কাজী হেলালের ‘বুকের গহীনে ডেলফিনিয়াম’
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞান
সম্প্রতি আমাদের টরন্টোর কবি কাজী হেলালের একটি কাব্যগ্রন্থ আমার হাতে এসে পড়ে। কবিতা বোঝার মতো যথেষ্ট সাহিত্যজ্ঞান আমার মধ্যে নেই। তাই একটা বই পড়ার পরে নিজের মন্তব্য প্রকাশের ধৃষ্টতা করা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবে ভালো খবর হল, আমি সাহসী মানুষ এবং কাজী হেলালের মত একজন কবির বই পড়ার পরে মনে হল একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করাই যায়।
নাম খুবই ইন্টারেস্টিং ‘বুকের গহীনে ডেলফিনিয়াম’। অন্যরকম নামটি দেখে একটু থমকে গিয়েছিলাম। চমৎকার এক ফুলের নাম ডেলফিনিয়াম, যা বইটির প্রচ্ছদে রক্তাক্ত অবস্থায় ফুটে রয়েছে। ডেলফিনিয়ম সম্পর্কে একটি বিশেষ তথ্য হল সুন্দরী এই ফুলটি বিষাক্ত। পৃষ্ঠা উল্টে প্রথমেই পড়লাম ‘বুকের গহীনে ডেলফিনিয়াম’ কবিতাটি। অধরা প্রেমে পাগল প্রেমিকের মন ডেলফিনিয়ামের মতোই সুন্দর এবং বিষময় হয়। প্রেমিকার ফিরিয়ে নেওয়া মুখে – আহা কী বেদনা!
এরপরে খুব আয়োজন করে এককাপ গরম চা হাতে নিয়ে বৃষ্টির দিনে একলা বারান্দায় আরাম চেয়ার নিয়ে আয়োজন করে পড়তে শুরু করলাম প্রথম কবিতা থেকে। পড়তে পড়তে মনে হল, আমি কবির বর্ণনা করা প্রকৃতির সাথে মিশে যাচ্ছি। কবি খুব মজা করে করে প্রকৃতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বিষয়গুলো তুলে এনেছেন। যেখানে আমার বাংলাদেশ এবং তুষারাবৃত শীতল কানাডার প্রকৃতির বিশেষ দিকগুলো কাব্যিক রসে শুকনো কাগজে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। হিরেগলা শিশির, দুষ্টু ঘাসফড়িং, জোছনাভেজা আলো, বাস্তুসাপ, ব্যাঙ, গাছ, পাখি, মাছ সকলেই এক একটি চরিত্র হয়ে এসেছে। কবিতায় মানুষ, শিশু, মা এমনকি বিপ্লবী যোদ্ধাদেরও সেই বিশাল প্রকৃতির অংশ বলে মনে হয়েছে। কবিতা পড়তে পড়তে আমি বারে বারে ফিরে গেছি প্রকৃতির কাছে।
আরেকটি ব্যাপার আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে, আর তা হল একজন টাইম ট্রাভেলারের মতই তিনি পদচারণা করেছেন অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে। তাঁর অতীত শুরু হয়েছে সৃষ্টির আদিকাল থেকে যখন সৃষ্টিকর্তা প্রথম মানব সৃষ্টি করেন। এরপরে বেশ কয়েকটি কবিতায় তিনি মানব সভ্যতার অগ্রগতি এবং লজ্জাজনক অধ্যায়গুলো তুলে ধরেছেন প্রচণ্ড আবেগে এবং তীব্র প্রতিবাদে। মানবজাতির ইতিহাসকে কাব্যের মাধ্যমে তুলে ধরার মত সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে তা সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য কবিকে অভিবাদন জানাই। পাঠক হিসেবে আমি আপ্লুত হয়েছি কবির সীমাহীন সীমানা দেখে। তিনি তাঁর কাব্য মানবতৈরী ভৌগোলিক এবং সময়ের সীমানার বাইরে নিয়ে গেছেন।
কবিতা পড়ে আরও মনে হয়েছে কবি নানা ঘটনা থেকে কবিতা লেখার অনুপ্ররণা পেয়েছেন। কালোমানুষের প্রতি সাম্প্রদায়িক অত্যাচার থেকে শুরু করে, মার্কিন গর্ভপাত বিষয়ক আইন, নারী স্বাধীনতা-সহ আরও অনেক দেশের এবং আন্তর্জাতিক ঘটনা শুধু তুলেই ধরেননি, বরং লিখিত শব্দের মাঝে কবিতার রসে সিক্ত করে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে এবং পাঠকের মনে আবেগের ঝড় তুলতে সক্ষম হয়েছেন। আমার মনে নারী স্বাধীনতা এবং নারীদের নিয়ে ঐতিহাসিক কবিতাগুলো বিশেষভাবে দাগ কেটেছে।নারীদের নিরাপত্তা, বিবাহ, পোশাকের স্বাধীনতা এমনকি তাদের নিজেদের শরীরের উপরে অধিকারের হরণ বিষয়গুলো কবিতায় উঠে এসেছে। কবিতা পড়ে মনে হয়েছে কবি আমাদের সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতার অনেক অনেক ঊর্ধ্বে।
কবি অনেকগুলো কবিতায় আমাদের বাংলাদেশের এবং নানা দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা যুদ্ধ করেছেন, লড়াই করেছেন এবং নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁদের শ্রদ্ধাভারে স্মরণ করেছেন। তাঁর কবিতায় নায়ক হয়ে এসেছেন তারামন বিবি, ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-সহ আরও অনেক মহাপ্রাণ পেয়েছেন কাজী হেলালের কবিতায়। তিনি বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, তেমনি বর্তমান সময়ের গাজার শহীদদের কথাও ভোলেননি। তিনি আমাদের সবুজ নায়ক, মাটির পুত্র শাইখ সিরাজকে নিয়েও অসামান্য কবিতা রচনা করেছেন। কবিতা লিখেছেন আর্জেন্টিনা, তাদের প্রাণের ফুটবল এবং ফুটবলের মহানায়ক মেসির কথা।
অনেক অনেক গুরুগম্ভীর কবিতার ফাঁকে ফাঁকে কবি আবার প্রায়শই চলে গেছেন তাঁর ছেলেবেলার হাসিমাখা দিনগুলোতে। মনে করেছেন প্রাণের খেলার সাথীদের কথা। শৈশবের চোখে এঁকেছেন বাংলাদেশের প্রকৃতি, সম্পর্ক এবং মানসিকতা। আবার বিষন্ন হয়েছেন ছেলেবেলার বহুকিছু হারিয়ে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সাথে আমরা এগিয়ে গেলেও পেছনে পড়ে থাকে মধুমাখা সব স্মৃতি। জলে ভরপুর যৌবনা নদীও একসময় শুকনো চৌচির হয়। মাছেরা ব্যাঙেরা হারায় বাসস্থান। আমরা হারাই সবুজ শৈশব। আমরা বয়সের আগেই বিষন্ন বুড়োমানুষ হয়ে উঠি।
এরপরে আসে প্রেম। তাঁর প্রেমহীন প্রেমপত্রেও প্রেম ধরা পড়ে। উত্তাল সমুদ্রের সুনামির মত আছড়ে পড়ে প্রেম যেমন আছে তেমনি আছে পদ্মফুলের মধুর মত মিষ্টি প্রেম। কোথাও তিনি আয়োজন করে প্রেম পড়ার সময় নির্ধারণ করেন, আবার কখনও সেই সময় কখনোই আসে না। কোনও প্রেমিক প্রমিকার খোঁজে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তালাশ করেন, আবার কোনও প্রেমিক আগুনে পোড়ার সোনার মত খাঁটি প্রেম প্রাপ্তির পরেও পরির খোঁজে যায় সোনাকান্দির বাজারে। আর সেই কবিতা পড়ে আমার মন হু হু করে ওঠে। চোখের কোনে জমে অনর্থক জল।
কবির এই তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের ৫২টি কবিতার মধ্যে যদি বলা হয় সবচেয়ে প্রিয় কবিতা কোনটি, তবে আমি বলব ‘জ্ঞানবৃক্ষের নিচে’ কবিতাটি। এটি দিয়েই বইটির সমাপ্তি। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা এবং গল্প। মানব জীবনের গূঢ় কথাটি উঠে এসেছে কবিতায়। নশ্বর কর্দমাক্ত পৃথিবীতে মানুষের উৎস, পদচারণার কথা বলা হয়েছে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং সমাধানের মাধ্যমে তৃপ্ত হয়েছে আমার পাঠক হৃদয়।
শেষের কবিতাটি শেষ করার পরে পৃষ্ঠা উল্টে লাল কাগজের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। শব্দশৈলী লেখা পাতায় হঠাৎ করেই চিত্রিত হল কবিতাগুলোয় বর্ণিত নানা ঘটনা।
বাইরের আকাশে কাজল মেঘের ঘনঘটার সাথে সাথে মনটাও কেমন বিষন্ন হয়ে উঠল। শূন্য চায়ের কাপ দেখে নিজেকেও শূন্য শূন্য বলে মনে হল। এই হল কবিতাচ্ছন্ন মনের আবেগ।
কবি কাজী হেলাল আমাকে কবিতাগ্রস্থ করে তুলেছেন, যা কেবল একজন কবির পক্ষেই সম্ভব।