কানাডাতে সাম্প্রতিক অভিবাসন ও নানাবিধ সমস্যা
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে সাধারণ মানুষ কানাডা এসেছেন। এই আগমন অব্যাহত আছে। আগমনের মূল উদ্দেশ্য অর্থ উপার্জন। তারপর উন্নত জীবন যাপন এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন।
অনেক আগে থেকেই কানাডাতে লোকজন আসা শুরু হলেও এবারের আগমন কিছুটা ভিন্ন রকমের। সহজে ভিজিট ভিসা পাওয়াকে কেন্দ্র করে আগমনের গতি অধিক বেগবান হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ কানাডা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে থাকেন তা অত্যন্ত ইতিবাচক ও রঙিন। বরাবর স্বপ্নের ও স্বপ্ন-পূরণের দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে কানাডা। একবার ঢুকে যেতে পারলেই হলো! তারপর সবকিছুই সুখকর। কিন্তু বাস্তবে ঠিক এরকম নয়। অনেক কঠিন।
সহজলভ্য ভিজিট ভিসা নিয়ে যারা সম্প্রতি এসেছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগের কাজে কর্মে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। অদক্ষ কর্মী বলা যায়। বিশেষ লেখাপড়াও নেই। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অনেকে জানেন না আবার কেউ কিছুটা জানলেও তা অপ্রতুল। প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করে এবং অনেক কিছু না জেনেই চলে এসেছেন। কঠিন বাস্তবতায় তারা এখন অনেকটাই দিশেহারা ও অসহায় বোধ করছেন।
দেশে যাদের মাধ্যমে তারা এসেছেন তারা একটা ধারণা দিয়েছিল কানাডা এলে আলাদিনের চেরাগের মত সবকিছু পাওয়া যাবে! কিন্তু কিছুই মিলছে না। সবাই এখানে এসেই তড়িঘড়ি করে রিফিউজি ক্লেইম করছেন। তাতেও অনেক খরচ হচ্ছে। তবে লিগ্যাল এইড পাওয়া যায়। অনেকেই যদিও তা জানেন না। তদুপরি ক্লেইম বিষয়ে তাদের পরিষ্কার কোন ধারণাও নেই। কিন্তু ক্লেইম না করলে থাকা যাবে না তা বুঝতে পারছেন।
কানাডা সরকারের তরফ থেকে রিফিউজি এবং মানবিক পুনর্বাসন নামে একটি প্রোগ্রাম আছে। এক্ষেত্রে জানা দরকার কনভেনশন রিফিউজি কী বা কারা? আন্তর্জাতিক জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যিনি রিফিউজি হবার যোগ্যতা রাখেন তিনিই কনভেনশন রিফিউজি হিসেবে গণ্য হবেন। কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জাতিসংঘ কনভেনশন রিফিউজি বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আন্তর্জাতিক জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যারা রিফিউজি হবার যোগ্য, তাদের কনভেনশন রিফিউজি হবার যোগ্যতা কীভাবে নির্ধারিত হয়? যিনি বা যারা নিজ দেশে কোন অন্যায় শাস্তি, হয়রানি এবং ধর্মীয়, রাজনৈতিক বৈষম্য, অত্যাচার নির্যাতন ইত্যাদির শিকার হন এবং প্রাণনাশের আশংকা থাকে এবং সেইসব কারণে নিজ দেশ ত্যাগ করে চলে আসেন। আর ফিরে যেতে ইচ্ছুক নন। তারাই জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী কনভেনশন রিফিউজি। কনভেনশন রিফিউজি ক্লেইম এবং এসাইলাম ক্লেইম মূলত এক জিনিস। যারা রিফিউজি ক্লেইম করবেন তারা কানাডাতে যে এন্ট্রি পয়েন্ট (অর্থাৎ বিমানবন্দর, স্থল বন্দর, নৌ বন্দর) দিয়ে ঢুকবেন সেখানেই ক্লেইম করতে পারবেন অথবা ভিতরে ঢুকে ক্লেইম করতে পারবেন। সম্প্রতি যারা এসেছেন তাদের অধিকাংশ ভিতরে ঢোকার পর ক্লেইম করছেন বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
আইআরসিসি বা ইমিগ্রেশন, রিফিউজি এন্ড সিটিজেনশীপ কানাডা একটি সংস্থার নাম। রিফিউজি ক্লেইমের আবেদনপত্র বা বেসিস অব ক্লেইম আইআরসিসি-তে দাখিল করা হয়। বেসিস অব ক্লেইমের সঙ্গে কাগজপত্র জমা দেয়া লাগে। পরের ষ্টেজে এলিজিবিলিটি টেষ্ট বা যোগ্যতা প্রমাণ। সাধারণত সেখানে একটা ইন্টারভিউ নেয়া হয়ে থাকে। এই টেস্টে প্রাথমিক প্রমাণের দায়িত্ব আবেদনকারীর উপর বর্তায়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্লেইম করার যোগ্য বিবেচিত হলে আবেদনকারীকে দেয়া হবে ফটোসহ একটি সার্টিফিকেট। এর নাম রিফিউজি প্রোটেকশন ক্লেইমেন্ট ডকুমেন্ট। এটি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি একটি দলিল। কোনভাবেই হারানো যাবে না। এটি কানাডা অবস্থানে আপনার স্টেটাস বোঝায়। তদুপরি মেডিক্যাল সুবিধা পাওয়া যাবে।
বেসিস অব ক্লেইমের সঙ্গে ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার জন্য দরখাস্ত করা জরুরি। ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে গেলে কাজ পেতে সুবিধা। সোশ্যাল ইনসুরেন্স নাম্বার আরেকটি জরুরি ডকুমেন্ট। ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে গেলে তা দেখিয়ে সার্ভিস কানাডা থেকে এই নাম্বার সংগ্রহ করতে পারবেন। ট্যাক্স রিটার্নে সিন নম্বর জরুরি। ইতিমধ্যে সার্ভিস ওন্টারিও (যারা ওন্টারিও প্রদেশে আছেন) থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফটো আইডি কার্ড যোগাড় করতে হবে। ব্যাংক একাউন্ট খোলাসহ মোবাইল নাম্বার নেয়াও জরুরি। কাগজপত্র দিয়ে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারে আবেদন করলে মাসিক কিছু অর্থ ও এককালীন কিছু অর্থ ফার্নিচার এবং পোষাক কেনার জন্য পাওয়া যাবে।
এলিজিবলিটি টেস্টে উত্তীর্ন হবার পর কেইস হিয়ারিং এর জন্য ফাইল পাঠানো হবে কানাডার ইমিগ্রেশন এন্ড রিফিউজি বোর্ডের কাছে। একসময়ে কেইস হিয়ারিং হবে। সেখানে কেইস প্রমাণের দায়িত্ব ক্লেইমেন্টের উপরেই থাকবে। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা সারকামষ্টেনসিয়েল এভিডেন্সের উপরও গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে কিছু বেসিক কাগজপত্র তো থাকতেই হবে।
ইদানিং যারা এসেছেন তাদের অনেকের কাছেই কোন কাগজপত্র নেই। হিয়ারিং হয়ে যদি কেইস মন্জুর হয় তখন আপনি কনভেনশন রিফিউজি হিসেবে গণ্য হবেন এবং পার্মানেন্ট রেসিডেনসি বা পিআর পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। যদি কেইস না মন্জুর হয় তবে নির্দিষ্ট সময় মধ্যে আপীল করতে পারবেন। সেখানে আপনার ত্রুটিবিচ্যুতি পূরণ করার সুযোগ পাবেন। সেক্ষেত্রে কাগজপত্রের অভাব থাকলে তা অবশ্যই যোগাড় করতে হবে। সেখানেও ব্যর্থ হলে সর্বশেষ ফোরাম হলো জুডিশিয়াল রিভিউ।
নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে রিভিউ দরখাস্ত করতে হবে। আইনগত বিভিন্ন পয়েন্টসহ ন্যাচারাল জাষ্টিস লংঘিত হয়েছে কি না তা রিভিউ ফোরামে বিবেচনা করা হয়। আইআরবি কতৃক কেইস রিজেক্ট হলে আপীল না করে আরেকটি পদ্ধতি আছে। সেটি হলো পিআরআরএ বা পার্সোনাল রিস্ক এসেসমেন্ট। এখানেও আবেদন করতে হবে। তখন বিবেচনা করা হবে দেশে ফেরত পাঠানো হলে আবেদনকারীর উপর সেখানে কী ধরনের ক্ষতি, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদির সম্ভাবনা আছে। তা আবেদনকারীর অনুকূলে গেলে তিনি একধরনের স্টেটাস পাবেন ও পিআর এর জন্য আবেদন করতে পারবেন। সার্বিকভাবে রিফিউজি কার্যক্রম শেষ হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। মানসিকভাবে শক্ত থেকে ধৈর্য ধরে এগুতে হবে।
টরন্টোতে সাম্প্রতিককালে যারা এসেছেন তার মধ্যে একজনের সঙ্গে আমার সরাসরি আলাপ হয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে তা শেয়ার করছি। তিনি প্রায় দেড়মাস হলো বাংলাদেশ থেকে টরন্টো এসেছেন। যার মারফতে এসেছেন তাকে বিশলক্ষ টাকা দিয়েছেন। তাকে বলা হয়েছে এখানে এলে অঢেল টাকা রোজগার করতে পারবেন। দেশে তিনি একটি ছোট দোকান চালাতেন। সংসার মোটামুটি চলে যেত। আসার সময় খরচ কুলোতে দোকান বিক্রি করে দিয়ে এসেছেন। লেখাপড়া স্কুল পর্যন্ত। এখানে এসে কোন কাজ যোগাড় করতে পারেননি তখন পর্যন্ত। সঞ্চিত কিছু অর্থ খুব সাবধানে হিসাব করে খরচ করে চলছেন। এতে আরো দিশেহারা হয়ে গেছেন। স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে আসায় আরো বেশি চিন্তিত। এখানে আরো তিনজনের সঙ্গে একটি বেইজমেন্টে থাকছেন। একটি ফুডব্যাংক থেকে সপ্তাহে একদিন চাল ডাল তেল ইত্যাদির ব্যবস্থা হয়েছে। অন্য জিনিসপত্রাদি কিনতে হয়। কেইস করেছেন একজনের মারফতে। তবে এখনো লইয়ার এর সাথে দেখা হয়নি। সোশ্যাল থেকে সাহায্য পেতে দরখাস্ত করেছেন। এখনো রিপ্লাই আসেনি। বেশ কষ্টে ও চিন্তায় আছেন। আমি বলেছিলাম, একটু খবরাখবর নিয়ে আসলেন না কেন? তিনি ইংরেজিতে বিশেষ বলতেও পারেন না। ভাষা একটি বড় সমস্যা। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ফ্রি ইএসএল কোর্স করে তা দূর করা উচিত। না হলে পদে পদে আপনাকে ভাষা সমস্যায় ভুগতে হবে। যারা ইতিমধ্যে কেইস করেছেন তারা অবশ্যই লইয়ার বা ব্যারিস্টার সাহেবের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করবেন এবং তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেবেন।
প্রসঙ্গত কানাডা’র সংবিধান বা কনস্টিটিউশন সম্পর্কে সামান্য উল্লেখ করছি। কানাডা’র সংবিধান ক্রমশ বিকশিত হয়েছে। যা অপূর্ব একটি স্থাপত্য নিদর্শনের মতো। নারী পুরুষের সমান অধিকার। আছে ধর্মীয় স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, মিডিয়ার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের অধিকার এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করেছে সংবিধান। শান্তি ও সুশাসনের জন্য সংবিধান। এখানে পার্লামেন্ট সদস্যরা আইন প্রণয়ন করেন। গভর্মেন্ট আইন প্রয়োগ করেন আর সুপ্রিম কোর্ট রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। কানাডা’র সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। সংবিধানের সুশীতল ছায়াতলে সবাই নিরাপদে আছেন।