কানাডায় বিজ্ঞান: কিছু কথা

জান্নাতুল নাইম

উন্নত জীবন ব্যাবস্থায় বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কানাডা সরকার সব সময় অনুধাবন করে এসেছে। বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসেবে কানাডা সুপেয় পানির যেমন ভাগ্যপ্রসন্ন দেশ তেমনি অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদেও। OECD (Organization for Economic Co-operation and Development) দেশগুলোকে মধ্যে কানাডা হলো দ্বিতীয় রাংকিং এ আইস্ল্যাণ্ড এর পরেই যার মাথাপিছু পানি ব্যবহার হার হিংসাত্মক পর্যায়ে। এসব বিষয় মাথায় রেখে কানাডা বিজ্ঞানেও লিডিং রোলে অৰ্থাৎ নেতৃত্বের অবস্থানে আছে. অর্থনীতির পাশাপাশি উন্নত জীবনের বড়ো হাতিয়ার যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার সেটা কানাডা শুরু থেকেই বুঝে বিজ্ঞানকে কাজে লিগিয়েছে নানা ক্ষেত্রে। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট খাতকে প্রাইভেট সেক্টরে এনে কিভাবে তার বাস্তবিক প্রয়োগ বৃদ্ধি করে সবচেয়ে কর্মক্ষম , ও পেশাগতভাবে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায় তার একটা প্রজেক্ট হাতে নেয়। ২০০৭ সালের বাজেটে ১.৯ বিলিয়ন ডলারের এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য ছিল কানাডাকে ওয়ার্ল্ড লিডার বানিয়ে বর্তমান বিশ্বকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে লিড দেয়া অর্থাৎ পথ প্রদর্শকের দায়িয়েত্বে এদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা।

কেন কানাডা এমন চিন্তা করলো এবং এখনো করে তার যথেষ্ট কারণ যেমন আছে তেমন প্রমানও আছে, যদি একটু খতিয়ে দেখা যায় তবে দেখবে কানাডা ডায়াবেটিকস এর ইন্সুলিন, মোবাইল ফোন ব্ল্যাকবেরি থেকে শুরু করে স্পেস স্টেশন অর্থাৎ স্যাটেলাইটে প্রযুক্তিতে কানাডার ভূমিকা অগ্রগণ্য। নীরবে মৃত্যু ব্যাধি ডায়াবেটিকস এ আক্রান্ত মানুষের জীবনের অত্যান্ত জরুরি ওষুধ ইন্সুলিন আবিষ্কার বিশ্বের মিলিয়ন মিলিয়ন জনগণের জীবন রক্ষা করেছে ও জীবনযাপনে বিশেষ পরিবর্তন এনেছে। ফলে নতুন এই প্রজেক্টে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশীপ বিনিয়োগে কানাডা সরকার গবেষণা ও প্রযুক্তিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে কৌশলগত পরিকল্পনা হাতে নেয়। যার মধ্যে ওয়ার্ল্ড ক্লাস গবেষণায় কানাডিয়ান সামাজিক অবস্থা , পরিবেশগত বসবাসের সুবিধা এবং  অর্থনৌতিক উন্নতির ফ্যাক্টরগুলো বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। জি -সেভেন দেশের মধ্যে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট এর উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক কাটিং এইজ গবেষণার অবকাঠামো তৈরী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নত যন্ত্রপাতিসহ সকল সুবিধা প্রদানের জন্য বিনিয়োগ করে, তাতে প্রাইভেট ফ্যাসিলিটিগুলোতে ফেডারেল ট্যাক্স কমিয়ে আনার পাশাপাশি ব্যাক্তিগত ট্যাক্সও হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়।

২০০৭ সালের কানাডা গভর্নমেন্টের এটি ছিল একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ যে কানাডা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কিভাবে উৎসাহিত করে.আসছে। কানাডা সরকারের এধরণের প্রচেষ্টা অব্যহত আছে বিধায় টপ নোচ প্রযুক্তিতে কানাডা বিশ্বে যথেষ্ট এগিয়ে আছে। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ছাড়াও আধুনিকায়ন প্রক্ক্রিয়া সব সময় অব্যাহত আছে, যার ফলসরূপ কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্দালয়ের অবস্থান ওয়ার্ল্ড রাংকিং এ একশ এর মধ্যে স্থান করে থাকে,

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আধুনিক প্রচেষ্টাগুলোর ব্যাবস্থাপনায় প্রভিন্সিয়াল টেরিটোরিয়াল পার্টনারশীপ বৃদ্ধি করা ,  বুধ্ধিমান ও জ্ঞানী ছাত্রদেরকে প্রযুক্তিতে শক্তিশালী করা এবং গ্লোবালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে OECD দেশ ও আন্তর্জাতিক অগগ্রগন্ন দেশগুলোকে সাথে পার্টনারশিপে কাজ করা. সেক্ষেত্রে OECD দেশের সাথে মেট্রিকস উন্নয়ন ও বেঞ্চমার্কিং জরুরি করার লক্ষে কাজ করা বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হয়।

এবার পুরো কানাডা জুড়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বিখ্যাত কয়েকজন কানাডিয়ান নাগরিকদের কিছু তথ্য তুলে ধরা যাক।

ত্রিশ বছর পালন হিসেবে কানাডা এনসাইক্লোপিডিয়া ত্রিশ জন বিজ্ঞানী নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরী করেছিল যার রেফারেন্স নিচে  দেয়া হলো, এটুকু না বললেই না যে আমাদের প্রত্যেকেরই কানাডিয়ান হিসেবে গর্ববোধ করার অনেক কিছুই আছে।

প্রথমেই যার নাম বলবো তিনি হলেন আব্রাহাম জেসনের যিনি আধুনিক পেট্রোলিয়াম ইন্ডাস্ট্রির জনক এবং যিনি কেরোসিন তেল আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ছিলেন একধারে একজন মৃত্তিকা বিজ্ঞানী , একজন কেমিস্ট ও একজন লেখক।

আব্রাহাম গ্রোভস যিনি একজন ফিজিসিয়ান ছিলেন। তিনি ষাট বছর মেডিকেল প্র্যাক্টিসের সময়ে অপেনডেক্টমি (appendectomy) সফলতার সাথে চর্চা করেছিলেন।  তার সময়ে এ মেডিকেল টুলস স্টেরিলাইজিঙ স্ট্যান্ডার্ড প্রাকটিস এ পরিণত হয়।

আদ্রিয়ান পৌলিত, তিনি ছিলেন একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার ও গণিতবিদ।

আগ্নেস শার্লট হিগিন্স ছিলেন একজন নিউট্রিশনিস্ট এবং তিনি হিগিন্স পদ্ধতি নাম একটি নিউট্রিশন প্রোগ্রাম চালু করেন যা গর্ববতী মায়েদের জন্যে নিজের ও নুতন শিশুর স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করেন।

অ্যালেন নিউটন ক্যাম্পবেল কেমিস্ট ছিলেন যিনি গবেষণা করেন ইলেক্ট্রোলাইটিক দ্রবনের বিদ্যুৎ প্রবাহ ধর্ম।

আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল যাঁকে টমাস আলভা এডিশন এর পর  ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দ্বিতীয় বিজ্ঞানী বলা যায়।  তিনি টেলিফোনের আবিষ্কারক ছাড়াও বধির জনগণের জন্যে কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি স্কটল্যান্ডএ জন্মগ্রহণ করলেও পরে পিতা  মাতার সাথে ইমিগ্রেশন নিয়ে আসেন কানাডাতে। তিনি কেপ ব্রেটন আইল্যান্ড, Nova Scotia এ বেদ্দক এর কাছে বিশাল আবাস গড়ে তোলেন। তিনি ও তার পরিবার গ্রীষ্ম কাটিয়েছেন সে বাড়িতে। বর্তমানে বেল  কানাডা হলো কানাডার জয়েন্ট তিনটি টেলিফোন, ইন্টারনেট, মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডার মধ্যে ফাইবার অপটিক্স ও দ্রুতগামী ডাটা সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে সর্বাগ্রে অবস্থান করছে। 

গত বছর আমি আমার পরিবার নিয়ে গিয়েছিলাম এই ঐতিহাসিক জায়গায়, নিজ চোখে তার জাদুঘর , আবিষ্কৃত অনেক মূল্যবান যন্ত্রপাতি, ও তার সমাধি দেখার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। ভালো লেগেছিলো বেদ্দক আবাসিক বিশাল বাড়ি অঞ্চল উপদ্বীপ স্বচক্ষে দেখা পানি ভ্রমণের সময়। এই বিখ্যাত কানাডিয়ান নাগরিক কানাডিয়ান নৌবাহিনীকেও কোচ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।

এলিস এভেনলি উইলসন ছিলেন প্রথম নারী মৃত্তিকা বিজ্ঞানী যিনি কানাডার ফসিল ও  পাথর নিয়ে প্রচুর সার্ভে করেন এবং অধ্যয়ন এর কর্তৃত্ব স্বীকৃতি দেন সেন্ট লরেন্স নদীর উপত্যকা এলাকার। তিনি পুরুষ প্রধান সমাজের নানা বাধা পেরিয়ে নিজের পেশাকে মজবুত আসনে নিতে সমর্থ হন এবং প্রথম নারী সদস্য রয়েল সোসাইটি অফ কানাডা পরিণত হন ১৯৩৮ সালে।

অ্যান্ড্রু ওয়াভের আবহাওয়া বিজ্ঞানী যিনি তার আবহাওয়া বিষয়ক গবেষণার জন্য সুপরিচিত এবং সেই সুবাদে রাজনীতিবিদ হন এবং  ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রভিন্স এর প্রথম গ্রীন পার্টির মেম্বার অফ পার্লামেন্ট (এম এল এ ) হন।

আর্মন্ড ফ্র্যাপিয়ের ফিজিশিয়ান ও মাইক্রোবায়োলোজিস্ট পাবলিক হেলথ এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরেন।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্রিজিং  ব্লাড সিরাম এবং বেশ কিছু ভ্যাকসিন তৈরি করেন।

এছাড়াও স্টেম সেলের আবিষ্কার, প্লেট টেক্টোনিক,  কম্পিউটারাইজড আবহাওয়া  ফরকাস্টিং , CCD CHIPS আবিষ্কার, ব্রেন এর ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স ম্যাপ করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। 

এবার কিছু বিখ্যাত কানাডিয়ান অস্ট্রোনট প্রসঙ্গ ও  সেইসব মহান মানুষের কথা বলা যাক।

জাতীয় গবেষণা পরিষদ কানাডা কার্যক্রম ১৯৮৩ থেকে এ পর্যন্ত ১৪ জন অস্ট্রোনট প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন ও নয় জন স্পেস অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন মিশনে নাসা (NASA) ও আই এস এস (ISS) প্রজেক্টে।  কানাডার্ম ও কানাডার্ম-২ রোবটিক প্রযুক্তিতে কানাডা খুবই সাফল্যজনকভাবে কাজ করে চলেছে।

একটু পিছে গেলে দেখতে পাই প্রথম কানাডিয়ান তৈরী স্যাটেলাইটে Alouette 1, স্পেস এ যাত্রা শুরু করে ১৯৬২ সালে করে তারপর এক যুগের বেশি অন্তর ১৯৮৩ সালে প্রথম কানাডিয়ান অস্ট্রোনট গ্রুপ নির্বাচিত হয়। সাতজন অস্ট্রোনট এর মধ্যে ক্রিস হাডফিল্ড, জুলি পাইয়েট, মার্ক গার্নাও, রবার্ট তিরস্ক, ডেভ উইলিয়ামস, বিজার্ণি ট্রিগ্যভাসন ও স্টিভ ম্যাকলিন ছিলেন এবং দ্বিতীয় গ্রুপেও ক্রিস হাডফিলড, জুলি পাইয়েট ও ডেভ উইলিয়ামস স্থান করে নেন ১৯৯৭ সালে। জুলি পাইয়েট, একজন কম্পিউটার ভাষা স্বীকৃত গবেষক ছিলেন তিনি পবর্তীতে একজন গভর্নর জেনারেলও নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাইকেল ম্যাককি, রোবোটিক ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বিশেষ ভূমিকা রাখেন কানাডার্ম পরিচালনায়।    

পরবর্তীতে তৃতীয় ২০০৮ ও চতুর্থ গ্রুপ ২০১৬ সালের নির্বাচনে বারোজন অস্ট্রোনট নাসা টিমে কাজ করার সুযোগ লাভ করে। যার মধ্যে ২০১১ সালে ডেভিড সেন্ট জ্যাকুই এ জেরেমি হ্যানসেন মুক্ত আরোহন ও অবতরণ পরীক্ষায় সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। সাম্প্রতিক জশুয়া কুট্রিক ও জেনী গীবনস পরবর্তী অস্ট্রোনট হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

কানাডা সবচেয়ে সাফল্য অৰ্জন করেছে রোবটিক আর্ম টেকনোলজিতে যার জন্য কানাডা ভুবন বিখ্যাত হয়েছে। ত্রিশ বছরেরও অধিক সময়ে ধরে কানাডা এই রোবোটিক আর্ম সেক্টরে অবদান রাখছে স্পেস শাটল মিশন ম্যানেজমেন্ট এ। কানাডা অস্ট্রোনট টীম ডিসাইন, কনস্ট্রাকশন , টেস্টিং , অপারেশন্স শেষ করে প্রথমবারের মতো স্পেস স্টেশন এ স্থাপন করে নভেম্বর ১৩, ১৯৮১ সালে। কমিশনিং শেষ করে কানাডার্ম নাসা আরো চারটা রোবটিক আর্ম প্রজেক্ট দেয় যেগুলো ম্যাকডোনাল্ড , দেত্ত্বিলের এন্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড নাম পরিচিত আছে..

কানাডার্ম এর উল্লেখযোগ্য ব্যবহারগুলো হলো:

১) স্যাটেলাইট কে অরবিতে পাঠানো

২) স্যাটেলাইট রিপেয়ার করা

৩) ISS অন্যানো আরমগুলো একত্ৰিত করা

৪) স্পেস ওয়াক করার সময়ে অস্ট্রোনটকে সাহায্য করা

৫) আইমাক্স ক্যামেরা ব্যবহার করে ফিল্ম তৈরী করা

৬) অরবিটার বুম সেন্সর সিস্টেম এর মাধ্যমে স্পেস শাটল এর তাপীয় সিস্টেম সুরক্ষা করা

কানাডিয়ান অস্ট্রোনট ও তাদের জীবন ব্যবস্থা, অভিজ্ঞতা , চ্যালেঞ্জেস বিষয়গুলো আরো অনেক ডিটেল জানার সুযোগ হলে দেখা যাবে আমরা কানাডিয়ান নাগরিক বিজ্ঞানে যেমন এগিয়ে গিয়েছি তেমনি বিজ্ঞান প্রযুক্তিতেও।

রেফারেন্সেস:

১. https://www.thecanadianencyclopedia.ca/en/browse/people/science-technology

২. https://www.thecanadianencyclopedia.ca/en/article/30-scientists

৩. https://ised-isde.canada.ca/site/plans-reports/en/science-and-technology-strategy/mobilizing-science-and-technology-canadas-advantage

৪. https://www.groundwatercanada.com/canada-second-among-oecd-countries-with-most-significant-water-resources-per-capita/#:~:text=Canada%20ranks%20second%20in%20the,of%20water%20resources%20per%20capita.