শেষভাগে আরেকটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন – মহিলা সংগীতকারদের আর্থিক, গুণগত ও সামাজিক অবস্থানের উন্নতি।  ফলশ্রুতি হিসেবে  আমরা পাই Celine Dion , Shania  Twain-র  মতো শিল্পীদের, যারা বিশ্বের দরবারে কানাডার সঙ্গীতকে পুরোভাগে নিয়ে এসেছেন।   

বিংশ শতকের মাঝামাঝি ক্যারিবিয়ান সঙ্গীত   বিশেষত সোকা ও ক্যালিপ্সো এই দুই ধারার সঙ্গীত বিশেষ ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নিউ ইয়র্কের সিটি ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের ক্যারিবিয়ান রেডিও স্টেশন সম্পর্কে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত সেখানকার স্থানীয় ক্যারিবিয়ান সম্প্রদায়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে।  সেই সময়ে কানাডা র বিভিন্ন রেডিও চ্যানেল এই সঙ্গীতকে অক্ষুন্ন মর্যাদায় প্রচারের দায়ভাগ তুলে নেয়। এর অব্যবহিত পরে বেশ কিছু বিশিষ্ট ক্যারিবিয়ান শিল্পী কানাডায় চলে আসেন এবং পাকাপাকিভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমানে এই সঙ্গীত শুধু তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার পাশাপাশি  মূলধারার ও বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অভিবাসী শ্রোতাদের মধ্যেও  জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ।

কানাডায় চিনা সংগীতের আগমন ঘটে ১০০ বছরের ও বেশ কিছু আগে, মূলত খনি  ও বিভিন্ন  শাখার শ্রমিকদের বিনোদনের উদ্দেশ্যে।  বিগত ৪০-৪৫ বছর ধরে ক্রমবৃদ্ধিমান চিনা অভিবাসনের ফলস্বরূপ  সেদেশের বহু বিশিষ্ট  সংগীতবিদ কানাডায় পাকাপাকি ভাবে আস্তানা গাড়েন।  কানাডার বিভিন্ন শহরে চাইনিজ ensemble  গড়ে ওঠা ছাড়াও ভিন্ন সংস্কৃতি র সঙ্গীতধারার সঙ্গে বহু যৌথ প্রকল্পের কাজ  চলেছে এবং চলছে। 

কানাডায় ভারতীয়দের অভিবাসন শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। এই অভিবাসীরা ছিলেন প্রধানত শিখ পাঞ্জাবি। ষাটের দশক থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে উচ্চশিক্ষিত  বিভিন্ন পেশার মানুষেরা  কানাডায় চলে আসতে শুরু করেন পাকাপাকিভাবে। এদের অধিকাংশই  পেশাগতভাবে সাফল্য লাভ করেন  এদেশে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এই সাফল্য প্রতিফলিত হয়। ক্রমে এই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের উপযোগী করে তোলার পাশাপাশি  তারা নিজ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চর্চা ও পালন  করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন বিশেষত পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে। পাঞ্জাবি লঘুসংগীত ভাংড়া র পাশাপাশি ভারতীয় মার্গ সংগীতের চর্চা, প্রচার ও প্রসার হতে থাকে।  বিশিষ্ট শিল্পী ও সংগীতকাররা আমন্ত্রিত হয়ে আসেন সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য।  হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটিক, এই দুই শাখার  উচ্চাঙ্গ সংগীতের  উন্নত মান, গভীরতা ও আধ্যাত্মিকতা দেশ জাতি নির্বিশেষে জনমানসকে স্পর্শ করে। ইউরোপিয়ান উচ্চাঙ্গ সংগীতের পাশাপাশি ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কানাডার বিদগ্ধ শ্রোতাদের মাঝে তার যোগ্য স্থান করে নিয়েছে।

কানাডার মতো এত বৈচিত্রময় ও সমৃদ্ধ সঙ্গীত সম্ভার পৃথিবীর যে কোনো দেশেই দুর্লভ। এই সম্ভারে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সঙ্গীত ধারা তাদের বৈশিষ্ট্য বজায়  রাখে, প্রয়োজনমতো সংমিশ্রিত (fusion)ও হয়।  তৈরি হবে আরো নতুন পথ, নতুনতর সঙ্গীত, যা বিশ্বের সঙ্গীত দরবারে কানাডার জন্য রচনা করবে  এক নতুন আলোকিত আসন।