কর্মময় এক জীবনের আলেখ্য
সুব্রত কুমার দাস টরন্টোবাসী এক সদাহাস্যময়, সাহিত্যানুরাগী, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির নাম। তিনি তার আপন প্রতিভা বলে মাত্র দশ বছরেই উত্তর-আমেরিকায় বাংলা ভাষাভাষী সংস্কৃতি-অঙ্গনে এক বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন। বললে ভুল হবে তার এ অবস্থান শুধু বাংলা সংস্কৃতির মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি কানাডীয় সংস্কৃতির মূলধারাতেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। এছাড়াও সংস্কৃতির বিবিধ অঙ্গনে রয়েছে তার অবাধ পদচারণা। টেলিভিশনের পর্দায় তাকে কখনও দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে, কখনও নজরুল, কখনও চৈতন্যদেব, কখনও কানাডীয় সাহিত্য, আবার কখনও মহাভারত নিয়ে আলোচনা করতে। তার মনোজ্ঞ আলোচনায় উঠে আসে ঘটনার পেছনের নিগুঢ় ঘটনা, দেখার বাইরে কতো না-দেখা জগতের খোঁজ, শোনার বাইরেও কতো অশ্রুত বাণী।
টেলিভিশনের গতানুগতিক বিনোদন ধারার পাশাপাশি তিনি নির্মাণ করেছেন এক নতুন সুস্থ, সৃষ্টিশীল স্রোতধারা। সৃষ্টি করেছেন নতুন এক দর্শক শ্রেণি। নিজ সাহিত্যের পাশাপাশি কানাডীয় সাহিত্যের রূপ-রস-গন্ধের সাথে কানাডীয় বাঙালিদের পরিচয় তথা ভিন্ন দুই সংস্কৃতির মাঝে সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে তার নিরলস প্রচেষ্টা সত্যি প্রশংসার দাবীদার।
সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি তার এই অনুরাগ, উৎস বাংলাদেশ থেকে কানাডার মাটিতে পরবাসী হয়ে জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি আজকের সুব্রত কুমার দাস হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে তার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা, অধ্যবসায় আর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর এক গভীর তাড়ণা। কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি একে একে প্রকাশ করেছেন ঊনত্রিশটি গ্রন্থ। তার প্রতিটি গ্রন্থেই তিনি রেখেছেন তার বহুমুখী পাণ্ডিত্যের ছোঁয়া, আর মুন্সিয়ানা। তার এই সৃষ্টির কথা, সৃষ্টির পেছনের কথা-সহ অকথিত জীবনের অনেক কাহিনি তিনি তার সাম্প্রতিক গ্রন্থ “উৎস থেকে পরবাস’-এ এক দীর্ঘ আলাপচারিতার মাঝে অকপটে বলে গেছেন। তার কথাকে গ্রন্থনা করেছেন আরেক লেখিকা – দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিক।
তার আলাপচারিতায় তিনি বলে গেছেন তার জন্মস্থানের নিকটবর্তী এলাকা কোড়কদীর কথা, শৈশবের বেড়ে ওঠা দিনগুলোর কথা। ব্যক্ত করেছেন সেই ছোট্ট বয়সে ‘বাঁশরী’ লাইব্রেরী গড়ে তোলার উন্মাদনার কথা। স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন বাচ্চু রাজাকারের উদ্ধত রাইফেলের সামনে পিঠমোড়া করে বাঁধা তার পিতার কথা।
সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় পরাধীনতায় তার হ্রদয়ের রক্তক্ষরণ, শিকড় ছেড়ার কষ্টবোধ আমাদের যেমন আহত করে, তেমনি ইউনেস্কোর সাথে যুক্ত হয়ে পৃথিবীজুড়ে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ৫০ শিক্ষকের মধ্যে অন্তর্ভুক্তির মতো বিশাল অর্জন আমাদের গর্বিত করে। আমাদের গর্বিত করে তিনি যখন উত্তর আমেরিকায় বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তার ঝুলিতে জমা করেন গায়ত্রী গ্যামারসের মতো ঈর্ষণীয় পুরস্কার। গর্বিত করে যখন কানাডার লেখকদের বৃহত্তম সংগঠন রাইটার্স ইউনিয়ন অব কানাডার ‘রাইট’ মুখপত্রে তার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। অভিভূত হই – যখন তার নাম কানাডার শ্রেষ্ঠ ২৫ অধিবাসীর নামের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পায়। কানাডার সাহিত্য নিয়ে তাঁর বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে কানাডার স্বনামধন্য কবি ও ঔপন্যাসিক টরন্টো পোয়েট লরিয়েট অ্যান মাইকেলস সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন – ‘On behalf of Canada, on behalf of Toronto, I salute Subrata. I congratulate Subrata.’
তার এই অসামান্য অর্জনে যারা তাকে অনুপ্রাণিত করেছেন, তাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানাতে এতটুকু কসুর করেননি। এমনকি তার এই সাফল্যের পথে যারা কাঁটা বিছিয়ে রেখেছিল তাদেরকেও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়। গ্রন্থের দীর্ঘ অধ্যায় জুড়ে লেখক তার শিক্ষক ও পথপ্রদর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এই প্রবাস-জীবনে যারা আপদে বিপদে এগিয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত তাঁদের কথাও বলেছেন। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন ঢাল হয়ে, তাদেরসহ অসংখ্য গুণগ্রাহীদের প্রতি তার এই কৃতজ্ঞতাবোধ লেখকের মানবিক মূল্যবোধের এক বিশেষ দিক উন্মোচিত করেছে।
একদিন তিনি কানাডীয় সাহিত্যের বিশাল সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে ওই সমুদ্রে সাঁতার কাটতে চেয়েছিলেন। যা একসময় ছিল অসম্ভব, তা তিনি তার গভীর অধ্যবসায়, আর নিজ সৃষ্ট পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সম্ভবে পরিণত করেছেন। সে অর্থে তার এ গ্রন্থ কানাডীয় সাহিত্যানুরাগীদের জন্য এক বিশেষ দিক নির্দেশক। আমি তার এই আত্মজীবনীমূলক ও গবেষণাধর্মী এই গ্রন্থের বহুল প্রচার ও সাফল্য কামনা করি।
উৎস থেকে পরবাস – সুব্রত কুমার দাস, সাক্ষাৎকার গ্রহণ – দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিক, প্রচ্ছদ – মোস্তাফিজ কারিগর, মূর্ধন্য প্রকাশনী, ঢাকা, বইমেলা ২০২৩, মূল্য – ৫০০ টাকা