কানাডায় একাকীত্ব – এক নিরব মহামারী

সুশীল কুমার পোদ্দার

কেউ কি আছ? এক বিশাল বাড়ীর প্রাচীরে প্রতিফলিত হয়ে আমার কথাগুলো ফিরে ফিরে আসে। অবিন্যস্ত বাগানের বৃক্ষ-লতারা আমার দিকে বিহ্বল হয়ে থাকিয়ে থাকে। অদূরে ঝাউ গাছগুলো বাতাসে দুলে  মাথা নাড়িয়ে বলে – নেই, কেউ নেই, এখানে কেউ থাকে না।

গ্রীষ্মের তাপস্পর্শে এখানে সেখানে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে বেশ কিছু সতেজ পিয়নি। মাথায় তাদের ফুলের উদ্ভাস। আমরা একদিন এ পথ দিয়ে যেতে ওর মনোলোভা সৌন্দর্যের আকর্ষণে বাঁধা পড়েছিলেম। তাকিয়ে ছিলেম  অনেকক্ষণ। কখন যে এক অশীতিপর বৃদ্ধা ঘরের দুয়ার খুলে আমাদের পিছে এসে দাঁড়িয়েছিল বুঝতে পারিনি। ছোট্ট এক কুকুর কেউকেউ করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আমরা বৃদ্ধাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। কঙ্কালসার, চক্ষু কোটরাগত এক স্যাঁতসেঁতে বিবর্ণ মানবী। সে হেসে বলেছিল চারা নেবে? কাঁপতে কাঁপতে হাতে দস্তানা পড়ে স্টোররুম থেকে নিয়ে এসেছিল ট্রয়েল। আমরা তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেম। মলিন হেসে সে বলেছিল, আমাকে করতে দাও, কেউ সাহায্য করলে আমার মনে হয় আমি বেঁচে নেই – এ বিশ্ব জগতের মাঝে আমি এক অবাঞ্ছিত প্রাণী। আমরা বলেছিলেম – এতো বড় বাড়িতে তুমি একা থাক? সে বলেছিল – একা, একা কোথায়? কুকুরটির দিকে তাকিয়ে বলেছিল – এই যে, আমার এক মেয়ে, ঘরে আছে আরেক ছেলে, আর আছে বাগান ভরা বৃক্ষলতা। ওরাই আমায় সঙ্গ দেয়। পায়ের কাছে বসে থাকা কুকুরটি সেদিন আহ্লাদে আবারও কেউকেউ করে উঠেছিল। স্নিগ্ধ এক বাতাস বয়েছিল সেদিন। ঝাউ গাছগুলো সন-সন করে, মাপলের রক্তিম পত্রগুলো মর্মর ধ্বনি তুলে বলেছিল – আপনার চেয়ে পর ভালো, আর পরের চেয়েও বন।

আমরা বলেছিলেম – তোমার নেই কোন আপন জন? বৃদ্ধা তার অঙ্গনের পানে তাকিয়ে থেকে আপন মনে বিড়বিড় করে কোথায় যেন ক্ষণিকের তরে  হারিয়ে গিয়েছিল। দোতলা বাড়ি, চার চারটে গ্যারেজ। এককালে হয়তো যন্ত্র শকটের গর্জনে মুখরিত ছিল তার অঙ্গন। সে বলেছিল – বড় দুই ছেলে এ অনন্তের মাঝে হারিয়ে গেছে, আর বাকীরা থাকে আমেরিকায়। ওরা ওদের নিজের জীবনে ব্যস্ত, সময় করে উঠতে পারে না। তার শেষ অবলম্বন তার স্বামী দুবছর আগে করোনাতে চলে গেছে। আর তার নশ্বর শরীরে বাসা বেঁধেছে দুরারোগ্য ক্যান্সার। আমরা বলেছিলেম – তোমার সন্তান তোমার খোঁজ খবর নেয় না? সে বলেছিল – নেয় তো! ওরা আমায় লং-টার্ম-কেয়ারে অনেকদিন রেখেছিল। ওখানে থাকতে যে আমার মন চায় না !  আমার মন পড়ে থাকে আমার বাড়িতে।  বৃদ্ধা আমাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তার পেছন বাড়িতে। এক বিশাল পুষ্পোদ্যানের মাঝে এক সান-বাঁধানো  বেদীতে ফুলে ফুলে আনত ম্যাগনোলিয়া দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলেম। ম্যাগনোলিয়ার গায়ে এক রেড রিবন – তাতে লেখা – আমি তোমায় ভালোবাসি, আমি তোমার যত্ন নেই। বৃদ্ধা ইশারায় আমাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ম্যাগনোলিয়ার  ছায়াতলে । আমাদের বলেছিল – ওকে জড়িয়ে ধর, দেখ ও তোমাদের সকল কষ্ট, সকল উদ্বেগ দূর করে মনে এনে দেবে এক গভীর প্রশান্তি। আমিও তো আমার যাপিত জীবনের সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা ওকে সঁপে দিয়েছি । মাঝে মাঝে সন্তানদের কথা মনে পড়ে, স্বামীর কথা মনে পড়ে, কষ্টগুলো জমে হয় পাহাড়সম। আমি আমার সব কথা বৃক্ষরাজিকে বলি, জ্যাক আর এরিনাকে বলি। ওরা আমার কথা খুব মন দিয়ে শোনে। জান, আমার এ মেয়েটি আমার মন খারাপ হলেই  বুঝতে পারে। ও দৌড়ে এসে আমার কোলে মাথা গুঁজে খুনসুটি করে, আমি সবকিছু ভুলে যেয়ে আবারও ফিরে আসি আমার যাপিত জীবনে। ওদের জন্য আমার বড়ো কষ্ট হয়। আমি চলে গেলে, ওরা হয়তো আমার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করবে! 

সেদিন বৃদ্ধার চোখে ছিল না কোন কারোর প্রতি অভিযোগ, কোন অনুযোগ।  তারপর তার সাথে আমাদের প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো। তার কুকুরগুলোও আমাদের আপন করে নিয়েছিল। দৌড়ে এসে দু’পা তুলে কি যেন বলতে চাইতো। আমরা ওদের গায়ে হাত রাখতেম, আদর করতেম। বৃদ্ধার অতিশয় প্রশ্রয়ে আপন মনে করে  আমরা চলে যেতেম তার  ম্যাগনোলিয়ার কাছে, তীব্র শীতে ঋজু হয়ে দাড়িয়ে থাকা সর্বংসহা পাইনের কাছে;  ওদের  স্পর্শ করে বলতেম – কিরে কেমন আছিস তোরা? আমার কেন যেন মনে হতো ওরা  আমার কথা বুঝতে পারে।

আমার বাড়ির অনতিদূরে ক্রীক ধরে আঁকাবাঁকা বনপথ পার হতেই তার বাড়ি। পেছনে বয়ে গেছে গ্র্যান্ড রিভার। আমরা তাকে অনেকদিন দেখতে না পেয়ে আনমনে ঘুরে বেড়াই নদীতীরে। নদী বলতে যে এপার নেই ওপার নেই ছায়াচিত্র মনের কোনে ভেসে উঠে, তার ছিটেফোঁটা  কোথাও নেই।  বিভারেরা অপর পারে গাছ কেটে বাসা বেধেছে। শীতের শীর্ণকায় বনভূমি প্রকৃতির আবাহনে সারা দিয়ে মেতে উঠেছে নিরন্তর সৃজনে। সময় নেই, সময় নেই বলে বৃক্ষলতারা হৈহৈ করে এগিয়ে চলেছে আকাশকে ছুঁবে  বলে। আমরা নদী তীরে ঝুঁকে থাকা এক উইলোর ছায়াতলে বসে থাকি। সারা শরীর সবুজে ঢেকে উইলো চেয়ে আছে নদীর জলে। কিছু পত্রগুচ্ছ কী  মনে করে নদীজলে নিমজ্জিত হয়ে তাকিয়ে দেখছে স্রোতের ঘূর্ণাবর্ত । স্রোতেরা এগিয়ে চলছে পাথর খণ্ড পার হয়ে – ঠিক আমাদের জীবনের মতো। প্রবাহমান স্রোতেরা মনের মাঝে খোঁচা দিয়ে  জাগিয়ে তোলে কতো দুঃখময়  হারানো স্মৃতি । নিজকে বড় রিক্ত, বড় নিঃস্ব মনে হয়। এক অব্যক্ত কষ্টবোধ বুদবুদের মতো উঠে আসে অজানা কোন উৎস হতে। এক সর্বগ্রাসী হাহাকার ঘিরে ধরে আমাদের। মনে মনে বলি তাহলে কি বৃদ্ধাকে আমরা ভালোবেসে ফেলেছিলেম? আমরা ফিরে চলি। যাবার পথে মনে হয় সদর দরজায় যেয়ে আঘাত করে বলি – তুমি কি ফিরেছ?

আমরা  ঘুরে যাই বাড়ির সদরে, কোনদিন আসা হয়নি এদিক। বাড়ির সামনে এক বোর্ডে লেখা – নো ট্রেসপাস, প্রাইভেট প্রপার্টি। আমরা থেমে যাই, চোখে পড়ে আরেকটি লেখনি – প্রোপার্টি ফর সেল। মাথার উপর লাল ব্যানারে লেখা – সোল্ড। এ জীবন অনিত্য, এ সংসার অনিত্য  জেনেও মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। আমার জীবনের অনাগত ভবিষ্যৎ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ আমরা দুই বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা। আমাদের সন্তানকে কতো দিন চোখে দেখিনি; মুঠোফোনের পর্দায় দেখতে পেলেও কতদিন ছুঁয়ে দেখিনি। ওরা কর্মসূত্রে বাসা বেঁধেছে দূর কোন শহরে। নিঃসঙ্গতা বাসা বেঁধেছে আমাদের যাপিত জীবনে। রাস্তা ঘাটে লোকজনকে দেখলে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কারোর হাতে সময় নেই। সবাই ছুটে চলেছে সময়ের সাথে।  মাতৃদিবস আসে, আসে পিতৃদিবস। ওরা টেলিফোন করে বলে ‘হ্যাপি ফাদার্স ডে’,’ হ্যাপি মাদার্সডে ডে’। গদবাধা কিছু কথা বলে ওরা কথা হারিয়ে ফেলে। আমরা নিরুপায় হয়ে ফোন রেখে দেই। চোখে জল আসে, ওদেরকে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে সাধ হয়। মুখে হাসি টেনে এনে ওদের মাকে বলি – দেখ, ছেলেপুলে কতো বড় হয়ে গেছে, ওদের নিজের সংসার হয়েছে, ওরা ওদের বাবা-মার কতো খেয়াল রাখে !

হয়তো এমনি করে খেয়াল রাখতে রাখতে একদিন ঘরের কোনে রাখা টেলিফোনটা নিরন্তর বেজে যাবে। সন্তানেরা উত্তর না পেয়ে পুলিশকে খবর দেবে। বাড়ির সামনে এসে হাজির হবে গাড়ি বহর। প্যারা-মেডিকরা নাক চেপে বয়ে নিয়ে যাবে গলিত লাশ। আমরা আকাশ থেকে দেখব আমাদের সন্তানেরা ছুটে এসেছে। তড়িঘড়ি করে ওরা ছুটে যাবে বেড রুমে; চাবি না পেয়ে ভেঙ্গে ফেলবে আলমারির ডালা, উইলের কাগজে ওদের নাম দেখে বার বার নিশ্চিত হয়ে ভেঙ্গে পড়বে মেকি কান্নায়।

আমার  মনোজগতে উদ্ভূত এ অসংলগ্ন চিন্তামালাকে বাস্তবের ভূমিতে দেখতে আমার বড় ভয় হয়, বড় বেশী কষ্ট হয়!  দীর্ঘ প্রবাস জীবনে এমনি কতো ঘটনার সাক্ষী  হয়েও মেনে নিতে বড় বেশি কষ্ট হয়। মনে পড়ে আমার  শাশুড়ি মাতার কথা। বড় সাধ করে নিয়ে এসেছিলেম আমাদের সাথে থাকবে বলে। দেশের আলো হাওয়ায় জড়িয়ে থাকা জীবনাচরণ তিনি এদেশে নিয়ে এসেছিলেন সাথে করে। আমরা তাকে সময় দিতে পারিনি। প্রযুক্তির প্রশ্রয়ে  গড়ে উঠা আমার সন্তানেরা হাই হ্যালো ছাড়া তাকে আর কিছুই দিতে পারেনি। একাকীত্বে তিনি যে ছটফট করতেন তা বুঝতে পারিনি। শূন্য ঘরের জানালায় চোখ রেখে তিনি হারিয়ে যেতেন। একদিন তিনি করুন প্রার্থনা করেছিলেন – আমায় দেশে পাঠিয়ে দাও। আমরা তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেম। তার তৃষিত হৃদয় আপন মাটিতে  শেষ নিঃশ্বাস ফেলবে বলে কতো  না উৎকণ্ঠিত ছিল! 

মলিকুলার পরিবারে বড় হয়ে ওঠা  আমাদের উপমহাদেশের সন্তানেরা তাদের বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে বাবা-মাকে  এই দূর দেশে নিয়ে এসে ছেড়ে দেয় একাকীত্বের মাঝে। তারা ভাবে তারা  তাদের পিতামাতাকে দিয়েছে এক নতুন জীবন, এক সুখের জীবন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পিতামাতার এ সুখের জীবন হয় অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। একাকীত্বের ভারে চুপসে  যায় তাদের জীবন। পার্কের এক কোনে বসে কেমন অসহায় হয়ে আকাশের পানে চেয়ে থাকে। পরিযায়ী মেঘেরা উড়ে যায় মাথার ‘পর, আর যেতে যেতে বলে – মিথ্যে, এই মায়ার বাঁধন, ফিরে যা আপন ঘরে। 

আমি পশ্চিমা বিশ্বের এ জীবনকে, এ জীবনবোধকে মেনে নিতে বড় বেশি দ্বিধান্বিত। কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ ঠাহর করে উঠতে পারিনে। এককালে আমাদের ভারতবর্ষীয় মূল্যবোধে আমরা গর্বিত বোধ করতেম। পিতা-মাতার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে তাদের ছেড়ে দিতেম  ভরা পরিবারের মাঝে । যদিও তারা সেই পরিবর্তিত অবস্থানে অভিযোজিত হতে নিয়ত সমস্যার মুখোমুখি হতো, তবুও তারা সঙ্গ পেত আপনজনের। কিন্তু আজ সব কিছু বদলে গেছে। জীবন, জীবিকা আর প্রযুক্তির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় আজ  পূর্ব পশ্চিমের মাঝে ব্যবধান দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। দিন দিন একাকীত্ব এক নিরব মহামারীর দিকে এগিয়ে চলেছে। আমাদের সুন্দর দেশ কানাডাও এ থেকে পিছিয়ে নেই। এখানে প্রতি পাঁচজনে একজন একাকীত্বের শিকার, আর এর মাঝে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে জীবনের শেষ পর্যায়ে যারা পা রেখেছে এই মাটিতে। এ তো গেল হিসেবের কথা, কিন্তু হিসেবের বাইরে আড়ালে অন্তরালে রয়ে গেছে বিশাল এক  একাকী জনগোষ্ঠী। মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করে আমার দেশের পিতামাতা জীবনের শেষ সম্বল তাদের সন্তানদের হাতে তুলে দিয়ে দুমুঠো ভাতের জন্য পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়। কপাল ভাল থাকলে দুটো খাবার জোটে, চিকিৎসা জোটে, মরণের পর ঘটা করে শেষকৃত্য পালিত হয়; আর যারা দুর্ভাগা তাদের ভাগ্যে জোটে অশেষ গঞ্জনা; চারিদিকে আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত হয়েও তারা হয়ে যায় উপেক্ষিত, যা একাকীত্বের চেয়েও ভয়াবহ। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় উপেক্ষার চেয়ে একাকীত্ব অনেক শ্রেয়। স্বার্থান্বেষী আপনজনের চেয়ে অনেক আপন কুকুর বেড়াল, আর আমায় ঘিরে থাকা বৃক্ষলতা।